বিদ্যুৎ সরকার : সুবর্ণ-রেখা ছায়াছবির সীতা নামের সেই ছোট্ট মেয়েটির কথা মনে পড়ে? অদ্ভূত সুন্দর দু’টি চোখ। জল টলমল শান্ত দীঘির অসীমের গভীরতা নিয়ে অপলক চেয়ে থাকে মুখ পানে। হাজারো প্রশ্ন তার চোখের দৃষ্টিতে। শেকড় ছিন্ন, বাস্তু-ভিটা ত্যাগ করে উদ্বাস্তু হোয়ে নগর থেকে গ্রামে, শহর থেকে উপ-শহরে, উত্তর থেকে দক্ষিণে, পূর্ব থেকে পশ্চিমে ঠিকানাবিহীন অবিরাম পথ চলা। দাদা স্বপ্ন দেখায় নতুন মাথা গুজার স্থান, নতুন বাড়ি। সীতা স্বপ্ন আবিষ্ট হয়ে থাকে – নতুন বাড়ির কাঁচা বাশের বেড়ার বুনো গন্ধ পাবার আশায়, নিকোনো উঠোনে আঁকা এক্কা-দোক্কার ঘর। সেই অধরা স্বপ্ন চোখের আঙিনা ছুঁয়ে সহসাই ঝরে পড়ে মাটির বুকে। দাদার হাত ধরেই আবার চলে আসে সুবর্ণ-রেখা নদীর পাড়ে নতুন ঠিকানায়। সাথে আসে কুড়িয়ে পাওয়া তারই বয়সের একটি ছিন্নমূল শিশু। নাম ওর বলাই। দু’জনে ভাল বন্ধু হয়ে যায় প্রথম দেখাতেই। সুবর্ণ রেখার জোয়ার-ভাটা তাদের মনেও প্রভাবিত করে সময়ের আবর্তে। নদীর জলে জলছবি আঁকে। বালু চরে ঘর নির্মাণ করে দু’জনে, ঢেউ এসে সে ঘর ভেংগে দেয় অবলিলায়। ভাংগা-গড়ার এমন খেলা তাদের মন খারাপের গল্প শোনায়।

কখনো কখনো সীতার চোখে জল নিয়ে আসে। সুবর্ণ রেখার মত তার চোখ দুটিও কখনো শান্ত আবার কখনো অশান্ত হয়ে যায় স্মৃতির পলেস্তারায়। মনে পরে তার ফেলে আসা বাড়ির কথা। সেখানেও এমন একটি নদী আছে। নদীর পার ঘেঁষে তাদের ছোট্ট বাড়ি। ছোট্ট বাড়ির ছোট্ট উঠোন, উঠোনের এক কোণে একটি গোলাপের ডাল পুতে ছিল ফুল ফোটানোর প্রত্যাশা নিয়ে কিন্তু, সে তো চলে এলো। আদরের বিড়াল ছানা মিনি, কবুতরের ঘর এ সবের এখন কী হবে? কে তাদের দেখা-শোনা করবে, খাবার দেবে জল দেবে সময় অসময়ে। কবুতরগুলো সকাল হতেই বাক্ বাকুম্ করে ডাকতে থাকবে আমি না থাকলে কে অমন যত্ন করে চালের কুড়ো উঠোনে ছড়াবে? গোলাপের ডাল থেকে নিশ্চয়ই এদ্দিনে নতুন পাতা গজিয়ে উঠেছে। আর, আমার কুট্টি বিড়াল ছানা? সে তো আমাকে না পেয়ে মিউ মিউ করে সমস্ত বাড়ি খুঁজে বেড়াবে! কে ওকে দুধ দিয়ে ভাত মেখে কোলে বসিয়ে আদর করে খাওয়াবে? তিন্নি, মুনিয়া, শাপলা ওদের সাথে কবে আবার দেখা হবে আমার! কত্তোদিন উঠোনে ঘর এঁকে আমরা এক্কা-দোক্কা খেলি না। পুতুল পুতুল খেলা, সেওতো ভীষণ ভাবে মনে পড়ছে। এসব কথা মনে হলে সীতার চোখে জল আসে। তখন সীতা একা হোয়ে যায়, একান্তই একা।

মাঝে মাঝে একা হতে তার ইচ্ছে করে। একাকিত্ব মানুষকে ভাবতে শেখায়, অনুভবেও ছোঁয়া লাগে। ছোট্ট সীতা অত শত কিছুই জানে না, বুঝেও না। ও’ তার ছোট মনে যা চায় তাই করে আনমনে শুধু এটুকুই। তখন সীতা সুবর্ণ রেখা নদীর পারে চলে আসে একা একা। নদীর দিকে দু’চোখ মেলে ধরে। ‘চোখে নামে বৃষ্টি…।’
বিদ্যুৎ সরকার : লেখক ও আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা