বিদ্যুৎ সরকার : ভালোবাসার সুখের কাউন্টারে ভাল লাগার চেকগুলো ভাঙিয়ে ভাঙিয়ে কেমন সুখহীন জীবন যাপনে অভ্যস্থ হয়ে যাচ্ছি আমি। সুখের হেয়ালী হাওয়ায় কপালের উড়ো উড়ো চুলগুলো হাত দিয়ে সরিয়ে দিয়ে আয়নায় নিজ প্রতিবিম্ব দেখে কেমন অসহায় বোধ করি প্রায়শঃই। চোখের নিচে কালশিটে আভা, দিন দিন গভীরতা পাচ্ছে কেবল। নির্ঘুম রাতের স্বাক্ষী হতে হতে চোখ দুটোর এমনতরো বেহাল অবস্থা। ঘুম হয় না বলে একটি “ইমছমমিয়া” আতঙ্ক আমার চিন্তার সাথে সংযোজিত নতুন একটি বিড়ম্বনা আর কি! দিন শেষে রাত আসে। রাতের আঁধারে আমার ভাবনাগুলো, স্মৃতিগুলো বড় বেশি দৃশ্যমান হয়ে উঠে, আলোকোজ্জ্বল হয়ে উঠে আমার কাছে। অথচ, কতোদিন ঘুমের মাঝে এসব কিছু স্বপ্নে দেখার কী দারুণ ইচ্ছে জাগতো আমার মনে। সে স্বপ্ন দেখা আর হয়নি কখনো, কোন দিন। আর, এখন তো প্রতি রাতেই সত্যি সত্যি দেখে যাচ্ছি বিরামহীন। এমন অনেক কিছুই আছে যা স্বপ্নে দেখতেই শুধু মন চায়, এমন অনেক কিছু আছে একা একা আনমনে ভাবতে ভাল লাগে। স্বপ্ন সত্যি হয়ে গেলে, ভাবনা বাস্তব হয়ে সম্মুখে দাঁড়ালে কেমন উশৃঙ্খল হয়ে পড়ি, অগোছালো হয়ে যাই এবং “অদৃশ্যমান আমির” কাছে কতো সহজেই আত্মসমর্পন করে ফেলি “দৃশ্যমান এ আমি”। জানালা দিয়ে উকি মারলে পাহাড় ছোঁয়া মেঘ হাত বাড়ালেই বুঝি ছুঁয়ে দেখা যাবে। আমি তো এতটুকুই চেয়েছিলাম তবু কেন মেঘের রথ এসে আমাকে তুলে নিয়ে যায় কোন্ অচিনপুরে। আমি যেন নিজকে হারিয়ে ফেলি এক অ-সুখের ‘বø্যাকহোল’-এ। সুনীল অন্ধকারাচ্ছন্ন ‘বø্যাকহোল’, অন্তহীন যাত্রার বিরামহীন পথ চলা। মেঘের রথ চলছে তো চলছেই, আমি শুধু একজন সোয়ার হয়ে থাকি নির্বাক, নিথর পুরুষোত্তম।
ইদানীং আমি জলরং-এ ছবি আঁকি। মনের ছবি রংতুলি দিয়ে ফুটিয়ে তুলি যখন যেমন খুশি মন চায়। প্রথমেই আকাশী রং মেখে মাঝে মাঝে কিছুটা সাদা মিশিয়ে দিলাম, থোকা থোকা পেজা তুলোর মতো মেঘে যেন শরতের আকাশ। ছবির নিচটায় সবুজ রং-এর প্রলেপ দিয়ে কেমন ঘাস আর ছোট ছোট গাছের “এফেক্ট” নিয়ে এলাম। আকাশ আর সবুজ প্রান্তরের মাঝে একটি সরু জলের রেখা টেনে দিয়ে আমি নিজেই ভীষণ অবাক- এ যেন আমারই গ্রামের “ল্যান্ডস্কেপ”, ছোট্ট নদী, নদীর ওপারে সেন পাড়া। যেখানটায় পুজোর সময় মেলা বসতো, যাত্রা চলতো, শেষ দিনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। সেন পাড়ার ছোট বড় সবাই গান গাইতো, নাচ হতো, ছোট শিশুদের মুখে মিষ্টি মিষ্টি ছড়া। আমরা দল বেধে সেখানে যেতাম । ভাগ্য ভাল থাকলে কপালে নাড়ু, সন্দেশও জুটে যেতো। আমার আকর্ষণটা ছিল অন্যখানে- সহপাঠী নীলাঞ্জনার কণ্ঠে রবীন্দ্র সঙ্গীত শোনা। চোখ বুজে হারমনিয়াম বাজিয়ে বাজিয়ে রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতো- ‘ছায়া ঘনিয়েছে বনে বনে….’ ওর কন্ঠে যতবার গানটি শুনেছি ততোবারই কেন জানি আমার দারুণ ভাল লাগতো। এক সময় এ গানটা আমারও মুখস্থ হয়ে গিয়েছিলো। নীলাঞ্জনা যখন চোখ বুজে গানটি গাইতো অবাক হয়ে, তন্ময় হয়ে ওকে দেখতাম। এক সময় সত্যি সত্যি ওর সেই মুহূর্তটির প্রেমে পড়ে গেলাম আমি। কিন্তু, ক্লাসে এলে কখনো ওকে এ সত্যটি বলতে পারতাম না। এটা আমার কাছে একটি “না বলা কষ্ট” ছিল। সে কষ্ট এখনও দূর দেশে এসেও ধরে রেখেছি। নীলাঞ্জনা কোথায় আছে জানি না, সে কি পুজো এলে এখনও সেই গানটি গায়? সেন পাড়ায় কি এখনও পূজোর সময় মেলা বসে, যাত্রা চলে আর শেষের দিন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান? শরতের আকাশ, সবুজ প্রান্তর, ছোট্ট নদী, ওপাড়ে সেন পাড়া মাইকে দেবাঙ্গনার কণ্ঠে পূজোর গান- “ছায়া ঘনিয়েছে বনে বনে”। যেন নীল শাড়ি পড়ে নীলাঞ্জনাই গান গাইছে, চোখ বুজে বুজে আমি ভাবতে থাকি সুদূর এখান থেকে। সবই তো স্বপ্নীল ভাবনার অবান্তর চিন্তার ফসল। তবুও কেন জানি ভাবি, ভেবে ভেবে দুঃখময় সুখের সন্ধানে পথ চলি।
বিদ্যুৎ সরকার : লেখক ও আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা