সাজ্জাদ আলী : ইস্তাম্বুলে ট্রানজিট টাইম মাত্র ১ ঘন্টা ২০ মিনিট। খুব তাড়াহুড়োর মধ্য দিয়ে উড়োজাহাজ বদল করতে হলো। এবার চড়লাম দানবাকৃতির একখানা বিমানে। জাহাজের ভেতরটা একেবারে ঝকঝকে তকতকে। মনে হয় যেন এয়ারক্রাফটখানা ফ্যাক্টরি থেকে আজই ডেলিভারি হয়েছে। নতুনের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। অনেকটা নতুন গাড়ির গন্ধের মতো। জিরো মাইলেজের গাড়ি কিনলে মাসখানেক গন্ধটা নাকে আসে। নতুন বউয়ের গায়েও গন্ধ থাকে। যতদূর মনে পড়ে সপ্তাহ দুয়েক সে গন্ধে মাতোয়ারা ছিলাম।
বিমানের অর্ধেক আসনই খালি। নর্থ আমেরিকার বিভিন্ন শহর থেকে ঢাকাগামী যাত্রীরা তুরস্কের ইস্তাম্বুলে এসে জড় হয়েছে। সেই সব যাত্রীরাই এই ফ্লাইটে চেপেছে। আমার মতোই কেউ এসেছে কানাডার টরন্টো থেকে বা মন্ট্রিয়ল। অন্যেরা নিউইয়র্ক, বোস্টন, ওয়াসিংটন ডিসি, শিকাগো ইত্যাদি শহরগুলো থেকে। আমার আসনের সাথে লাগোয়া বাকি দুটো আসনই খালি। আধশোয়া স্টাইলে সিটের উপরে পা তুলে আয়েশ করে বসলাম। তিনটি বালিশ পরপর পাতিয়ে তাকিয়ার মতো বানিয়েছি। আরাম একেবারে উপচে পড়ছে! উড়োজাহাজ ততক্ষণে উড়াল দিয়েছে। রূপবতী এয়ারহোস্টেজ ট্রলি ভরে চা-কফি-বিয়ার ইত্যাদি নিয়ে এলো। তাকে না করলাম, বললাম একবারে ডিনার করবো।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীত ভাবনা নিয়ে সংকলিত একখানা বই পড়া শুরু করলাম। হাতে হলুদ কালিওয়ালা হাইলাইটার কলম। কবির গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্যগুলো দাগ দিয়ে রাখছি। নিজ গানের শুদ্ধতা রক্ষায় কবির চিন্তাভাবনা একেবারে গোঁড়াপন্থি। মৌলবাদীও বলা যায়। তাঁর সাথে একমত হওয়া বড়ই দুস্কর। বইয়ের কনটেন্ট সরস না, কাঠখোট্টা। কোনো কোনো প্যারাগ্রাফ দুবার না পড়লে ঠিক বুঝে উঠি না। ১৫/২০ পাতা পড়ার পরে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছি।
কতক্ষণ অচেতন ছিলাম জানি না। এক সময় অনুভব হলো আমার চুলে কেউ যেন বিলি কাটছে। তার আঙ্গুলের ছোঁয়ায় আমার ঘুম ভেঙ্গেছে, কিন্তু চোখ মেলছি না। ওই ঘোরের মধ্যেই মনে হলো, তবে কি স্বপ্ন দেখছি? কে আমার মাথায় হাত বুলাবে? যদিও চোখ মেললেই সব পরিস্কার হয়। তবুও ঘুমের ভান করে পড়ে রইলাম। সুখের স্পর্শটুকু যতক্ষণ থাকে থাকুক না!
আমার ডাক নাম ধরে ডাকলো কেউ। নারী কন্ঠ। বলে, অ্যাই আর কত ঘুমাবি? ওঠ এবার। চেয়ে দেখি রমা, আমার সিটের উপরে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে। পলকহীন চেয়ে আছি আমি। ২৩ বছর পরে দেখলাম ওকে। বয়সের ছাপ পড়েছে মুখে। পরনে জিন্স আর গায়ে মেরুন রঙের হাতাকাটা টি-শার্ট। দেহের গড়নটি এখনও সেই এক লিটারের কোকের বোতলের মতোই আছে। বুক এবং পাছা ভরাট, কিন্তু পেট চিকন। চেহারায় একটা ব্যক্তিত্বের ছাপ ফুটেছে, যা আগে ছিলো না। বলল, হ্যারে ভ্যাবলাকান্ত, কী দেখতিছিস এমন কইরা? চিনছিস আমারে? পা সরা, বসতি দে। বলে নিজেই আমার পা ঠেলেঠুলে বসে পড়লো।
উঠে বসতে বসতে ঘোর কাটানোর চেষ্টা করছিলাম। এ কেমন কো-ইনসিডেন্স! রমা কোথা থেকে এলো? প্রায় দেড় দশক গড়িয়েছে ওকে একটা ফোনও করিনি, সেও না। কোথায় আছে, কেমন আছে, কিছুই তো জানি না। বললাম, বিলি কাটার অভ্যাসটা তোর আজও আছে দেখছি রমা! আঙ্গুলগুলোও সেই আগের মতোই তুলতুলে।
কেমন আছিস, ছোট্ট প্রশ্ন রমার।
বেশ আছি, তুই কেমন বল?
কবে ফিরবি টরন্টোতে, জানতে চাইলো রমা।
আমি যে টরন্টোতে থাকি তা তুই কেমনে জানিস? তোকে তো তা বলা হয়নি কখনও।
জানি জানি, তোর প্রডাক্সশনের সবগুলান টিভি শো আমি দেখি রে।
ক’দিন থাকবি বাংলাদেশে? তারপরে ফিরবি কোথায়, মানে এখন তুই কোথায় থাকিস, জানতে চাইলাম আমি।
৮/১০ দিন পরেই আবার বোষ্টনে ফিরতে হবে। আম্মা মারা যাওয়ার কারণে আমি ধানমন্ডিতে ৪টা ফ্লাট আর উত্তরায় একটা বাড়ির মালিক বনেছি। যত্ত সব উটকো ঝামেলা! ওগুলো একটু দেখভাল করেই ফিরে যাবো। অফিসে কাজের অনেক চাপ আছে। তা তুই একা ট্রাভেল করছিস যে? বউকে আনিস নি?
না রে দোস্ত, বউয়ের সাথে আমার প্যাকেজ ডিল না। একসাথে খাবো, একসাথে শোবো, একসাথে চলবো, তা না মোটেই। তেমনটা যদি হয় তো ভালই, না হলে তা নিয়ে আকুলিবিকুলি নেই। তিনি সব বিবেচনায় স্বয়ংসম্পূর্ণ একজন ইন্ডিবুজুয়াল। একা চলতে সক্ষম। তাঁর সার্কেলে তিনি চলেন, আমার সার্কেলে আমি। দরকার পড়লে পরস্পরকে সাহায্য করি, নইলে যার যার তার তার।
রমাকে নিয়ে তো মহাকাব্য লেখা যায়। মনের পর্দায় আলো জ্বলে উঠলো। নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে নিউইয়র্ক শহরে রমার সাথে আমার পরিচয়। আমরা একই ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে পড়তে যেতাম। ও ক্যামিক্যাল ইঞ্জিয়ারিং, আমি বিজনেস। ধনাঢ্য বাবার একমাত্র মেয়ে সে। অঢেল ডলার আসতো দেশ থেকে। হেন বদ নেশা নেই যা রমার ছিলো না। সিগারেট, মদ, গাঁজা, পুরুষ, হেরোইন সব। সারা ক্যাম্পাসে আমরা দুজনই মাত্র বাঙ্গালী স্টুডেন্ট তখন। চরিত্রগত মিল না থাকলেও শুধুমাত্র ভাষার মিলের কারণেই আমরা পরস্পরের কাছে এসেছিলাম। তা বেশ কাছেই। সে কথা বলতে আজ কৃপণ হবো কেন?
এক আশ্চর্য ব্যাপার ছিলো, সোম থেকে শুক্রবার রমা কখনও মাদক স্পর্শ করতো না। এমন কি সিগারেটও না। ওই শনি রবিবার এলেই তার যাচ্ছেতাই অবস্থা। প্রায়ই রমা অচেতন হয়ে ক্যাম্পাসের গাছতলায় বা ফুটপাথে পড়ে থাকতো। অনেকবারই সেখান থেকে ওকে পাঁজাকোলে তুলে ওর হোস্টেলের বিছানায় শুইয়ে দিয়ে এসেছি। তবে মদ গাঁজা যাই খাক, পড়াশুনায় তুখোড়। ডিপার্টমেন্টের একেবারে সেরা ছাত্র। ফাইনাল সেমিস্টারের রেজাল্ট হবার আগেই সানফ্রান্সিকোর একটা কম্পানি ওকে নব্বই হাজার ডলার বাৎসরিক বেতনের চাকুরি দিয়েছিলো।
রমা বসে আছে আমার পাশে। চুপচাপ, কথা বলছে না। হয়তো আমারি মতো স্মৃতি হাতড়াচ্ছে। ওর ডান হাতখানা আমার দুহাতে মুঠোবন্দি। বড়ই অদ্ভুত স্বভাব ছিলো রমার। মাঝেমধ্যেই দুর্দান্ত সব কান্ড ঘটাতো। এক রাতে রান্না করবো বলে মুরগীর মাংস জলে ভিজিয়েছি। চারকোণা করে পেপে কাটছি মাংসের তরকারীতে দেবো। এমন সময়ে কলিং বেল বেজে উঠলো। দরজা খুলে দেখি ঘাড়ে মস্ত ব্যাগ ঝুলিয়ে রমা দাঁড়িয়ে। বললাম, কি রে তুই? ভিতরে আয়। না বলে কয়ে হঠাৎ এলি যে? দুপুরেও তো কইলি না যে আসবি? সব ঠিকঠাক আছে তোর?
কিচ্ছু ঠিক নাই রে দোস্ত, বিরাট এক প্যাচ লাগাইয়া ফালাইছি। তোর বাসায় ৭ দিন থাকা লাগবি। বেড শেয়ার করতি চাবো না, আমি সোফার উপরে ঘুমাবো। আর তুই রান্নার ঝামেলায় যাইস না। এস্টোরিয়ার তাজমহল রেস্টুরেন্টে আমাগে দুজনের সারা সপ্তার খাবার অর্ডার কইরা দিছি।
আচ্ছা সে হবেক্ষণ। কিন্তু তুই নতুন কইরা আবার কি প্যাচ লাগালি সেইডা ক’ দেহি। আর বেড শেয়ার করবি না ক্যান রে বাদরী? তোর কি আবার সতীপনার বাতিক জাগলো নাকি রে, জানতে চাইলাম আমি।
দোস্ত নতুন প্যাচটা শুনলি তো তুই ক্ষেইপা যাবি। একটা এক্সপেরিমেন্ট করতি যাইয়া ধরা খাইছি।
আচ্ছা থাক তুই কইতে না চাইলে না কবি। যা বাথরুম থেইকা ফ্রেস হইয়া আয়। খিচুড়ি রাঁন্দা আছে, ঝটপট গোস্তটা রাইন্দা ফেলতেছি।
তরে কথাডা না কইলেও তো প্যাটের মইধ্যে গ্যাস জমবো। শোন দোস্তো, ওই যে ব্যটারা বেইশ্যা ভাড়া করে না! আমারও মন চাইলো। সেদিন ডাউন টাউন থেইকা একজন ব্যাটা বেইশ্যা ভাড়া কইরা আনছিলাম। সারা রাইত আমার হোস্টেলের রুমে তারে খাটাইছি। ব্যটা খাটতে পারে বটে!
তা এর মধ্যে প্যাচটা কি রমা? ব্যটা খাটতি পারে ভাল, তোরও তো সে কাজে নামডাক আছে। এর মধ্যে সমস্যাটা কী, জানতে চাইলাম আমি।
আর বলিস না যত্তসব ফালতু ল্যাঠা। ওই স্প্যানিসের বাচ্চারে দু’শ ডলার দেবার কথা ছিলো। সকালে হারামজাদাটা কয়, রাইতে ঘুমাতি দেও নাই, অনেক সার্ভিস নিছো, এখন ৫০০ ডলার দিবা। আচ্ছা ক’তো এইডা কথার খেলাপ না? আমি হ্যারে দুই’শ ডলারের সাথে আরো এক’শ বকশিস দিয়া রুম থ্যাইক্যা বাইর কইরা দিছি।
তা বেশ করেছিস। কিন্তু সমস্যাটা কী। তোকে হোস্টেল ছাড়তে হলো কেন?
শয়তানের বাচ্চাটা হোস্টেল সুপারের কাছে নালিস দিছে। তুই তো জানিস, হোস্টেলে বন্ধু বা বান্ধবীগো সাথে যা খুশি করা যায়, কিন্তু বেশ্যা ভাড়া করে আনা যায় না। বেরসিক সুপারিন্টেন্ডেন্ট আমারে সাতদিনের জন্য সাসপেন্ড করছে, কাঁদো কাঁদো সুরে বললো রমা।
আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে তুই এখন বাথরুমে যা। যা করছিস ভালই করছিস। বেশ্যার সাথে মিলনের স্বাদটা তো পাইলি। নইলে এই চাহিদাটা তোর মনটারে সারাজীবন উচাটন রাখতো। জীবনের কোনো অভিজ্ঞতাই তুচ্ছ না বন্ধু।
রমার ভাষায় আমি ছিলাম একটা গেঁয়ো ভূত। সে কথা মিথ্যাও না। আমি তো দাদীর বাড়ি থেকে সরাসরি উড়ে এসেছিলাম নিউইয়র্কে। মাঝে কোনো ব্রেক জার্নি ছিলো না। মানে ঢাকা বা অন্য কোনো বড় শহরে থাকিনি কখনও। রমা শহরের মানুষ। ও মেপে মেপে হাসে, নীরবে কাঁদে, লেট্রিনে পানি লাগে না, টিস্যু পেপারই যথেষ্ট। বাথ টাবে গোসল করে। সাঁতার জানে না। পুকুরে নামেনি কোনো দিন, নদীতে ঝাপায় নি। বর্ষার চিরচিরে জলে পুটি মাছের ঝাঁক দেখেনি কখনও। সে যেন টবে ফোটা গোলাপ। ক্ষেতের সর্ষে ফুলে ভ্রমরের নাচানাচি সে চেনে না। রমার সাথে আমার কত অমিল! আবার কতই না মিলেমিলে একাকার হয়েছিলাম আমরা।
ওর দুগাল টিপে দিয়ে বললাম, কী রে রমা কথা কবি না? পণ করিছিস নাকি?
কত্তবছর বাদে তুই আবার আমার গাল টিপলি ক’তো? কতজনেই তো কত জায়গা টিপলো, কিন্তু তুই ছাড়া আর কেউই আমার গালের মায়ায় পড়েনি দোস্ত!
এখনও হ্যারির সাথে আছিস তো রমা, ছোট্ট করে জানতে চাইলাম।
না রে, সে তো কবেই চুকেবুকে গ্যাছে। ১১ বছর হলো আমি একা। বিষন্ন শোনালো রমার গলা। মলিন হলো ওর মুখখানা।
প্রশ্নটা করে তবে কি ওকে কষ্ট দিলাম? পরিস্থিতি হালকা করতে বললাম, কী বলছিস রে রমা? জীবন না হয় চললো। কিন্তু ১১টা বছর তোর মতো সেক্সি গার্লের যৌবন চললো কি ভাবে? তুই আবার ব্যটা বেশ্যা ভাড়া করছিস না তো?
হা হা করে উচ্চস্বরে হেসে উঠলো রমা! বললো, তুই দেখছি ভুলিস নি সে কাহিনী?
একটু দম নিয়ে রমা আবার বলা শুরু করলো। এবার বেশ গম্ভীর সে। বলে, কি জানিস তোর সাথে যোগাযোগ রাখি নাই বটে, কিন্তু মনের মধ্যে সব দিনই তুই জ্বলজ্বলে আছিস। কতজন এলো গেলো কিন্তু তোর মতো প্রেমময় বন্ধু জীবনে দ্বিতীয়টি আসে নি।
তোকেও ভোলা যায় না রমা। শত চেষ্টা করেও না, মৃদু স্বরে বললাম আমি।
আচ্ছা শোন না, আমি তো তোর বাস্তবতাটা জানি না। যদি সম্ভব হয় তবে তুই ঢাকায় আমার ফ্লাটে ওঠ। ক’টা দিন তোকে ঘিরে কাটাই। খুব ইচ্ছা করতিছে জানিস! ক’ তুই থাকবি?
সে ইচ্ছা তোর থেকে আমার কিছু কম না রে পাগলী! কিন্তু রমা সেটি যে হচ্ছে না। আমি যাচ্ছি জেনে ঢাকায় আম্মার বাসায় বোনেরা সব জড় হইছে। কী ব্যাখ্যা দাঁড় করাবো আমি ক’ তো?
আচ্ছা ঠিক আছে। বুঝতি পারছি। তোর আর ব্যাখ্যা খুঁজতি হবে না। ঢাকায় তুই মায়ের সাথেই থাক। তবে আমরা কিন্তু এক সাথে ফিরবো। ২/৪ দিন ইস্তাম্বুলে থাকবো। হাত ধরাধরি কইরা শহরটা ঘুইরা দেখবো। বল তুই রাজি, আকুল অনুরোধ রমার।
কি হবে আর কাসুন্দি ঘেটে? ভাবছি আমি। আবার পরক্ষণেই মন বলে এ সবের মধ্যেই তো জীবনের পূর্ণতা। পূরোনোকে নতুন করে পাওয়ায় এক আনন্দ শিহরণ আছে!
আমার কাঁধে ওর কপাল ঠেকিয়ে ধাক্কা দিয়ে বলে, কি এত ভাবতিছিস ক’ তো? কথা কিন্তু ওইডাই ফাইনাল। ইস্তাম্বুলে আমরা থাকছি ক’টা দিন।
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডা’র নির্বাহী)