বিদ্যুৎ সরকার : মনীষাদের সেই রকটা তেমনি আছে। শুধু, সময়ের ব্যবধানে সিমেন্টের পলেস্তারা কোথাও কোথাও খসে গেছে। অদূরে যে সাধুর চায়ের টংঘর, যেখান থেকে আমরা নিত্য শিঙ্গারা ও মশলা চা খেতাম সেটিও আছে তবে, প্রিয় সাধুদা বেশ ক’বছর হলো গত হয়েছেন। এখন তাঁর ছোট ছেলেই টংঘরের মূল দায়িত্বে। একজন সহকারী সারাদিন চা বানানো ও বিক্রির কাজটি করে থাকে। টংঘরে ছোট একটি রেডিওতে ঋগ ব্যান্ডে বাংলা, হিন্দি সিনেমার গান, মাঝে মধ্যে সমকালীন রক্ এন রোল ধাঁচের গান বেজে চলে বিরামহীন। ইদানীংকার রকবাজদের কেউ কেউ এসব গানের শ্রোতাও। প্রতিদিন বিকেলে ও ছুটির দিনগুলোতে দু’বেলাই রকবাজদের আড্ডা জমে থাকে সংগীত, শিল্পকলা, সিনেমা, মাঠে ময়দানের সব বিষয় নিয়ে- যেমনটি আমাদের সময়েও বিদ্যমান ছিল। যখনই মনীষাদের বাড়ির সম্মুখ দিয়ে হেঁটে যাই তখনই বন্ধুদের কথা ভীষণভাবে মনে পড়ে যায়। সবাই আজ পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অবস্থান করছে। শুধু, ক্ষয়ে যাওয়া এর কটি স্থির স্মৃতি চিহ্ন হয়ে রয়ে গেছে। খুব বেশি মিস করছি দেবাশীষ। তুই, আমি, শিবু, নোমান, বার্নাড, যোশেফ, তুহিন, সুমন কখনো কোন বিশেষ কারণ ছাড়া এ আড্ডাটা মিস করতে চাইতাম না। পূজা, ঈদ। বড়দিন কোন অনুষ্ঠানই আমাদের হাতছাড়া হতো না তুমুল আনন্দ ব্যতীত। কেমন করে আমরা একে একে পরস্পরের থেকে দূরে সরে গেলাম জীবন জীবিকার সন্ধানে।

মনীষার প্রতি তুই একটু বেশি বেশি দুর্বল ছিলি, তাই না? খুব কম দিনই মিস করেছিস রকের আড্ডা এবং মনীষার দুষ্টু মিষ্টি চাহনি। জানালার শীতল শিক ধরে প্রতিদিন বিকেল বেলায় অন্তত একবার হলেও আকাশটাকে দেখে নিত চোখে রোদের মাসকারা মেখে। হৃদয়ে এক সমুদ্র মমতা ধারণ করে পাখিদের নীড়ে ফেরার মুহূর্তরা তাকে খুব বেশি বিচলিত করতো। তুই বলতিস হয়তো মনীষাও এমন একটি শান্ত, স্নিগ্ধ নীড় খোঁজে ফিরে প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ। শৈশব, কৈশোর, যৌবন- স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে অতঃপর ভাগ্যবানদের চাকুরী আর বাকীদের দুর্বিষহ সসয় কাটানোর একমাত্র অবলম্বন মনীষাদের রক। সময়ের সাথে সাথে বন্ধুদের অবস্থা ও অবস্থানের পরিবর্তন হতে থাকে অজান্তেই। একে একে আমরাও বিচ্ছিন্ন হতে থাকি পরস্পরের ভালোলাগার বাহুডোর থেকে, ভালোবাসার আলিঙ্গন থেকে। এমন করে চলে যেতে হলো বলে তোর কতটা কষ্ট স্বেচ্ছায় বয়ে নিতে হচ্ছে তা আজো জানা হলো না দেবাশীষ। শুধু তোর সারা গায়ে জ্বলে নিভে অ-সুখের জোনাকি। তুই কি এখনো গান শুনিস সুমন, নচিকেতা, রূপঙ্করের গান- জীবনমুখী গান, যৌবনের গান? তুইই বল কেমন করে ছেড়া বোতামের ক্ষত ভুলা যায়, লেগে থাকে সুতো তোর হৃদয়ের এক কোণায়? তুইতো বলে হিম পাহাড়ে বেড়াতে যাবি বন্ধুদের নিয়ে যেখানে, রঙে রঙে দিশেহারা পাহাড়ি বনফুল। দুষ্টামি করে প্রায়ই বলতি মনীষাকে উদ্দেশ্য করে ‘যদি চাও দুমুঠো এমন ফুলেল বিকেল ছুড়ে দেব তোমার ঝুল বারান্দায়’। শাশার কথা মনে আছে তোর? আমার ক্লাসমেট, পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম তোর সাথে এক কফি-শপে- সেওতো কোথায় হারিয়ে গেছে আমার সুনীল আকাশ থেকে এক নীরব চন্দ্রগ্রহণের আঁধারে। পূর্ণেন্দু পত্রীর কবিতার মেঘ হয়ে পাহাড়কে ভালোবেসেছিল কোনদিন সে। তোর আমার, এমন কি আমাদের সবার এক স্মৃতিময়, স্বপ্নময়, অবিনশ্বর ভাললাগার মুহূর্তগুলোর কাছে চিরকাল আবদ্ধ হয়ে আছি এবং এভাবেই থাকতে বড় বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছি প্রতিনিয়ত। কেন আমরা সে সময়গুলোর আলিঙ্গন থেকে কেউই মুক্ত হতে পারছি না কোনভাবেই? সে সময়ের সকল ভালোলাগা- মন্দলাগার মায়াজালে আটকে পড়েছি হয়তো চিরদিনের জন্যই! কী এক অদ্ভুত স্মৃতি কাতর ম্যাগনেটিক ফিল্ডের সীমানায় সীমাবদ্ধ আমারা সকলেই। ইচ্ছে করেও এর মোহময় গণ্ডি থেকে মুক্ত হতে পারছি না কোনভাবেই। ইদানিংকার গান, কবিতা, ছায়াছবির এমনকি প্রেমও আমাদের অতোটা টানে না বিপথগামী হতে। তবে কি আমরা MID LIFE এর TIME BUBLE এ আটকে গেছি অজান্তেই? এখনকার কোন কিছুতেই মন টানে না, স্বপ্নের মতো প্রতিটি বিকেল যেন আরো খানিকটা পরমায়ু পেয়ে এমনিভাবেই বেঁচে আছে অতীতের সমস্ত স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে। তবুও তুই মাঝে মাঝে ফেসবুকের দেয়ালে লিখে যাস তুই ভাল আছিস। দেবাশীষ তুই রাতের তারাদের পাহাড় দিস, রোজ রাতে নেশাতুর হয়ে ফিরতে চাস। নেটওয়ার্কের সীমান্ত পার হলে সীমাহীন নৈশব্দের গহীনে আমরা একে একে ডুবে যেতে তাকি দেবাশীষ। এক পাহাড় স্মৃতি চাপিয়ে দিয়ে কোথায় হারিয়ে গেলি তুই? “ইস দেবাশীষ তুমি বড় হয়ে গেছ দেবাশীষ, ইস দেবাশীষ চেনা ঠিকানায় নেই হদিস। ইস দেবাশীষ বয়ে গেল শুধু বছরের ঢেউ, ভালোবাসা যাকে তার পাশে অন্য কেউ”।
পুনশচ: অনুপম রায়ের ‘ইস দেবাশীষ’ গানের অনুপ্রেরণায় এ লেখাটি।
বিদ্যুৎ সরকার : লেখক ও আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা