বিদ্যুৎ সরকার : এক ঝটকায় টেনে উঠালো। পাদানীতে কোনভাবে পাটা রাখতে পেরেছিলাম এই যা। সিটে বসতে গিয়ে ওর উপরেই পড়ে গেলাম। সে দিনই প্রথম এতো কাছ থেকে তার শরীরের গন্ধ পেলাম। স্থির হোয়ে বসেই জিজ্ঞেস করলাম, কী ওডিকলোন তুমি মেখেছো? সে বলেছিল – না তো কোন কিছুই মাখিনি। তা হলে সবটাই তোমার শরীরের সুঘ্রাণ? আমার বুঝার ভুল ছিলো। ট্রাম চলতে শুরু করেছে গড়ের মাঠের সবুজ ঘাসের শরীর ছুঁয়ে। মাঝে মাঝে গাছের শান্ত, শীতল ছায়া। যেন, রোদ-ছায়ার লুকোচুরি খেলা। সেদিনই প্রথম ট্রামে চড়া আমার। শ্লথগতি, এক পাশে এসপ্ল্যানেড অন্য পাশটায় কেসো রিনা এভিনিউ। সাথে সাথে মনে পড়ে গেল, ‘চল রিনা কেসো রিনায় ছায়া গায়ে মেখে একটু একটু করে এগিয়ে যাই।’ খুব মিষ্টি একটি গান। একটু অন্যমনস্ক হতেই পিঠে ওর হাতের আলতো ছোঁয়া। ‘কি ভাবছো? দেশের কথা? মন খারাপ হোয়ে গেল? যুদ্ধ কতোদিন চলবে তা বলা মুশকিল। লড়াই চালিয়ে যেতে হবে শেষ অব্দি। বাবা-মাকে রেখে এসেছো, মন খারাপ হওয়াটা স্বাভাবিক। আবার দু’দিন বাদেই ক্যাম্পে ফিরে যেতে হবে তোমাকে।’

কথা বলতে বলতে বাদামের খোসা ছারিয়ে আমাকে দিচ্ছিল, নিজেও খাচ্ছিল। বাদামের খোসার ভেতর লুকিয়ে থাকে ভালো লাগর শিহরন, ভালোবাসার নিবিড় প্রকাশ। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল – এর কাছে আসতেই ঘন্টা বাজিয়ে ঝটপট নেমে পড়তে বললো সে। দু’জনে হাঁটছি পাশাপাশি, কাছাকাছি। বাতসে ওর চুল উরে এসে আমার চোখে মুখে মেঘের মতোন ছড়িয়ে পরছিল বারবার। ওর চুল থেকেও সুঘ্রাণ ছরাচ্ছিল, নিশ্চয়ই ভালো কোন বিদেশি শ্যাম্পুর সৌরভ হয়তোবা। এর আগেও এরকম গন্ধ পেয়েছি ওর চুল থেকে বেশ ক’বার। উৎস জানতে চাইনি। হেঁটে হেঁটে এক সময় নন্দনে চলে এলাম। এর আগেও নন্দন ও একাডেমি অফ ফাইন আর্টস এ- এসেছি মুভি ও শিল্প প্রদর্শনী দেখতে। দু’জনে গরম কফি নিয়ে বসলাম। এলোমেলো গল্প হচ্ছিল। যে গল্পের সিংহভাগ জুড়েই ছিল ‘মুক্তিযুদ্ধ’।
আলোচনা হাল্কা করতে প্রসংগ পালটিয়ে বাংলা ছবির ভবিষ্যৎ, সমকালীন শিল্পকলা, ও’র যাপিত জীবনের ঘটনা প্রবাহ। কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে আমাকে বসিয়ে রেখে ও চলে গেল নন্দন হলের দিকে। বুঝে নিতে অসুবিধে হলো না উদ্দেশ্য, নতুন কোন ছবি দেখা – আমারও পছন্দ। ওর নাম নদী। নদীর সাথে পরিচয় ট্রেনের কামরায়। কৃষ্ণ নগর থেকে শিয়ালদহগামী ট্রেনে। বসে আছি, কিছুক্ষণ পর পাশের খালি সিটটিতে যে বসেছিল সেই নদী। ট্রেন চলতে শুরু করলো। আমাদের কথামালার বুননও ক্রমবর্ধমান হতে থাকে। দু’জনেরই গন্তব্যস্থল শিয়ালদহ। সে প্রতি দিনের অফিস যাত্রী। আমার উদ্দেশ্য বন্ধু সাক্ষাৎ। আমার পরিচিতির বিষয়টি ক্ষুদ্র, যৎসামান্য হলেও তাকে আকর্ষণ করতে অব্যর্থ ছিল। জয়বাংলা থেকে উদবাস্তু হয়ে আসা ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ, বিষয় দুটি তাকে দ্রুত আন্তরিক হতে অনুপ্রাণিত করেছিলো। নদীর পূর্ব পুরুষরা এক সময় ফরিদপুরের আদিবাসী ছিল। পয়ষট্টির দাঙ্গায় শেকড় ছিন্ন করে কৃষ্ণ নগরে গোরাপত্তন করে। আলাপচারিতায় বুঝতে অসুবিধা হয় না, বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি নদীর আন্তরিকতা, ভালোবাসা কতটা গভীর। শিয়ালদহ পৌঁছলে আমরা দু’জন দু’দিকে যাবো তাই বিচ্ছিন্ন হবার পূর্বেই নদী তার ফোন নাম্বার একটি কাগজে টুকে দিল। আবারো মনে করিয়ে দিল, প্রতি অফিস ডে তে সে এ সময়ের গাড়িতে করে কোলকাতায় আসে। এ যাত্রার পর বেশ কয়েকবার নদীর সাথে দেখা হয়েছে। সম্পর্কের বন্ধনটাও অনেক দৃঢ় হয়েছে। বিষয়টি কিছুদিনের মধ্যে আমাকে ভাবাতে শুরু করলো। এটা কি শ্রেফ বন্ধুত্ব নাকি আরও বেশি কিছু। রাত হলেই ভাবনার গভীরে চলে যাই আমি। যুদ্ধের অপারেশনে গেলে অবশ্য ভাবনাগুলো মাথায় থাকে না কখনোই। কিছুক্ষণ বাদেই নদী ফিরে এলো। কাছে এসে টিকিট দুটো দেখিয়ে বললো, তপন সিনহার ছবি, অপর্না সেন অভিনিত ‘এখনই’ নিশ্চয়ই তুমি খুশি হবে? পত্রিকায় ছবিটির রিভিউ পড়েছি তাই, কিছু না ভেবেই ঝটপট টিকেট দুটো নিয়ে নিলাম। কিছুক্ষণ বাদেই ছবি শুরু হবে, নির্দিষ্ট আসনে গিয়ে বসলাম, প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ। ছবি শুরু হলো, ইয়ং জেনারেলশনের টানাপোড়েন নিয়ে ছবির কাহিনী গড়ে উঠেছে। এক সময় ঘাড়ের অনেকটা কাছেই নদীর গরম নিঃশ্বাস অনুভব করলাম। তার কিছুটা পর ওর ঠোঁটের স্পর্শ, চুইংগামের মিষ্টি গন্ধ এসব কিছুতে ছবি দেখার ঘোর থেকে ছিটকে পড়লাম কিছুক্ষণের জন্য। ছবি দেখে বের হোয়ে হাঁটতে শুরু করলাম ট্রাম স্টপেজের দিকে। অনেকক্ষণ দু’জনের মধ্যে কোন কথা হয়নি, নদী একবারও চোখ তুলে তাকায়নি। আমিই প্রথম নিরবতা ভেংগে একটা চুইংগাম দিতে বললাম নদীকে। মুখটা কেমন শুকিয়ে যাচ্ছে। ‘আমার কাছেতো কোন চুইংগাম নেই।’ তখন যে চুইংগামের গন্ধ পাচ্ছিলাম। ‘কই নাতো’। তাহলে আমারই ভুল হবে হয়তো। প্রতিবারই ঘ্রাণের ব্যাপারে আমার অহেতুক ভ্রম হচ্ছে। ট্রাম থেকে নেমে বাসে শিয়ালদা। অতপর কৃষ্ণনগর লোকালে চেপে কৃষ্ণনগর। মাঝ পথে নৈহাটিতে ভারের চায়ের উষ্ণতা। দীর্ঘ সময় নদী নিজ থেকে কিছু বলার চেষ্টা করেনি। জানি না এটা তার লজ্জা নাকি অভিমান! শুধু ট্রেন থেকে নেমে বাসা যাওয়ার পূর্বে বললো ‘ভালো থেকো, যোগাযোগ করো।’ দু’দিন বাদে ক্যাম্প থেকে যুদ্ধে চলে যেতে হলো।

সীমান্তবর্তী প্রায় সকল স্থানেই শত্রুদের মোকাবেলা করতে হচ্ছিলো। হঠাৎ একদিন এমন সম্মুখ যুদ্ধে গুলির আঘাতে আমার ডান হাতের ভীষণ ক্ষতি হলো। আমাকে সীমান্ত থেকে ফিরিয়ে আনা হলো একটি মোবাইল মেডিক্যাল ক্যাম্পে এবং পরদিন সরাসরি কোলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।

জরুরি অপারেশনের প্রয়োজন হয়ে পরেছিল। আঘাত গুরুতর, বিচ্ছিরিভাবে ভেঙে বিচ্ছিন্ন হয়ে ছিল। কিছুতেই হাতের ব্যথা কমছিল না। হাসপাতালের বেডে শুয়ে শুয়ে যুদ্ধের প্রাত্যহিক খবরা-খবর জানছিলাম দৈনিক পত্রিকার মাধ্যমে। এর মধ্যে নদীর সাথে যোগাযোগ করিনি ইচ্ছে করেই। এ খবর জানলে সে অস্থির হয়ে পড়বে নিমেষেই। শুধু যুদ্ধে যাওয়ার খবরটি কোনভাবে পৌঁছাতে পেরেছিলাম ওর কাছে। তার ধারণা এখনো আমি যুদ্ধেই আছি। মাসখানেকের মধ্যে চলমান যুদ্ধের আমূল পরিবর্তন ঘটলো। প্রায় যুদ্ধ জয়লাভের দোর গড়ায় আমরা। কিন্তু হাতের অবস্থা আরও জটিল হলো।

প্লাস্টার খোলার পরও হাত কোনভাবেই সোজা করতে পারছিলাম না। কোন কাজ করা সম্ভব হচ্ছিলো না, থেরাপি চলছিল। কয়েক দিনের মধ্যে যুদ্ধ চরম আকার ধারন করলো। পাক বাহিনী’র পতন শুধু সময়ের ব্যাপার, ওরা পিছু হটছে, মুক্তি বাহিনী ও মিত্র বাহিনী একত্রিত হয়ে একের পর এক এলাকা শত্রু মুক্ত করছিল। প্রতিদিন সংবাদ পত্রগুলোর শিরোনাম এ যুদ্ধের খবরা – খবর। দু-এক দিনের মধ্যে পাক বাহিনীর অন্তিম পতনের শংকা দেখা দিল। পরদিনি সর্বত্র খবর ছড়িয়ে পরলো, পাক বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছে।

ঢাকায় এর আয়োজন চলছে। হাসপাতালে সবাই শুভেচ্ছা বিনিময় করছে। আমি আবেগাপ্লæত হয়ে গেলাম, মন ছুটে গেল বন্ধু সান্নিধ্যে। বিকেলে ক্যাম্প থেকে দু’বন্ধু এসে আমাকে রিলিজ করিয়ে নিয়ে গেল। সবাই শত্রুমুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে যাচ্ছে। পর দিন সবাই ট্রাকে করে বেনাপোল হোয়ে ঢাকা অভিমুখে ছুটছে। কী যে আনন্দ! ব্যথা -বেদনা ভুলে গেলাম নিমেষেই। নদীর সাথে একবার দেখা করার ইচ্ছে জেগে ছিল কিন্তু সময়ের অভাবে ও অন্যান্য জটিলতার কারণে হয়ে উঠেনি। ভাবলাম পরে এসে না হয় দেখা করে যাব। ফিরে কিছুদিন পর ঢাকা মেডিকেল কলেজে যোগাযোগ করে পুনরায় চিকিৎসা শুরু করা হলো। সেখানে আমার মতো অনেক মুক্তিযোদ্ধা হাত কিংবা পায়ের মারাত্মক ক্ষতাবস্থা নিয়ে ভর্তি। কিছু দিন বাদে সুযোগ এলো উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মান যাওয়ার। যেখানে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হাত-পা’র সবচেয়ে ভাল চিকিৎসা সম্ভব। অনেকের মতো আমারও মেজর অপারেশন করে শেষ অব্দি অচল হাতকে সচল করতে সফল হয়েছিল। এর জন্য আমাকে প্রায় চার মাসের অধিক সময় জার্মান অবস্থান করতে হোয়েছিল।

দেশে ফিরে নদীর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলাম। নিজকে কিছুটা অপরাধি মনে হচ্ছিল যেন। মাঝখানে এতটা মাস কেটে গেছে যোগাযোগবিহীন, ভাবতেই অবাক লাগে। কেমন করে পারলাম! নদী কি ভাববে? সে তো ঘটে যাওয়া এ সকল ঘটনার কিছুই জানে না। এতোদিন যুদ্ধ বিদ্ধস্ত বাংলাদেশের সাথে বহিঃবিশ্বের যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিলো না।
যোগাযোগ পুনঃস্থাপন হওয়ায় টি এন্ড টি গিয়ে নদীর সাথে ওভারসিজ কল করে যোগাযোগ করতে চাইলাম কিন্তু নম্বরটি বিচ্ছিন্ন বলে বার বার জানান দিচ্ছিল। মাস খানেকের মধ্যে প্রস্তুতি নিলাম কোলকাতায় যেতে। মূল উদ্দেশ্য নদীর সাথে সাক্ষাৎ করা। কতোদিন নন্দনের গরম কফি খাওয়া হয় না, নতুন কোন মুভি দেখা এবং সর্বোপরি নদীর কন্ঠে প্রায়ই শ্রæত কবিতার পংক্তি মালা – নবীন কিশোর তোমাকে দিলাম বোতামবিহীন ছেড়া শার্ট আর ফুসফুস ভরা হাসি। কবিতা নদীর ভীষণ পছন্দ, সুযোগ পেলেই বিভিন্ন কবিতা থেকে কোন অংশ বলা চাই। আমার ভালো লাগতো। পরস্পরের কাছে যাওয়ার রঙিন দিনগুলো যুদ্ধকালীন সময়ে আমাকে দু’দন্ডের সুখ দিয়েছিল বৈকি! সে সময় দেশে বাবা-মা, আত্মীয় স্বজনদের ছেড়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ আমার জন্য সত্যিই অনেকটা চেলেঞ্জিং ছিল। কখনো কখনো একাকিত্বে ভুগতে হতো আমাকে। নদীর বন্ধুত্ব, আন্তরিকতা সে একাকিত্ব অনেকাংশে ঘুচিয়ে দিতে স্বার্থক হয়েছিল। বন্ধুত্বের বন্ধন দৃঢ় করতে তার জুড়ি মেলা ভার। নদী যেন বন্ধু বৎসল নির্মেঘ আকাশের মতোন, স্বচ্ছ সরল বহমান এক নদী আমাকে সিক্ত করে রাখে, সজীব করে দেয় অহর্নিশ। কোলকাতা পৌঁছেই ট্যাক্সি নিয়ে সরাসরি নদীর অফিসে।

অফিসে ওর নির্দিষ্ট জায়গায় না পেয়ে জিজ্ঞেস করতেই জানা গেল মাস কয়েক আগেই সে চাকরি ছেড়ে চলে গিয়েছে। দেরি না করে চলে এলাম শিয়ালদা, সেখান থেকে সরাসরি কৃষ্ণনগর লোকালে, পৌঁছতে প্রায় তিন ঘন্টা সময় লেগে যাবে। এতোটা লম্বা সময় জার্নি আমার কাছে কতটা দীর্ঘ সস্তিবিহীন। তবুও নদীর সাথে এতোদিন পর দেখা হবার বিষয়টা আমাকে যেন শান্তনা এনে দিচ্ছিল বার বার। এতোদিন পর দেখা হলে নিশ্চয়ই খুশিতে জড়িয়ে ধরবে নাকি যোগাযোগ রাখিনি বলে অভিমানে কোন কথাই বলবে না? নিশ্চয়ই আমাকে আজ কোনভাবেই চলে আসতে দিবে না। ভালোই হবে, রাতভর গল্প করবো, মুক্তিযুদ্ধের গল্প, আমার আহত হবার গল্প এবং যুদ্ধপরবর্তী চিকিৎসার জন্য জার্মান গমণের গল্প। জানি এসব হয়তো তার কাছে বিচ্ছিন্ন হবার ঠুনকো অজুহাত বলেই মনে হবে। শুনবো নদীর অভিমানের গল্প, মন্দ লাগার গল্প। আজ পূর্নিমা, ছাদে শুয়ে শুয়ে দু’জনে আকাশ দেখবো, আকাশে আজ তারার মেলা। নদীর শরীরের ওডি কোলনের সুগন্ধ,বাতাসে উড়ে আসা দুষ্ট চুলগুলোর মিষ্টি গন্ধ এবং এক সময় মুখে এসে পড়া চুলগুলো সরাতে গিয়ে হঠাৎ করে সেই চুইংগামের অলিক গন্ধটাও অনুভব করবো হয়তো। দূরে কোথাও বেজে যাবে, ‘সেই রাতে রাত ছিল পূর্ণিমার, রঙ ছিল ফাল্গুনের হাওয়াতে।’ রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে ছুটে যায় দূর পাল্লার ‘লাল গোলা’ ট্রেন। নির্ঘুম রাতের ভালোবাসার প্রহরী দু’জন এক মায়াবী মাধুর্যে যেন জেগে আছি অমৃতের সন্ধানে। চলমান ভাবনা-চিন্তার ছেদ টেনে হঠাৎ সচল ট্রেনটি অচল হয়ে থেমে গেল শেষ গন্তব্যে এসে। স্টেশন থেকে রিকশা করে চলে এলাম নদীদের বাড়ি। কড়া নারতেই ওর মা দরজা খুলে দিয়ে আমাকে বসতে বললেন। একটা উত্তেজনা, একটা শিহরণ আমার রক্ত প্রবাহে। এইতো সুন্দর একটি তাঁতের আটপৌরে শাড়ি পড়ে হাজারো প্রশ্ন চোখে আমার সম্মুখে হাজির হলো বুঝি! ওর মা’র দেয়া চা মিষ্টি খেতে খেতে জেনে নিলাম নদীর বিয়ে হয়ে পারি জমিয়েছে জার্মানের ফ্রাংকফ্রিট শহরে। কী আশ্চর্য আমিওতো ওখানেই ছিলাম চিকিৎসাকালীন চার মাস। কেন একটি বারও দেখা হলো না ভুল করে? এটাই বুঝি ভাগ্যের নির্মমতা! আমার হঠৎ ঠিকানাবিহীন হারিয়ে যাওয়া, নিরুদ্দেশ হওয়া – এতো কিছুর মধ্যে, আমাকে খুঁজে না পাওয়া তাকে ব্যথিত করেছিল নিশ্চয়ই, দুঃখ জাগিয়ে ছিল মনে। একটা শূন্যতা, একাকিত্ব আমাকে গ্রাস করেছিল ক্রমশ। অসহায়ের মতো আমি যেন বার বার আত্মসমর্পন করে চলছি নিজেরই বিবেকের কাছে। বের হোয়ে আসার সময় নদীর দেয়া একটি এনভেলাপ আমার হাতে তুলে দিলেন ওর মা। সাদা এনভেলাপের ভেতর নীল কাগজের উপর লেখা – কষ্ট পাবে জানি, তুমি আমায় তখন ‘দুঃখ’ বলে ডেকো। দুঃখের রঙ কি নীল? আমি কেন এতো কষ্ট পাচ্ছি! আমার কষ্টগুলো কি তার দুঃখগুলোকে একটু ছুঁয়ে দেবে? পাশাপাশি, কাছাকাছি চলবে অনন্তের সহযাত্রী হয়ে সেই দুঃখ – কষ্টগুলো। নদী তুমি কি শুনতে পাও Stevie Wonder- এর সেই গান – ”I just call to say I love you?’
বিদ্যুৎ সরকার : লেখক, আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা