বিদ্যুৎ সরকার : আমার কোন স্বপ্ন নেই। স্বপ্ন নিয়ে আমার কোন ভাবনাও নেই। তাই স্বপ্নের টানাপোড়েনে আমাকে পড়তে হয়নি কোন কালেও। স্বপ্নটা আসলে কি? আমি ভীষণভাবে কনফিউজড। স্বপ্ন কি চাওয়া ও পাওয়ার ফলাফল, স্বপ্ন কি প্রাপ্তির চাইতেও বেশি কিছু। স্বপ্ন কি অধরা এমন কিছু যা অপ্রত্যাশিতভাবে পাওয়ার ভাবনায় বিভোর থাকে সর্বক্ষণ। স্বপ্ন কি ভাবনার অধিক কিছু যা মনকে অতি উৎসাহী করে তোলে এর পিছু হাঁটতে অনন্তের পথ যাত্রী হয়ে। তাই, আমার কোন স্বপ্ন নেই। স্বপ্নবাজ মানুষের সাথে আমার পার্থক্যটা পাহাড় প্রমাণ। আদর্শগতভাবে এ দুয়ের মধ্যে মিলের চাইতে গড়মিলের আধিক্যই প্রকট। দুই বিপ্রতীপ অবস্থানে আসিন। আমার কিছু ইচ্ছা আছে যা পূরণে আমি সচেষ্ট থাকি প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি দিন। সাধ ও সাধ্যের মধ্যে আমার ইচ্ছে পূরণ সীমাবদ্ধ থাকে কিংবা রাখি খুব সচেতনভাবেই। আমার শৈশব কেটেছে গ্রামে। মূলত আমি গ্রামেরই সন্তান। যেখানে সবুজ বলতে বুঝে নিতাম গাছ – গাছালির সমারহ। নীল বলতে আকাশের নীল সামিয়ানা, লাল বলতে অস্তগামী সূর্যের লালিমা – এভাবেই সবকিছু আমরা খুঁজে নিতাম প্রকৃতির অফুরান ভান্ডার থেকে। ধান শালিকের কিচির মিচির শব্দ ছিল আমাদের প্রত্যুষের ‘ওয়েক আপ কল।’ ‘ভোর হলো, দোর খোল খুকু মনি উঠরে…. ’ ছড়ায় ছড়ায় শুরু হোয়ে যেতো লেখা – পড়ার শুভ মহরত। পান্তা ভাতের শান্ত উপহার সকাল প্লাস অপরাহ্নের উদর পূরন সাঁজের বেলা অব্দি কাটিয়ে দিতাম। বলা ভাল, দিতে হতো। পায়ে হেঁটে তিন কিলোমিটার পথ পারি দিয়ে আমাদের স্কুলে পৌঁছা। স্কুল শেষ আবার তিন কিলোমিটার পথ! তখন সূয্যিমামা পশ্চিম গগন রক্তিম করে বেলা শেষের প্রহর গুনতো। ছুটির দিনগুলোতে আমাদের মস্ত উঠোন রূপান্তরিত হতো ছোট্ট অলিম্পিয়াডে। কানামাছি, গোল্লা ছুট, দাড়িয়াবান্দা, বাতাবি লেবুর ফুটবল, লাটিম, মারবেল – কি না খেলা হতো ওখানটায়। উৎফুল্ল আর উচ্ছ্বাসে ভরিয়ে দিত ছুটির দিনগুলো। পরীক্ষা শেষে গ্রীষ্মের লম্বা ছুটিতে গ্রামগুলো নানান ফল-ফুলের সুঘ্রানে ভরে উঠতো। মিষ্টি মধুর গন্ধে ম ম করতো চারিদিক। শৈশবে ইচ্ছে হতো বৃত্তির টাকা থেকে কিছু বাঁচিয়ে কয়েকটি ফলের চারা কেনার। এক সময় কিনেও ফেললাম। সেগুলো পরবর্তীতে ফলবতী হলো আপন বৈভবে। ফলবতী গাছগুলোর মতোন বাড়ির আশেপাশের অব্যবহৃত জায়গাগুলো ভরে উঠলো নানান সব্জি ফলনে।
স্কুলের পাট চুকিয়ে কলেজে ভর্তী হওয়ার বিষয়টি চলে এলো। একটু ভাবনায় পরতে হোয়েছিল সবারি। কলেজে ভর্তি হতে হলে আমাকে জেলা শহরে যেতে হবে। শুধু তাই নয় আমার আহার-বাসস্থানের ব্যাপারটিও এর সাথে জড়িত। নিম্ন মধ্যবিত্তের সংসারে কিছুটা চিন্তার কারন হয়ে দাঁড়ালো। আমি ঠিক করে ফেললাম কোন বাড়ির গৃহ শিক্ষকের দায়িত্বটা আমাকে নিতে হবে। তাতে করে থাকা-খাওয়ার বিষয়টির সমাধান হয়ে যাবে। আর বাচ্চাদের পড়ানোর ব্যাপারটি আমি বরাবরই ভীষনভাবে এনজয় করে থাকি। এক সময় কলেজে ভর্তি হয়ে গেলাম সাথে গৃহ শিক্ষক হিসেবে সে বাড়ির দু’টো শিশুকে সন্ধ্যেতে পড়ানোর দায়িত্বটিও সুন্দরভাবে পালন করে যচ্ছিলাম। এসএসসি’তে ভাল রেজাল্ট করার সুবাদে কলেজ ভর্তি, টিউশন ফি মউকুফতো হলোই উপরন্তু স্কলারশিপের বেচে যাওয়া টাকাগুলো জমাতে শুরু করলাম আমার ছোট ছোট ইচ্ছে পূরণের অংগীকার নিয়ে। ইচ্ছে আছে বেশ কিছু টাকা জমলেই পুকুরটায় মাছ ছাড়বো, কয়েকটি হাঁসও পালবো সাথে। তখন নিস্তরংগ পুকুরের জল তরঙ্গায়িত হবে, দোলা লাগবে মনে। এবার শীতে পূঁই, সিম আর লাউয়ের যে চারা লাগিয়েছিলাম সেগুলো থেকে ফুল আসতে শুরু করেছে। বিশেষ করে বিভিন্ন রঙের সিম ফুলগুলো যেন ছোটো ছোটো রঙিন প্রজাপতি উড়িবার প্রত্যাশায় অপেক্ষায়মান। শীত এলে গ্রামের পরিবেশ অনেকটাই পালটিয়ে যায়। চারিদিকে যেন মাইল মাইল বিছানো সবুজ চাদর। সব্জি আর সব্জি। পিঠা-পুলির পার্বন, বাড়ি বাড়ি পিঠা খাওয়ার ধুম। সবার মনে জাগে প্রাণের সঞ্চার। আনন্দঘন হোয়ে উঠে প্রতিটি ঘর, প্রতিটি বাড়ি। লেখা-পড়া শেষে আমি যখন উপার্জনক্ষম হবো তখন গ্রামের প্রতিটি শিশুর লেখা-পড়ার জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবো। গ্রামের প্রতিটি শিশু শিক্ষিত হলে শিক্ষার আলোয় আলোকিত হবে প্রতিটি ঘর, উজ্জ্বল হবে সমগ্র গ্রাম, আলো ঝলমল। আমার এ ইচ্ছে পূরণে আমি অবিচল, দৃঢ়, প্রত্যয়ী। এ মৃত্তিকা আমার, এ সবুজ বনভূমি আমার, এ চঞ্চল নদী আমার, আকাশ ছোঁয়া পাহাড়ের উপত্যকা আমার, তোমার, সবার – একটি লাল-সবুজ পতাকা, একটি শক্তিমান জাতি, একটি মুক্তিযুদ্ধ – এ-সব কিছুইতো আমাদের গৌরবের। যেন ফুলের সৌরভ হয়ে ছড়িয়ে আছে চারিদিক, চারিধার।
বিদ্যুৎ সরকার : লেখক ও আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা