বিদ্যুৎ সরকার : নব্বই ছুঁই ছুঁই, পুরু লেন্সের চশমা চোখে এখনও কাছে কাগজ পেলেই একবার কাছে নিয়ে চোখ বুলিয়ে দেখতে চেষ্টা করেন ছবি সমগ্র। অল্প বিস্তর সবই খেতে পারেন। তাই, বয়সের তুলনায় অনেক সচল সমর্থ। তার মূল জীবনী শক্তি হলো তার ‘স্মৃতিচারণ’। গল্প বলতে ভালোবাসেন যখন-তখন। সময় পেলেই আমরা ছুটে যাই তার কাছে গল্প শুনতে। তার চারদিকে গোল হয়ে বসে সব্বাই গল্প শুনি আনমনে। একের পর এক গল্প বলে যায় অবিরাম। বেশির ভাগ গল্পই তার জীবন থেকে নেয়া। শৈশবের গল্প, যৌবনের গল্প, প্রকৃতির গল্প, দেশ ভাগের গল্প, মুক্তিযুদ্ধের গল্প। গল্প বলতে বলতে কখনো চোখে জল এসে যায়, ঝাপসা হয়ে আসে দু’চোখ। চশমা পরিস্কার করার ছলে চোখ মুছে নেয় গোপনে। একটু থেমে আবারও তার গল্প বলা শুরু। এসব গল্পের মাধ্যমে অতীতকে টেনে আনেন বর্তমানের দোরগোড়ায়, বুঝাতে চেষ্টা করেন পার্থক্য ও পরিবর্তনের বিষয়-আসয়।
পূথিগত বিদ্যা অর্জনে খামতি থাকলেও জ্ঞানের পরিধি ছিল যথেষ্ট। বিদ্যা অর্জনে অনেক ইচ্ছে থাকলেও বাড়ি থেকে স্কুলগুলোর অবস্থানগত দূরত্ব ও যোগাযোগের ব্যবস্থা ছিল খুবি নাজুক। এমন করেই ইচ্ছেগুলো অংকুরেই ঝরে পরে যায়। বাড়িতেই তাকে পড়তে হতো। তাই ‘ধারাপাত’, ‘আদর্শলিপি’র মধ্যেই তার পূথিগত বিদ্যা অর্জন সীমিত রয়ে গেছে। তবে, শীতের সকালগুলোতে উঠোনে পাটি পেতে পড়তে বসে রোদের উষ্ণতা ও গুর-মুড়ির যোগ পড়ার গতিকে অধিক বেগবান করে দিত। এসব সুখময় স্মৃতি এখনো তাকে আপ্লুত করে। বর্ষার রিমঝিম বৃষ্টি পড়ার শব্দ, পুকুরের অথৈ জলে সাতার কাটার মনোময় স্মৃতি তাই বা কম কিসে? শৈশব-কৈশোরের সন্ধিক্ষণে মস্ত উঠোনে সব খেলার সাথীদের এক্কা-দোক্কা, গোল্লাছুট, দাড়িয়াবান্ধা – সব স্মৃতিই তো এখনো অমলিন। স্মৃতিচারণ করতে করতে মাঝেমধ্যে জল খাবার ছলে একটু জিরিয়ে নেয় ইন্দুবালা। এমন করে প্রতিদিনই তার গল্প বলার আসর জমে উঠে। অবসর পেলেই সে তার ছোট্ট জানলা গলিয়ে দৃষ্টি মেলে ধরে চারিদিকে। দৃশ্যমান অনেক কিছুর সাথেই তার স্মৃতি জড়িয়ে। চালতা গাছটা নিজ হাতেই লাগানো। ধিরে ধিরে চারা থেকে পরিপূর্ণ ফলবতী বৃক্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে। চালতা গাছে যে দিন প্রথম ফুল ফোটে ইন্দুবালার আনন্দের সীমা ছিলো না। ধপ ধপে সাদা, ভিতরে হলুদ রেনু, মৃদু সুঘ্রাণ – সমবেত সৌন্দর্য ইন্দু বালাকে এখনো তাড়িয়ে বেড়ায়।
চালতার পাশের যে আম গাছটি রয়েছে সেটিও তার লাগানো। জৈষ্ঠের পাঁকা সিঁদুর রঙের আম দেখে অস্তগামী সূর্যের কথা মনে পড়ে। সাজ বেলায় তখন তাদের সব খেলা সমাপন করে ঘরে ফেরার সময় হতো। আর ছোট্ট জানালা গলিয়ে দৃষ্টি মেলে ধরে চারিদিকে। আর অন্তরের দৃষ্টি খোলা থাকে স্মৃতিজাগানিয়া দূরন্ত শৈশবের দোরগোড়ায়। বর্ষায় পুকুরের জলে বৃষ্টি পড়ার দৃশ্য দেখতে দেখতে শৈশবের সবাই মিলে গল্প শোনার দিনগুলোর কথা মনে পড়ে ইন্দু বালার। সময় পেলেই জানালার মধ্য দিয়ে সে খুঁজে বেড়ায় বাড়ির চারপাশের দৃশ্যমান লতাগুল্ম, গাছ-গাছালি মানুষের আগমন নির্গমন। ভালো লাগে এ সকল পরিচিত সুগন্ধময় দৃশ্যগুলো। অনেকেই জানালার কাছে এসে দু’দন্ড দাঁড়িয়ে কথা বলে, কুশলাদি জিজ্ঞেস করে। ইন্দু বালার এ জানালা তার অনেক প্রিয়। তার কাছে যেন চলমান একটি রঙিন টেলিভিশন। একটি রংমহল। আছে অতীতের স্মৃতি, বর্তমানের সুখ-দুঃখ, ভালোবাসা, প্রেম, ভবিষ্যতের স্বপ্ন নির্মাণের উপকরণ, আয়োজন। একাত্তরে এ জানালাটা এখানেই ছিল। তবে এখন যেমন কাঠের ফ্রেমে আবদ্ধ তেমনটি নয়। এ জানালা দিয়ে সে অপলক নেত্রে তাকিয়ে ছিল তার ছেলের চলে যাওয়ার পথের দিকে। ইন্দু বালার ছোট ছেলে বন্ধুদের সাথে ভারতে চলে গেছে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবে বলে। প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধ করেছে সে খবর ইন্দুবালার অজানা ছিল না। একাকী সময় পেলে তাকিয়ে থাকে যুদ্ধ শেষে ছেলের ফিরে আসার পথের দিকে। কিন্তু, আজও সে ফিরে আসেনি।
যুদ্ধ শেষ হলো। মুক্তিযোদ্ধা – মিত্র বাহিনী মিলে দেশকে শত্রুমুক্ত করে পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করলো। স্বাধীনতা অর্জনের আনন্দটা তাকে স্পর্শ করেছিল ভীষণভাবে। তবুও যুদ্ধ শেষে তার ছেলের ফিরে না আসার বিষয়টি তাকে ব্যথিত করেছে অনেকাংশে। এখনও সে স্বপ্ন দেখে ছেলের ফিরে আসার। এতো দিনে তার জানা হোয়েছে, বুঝা হোয়ে গেছে এ স্বপ্ন শুধুই স্বপ্ন, মরুদ্যানের মরিচিকা। তবুও এ অলিক স্বপ্ন বিভোর হোয়ে সুখের সন্ধানে নিজেকে যুক্ত করে দুঃখটা একটু লাঘব করতে চায় ইন্দু বালা। ইন্দু বালার স্মৃতির জানালা, ভালোবাসার জানালা, একটি মুক্তিযুদ্ধের শিহরণ জাগানিয়া জানালা, সুখ-দুঃখের জানালা, স্বপ্ন নির্মাণের জানালা – অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতের সেতু বন্ধনের জানালা যেন।
বিদ্যুৎ সরকার : লেখক ও আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা