নিজের বই পাঠ করছেন নরমা ড্যানিং

রাশেদ নবী : ইনুক-কানাডিয়ান কবি ও লেখিকা নরমা ডানিং এর গল্পগ্রন্থ ‘ডায়িনা’ (Tainna) ২০২১ সালের ইংরেজি কথাসাহিত্যে গভর্নর জেনারেলের পুরস্কার অর্জন করে। ছয়টি ছোটগল্প সংবলিত এই গ্রন্থের কেন্দ্রীয় উপজীব্য কানাডার ইনুইট জনগোষ্ঠীর আত্মপরিচয়ের সংকট। গল্পগুলির চরিত্ররা সেই সংকট নিয়ে উচ্চকন্ঠ নয় কারণ তারা কানাডার নাগরিক সমাজে নামগোত্রহীন। তারা উত্তর মেরু বা আর্কটিকের গ্রাম থেকে পশ্চিমা জীবন-যাপনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে আসে দক্ষিণের নগরে, কিন্তু তাদের আত্মপরিচয় তাদেরকে শ্বেতাঙ্গ সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে। এই বিচ্ছিন্নতার অভিজ্ঞতা এই গল্পগ্রন্থের বিভিন্ন চরিত্রদের একটি অভিন্ন গল্পের অংশ করে তোলে।

শ্বেতাঙ্গ উপনিবেশিবাদীরা ইনুইট জনগোষ্ঠীকে ’এস্কিমো’ হিসেবে পরিচিত করে। এস্কিমো শব্দের অবমাননাকর অর্থ হল বর্বর বা অসভ্য। চার দশক আগে, ১৯৮০ সালে, বহুজাতিক ইনুইট সংগঠন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এই উপনিবেশিক পরিচয় প্রত্যাখান করে ইনুইট হিসেবে তাদের জনগোষ্ঠীর পরিচয় পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। তা সত্তে¡ও শুধু কানাডা নয়, পৃথিবীর বহু দেশেই এস্কিমো শব্দের ব্যবহার এখনও বহুল প্রচলিত। ইনুইট শব্দটি ইনুক শব্দের বহুবচন রূপ। ইনুক মানে ব্যক্তি আর ইনুইট মানে জনগণ। এই জনগোষ্ঠীর ভাষা ইনুকটুট। প্রায় ৫,০০০ বছর ধরে ইনুইট জনগোষ্ঠী বাস করে আসছে আর্কটিক অঞ্চলে, যার বিস্তার আলাস্কা থেকে রাশিয়া পর্যন্ত। কানাডায় তাদের বাসভূমি ’ইনুইট নুনানগ্যাট’ বা ’ইনুইট মাতৃভূমি’ চারটি অঞ্চল নিয়ে গঠিত : ইনুভিয়ালুইট (নর্থ ওয়েস্ট টেরিটরিজ), নুনাভুট, নুনাভিক (কুইবেক এর উত্তরাঞ্চল) ও নুনাটসিয়াভুট (ল্যাবরাডর এর উত্তরাঞ্চল)। এই বিশাল ভৌগলিক বিস্তার হয়ত তাদের মধ্যে জাতিগত সংহতি তৈরির ক্ষেত্রে অন্তরায়, কিন্তু এর চেয়ে বড় অন্তরায় তাদের জনসংখ্যার ক্ষুদ্র আকার। কানাডায় তাদের মোট জনসংখ্যা মাত্র ৬৫,০০০, যার এক-চতুর্থাংশ বাস করে ইনুইট নুনানগ্যাট এর বাইরে, কানাডার বিভিন্ন শহরে।

এত ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর সাহিত্য ও সংস্কৃতি সাধারণত লোকচর্চায় সীমাবদ্ধ থাকে এবং তা সহজে সেই জনগোষ্ঠীর ভৌগলিক ও সাংস্কৃতিক পরিসীমা অতিক্রম করতে পারে না। সা¤প্রতিক উত্তর-উপনিবেশিক গবেষকদের বিবরণ থেকে জানা যায় যে ইনুইট সাহিত্যের ইতিহাস দুশো বছর। কিন্তু এত প্রাচীন সাহিত্যের ঐতিহ্য সম্পর্কে বর্হিবিশ্ব খুব অল্পই জানে। এর কিছু রচিত ইনুকটুট ভাষায় আর কিছু উপনিবেশবাদীদের ভাষায়, বিশেষত ইংরেজি ও ফরাসি। দুঃখজনকভাবে, সব সাবেক উপনিবেশিক সংস্কৃতির মতই ইনুইট সংস্কৃতিকেও বহির্বিশ্বে পরিচিতির জন্য নির্ভর করতে হয় ইংরেজি বা ফরাসি ভাষার উপর।

নরমা ডানিং সাংস্কৃতিক পরিচয়ে ইনুক কিন্তু তার প্রাত্যহিক জীবনের ও সাহিত্যচর্চার ভাষা ইংরেজি। পেশায় সে অ্যালবার্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা। তার গ্রন্থের চরিত্ররা নিজ সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন ইংরেজিভাষী, নগরবাসী ইনুইট। তার পুরস্কারপ্রাপ্ত গ্রন্থের শিরোনাম ইংরেজি অক্ষরে ঞধরহহধ লেখা হলেও ইনুকটুট ভাষায় এর উচ্চারণ ডায়িনা, যার অর্থ ’অদেখা মানুষ’।

এই শিরোনামের একট সুপ্ত সাংস্কৃতিক তাৎপর্য রয়েছে। এই নামকরণের মাধ্যমে নরমা ইঙ্গিত করার চেষ্টা করেছে যে আর্কটিক থেকে এসে কানাডার শহরে বাস করলেও ইনুইট জনগোষ্ঠীর সদস্যরা মূলধারা সমাজের অগোচরে থেকে যায়। এই নামকরণে সম্ভবত নরমার নিজের বাল্যজীবনের অভিজ্ঞতার প্রভাব রয়েছে। তার বাল্যকালে, কুইবেকে তার সমবয়সীরা নিজেদের কেউ জার্মান কেউ ডাচ বলে পরিচয় দিত। নরমার ইনুইট পরিবার তাকে শেখায় কুবেকোয়া হিসেবে পরিচয় দিতে। ফলে নরমা বড় না হওয়া পর্যন্ত সে তার ইনুইট পরিচয় সম্পর্কে অবগত হয় নি। নরমার মতে, বহু অভিবাসী ইনুইট শ্বেতাঙ্গ সমাজে তাদের আত্মপরিচয় প্রকাশ করতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে না।

‘ডায়িনা’ বা ’অদেখা মানুষ’ নামকরণ অর্থবহ হয়ে ওঠে ’ডায়িনা’ গল্পে। এই গল্পের মূল চরিত্র, বানি, যাকে নরমা উপস্থাপন করে রহস্যময় মৃতদেহ হিসেবে। এক মেজর বিলি সেই মৃতদেহ আবিষ্কার করে একটি গল্ফ কোর্সে। বিলি প্রথমে দেখতে পায় গোল হয়ে বসে থাকা এক ঝাঁক কানাডা গুজ। পরে সে দেখে সেই পাখিরা আসলে বানির মৃতদেহ ঘিরে বসে আছে । পুলিশ বানির পরিচয় খুঁজে বের করতে আগ্রহী হয় না কারণ মৃতদেহের সাথে কোনো আইডি নাই। ক্রমে বানির জীবনেতিহাস থেকে জানা যায় যে চৌদ্দ বছর বয়সে কিশোরী বানি তার মায়ের সাথে আর্কটিকের এক গ্রাম থেকে এডমন্টনে আসে এক শ্বেতাঙ্গের সাথে। তার মা তাকে আশ্বাস দেয়, ”ভাল দিন আসছে।” বানি আশা করে হাই স্কুল শেষ করে সে দক্ষিণের বড় স্কুলে মানে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে। কিন্তু এডমন্টনে এসে মা ও মেয়ে দুজনেই পতিতাবৃত্তি বেছে নিতে বাধ্য হয়। বানি গর্ভবতী হওয়ায় তার ভবিষ্যত সন্তানের কথা চিন্তা করে পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন করে । কিন্তু তার ছেলে জন্মাবার সাথে সাথে এক সোসাল ওয়ার্কার এসে তার ছেলেকে নিয়ে চলে যায়। বানির কাছে বেঁচে থাকা অর্থহীন হয়ে পড়ে। মেজর বিলি যখন তার মাকে বলে যে এক ঝাঁক কানাডা গুজ বানির মৃতদেহ ঘিরে রেখেছিল, তখন তার মা বলে, ”ভাল লক্ষণ। তার মানে সে ভাল আছে। অন্য এক দেশে।”
‘কুনাক’ গল্পের কুনাক অনুরূপ আরেকটি চরিত্র। পিতৃমাতৃহীন কিশোর কুনাক আর্কটিকের এক গ্রাম থেকে প্রথমে যায় উইনিপেগে, সেখান থেকে এডমন্টনে এবং তারপরে যায় ফোর্ট ম্যাকমারির তেলক্ষেত্রে কাজ করতে। সেখানকার সহজ অর্থ তাকে ঠেলে দেয় নিয়ন্ত্রণহীন জীবনযাপনের দিকে। কিন্তু কিছুদিন পরে সে কাজ হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে ফিরে আসে এডমন্টনে। শুরু হয় তার উদ্বাস্তু নগরজীবন। সেখানে তাকে আকর্ষণ করে এক ইনুক রমণী, আভিয়াক। আভিয়কও কুনাকের মত উদ্বাস্তু। পতিতাবৃত্তি ও ভিক্ষাবৃত্তি তার জীবিকার উৎস। কুনাক আভিয়াকের প্রতি অনুরাগ প্রদর্শন করতে চায়। কিন্তু আভিয়াক তাকে বিশ্বাস করে না। সে নিরুত্তাপ কন্ঠে কুনাককে জানায় তার একটি ছেলে ছিল; ছেলেটি মারা গেছে। মদ ও ড্রাগ ছাড়া আর কোনো কিছুর প্রতি আভিয়াকের আগ্রহ নাই। জীবনের প্রতিও না। কুনাক তাকে ভিন্নভাবে বেঁচে থাকতে আগ্রহী করতে চায়। কিন্তু আভিয়াক কুনাককে পিছনে ফেলে রেখে নদীর অতলে অন্তর্ধান করে।

নরমা ডানিং এর বইয়ের প্রচ্ছদ

‘এস্কিমো হেভেন’ সম্ভবত ডায়িনা গ্রন্থের সেরা গল্প। এই গল্প গল্পকার হিসেবে নরমার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে। এর পটভূমি চিত্তাকর্ষক এবং এর কাহিনী বাস্তবতা ও ফ্যান্টাসির অভিনব বুনন। এর দুই চরিত্র দুই সংস্কৃতির এবং বলা যেতে পারে লৌকিক ও অলৌকিক জগতের প্রতিনিধি। ফাদার পিটার একজন শ্বেতাঙ্গ পাদ্রি যে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের ব্রত নিয়ে উত্তরে একটি বসতিতে একটি ছোট গির্জা পরিচালনা করে। তার গির্জায় একদিন সশরীরে উপস্থিত হয় প্রবীণ ইটটুরা- এক ইনুক বাউণ্ডুলে। পাঁচ বছর আগে মৃত ইটটুরা কিভাবে সশরীরের হাজির হতে পারে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলে না ফাদার পিটার। ইটটুরা ফাদার পিটারকে আমন্ত্রণ জানায় তার সাথে গিয়ে এস্কিমো স্বর্গ দেখতে। এক অলৌকিক স্পর্শে তাদের স্থানান্তার ঘটে উত্তর থেকে দক্ষিণের এক শহরে। প্রথমে তারা যায় এক ম্যাকডোনাল্ডসে। সেখানে ইটটুরা এক গল্প ফেঁদে বসে যে সে একজনকে খুন করে তার বউ ভাগিয়ে নিয়ে গিয়েছেল। সেই লোকটার মেয়ে পাঁচ বছর আগে ইটটুরাকে নদীতে ডুবিয়ে মেরে ফেলে। ম্যাকডোনাল্ডসে যে মেয়েটি তাদের খাবারের অর্ডার নেয় সে সেই মেয়ে। সেখান থেকে বাসে চড়ে তারা যায় এক বার এ। সারাদিন এ্যাডভেঞ্চারের পর ইটটুরা ফাদার পিটারকে জানায় যে এস্কিমো স্বর্গ বলে কিছু নাই। ফাদার পিটার ইটটুরাকে জিজ্ঞেস করে সে স্বর্গ-নরক বলে কিছু আছে বলে বিশ্বাস করে কি না। উত্তরে ইটটুরা বলে :
“ফাদার পিটার, শুধু বর্তমান আছে। এই আমাদের বিশ্বাস। বর্তমানকে আমরা মেধা তালিকা তৈরির জন্য ব্যবহার করি না। যেভাবে পারি সাহায্য করার জন্য আমরা বর্তমানকে ব্যবহার করি। আমাদের জনবল কম। আমাদের একে অপরকে ভালবাসতে হবে। সবার প্রতি আমাদের সদয় হতে হবে।”

ইটটুরার অলৌকিক অস্তিত্ব নিয়ে আমরা কৌতুক বোধ করতে পারি, কিন্তু আমরা সবাই তার সাথে একমত হব যে আমরা সবাই সদয়তা প্রত্যাশা করি। তবে এটাও ঠিক যে সব সমাজে সবসময় তা সহজলভ্য হয় না। শুধু ইনুইট বা আদিবাসী নয়, সব অভিবাসী ও সংখ্যালঘুদের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি প্রাতিষ্ঠানিক অগ্রহণযোগ্যতা কিভাবে একটি সমাজকে রূঢ় করে তোলে বিশেষ বিশেষ গোষ্ঠীর প্রতি। এ ক্ষেত্রে অতীত বর্তমানকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। এরকম অতীতের একটি বড় দৃষ্টান্ত উপনিবেশিক শাসন। সাবেক উপনিবেশিক সমাজের সদস্যরা এখনও সেই অতীতের ভার থেকে সহজে মুক্তি পায় না, যেমন পায় নি ইনুইট জনগোষ্ঠী। তারা যখন পশ্চিমা সমাজে অভিবাসন গ্রহণ করে তখন তাদের নিজেকে প্রতিনিয়ত সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক অগ্রহণযোগ্যতা মোকাবিলার সংগ্রামে নিয়োজিত রাখতে হয়। যারা ভাগ্যবান তারা কোনো কোনো ক্ষেত্রে সফল হয়, এবং যখন সফল হয় তখন তারা পিছিয়ে পড়া সতীর্থদের থেকে নিজেদের আলাদা করে রাখে। আর যারা সফল হতে পারে না তারা সবার মধ্যে বাস করেও অদৃশ্য থেকে যায়। নরমার গল্পের চরিত্ররা এরকম হতভাগ্য অসফল অভিবাসী।

নরমার চরিত্ররা জানে শ্বেতাঙ্গ সমাজে তারা কতখানি অগ্রহণযোগ্য। কিন্তু তাদের বিচ্ছিন্নতা তাদেরকে সম্মিলিতভাবে তা মোকাবিলা করতে অনুপ্রাণিত করে না। ফলে তারা তাদের হতাশা ব্যক্ত করে হাস্যরসের মাধ্যমে। তারা শ্বেতাঙ্গদের নীতিবোধ নিয়ে তীব্র ব্যঙ্গ প্রকাশ করে, কিন্তু তা বর্জন বা গ্রহণ করা নিয়ে কোনো মতামত ব্যক্ত করে না।

ইনুইটদের ভৌগলিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস সম্পর্কে সামান্য ধারণা নরমার গল্পের পটভূমি অনুধাবনে সহায়ক হবে। তার মানে এই নয় যে যাদের সে ধারণা নাই তারা তা উপভোগ করতে পারবে না। তার গল্প যে কোনো ইংরেজিভাষী পাঠকপাঠিকার কাছেই আকর্ষণীয় হতে পারে। ছোটগল্পের পাঠক বা শ্রোতার কাছে স্থান ও কালের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হল গল্পের চরিত্র এবং তার আনন্দ-বেদনা। ছোটগল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল কোনো বিশেষ আবেগ ও মুহূর্তকে বিশদভাবে ব্যক্ত করে পাঠকের বা শ্রোতার কৌতূহল নিবৃত্ত করা। নরমা তার প্রতিটি গল্পে নৈপুণ্যের সাথে ছোটগল্পের এই বৈশিষ্ট্য মূর্ত করেছে।
রাশেদ নবী : লেখক, অটোয়া, কানাডা