মনিস রফিক : চলচ্চিত্রের যাত্রাপথ ইতোমধ্যে ১২৫-এ পা দিয়েছে। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নবীন আর শক্তিশালী এই শিল্পমাধ্যমকে ‘অষ্টম আশ্চর্য’ বলা হয়। আমাদের জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আশা-নিরাশা আর ভালোবাসার কথা যেভাবে এই শিল্পমাধ্যমে উঠে আসে, তা অন্য শিল্প মাধ্যমে সম্ভব হয় না। মূলত পূর্বের ছয়টি শিল্পের মিথস্ক্রিয়া আর প্রতিফলনে ঋদ্ধ চলচ্চিত্র নামের এই ‘সপ্তম শিল্পকলা’। শুরু থেকে বর্তমানের চলচ্চিত্রের যাত্রাপথটা কেমন ছিল, আর কোন কোন অনুসন্ধিৎসু ক্ষণজন্মা স্বপ্ন দেখা মানুষের স্বপ্নের ফসল এই চলচ্চিত্র, সে সব বৃত্তান্ত উঠে আসবে চলচ্চিত্রকর্মী মনিস রফিক এর লেখায়। চলচ্চিত্র যাত্রাপথের এই বাঁকগুলো ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে ‘বাংলা কাগজ’ এ।

তেইশ.
ঋত্বিক ঘটকের জন্ম ঢাকায় হলেও বাবার চাকুরীসূত্রে ঘুরতে হয়েছে বাংলার বিভিন্ন জেলায়। ফলে স্কুল পরিবর্তনও করতে হয়েছে তাঁকে বারে বারে। তাঁর জীবনের প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যালয় হচ্ছে ময়মনসিংহ মিশন স্কুল, তারপর কলকাতার বালিগঞ্জ স্কুলে ভর্তি হন তৃতীয় শ্রেণীতে। পরে ঋত্বিকের পরিবার স্থায়ীভাবে রাজশাহীতে বসবাস করলে ঋত্বিক ঘটক ভর্তি হন রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে। কিছুদিন পর তাঁকে আবার কলকাতায় পাঠানো হয় বড় ভাই মণীশ ঘটকের কাছে এবং ভর্তি করিয়ে দেয়া হয় পদ্মপুকুর ইনস্টিটিউশন স্কুলে। অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় তাঁকে কানপুর টেকনিক্যাল স্কুলে পাঠানো হয়। উদ্দেশ্য ছিল, সে ভবিষ্যতে ইঞ্জিনিয়ার হবে। কিন্তু কানপুর ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকায় এসে খুব কাছ থেকে শ্রমিকদের দুঃখ-কষ্ট দেখার ফলে তাঁর বিদ্রোহী মন সেই বয়সেই তাঁকে শ্রমিকদের ওভারটাইম আদায়ের সংগ্রামে পথে নামায়। তখন পড়াশুনার চেয়ে তাঁর কর্মকাণ্ডে ভীড় জমাতে শুরু করে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের ন্যায্য দাবি আদায়। তাঁর পড়াশুনার ভবিষ্যত চিন্তায় তাঁকে আবার রাজশাহীতে ফিরিয়ে আনা হয় এবং ভর্তি করিয়ে দেয়া হয় কলেজিয়েট স্কুলে। কানপুরে দরিদ্র ও অসহায় মানুষদের কাছ থেকে দেখার ফলে তিনি কলেজিয়েট স্কুলের মত অপেক্ষাকৃত ধনী মানুষের ছেলেদের স্কুলে পড়তে চাইলেন না। ফলে মা ইন্দুবালা দেবীর বিশেষ অনুরোধে তাঁকে বাড়ির একেবারে কাছের রাজশাহী ভোলানাথ বিবেশ্বর (বি বি) স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়া হয়। তবে ম্যাট্রিক পরীক্ষার সময় তাঁর পরিবার থেকে এক রকম জোর করেই তাঁকে আবার রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়া হয়। জীবনে এই স্কুলে ঋত্বিক ঘটক তিন বার ভর্তি হন। ম্যাট্রিক পাশ করে ঋত্বিক ভর্তি হন রাজশাহী কলেজে। ১৯৪৬ সালে সেই কলেজ থেকে আইএ পাশ করে তিনি ভর্তি হন বহরমপুর কৃষ্ণনগর কলেজে। সেই সময় কর্মসূত্রে ঋত্বিক ঘটকের বড় ভাই মণীশ ঘটক বসবাস করতেন বহরমপুরে। কৃষ্ণনগর কলেজ থেকে ঋত্বিক ঘটক ইংরেজিতে প্রথম শ্রেণীতে স্নাতক হয়ে ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এ শ্রেণীতে, ইংিেরজ সাহিত্যে। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টিতে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে যাবার ফলে আর পার্টির দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এমএ পরীক্ষার চার মাস পূর্বে তিনি পড়াশুনায় ইতি টানেন।

যৌবনে চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋত্বিক ঘটক

১৯৪৮ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত ভারতীয় গণনাট্য সংঘের একজন একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে নাট্য আন্দোলনে ঋত্বিক ঘটক নিজেকে জড়িয়ে নেন। সেই সময় ঋত্বিক ঘটকের সহযোদ্ধাদের মধ্য অন্যতম ছিলেন শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত, অমর গাঙ্গুলী, বিজন ভট্টাচার্য, মৃণাল সেন, কালী ব্যানার্জী, সলিল চৌধুরী, কলিম শরাফী, বংশী চন্দ্রগুপ্ত, নৃপেন গঙ্গোপাধ্যায়, তাপস সেন, হৃষিকেশ মুখার্জী প্রমুখ। পঞ্চাশ দশকের একেবারে শুরুতেই ঋত্বিক ঘটক তখনো ছবি বানানোয় হাত দেননি। তখন সকাল হলেই ঘর থেকে বের হয়ে চলে যেতেন কোলকাতার হাজরা রোডের ছোট্ট এক চায়ের দোকানে। আট বাই বার ফিটের ন্যাড়া টেবিল আর ভাঙা চেয়ারে বসা দোকানদার নাম ছিল প্যারাডাইস ক্যাফে। দলের মধ্যে সবচেয়ে রোগাটে লম্বাটে আর ডাকসাইটের শরিক ছিলেন ঋত্বিক। তাঁদের সেই আলোচনায় ওঠে আসতো মূলত সিনেমা আর সশস্ত্র বিপ্লব। সিনেমাকে বিপ্লবের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে তারা চলতে শিখেছিল সেদিন থেকেই। ভারতীয় কমিউনিষ্ট পার্টির প্রতি অচঞ্চল বিশ্বাস রেখে সেদিন থেকেই তারা অন্ত:সারশূণ্য দেশজ সিনেমাকে তীব্রভাবে ঘৃণা করতে শিখেছিলেন, নতুন একটা ফ্রন্ট গড়ার জন্য মুখিয়ে উঠেছিলেন প্যারাডাইস ক্যাফে’র ভাঙা চেয়ার-টেবিল ঠাসা ওই ছোট্ট ঘরে, যে ফ্রন্টে বিপ্লব আর সিনেমা হাত ধরাধরি করে চলবে আর সিনেমা বলবে নিঃস্ব-নিরন্ন মানুষের কথা। সেই প্রাণচঞ্চল আসরগুলোয় যার গলা সবচেয়ে উঁচু পর্দায় বাঁধা ছিল তিনি হলেন বাংলা চলচ্চিত্রে নিরন্ন-নিঃস্ব-শিকড়চ্যুত মানুষের কন্ঠস্বর ঋত্বিক ঘটক।

১৯৫৩ সালে গণনাট্য সংঘের সর্বভারতীয় বোম্বে সম্মেলনে ঋত্বিক ঘটকের লেখা ‘দলিল’ নাটকটি প্রথম পুরস্কার পায়। ‘দলিল’ নাটকটি তাঁর ভাবনার যে জায়গাটা প্রবলভাবে স্পর্শ করেছিল সেটা হচ্ছে তাঁর ফেলে আসা রাজশাহীর স্মৃতি। রাজশাহীর পদ্মার পাড়েই মূলত ছিল তাঁর হৃদয়ের এক বিশাল রাজ্য। দেশ বিভাগের ফলে তাঁর সেই রাজ্যকে ছেড়ে আসতে হয়। ফলে ‘দলিল’ নাটকের মধ্য দিয়েই তিনি সবাইকে জানিয়ে দেন, ‘বাংলারে কাটিবারে পারিছ, কিন্তু দিলটারে কাটিবারে পার নাই।’ বাংলা ভাগকে তিনি কখনোই মানতে পারেননি। তিনি কখনোই মানতে পারেননি শুধু ধর্মীয় পরিচয়ে মানুষকে বাধ্য করা হবে নিজের পুর্ব পুরুষের ভিটে মাটি ছেড়ে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাতে। ঋত্বিক ঘটক নিজেও এই ভারত বিভাগ আর বাংলা ভাগের বিভিষিকাময় আগুনে পুড়েছিলেন। দেশ ভাগের পর তিনি কলকাতায় দেখেছিলেন সারি সারি উদ্বাস্তু মানুষের ভীড়। এই সব সাধারণ মাটির মানুষরা কখনোই নিজের আপন মাটির মায়া কখনোই ভুলতে পারেননি। এ মানুষগুলোর অনেকেই শেষ পর্যন্ত হয়ে গিয়েছিলেন নিঃস্ব, দরিদ্র, পাগল, ভিক্ষুক আর বেশ্যা।

সেই জন্যই চলচ্চিত্র নির্মাণ চিন্তা যখন ঋত্বিক ঘটকের মাথায় ভীড় জমিয়েছিল, তখন স্বভাবই একজন নিষ্ঠাবান মানবতা প্রেমিক হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছিলেন এমন সব কাহিনী যার মধ্যে লুকিয়ে আছে গৃহহীন মানুয়ের বেদনা-কান্না আর দীর্ঘশ্বাস। ১৯৫২ সালে নিজের সাতাশ বছর বয়সে তিনি প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণে হাত দিলেন, বানালেন ‘নাগরিক’ ছবিটি। ‘নাগরিক’ ছবির নায়ক রামু কোলকাতার অগণিত নাগরিকের মধ্যে একজন। কিন্তু অফিসপাড়ার অরণ্যের মধ্যে সে একজন বিশেষ নাগরিক। ছবির শুরুতে তার বৈশিষ্ট্য কিন্তু আর দশজন মধ্যবিত্ত যুবকের মত ভালো করে বাঁচার আকাঙ্খা। বাবার অবসরের পর অর্থের অভাবে তারা শ্যামপুকুরের বড় বাড়ি ছেড়ে কোলকাতার ঘিঞ্জি এলাকায় বাসা ভাড়া করে। নতুন ভাড়া বাড়িতে মায়ের মত রামুও হাঁপিয়ে ওঠে। সে স্বপ্ন দেখে খোলা পরিবেশে সুস্থ করে বাঁচবার। কিন্তু ব্যর্থ হয় বারে বারে। যে চাকুরীর জন্য সে হন্য হয়ে ছুটতে থাকে, তার সন্ধানে বার বার হোচট খেতে থাকে। সে চাকুরী পায় না। বরং বর্তমানের ঘিঞ্জি আবাসস্থল ছেড়ে কম ভাড়ার আরো ঘিঞ্জি কোন পরিবেশের দিকে রামু, তার মা-বাবা ও বোন যাত্রা শুরু করে।

১৯৫২ সালে নির্মিত ঋত্বিক ঘটকের প্রথম চলচ্চিত্র ‘নাগরিক’ এর পোস্টার

‘নাগরিক’ ছবিতে রামুকে তার একক জীবনের স্বপ্নকে অতিক্রম করে আস্তে আস্তে ক্ষয়ে যাওয়া মধ্যবিত্ত সমাজের বৃহত্তর সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। কোনো অতি নাটকীয় মুহূর্ত ব্যবহার না করে একেবারে অল্প কয়েকটি চরিত্রের মাধ্যমে এ কাহিনি গড়ে উঠেছে। রামুর জীবন প্রধানত দুটি ভাবের চাপে দোদুল্যমান। একদিকে বাবা-মা ও অবিবাহিত বোন। অন্যদিকে প্রেমিকা উমা, তার ছোট বোন শেফালি ও নেপথ্যে তাদের বিধবা মা। এ ছাড়া তাদের পেয়িং গেস্ট সাগর সেন, উদরসর্বস্ব যতীনবাবু এবং রামুর বন্ধু সুশান্ত যে বামপন্থী রাজনৈতিক আন্দোলন করবার ফাঁকে ফাঁকে রামুকে বাঁচার সংগ্রামে শামিল হতে আহ্বান জানাত। ‘নাগরিক’ চলচ্চিত্রে একটি চরিত্রকে নক্শার মতো করে সাজিয়ে রামুর বাঁচার লড়াইকে তার সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

ঋত্বিক ঘটক যখন ‘নাগরিক’ বানালেন, তখন তিনি সবে মাত্র সাতাশ বছরের এক যুবক। কিন্তু কী অদ্ভুত মুন্সীয়ানা দেখালেন তিনি কাহিনি ও চরিত্র নির্মাণে। শেষমেষ রামু’র চাকুরী হয় না, কিন্তু রামু হতাশায় ডুবে যায় না বরং আরো বেশি সাহসী ও প্রত্যয়ী হয়ে ওঠে নতুন দিনগুলোয় মাথা উঁচু করে এগিয়ে যাবেন বলে।

১৯০৯ সালে ঢাকায় জন্ম নেয়া ভারতীয় চলচ্চিত্র ইতিহাসের প্রখ্যাত পরিচালক বিমল রায়ের সম্মানে ভারতীয় ডাকটিকিট

রামুর জীবনের রোমান্টিকতাকে দুভাবে দেখানো সম্ভব ছিল। রামুকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিজের মত দাঁড় করানোর চেষ্টা করা অথবা নিজের সুখ স্বপ্নকে কম প্রাধান্য দিয়ে সমাজের বৃহত্তর অংশে সম্মুখীন করা। ঋত্বিক দ্বিতীয় পথেই রামুকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। রোমান্টিকতাকে তিনি প্রথম থেকেই ব্যবহার করেছেন বৃহত্তর সমাজ চেতনার হাতিয়ার হিসেবে। এ জন্যই বোধ হয়, বাস্তবের মধ্যে তিনি এক বিশেষ গতি এবং প্রাণের সঞ্চার করে আধুনিক বাংলা চলচ্চিত্রে বাস্তববাদকে নতুন পর্যায়ে উন্নীত করেন। হয়তো, ঋত্বিকের এই চিন্তাধারাকে সম্মান জানাতে গিয়েই সত্যজিৎ রায় নিজেই বলেছিলেন, ‘ঠিক সময়ে ‘নাগরিক’ মুক্তি পেলে ঋত্বিক ঘটকই হতেন পথিকৃৎ’। কিন্তু বাংলা চলচ্চিত্রের দুর্ভাগ্য ‘নাগরিক’ ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল এর তৈরির পঁচিশ বছর পর, ১৯৭৭ এর ৩০ সেপ্টেম্বর। ততদিনে ছবির নির্মাতা অনেক দুঃখ-কষ্ট আর অভিমানে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন অনন্তপাড়ে।

১৯৫২ সালে নিজের প্রথম চলচ্চিত্র ‘নাগরিক’ নির্মাণে হাত দেবার পূর্বে তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণে হাতে খড়ি নেন বিখ্যাত বাংলা ও হিন্দী চলচ্চিত্র পরিচালক বিমল রায় ও বাংলা চলচ্চিত্র পরিচালক নির্মল দে’র কাছে। তিনি সহকারী পরিচালক ও স্টোরী রাইটার হিসেবে কাজ করেন ‘তথাপি’ (১৯৫০) ও ‘বেদেনী’ (১৯৫১) চলচ্চিত্রে।

১৯০৯ সালে ঢাকার সুয়াপুর জমিদার পরিবারে জন্ম নেয়া বিমল রায় তখন কলকাতা এবং বোম্বের চলচ্চিত্র জগতে একজন স্বনামধন্য পরিচালক হিসেবে নাম করেছেন। তাঁর হিন্দী চলচ্চিত্র ‘মা’ (১৯৫২), ‘পরিণীতা’ (১৯৫৩), ‘দো বিঘা জমিন’ (১৯৫৩), ‘বিরাজ বৌ’ (১৯৫৪), ‘নকরী’ (১৯৫৪) এবং ‘দেবদাস’ (১৯৫৫) ইতোমধ্যে তাঁকে সর্বভারতীয় খ্যাতিমান চলচ্চিত্র নির্মাতার খ্যাতি এনে দিয়েছে। একে একে তিনি হাতের মধ্যে নিয়ে নিচ্ছেন ভারতের চলচ্চিত্রের সব উজ্জ্বল পুরস্কার। বাংলা ভাষার অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘দেবদাস’ নিয়ে ১৯৫৫ সালে নির্মিত তাঁর চলচ্চিত্রে তিনি দেবদাসের ভূমিকায় নেন সেই সময়ের জনপ্রিয় অভিনেতা দিলীপ কুমারকে আর চন্দ্রমুখী চরিত্রের জন্য বৈজন্তীমালাকে এবং পার্বতীর ভূমিকায় নেন কলকাতা থেকে সুচিত্রা সেনকে। চলচ্চিত্রটি চারটি শাখায় ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেলেও ব্যবসায়িকভাবে একেবারেই অসফল হয়। ফলে বিমল রায় তাঁর পরের চলচ্চিত্রটি ব্যবসায়িকভাবে সফল করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেন। ‘দেবদাস’ নির্মাণের পূর্বে প্রতি বছর যে বিমল রায় দুটি-তিনটি বা চারটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, তিনি এবার একটু দম নিলেন। তিনি একটি ভালো চলচ্চিত্র বানাতে চাইলেন, যেটা একই সাথে শৈল্পিক হবে ও ব্যবসায়িকভাবে সফল হবে।

এমন চিন্তা থেকেই বিমল রায় প্রথম কাজ শুরু করলেন একটি সুন্দর ও আকর্ষণীয় গল্প নির্বাচন করতে। তাঁর এই দীর্ঘ প্রচেষ্টায় তিনি সেই গল্পটি পেলেন একত্রিশ বছরের যুবক ঋত্বিক ঘটকের কাছে, যাকে তিনি চলচ্চিত্র জ্ঞানে হাতে কলমে শিক্ষা দিয়েছেন আর যে ঋত্বিক হচ্ছে বিমল রায়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু প্রখ্যাত সিনেমাটোগ্রাফার সতীশ ঘটকের ছোট ভাই। ঋত্বিকের ‘মধুমতী’ গল্পটি এক কথায় বিমল রায় লুফে নিলেন এবং সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন বিশাল বাজেটের ছবিটি তিনি বানাবেন। সেই সাথে তিনি ঋত্বিককে আমন্ত্রণ জানালেন বোম্বেতে গিয়ে এই চলচ্চিত্রে কাজ করার জন্য। ঋত্বিক সেই পঞ্চাশ সালে তাঁর বিমল দা’র কাছে চলচ্চিত্রে হাতে খড়ি পেয়েছেন, ফলে তিনি বিমল রায়ের আমন্ত্রণ ফেরাতে পারলেন না। তাছাড়া, তাঁর নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘নাগরিক’ মুক্তি না পাওয়ায় তিনি মানসিকভাবে কিছুটা হতাশায় সময় কাটাচ্ছিলেন। এই সবের পরও বিমল রায়ের ডাকে সাড়া দেবার আরেকটি বিশেষ কারণ ছিল, সেটা হচ্ছে, তাঁর বিমল দা’র কাছে ইতোমধ্যে সলীল চৌধুরী সঙ্গীত পরিচালক আর ঋষিকেশ মুখার্জী চলচ্চিত্র সম্পাদক হিসেবে ভালোভাবেই কাজ করছে আর বোম্বে চলচ্চিত্রে বেশ নামডাকও করে ফেলেছে।

বিমল রায়ের ‘মধুমতী’ নির্মাণের জন্য সেই কলকাতার হাজরা রোডের আট বাই বার ফিটের ন্যাড়া টেবিল আর ভাঙা চেয়ারের ‘প্যারাডাইস ক্যাফে’র তিনবন্ধু সলিল, ঋষিকেশ আর ঋত্বিক আবার এক হলো, সেই সাথে চলতে থাকলো তাঁদের সেই আড্ডা আর শৈল্পিক চলচ্চিত্র নির্মাণের, যে সব চলচ্চিত্রে উঠে আসবে সাধারণ নিরন্ন মানুষের কথা।

ঋত্বিক ঘটকের চিত্রনাট্যে এক রকম মহাযজ্ঞে শুরু হয়ে যায় ‘মধুমতী’ চলচ্চিত্রের নির্মাণ কাজ। প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন সেই সময়ের হিন্দী চলচ্চিত্রের দুই অতি জনপ্রিয় তারকা, দিলীপ কুমার আর বৈজন্তী মালা। ‘দেবদাস’ মুক্তি পাওয়ার তিন বছর পর ১৯৫৮ সালে ‘মধুমতী’ মুক্তি পায়। সেই সময়ে ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় আট মিলিয়ন খরচে চলচ্চিত্রটি আয় করে প্রায় চল্লিশ মিলিয়ন রূপী। সহজ কথায় ভারতীয় দর্শক মুগ্ধ হয়ে চলচ্চিত্রটি উপভোগ করে এবং সেই সাথে ‘মধুমতী’ জিতে নেয় এগারটি ফিল্ম ফেয়ার এওয়ার্ড। এমন কাহিনীর একটি ব্যবসা সফল চলচ্চিত্রের জন্য বিমল রায় অশেষ ভালোবাসা জানায় তাঁর অনুজপ্রতীম ঋত্বিক ঘটকের প্রতি।

১৯৫৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ঋত্বিক ঘটকের চিত্রনাট্যে বিমল রায় পরিচালিত জনপ্রিয় হিন্দী চলচ্চিত্র ‘মধুমতী’র পোস্টার

কিন্তু ‘মধুমতী’ মুক্তি পাওয়ার অনেক আগেই ঋত্বিক ঘটক বিমল রায় আর বোম্বেকে ছেড়ে রওনা হয়ে গেছেন কলকাতায় নিজের মত করে বাংলায় নিজের ভাবনার চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে। ঋত্বিক ঘটকের বোম্বে আর বিমল রায়কে ছেড়ে আসার পেছনে একটি নাটকীয় কারণ ঘটেছিল। ‘মধুমতী’র শ্যুটিং চলাকালীন একদিন বিমল রায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেদিন ছিল একটি গানের দৃশ্য যেটাতে অভিনয় করবেন দিলীপ কুমার আর বৈজন্তী মালা। বিমল রায় যেহেতু শ্যুটিং স্পটে যেতে পারছেন না সে কারণে তিনি সেই গানের দৃশ্যটি শ্যুটিং করার দায়িত্ব দিলেন ঋত্বিক ঘটকের উপর। তিনি ঋত্বিককে বুঝিয়ে দিলেন শট ডিভেশন ধরে ধরে শ্যুটিং করার জন্য। কিন্তু ঋত্বিক শ্যুটিং করেছিলেন নিজের মত করে, যেখানে শুধু গানের দৃশ্যের সেই নায়ক-নায়িকার আবেদনময় দেহ প্রকাশের চেয়ে আশে পাশের বিষয়বস্তু প্রাধান্য পেয়েছিল, যা আমরা সচারচর ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্রে দেখতে পায়। শ্যুটিং এর পর বিমল রায় যখন রাশ প্রিন্ট দেখেছিলেন তখন ভয়ানক ক্ষেপে গিয়েছিলেন ঋত্বিকের ওপর। তিনি কিছুটা চেঁচিয়ে বলেছিলেন, হারামজাদা, তুই জানিস এই দিলীপ কুমার আর বৈজন্তী মালার শিডিউল পেতে এখন এক বছর সময় লাগে! আর দর্শকরা হল এ কি তোর এই শৈল্পিক দৃশ্য দেখার জন্য আসবে? তারা আসবে নায়িকাকে দেখতে।

ঋত্বিক ঘটক তাঁর চলচ্চিত্রে নায়িকাকে ওভাবে দেখিয়ে কখনো দর্শকদের বিনোদন দেবার কথা ভাবতেন না। সেটা কখনো তাঁর চলচ্চিত্র নির্মাণ-স্বপ্নে ছিলো না। সেই সাথে ওমন ধরনের চলচ্চিত্র নির্মাণের সাথেও তিনি কখনো থাকতে চাননি। সেই কারণে সেই দিনই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন তাঁর স্থান তাঁর বাংলার কলকাতায়, যেখানে তিনি আর তাঁর বন্ধুরা এক সময় সেই হাজরা রোডের প্যারাডাইস ক্যাফে’তে বসে স্বপ্ন দেখতেন বিপ্লব আর সিনেমা হাত ধরাধরি করে চলবে আর সিনেমা বলবে নিঃস্ব-নিরন্ন মানুষের কথা। কলকাতায় ফিরে গিয়ে তাঁদের চলচ্চিত্র তৈরী করার জন্য ঋত্বিক তাঁর প্রিয় দুই বন্ধু ঋষিকেশ মুখার্জী আর সলিল চৌধুরীকে আহ্বান জানালে তাঁরা শুধু তাঁকে বলেছিল, তাঁরা তাঁদের বিমল দা’র কাছ থেকে কাজ করার যে সুযোগটা পাচ্ছে, সেটা কলকাতায় গেলে তাঁরা আর পাবে না।
ফলে দুই প্রাণপ্রিয় স্বপ্ন-দেখা বন্ধুকে ছেড়ে ঋত্বিক ঘটক বোম্বে ছেড়ে রওনা দিলেন কলকাতার পথে, নিজের মত করে নিজের স্বপ্নের চলচ্চিত্র বানানোর প্রত্যাশায়। (চলবে)