বিদ্যুৎ সরকার: “একটি মাধবী তুমি এখনো তো ঠিকই জেগে আছো”। সত্যিই তো মাধবী নামের মেয়েটি এখনো জেগে আছে সেই ‘৭১ থেকে আজ অব্দি তার চোখে ঘুম নেই-ঘুম আসে না। দু’চোখের পাতার ঘুম গুম হয়ে গেছে কোন কালে। ইচ্ছে হলে মাঝে মধ্যে আকাশ দেখে, গভীর রাতের আকাশ। নিস্তব্ধ, নির্মল আকাশ তারায় তারায় খচিত। ’৭১- এর যুদ্ধকালীন সময়ে রঘু শুধু একবারই দেখে যেতে পেরেছিলো স্ত্রী কন্যাকে। তখন মাধবীর বয়স কতইবা, ছয় কি সাত। সেই দেখাটাই মাধবীর স্মৃতি হয়ে গেঁথে রইলো চিরদিনের জন্য। ঝাঁকড়া চুল, গালভরা খোঁচা খোঁচা দাড়ি, তাতেই বাবাকে জড়িয়ে আদর করছিলো বার বার। এর কিছুদিন বাদেই ক্রাক প্লাটুনের সাহসী যোদ্ধা রঘু সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন। যেদিন খবরটি জানলো সেদিনই প্রথম সত্যিকার অর্থে কাঁদতে শিখলো মাধবী। ফুল হয়ে ফোটার স্বপ্নটা বুঝি কলি হয়ে ঝড়ে পড়লো চোখের আঙিনায়। মায়ের দু:খগুলো একটু একটু করে বুঝে উঠতে শিখছে মাধবী। তার মা’র এখন নুন আনতে পান্তা ফুড়োয়। মনে আগুন জ্বললেও চুলোয় আগুন জ্বলে না নিয়মিত। তবু থমকে যায়নি। ছোট কাল থেকেই পড়ালেখায় ভালো ছিলো মাধু, ক্লাশে কোনদিন সেকেন্ড হয়নি। তাই শত কষ্টের মধ্যেও মাধুর লেখাপড়াটা চালিয়ে নিতো ওর মা। এসএসসিতে অসম্ভব ভালো রেজাল্ট করে স্কুলের সুনাম অক্ষুন্ন রেখেছে। বিদায় নিতে এসে শিক্ষকদের আশীর্বাদ গ্রহণ করছিলো মাধু। হঠাত এক শিক্ষকের হাত মাথা ছুঁয়ে কেমন করে জানি একটু শরীর ছুঁয়ে গেল। শিক্ষকের উষ্ম হাতের ‘ইচ্ছা স্পর্শ’ তাকে আরো একটা অভিজ্ঞতার জন্ম দিলো।

পড়ালেখা শেষ করে শিক্ষকতার পেশায় আত্মনিয়োগ করে ভালো মানুষ গড়ার প্রত্যয় নিলো। সময়ের সাথে দু’জনের সংসারে কিছুটা স্বচ্ছলতা ফিরে এলেও মা’র শারিরীক অসুস্থতা মাধুকে ভীষণভাবে বিচলিত করেছিলো। যাত্রীহীন রাত্রিগুলো কেন যে আরো গভীর, আরো অন্ধকারময় মনে হয়। একাকীত্ব শুধুই দীর্ঘায়িত হতে থাকে। দু:খগুলো ছড়াতে থাকে সমস্ত বুক জুড়ে তার। অসুস্থ মায়ের ইচ্ছে পুরণে মাধুকে হঠাত বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হতে হলো তারই সহশিক্ষক অরিন্দমের সাথে। মাস চারেকের মাথায় মা চলে গেলেন পর পারে। দু:খের রং কেন এত কালো? সন্ধ্যা না হতেই যেন মশারির মতো নেমে আসে রাতের অন্ধকার। গভীর রাতের অহেতুক হাতছানি। দু’বছরের মধ্যেই জীবন ও জীবিকার শেকড় ছিন্ন করে অনিশ্চিত এক ভবিষত গড়তে ‘ল্যান্ডেড ইমিগ্রান্ট’ হয়ে টরেন্টোয় চলে আসা। প্রথমেই সংসারের হাল ধরতে হলো সন্তান সম্ভবা মাধুকেই। সুখ-দু:খ পাশাপাশি সমান্তরাল বহমান। সাত মাস বাদে মাধুর কোল আলোকিত করতে জন্ম নিলো এক কন্যা সন্তান। কঠিন বাস্তবতার মধ্যে যেন একটু সুখের ছোঁয়া, আনন্দের বারিধারা। সন্তানের দু’ বছরের মাথায় তার অর্টিজম ধরা পড়ে। বর তেমন কিছু করার সুযোগ পাচ্ছে না। মাধুর জীবন কেবলই এক অনিশ্চিতার বেড়াজালে আটকে যাচ্ছে। চাকরির খোঁজে বর পাড়ি জমালো ক্যালগেরি। কয়েক মাস পর তার পরকীয়া প্রেম গাঁথার সংবাদটি এসে পৌঁছে।

সুখের ঘরে শোকের বিউগেলের সুর বেজে উঠলো বুঝি? জীবন কি দু:খ কষ্টের ফলিত রসায়ন? ছ্যাকড়ার নিখাদ স্বর্ণের অনুসন্ধান? জীবনের প্রতি ধাপে ধাপে এত প্রতিঘাত? ভালোবাসা আহত হলে ভালোবাসায় রক্ত ক্ষরণ হয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাবার শাহাদত বরণ, মা’র জীবন যুদ্ধ, বাঁচার লড়াই। মাধুর বেড়ে ওঠা, শিক্ষকের “ইচ্ছা স্পর্শ”, মার রোগ শয্যা, হঠাত পরিণয়, মার চলে যাওয়া, জীবন বদলের স্বপ্ন নিয়ে ঐতিহ্যের শেকড় উপড়ে অভিবাসী জীবন ধারন, বছর ঘুড়তেই অর্টিষ্টিক কন্যার মাতৃত্ব বরণ, বরের পরকীয়া, সংসারের টালমাটাল অবস্থা-এই সমস্ত কিছুই তাকে আত্মঘাতী হতে প্রলুদ্ধ করছিলো বারংবার। মাধুর মনে হচ্ছিল সেই অভিশপ্ত কারিন্থের রাজা সিসিফাস এর মতো যাপিত জীবনের মস্ত পাথরটাকে ঠেলে ঠেলে যাচ্ছে অনবরত। মাধু এত সব প্রতিকুলতাকে দু’হাতে দূরে ঠেলে দিয়ে এখনো বেঁচে আছে। বেঁচে থাকার লড়াইয়ে তাকে জিততেই হবে। মাধবীলতা ফুলের সৌরভের মৌতাতে ভরে তুলবে জীবন। জীবন তো একটাই, ভিন্নতা শুধু গন্ধে, বর্ণে।
বিদ্যুৎ সরকার : লেখক, আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা