বিদ্যুৎ সরকার: আমার এ সুন্দর শহর, প্রাণের শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছি আমার হৃদয়ের গ্রাম হৃদয়পুরে। ‘যেখানে আমার তরুণ হৃদয় যা গেছে আজ হারিয়ে….’ এ শহরতো আমাকে বুকে টেনে নিয়েছিল প্রথম দেখাতেই, আমিই পারিনি তার এ মধুর ডাকে সাড়া দিতে সে বেলায়। বেলা, অবেলা, কালবেলা-য় তাও একটু একটু বুঝতে শিখেছি মনের মাধুরি মিশিয়ে যে বুকে টেনে নিতে চায় সেতো সত্যি সত্যিই ভালোবেসে ডেকেছিল প্রাণের টানে। আমিই বুঝিনি তাতো আমার অপারগতা, আমার অক্ষমতা। আমার শৈশব, আমার কৈশোর, যৌবন সবই কেটেছে আমার এ সুন্দর শহরে। এ শহরকে কেমন করে ছেড়ে চলে যাবো আমি। ‘যখন ভাবি, আমি নেই (এ শহরে) ব্যাথায় ব্যাথায় এ মন ভরে যায়…’।
তবুও আমাকে চলে যেতে হবে এটাই ধ্রুব সত্য। এ শহরের মৃত্তিকা, অলি গলি, রাজপথ সব কিছুই আমার নখ-দর্পনে। দৃষ্টিহীন আমার দুচোখে ভালোবাসার স্মৃতি নির্ভর দৃষ্টি এ পথ চিনিয়ে নেয় আমাকে শুরু থেকে শেষ অব্দি। ছায়ার সাথে কায়ার যেমন যুদ্ধটা মেনে নেয়া কঠিন তেমনি, আমার বিরুদ্ধে আমার অস্তিত্বের বিরোধ খুবই বেমানান। এ শহরে কলি থেকে ফুল ফুটতে দেখেছি, ফুল থেকে ফল হতে। সেই বৃক্ষকে কখনো এতোটা নির্দয় হতে দেখিনি তার শেকড় ছিন্ন করে কোথাও হারিয়ে যেতে। শুধু আমিই কেবল বোধহীন হীনমন্যতায় ভাসছি অহেতুক। কেন আমি চলে যাব আমার এ ভালোবাসার শহর ছেড়ে? এ শহরতো আমাকে বাঁচতে শিখিয়েছে। ধিরে ধিরে বেড়ে উঠায় সহায়তার হাত প্রসারিত করেছে। কেমন করে কল্পিত লক্ষে পৌঁছান যায় তার সঠিক পথটি চিনিয়েছে আমাকে। তবে কেন নির্বোধের মত সবকিছু দু’হাতে সরিয়ে দিয়ে আমাকে চলে যেতে হবে আমার এ শহর ছেড়ে। এটা কি উন্মাষিকতা নাকি চরম উদাসীনতা? চলে এলাম হৃদয়পুর গ্রামে, আমার হৃদয়ের গ্রাম। যেখানে বুকভরে নিঃশ্বাস নেয়া যায়, বিশুদ্ধ নিঃশ্বাস। প্রাণভরে ভালোবেসে বিশুদ্ধ ভালোবাসা পাওয়া যায়। সবুজে সবুজে ঘেরা আমার হৃদয়পুর গ্রামখানি নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের এক অনবদ্য ঠিকানা। সব অ-সুখ সুখে পরিণত হয়, সব দুঃখ-বিষাদ আনন্দে বিলিন হয়ে যায় অবলিলায়। সবুজটা কেমন গাঢ় সবুজ, আকাশটা নীলের গভীরে। ‘পাখি চায় আকাশের নীল, কবিতা চায় ছন্দের মিল…’!
অবুঝের মতো সবুজের মাঝে হারিয়ে যেতে নেই মানা। এ মৃত্তিকা আমার, এ সবুজ বনভূমি আমার। নদীর জলে আকাশের নীল, পাহাড়ের চূড়ায় মেঘের কারুকাজ, সোনালী ধানের ক্ষেত, পাখিদের কল-কাকলি এ সব কিছুইতো আমাকে আমরণ বাঁচতে উদ্বুদ্ধ করে। স্বপ্ন দেখায় সুখ সাগরে গানের তরী ভাসাবার। আমি কেমন করে ফিরিয়ে নেব ভাল লাগার দুচোখকে, ঢেকে রাখবো কুসুমিত হৃদয়খানি আনন্দের এই ঝর্নাধারা থেকে? তাই চলে আসা হৃদয়পুর স্টেশনে। এখান থেকে ভালোবাসার ট্রেন চলে যায় গঞ্জে থেকে ঘাটে ভাল লাগার সওদা করে ফিরে মানুষের অন্তরে অন্তরে। আমার একমাত্র ঠিকানা এখন আমার হৃদয়পুর গ্রাম। আমার শিকড়ের সন্ধানে অস্তিত্বের বন্ধনে বেঁচে থাকতে চাই বাকিটা জীবন। জীবন তো একটাই শুধু ভাল লাগার বিষয়-আসয়গুলো ভিন্ন। এই ভিন্নতাই প্রতিটি মানুষকে ভিন্নভাবে ভালোভাসতে উদ্ভুদ্ধ করে, প্রেরণা যোগায়। তাই মানুষ বিভিন্ন, তার পছন্দ অপছন্দ আলাদা, জীবন বোধও ভিন্ন। তার ব্যক্তিত্ব, ব্যক্তি সত্ত্বা ভিন্ন আংগিকে গড়ে উঠে ভিন্ন আবহে। কেহ হয়ে উঠে শহর কেন্দ্রিক মনভাবাপন্ন, কেহ হয় গ্রামমুখী। গ্রামের মাঝেই তার অস্তিত্ব খুঁজে পায়। শেকড়ের টানে ছুটে যায় সবুজের ভিড়ে, রচনা করে তোলে আপন ভুবন – আমি তাহাদেরই দলে।
বিদ্যুৎ সরকার : লেখক ও আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা