Home কলাম এই মেঘ এই রোদ্দুর : চশমাওয়ালা

এই মেঘ এই রোদ্দুর : চশমাওয়ালা

বিদ্যুৎ সরকার : লোকটি ওভার ব্রিজের নিচটায় হরেক রকম চশমার পসরা সাজিয়ে বসতো। দু’হাজার আট সাল থেকেই লোকটাকে প্রতিদিন ওখানটায় বসে থাকতে দেখেছি আমি। সকালের একটা নির্দিষ্ট সময় থেকে বিকেলের প্রথম প্রহর অব্দি সে ওখানটায় চশমা মানে “সানগøাস” বিক্রি করতো। সত্তর ঊর্ধ্ব এ লোকটির টেবিলে বিভিন্ন স্টাইলের চশমা পাওয়া যেতো যেগুলোর মূল্যও ছিল বিভিন্ন। সাব-ওয়ে ধরে কাজে যাওয়া-আসার পথে প্রায়ই সুন্দর সুন্দর ডিজাইনের চশমা নেড়েচেড়ে দেখতাম। দামে কম- সহনশীল হলে নিয়ে নিতাম। এভাবে আমার জিম্মায় সাত-সাতটি “সানগ্লাস” এসে গেছে। যেগুলো যে কোন শপিং মল থেকে কিনলে প্রায় দ্বিগুণ মূল্যে কি গুনতে হতো আমাকে। লোকটির বিশেষত্ব ছিল, ভীষণ যত্ন করে চশমা লাগিয়ে একটি ছোট্ট আয়না মুখের সামনে ধরে থাকতো এবং একগাল হেসে বলতো “সুপার লুকিং”। শুধু যে আমার বেলায় এমনটি করতো, তা নয়। যে কোন গ্রাহকের বেলায় ওরকম করতেন তিনি। বেশ ক’দিনে আমরা যেন পরস্পরের অনেক চেনা, অনেক জানা, অনেকদিনের পরিচয়ের সুতোতে গেঁথে ফেলেছিলাম অজান্তেই। অন্তরের গভীরে অনেকটা স্থান যেন দখল করে নিয়েছিল সে। হঠাৎ একদিন সেই লোকটিই অদৃশ্য হয়ে হয়ে গেল- একদিন, দু’দিন, পরপর অনেকদিন সে আর ফিরে আসেনি সেখানটায়। তারপরও দীর্ঘ সময় ধরে তার ফিরে আসার অপেক্ষায় ছিলাম। হয়তো সে অসুস্থ – এটা ভেবে অভয় দিতাম মনকে। সুস্থ হলেই ফিরে আসবে। এক সময় সিদ্ধান্ত— নিতে হলো সে আর ফিরে আসবে না কোন দিন। সে কি এ শহর ছেড়ে চলে গেছে অন্য শহরে বা অন্য কোন সাব-ওয়ে স্টেশনে? আমি তো তার যোগাযোগের সূত্র রাখিনি, কোথায় খুঁজবো তাকে? কেন জানি মনে হতে থাকলো তার অনুপস্থিতি আমাকে ব্য্যথিত করছে। অস্থির করে তুলছে অহর্নিশ। অথচ, সেতো আমার আত্মীয় নয়, বন্ধুও নয় তবে কেন কোন ভালোলাগার কোমল অনুভ‚তিতে আমাকে আবৃত করে তোলে। চোখ বাষ্পময় হয়ে উঠে। ঝাপসা হয়ে উঠে সম্মুখের দৃশ্যমান সবকিছু। পাখির অচেনা উড়ান বুঝি কোন অজানায় পৌঁছে দিল আমাকে। ভিক্টোরিয়া পার্ক সাব-ওয়ের স্টেশন এখন অনেক সুনসান, কাচের দেয়াল ঘেরা সাইকেল স্টেশন, রাতের সকল আঁধার দূর হয় অনেক আলোর ঝলকানিতে- সুন্দর থেকে সুন্দরতম এর চারদিক। বর্ধিত সৌন্দর্যে মন ভরে পথচারীর। কাচের ওপাশে আকাশের উদারতা। শান বাঁধানো গোল চাকতির উপর বসে প্রাত ভ্রমণের ¯স্বল্প বিরতির ফাঁকে অনেক অচেনা যাত্রী চেনা মুখের ছবি হয়ে দেখা দেয় প্রতিদিন। যে চশমাওয়ালা অদৃশ্য হয়ে গেছে তার মুখও বুঝি দৃশ্যমান হয়ে উঠে কখনো কখনো। সময়ের ধুলো পড়া কাচের জানালায় বহে সুবাতাস। কখনো কখনো অনেক দেখা কোন কিছু হঠাৎ করে চোখের আড়াল হয়ে গেলে তার জন্য মন কেমন করে। অনেককেই এ অবস্থার শিকার হতে হয় জীবনে দু-একবার। আমারও তেমনটি হয়েছিল এবং এখনো হয়ে থাকে মাঝেমধ্যে আমার এক পরশির কথায় এ গল্পের অবতারণা আমার। ভিক্টোরিয়া পার্কের গাড়ি পার্কিং-এ মাঝে মধ্যে তার সাথে দেখা হয়ে থাকে।

সে অফিসে যাচ্ছে আর আমি প্রাতঃ ভ্রমণ শেষ করে বাসায় ফিরছি, এ অবস্থায় দেখা হলে শুধুই কুশল বিনিময়। সে দিন অনেক দিন বাদে হঠাৎ দেখা, থামতে বলে সে ছোট্ট প্রশ্ন ছুড়ে আমাকে যেমন চমকে দিল তেমনি মনে করিয়ে দিল সেই সাব-ওয়ের পাশে ব্রিজের নিচের চশমাওয়ালার কথা। কেন তাকে আর দেখছি না, কোথায় হারিয়ে গেল কিছু না বলেই? খুঁজে না পাওয়ার এমন একটি বিয়োগান্তক গল্পের ¯স্মৃতি বয়ে চলতে হবে আমাকে প্রতিদিন, চিরদিন। আমিও চাই না আবার এমন একটি গল্পের অনুষঙ্গ হতে। এক সময় সম্পর্কের বয়স বাড়ে। সম্পর্ক অটুট হয়, নিখুঁত হয় আবার কেন জানি জানালার কাচের ন্যায় ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায় ছোট্ট একটি ঢিলে। ভিক্টোরিয়া পার্ক, সাব-ওয়ে ওখানটায়ই থাকবে। সুন্দর তিলোত্তমা হয়ে উঠবে আরো। যাত্রীর আনা-গোনা বৃদ্ধি পাবে দিন দিন। নতুন নতুন গল্পের সূচনা হবে ভিন্ন ভিন্ন পাত্র-পাত্রীর আবির্ভাবে। শুধু আমরাই থাকবো না চিরকালের সাক্ষী হয়ে।

বিদ্যুৎ সরকার : লেখক ও আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা

 

Exit mobile version