বিদ্যুৎ সরকার : পুকুর বলতে যা বোঝায় আসলে এ জলাশয়টি তা নয়। তবুও ওটাকে পুকুর বলতে ইচ্ছে করতো কেন জানি। সে পুকুরের চারপাশ ঘিরেই ফলজ বৃক্ষাদি। যাদের ফাঁক-ফোকর দিয়ে সূযর্ ্যরশ্মি পড়তো কলমি লতার, হেলেঞ্চার দলে। মাঝ দুপুরে রশ্মিগুলো তেরছাভাবে জলের ভিতর দিয়ে পুকুরের তলদেশ অব্দি পৌঁছে যেতো। তখন জলের ভেতর মাছেদের চলাফেরা লক্ষ্য করা মতো। থালা-বাসন ধোয়ার উচ্ছিষ্ট খাবার-দাবার খেতে মাছেরা ছুটে আসতো দল বেঁধে। পুকুর পাড়ে চুপ-চাপ দাড়িয়ে এ দৃশ্য দেখতাম। পুকুর পাড়ের আম গাছে যখন ফুল ফোটে বোল আসতো কিংবা চালতা গাছে সাদা ফুল ফুটতো তখন গন্ধে ম ম করতো চারদিক। রান্না ঘরের পেছনটায় এসকল জলজ অনুভ‚তি সম্পন্ন ¯স্মৃতগুলো এখনো ভাঁজে ভাঁজে জমে আছে মনের মাঝে। রান্না ঘরের পাশেই কলতলা। সেখানে একটি পাতি লেবু গাছ, বারো মাস যার অনুদানে সিক্ত হতো গৃহস্থ। রান্না ঘর আর মূল ঘরের মাঝে সুনসান নিকনো উঠোন। বিকেলে পাড়ার মেয়েরা কানামাছি, গোল্লাছুট, এক্কাদোক্কা খেলায় প্রাণ চঞ্চল করে তুলতো। সেই এক্কাদোক্কার ঘরের দাগের মতো সব ¯স্মৃতিরাও বুঝি একদিন মিলিয়ে যায় হৃদয়ের উঠোন থেকে। বাড়ির সামনেও ছিল সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত একটি ছোট্ট মাঠ। বাড়ি সংলগ্ন এ ছোট্ট মাঠের রাস্তা ঘেঁষে কাঠের দোতালা ঘর। যার ঝুল বারান্দায় পাশের কৃষ্ণচুড়ার ডাল এসে স্পর্শ রেখেছে। যখন লাল লাল ফুল ফুটত তখন দূর থেকে দেখতে ভাল লাগতো। মূল ঘরের সামনে যে ফুল বাগান সেখানে ছিল ঋতুভিত্তিক চেনা ফুলের গাছ-গাছালী। কিন্তু অচেনা শুধু একটি ফুলের নাম, শোভা, সুবাস আমাকে সত্যিই অবাক করে দিয়েছিলো। যার নাম গ্যান্ডি ফ্লাওয়ার। রাস্তা দিয়ে যাবার সময় তাকিয়ে দেখতাম ঐ বিশেষ গাছটির দিকে ফুল ফোটার প্রত্যাশায়। সন্ধ্যেতে প্রায়ই ঐ বাড়ি থেকে হারমোনিয়ামের আওয়াজ শোনা যেতো। অনেক পরে জানতে পেরেছিলাম ও বাড়ির ছোট কাকীই হারমোনিয়াম বাজিয়ে গলা সাধতেন। পরবর্তীতে যতবারই সন্ধেতে মার সাথে সে বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছি ততবারই মার অনুরোধে কাকী গান গেয়েছেন। সে সময়কার ভারতীয় আধুনিক গানই বেশি শুনতে পেতাম। যে গান গুলো এখনো শুনতে পাই বিভিন্ন শিল্পীর কন্ঠে ‘হারানো দিনের গান’ হিসেবেই।
রসহীন সুগন্ধী লেবুর সুরভী যেমন রসনা আস্বাদনে এনে দেয় ভিন্ন মাত্রা, তেমনি স্মৃতির এলবামের প্রাণহীন ছবিগুলো জীবন্ত হয়ে উঠে দূর প্রবাসে হঠাৎ কখনো কোন ঘটনার সাথে মিল খুঁজে পেয়ে। গ্রীষ্মের দুপুরে ও বাড়িতে গেলে ছোট কাকীর নিজ হাতে বানানো সযতনে কাচের বইয়োমে রাখা চালতা, বড়ই, তেতুল, কাঁচা আমের আচারের স্বাদ ও গন্ধে আমি বিমুগ্ধ হতাম প্রায়ই। কাকীর হাতে পুরনো তেতুলে বিশেষ উপকরণের মিশধন অনায়াসে জিভে জল এনে দিতো। চাপ কল থাকা সত্তে¡ও সেই পুকুরের জলেই চাল ধুয়ে আনতেন কাকী। সে সময়টাতে ও বাড়িতে গেলে রান্না ঘরে বসে বসে কাকীর মুখ থেকে অবাক হয়ে গল্প শুনতাম। কখনো গুনগুনিয়ে গান গাইতেন আনমনে। এক চুলোয় ভাতের হাড়ি চড়িয়ে অন্য চুলোয় আমার জন্য চিড়ে ভাজা করতেন বা মুড়ি মাখা, সাথে কাকীর চাল ধোয়া স্নিগ্ধ হাতের গরম চা। তখন আমার বয়সই বা কতো, হয়তোবা প্রথম স্কুলে যেতে শুরু করি চতুর্থ শেধণীর ছাত্র হয়ে। কাকীর এক ছেলে এক মেয়ে যারা আমার বয়সের চেয়ে কিছুটা ছোট ছিল। তাদের সাথেও খেলা-ধুলা করতাম।
বছর দুয়েক পর আবার ফিরে এলাম আমার স্মৃতির শহর কিশোরগঞ্জে। কিন্তু সে বয়সে অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম ছেড়ে আসা সেই ছোট্ট শহরের জন্যে স্কুলের বন্ধু, অন্যান্য খেলার সাথীকে বাদ দিলে সেই ছোট্ট কাকীদের বাড়িটিই যেন একটি ঘর হয়ে বিরাজ করতে থাকলো আমার শিশু মনে। ভৌগলিক দূরত্ব যতই বারুক না কেন আত্মীক দূরত্ব নৈকট্য পেতে থাকলো ক্রমশই। সেখান থেকে চলে আসার পর খুব একটা যাওয়া হতো না সেই ছোট্ট শহরে। অনেক বছর পর পর সুযোগ হলে ছুটে যেতাম। চাকুরির সুবাদে আশে-পাশে কখনো যেতে হলে কাকীদের দেখে আসতাম। তখন দ্ইু ভাই তিন বোনের আলোকিত কাকীর সংসার। কাকুর সাথে কথা হতো অনেক প্রশ্ন নিয়ে যিনি আমার বাবার একজন কাছের বন্ধু ছিলেন জীবনভর। শেষ দেখা হওয়ার কয়েক বছর পর কাকু গত হলেন। ঢাকায় বসে সে খবর জানতে পেরেছিলাম। এ ঘটনার পর সম্ভবত একবারই আমার যাওয়া হয়েছিল সেখানটায়। কাকীকে অনেক পরিবর্তিত রূপে দেখেছি তখন। শুধু শারীরিক কেন মানসিক বার্ধক্যও যেন তাকে অনেকটা স্থবির করে রেখেছিল। তারপর টরন্টো থেকে যখন দেশে গেলাম তখন সেই কাকীদের বাসায় যাওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছিলাম আগে-ভাগেই কিন্তু যাওয়া হয়নি। ‘সামনের বার যে কোন মূল্যেই আমি যাব’- এমন একটি ছোট্ট প্রতিজ্ঞা নিজের অজান্তেই মনের ভেতর পুষে রাখলাম আমি। দিন যায়, রাত আসে, শীতের আবির্ভাবে ম্যাপেল লিফগুলো ঝড়ে পরে অবলিলায়। হঠাৎ একটি ফোন আমার ছোট্ট প্রতিজ্ঞাটিকে প্রতিহত করে দিল, ভেঙে চুড়মার করে দিল চিরদিনের জন্য কালী বাড়ি রোড, লাল কৃষ্ণচুড়ায় ছুঁয়ে দেয়া কাঠের দোতালার ঝুল বারান্দা, গ্যান্ডি ফ্লাওয়ার, বাড়ির পেছনের হরিনের চোখের মতোন কালো ছোট্ট পুকুর। পুকুরের জলে লাল ডোরা কাটা সুখী পুটি মাছ, গোল চালতার পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা অজানা সুখ- এসব কিছুকে ছাপিয়ে শুধু একটি মুখই মুখ্য হয়ে প্রকটভাবে ভেসে উঠলো আমার মানস চোখে, ছোট্ট কাকীর সেই মুখটি। আর কোন দিন দেখা যাবে না সেই মুখ। গল্প বলার সেই মুখ, গান শোনাবার সেই মুখ, মায়ের মতো শাসন করার সেই মুখ। একটি টেলিফোনের সাথে বুঝি একটি চেনা মুখ অচেনা হয়ে গেল চিরতরে পার্থিব এ চেনা জগৎ থেকে।
বিদ্যুৎ সরকার : লেখক ও আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা