বিদ্যুৎ সরকার : হিমেল শীতের সকাল। কুয়াশায় আচ্ছন্ন দূরের ও কাছের দৃশ্যসমূহ। দূরকে আরো দূরের মনে হয়। দূরের গ্রামগুলোকে অনেক ঝাপসা দেখায়। একটি হালকা সবুজ রেখায় মৃয়মান হয়ে ধরা দেয় চারিধারের গ্রামগুলো। হয়তো একটু বাদেই কুয়াশার আবরণ সরে গিয়ে সোনারোদ সকাল উদ্ভাসিত হবে উঠোনের চারপাশে। ঘরের চৌ-কাঠ অব্দি ছড়িয়ে পড়বে সোনারোদ্দুরের আঁচল খানি। ঘুম ভেঙ্গেই কলতলার অস্থায়ী চুলোয় আগুনের হল্কা দেখে মন জুড়োয় এই ভেবে পিঠা বানানোর আয়োজন চলছে সত্যি সত্যি। গোল সাজের মধ্যে পিঠার তরল উপকরণ ঢেলে দিয়ে কিছুটা সময় অপেক্ষা সুখের প্রত্যাশায়। অতঃপর গরম গরম পিঠাকে ভেঙ্গে ধোয়াটে বাষ্পের মনকাড়া সুঘ্রাণ নিয়ে শুরু হয় এক নতুন সকাল। নারকেল, গুড় ও চিতই পিঠা এ এক অন্তহীন ভালোলাগার অনুভ‚তি, ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি। কেন জানি মনে হয় সারাটা বছরই যদি এমনটি হতো?
শীত এলেই অতিথি পাখির উড়ে আসে ভীন দেশ থেকে, ঝাঁকে ঝাঁকে, শত শত। কলকাকলিতে ছন্দময় করে তোলে প্রকৃতি। বিলের জলে, ঝিলের জলে জলতরঙ্গ বাজে অনবরত, বিরামহীন। দীঘির শীতল জলে ভাসমান নীল-হলুদে ছোপ ছোপ কচুরি ফুল। লুকিয়ে থাকা শান্ত মাছেদের দীর্ঘশ্বাস বুঝি অশান্ত করে তোলে দৃশ্যমান স্বচ্ছ তলদেশ।
কতো সহজেই না পরাজিত হয়ে আত্মসমর্পনে সমর্পিত মাছেরা। দু’দিন বাদেই দীঘির তলদেশ সজ্জিত হয়ে যায় ফসলের বীজ তলার সবুজ বিছানায়। কী অপ্রকৃতস্থ প্রকৃতি শুধুই পরিবর্তনশীল সময়ের আবর্তে।
শীত এলেই আমার ভীষণ পাহাড়ের কাছে যেতে ইচ্ছে করে। পাহাড়ের উচ্চতা আমাকে প্রতিযোগী করে তোলে অজান্তেই। সেই পাহাড়ের শিখরে পৌঁছার এক অহেতুক নিস্ফল প্রতিযোগিতা। কিন্তু, শীতে পাহাড়ের সেই আচ্ছন্ন রূপ? প্রছন্ন ভালোলাগার “ল্যান্ডস্কেপ” কেমন মনের মাঝে ‘ফ্রেমবদ্ধ’ হয়ে প্রেম নিবেদন করে যায় বারংবার। পাহাড়ের সু-গভীর খাদ যেন শুধুই নীল অন্ধকার, হারিয়ে যাবার এক অজানা ঠিকানা। ভয়, রোমাঞ্চ, শিহরিত করে তোলে চলার পথকে। এক সময় সব অনুতাপ, কষ্ট ছাপিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়ার আনন্দ উজ্জ্বল হয়ে উঠে সবার মনে। অন্ধকারাচ্ছন্ন ভোরে ‘সূর্যোদয়’ দেখার ব্রত নিয়ে মিলিত হওয়ার পূণ্যস্থান ‘টাইগার হীল’। ছোট ছোট শিশুদের অনুরোধে গরম কফির পেয়ালায় বার বার ঠোঁটের উষ্ণ পরশে শরীর চাঙ্গা হয়। শিশুদের মনও আনন্দে দোলে উঠে সাত সকালে পয়সা উপর্জানের চলমান ঝনান ঝনান শব্দে। সেই কতো বছর আগে দার্জিলিং গিয়েছিলাম। তারপর শিলং-এর পাহাড়ে। শেষ ‘সূর্যোদয়’ দেখা নেপালের নাগরকোট পাহাড়ের টিলা থেকে। সে এক মন পাগল করা অভুতপূর্ব দৃশ্য। যে দেখেছে শুধু সেই পেয়ে থাকে দেখার সবটুকু আনন্দ। এক শীতের সকালে আমাকে যেতে হয়েছিল প্রান্তিক শহর নেত্রকোনায়। ময়মনসিংহ হয়ে শম্ভুগঞ্জ ব্রিজ পাড়ি দিয়ে সতেজ সবুজের বুক চিড়ে কালো মসৃন রেখা ধরে সম্মুখে এগিয়ে যাওয়া পালা। বা দিকের সতেজ সবুজ প্রান্তর শেষে গাঢ় সবুজের নিঝুম গ্রাম। সে গ্রামের পরেই কালচে সবুজ ধূষর পাহাড়। ভারতের মেঘালয় পাহাড়। এ দিকটায় বিস্তৃত ময়মনসিংহের গারো পাহাড়। যার পাদদেশেই নাকি আলোক উচজ্জল বিরিশিরি চীনামাটির পাহাড়। অনেকেই বলে ‘পিঙ্ক পাহাড়’। শুধু যে পিঙ্ক তা নয় বেগুনি, পার্পল, লাল সব রংই মিশে আছে তাতে। বিরিশিরির আরেক সৌন্দর্য এর পড়শী সোমেশ্বরী নদী স্বচ্ছ সবুজাভ জলের ভেতর দৃশ্যমান নদীর তলদেশ। জলের ভেতর আলোক রশ্মির নানান কারুকাজ। বিশেষ নির্মাণশৈলী নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গারো, হাজং, কোচ আদিবাসী স¤প্রদায়ের আবাসস্থল। বিরিশিরির নৃ-গোষ্ঠীর কৃষ্টি, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অনুপম সাক্ষী এদের সাংস্কৃতিক একাডেমি। বিরিশিরির রূপ-লাবন্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, সোনালী নদীর স্নিগ্ধতা আমাকে বার বার হাতছানি দিয়ে ডেকে যায়। শীত এলেই আমার ভীষণ ইচ্ছে করে পাহাড়ের কাছে ছুটে যেতে। তাই যে কোন এক শীতের সকালে আমি চলে যাবো আমার অদেখা, বহু শ্রুত বিরিশিরির সৌন্দর্য সুধা আহরনে। যে সৌন্দর্য্য দূরে ঠেলে দিয়েও বার বার কাছে টেনে নিতে পারঙ্গম। বিরিশিরি আমার ভাললাগা, আমার ভালোবাসা যেন দেখা এক রাজকন্যা আমার।
বিদ্যুৎ সরকার : লেখক, আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা