শম্পা বণিক, ওয়াশিংটন ডিসি (যুক্তরাষ্ট্র) থেকে : না, আমি চট্টগ্রামের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সেই বিপ্লবী নারী প্রীতিলতা নই। যিনি বিপ্লবী সূর্যসেনের নেতৃত্বে তখনকার ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং জীবন বিসর্জন করেন।

কিংবা সমরেশ মজুমদারের ‘গর্ভধারিণী’ গল্পের জয়িতাও নই। যে উচ্চবিত্ত পরিবারের স্বাধীনচেতা মেয়ে হয়েও সমাজের উঁচু শ্রেণির আর দশটা মেয়ের মতো সে নয়। নয় বিলাসিতায় গা ভাসানো ঝকমকে এক্সপেনসিভ শোপিস। প্রতিবাদী ছিল আচরণে, প্রতিবাদী বেশভূষায়, ভাবনা-চিন্তায় সে স্বচ্ছ ও গতিশীল।

এই দুই নারীকে বাস্তবে ধারণ ও কল্পনায় লালন করা প্রতিবাদী একজন সাধারণ নারী আমি।

জয়িতার মতো আমিও স্বপ্ন দেখি একটা শ্রেণিহীন সমাজের, যেখানে থাকবে না বর্ণবাদ, ধর্মবাদ, লিঙ্গবাদ কিংবা ধনী-গরিবের বৈষম্য। থাকবে না সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বৈষম্যের কুৎসিত রূপ। আমি আমেরিকায় বর্ণবৈষম্য দেখে যেমন কষ্ট পাই, ঠিক তেমনি বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নামক এক বিচ্ছিরি শব্দের তকমা লাগানো মানুষের নীরবে দেশ ত্যাগ বা তাদের গুমরে কাঁদার শব্দে আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। অথবা ‘হামারা ভারত মহান’ বলা দেশটি যখন মহত্বের সেই স্থান ধরে না রাখতে পারে, অথবা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীরা নির্যাতিত হন; তখন খুব লজ্জা হয় এটা ভাবতে যে এটা মহাত্মা গান্ধীর অহিংসার দেশ। প্রতিবেশী সব দেশ তো মহানত্ব তাদের কাছ থেকে শেখার কথা ছিল। সবাই শুধু ক্ষমতায় বড় হলো, মানবতায় নয়। আবার বিশ্বের মোড়ল কথিত দেশটিতে বর্ণবৈষম্য দেখে আঁতকে উঠি।

৪৬ বছর বয়সী কৃষ্ণাঙ্গকে ফ্লয়েডের গলায় হাঁটুচাপা দিয়ে শ্বেতাঙ্গ পুলিশ মেরে ফেলছিল কিছুদিন আগে, আর ১৭ বছর বয়সের কৃষ্ণাঙ্গি তরুণী ডার্নেলা ফ্রেজিয়া নিকৃষ্ট হত্যার ভিডিওটি ধারণ করেন, যা পরে ছাড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। সেই সঙ্গে মানুষের বিবেক কেঁপে উঠেছিল, ‘আই কান্ট ব্রেথ, আই কান্ট ব্রেথ’ শব্দে।

১৬১৯ সালের দিকের কথা, যখন যুক্তরাষ্ট্রের সমুদ্রসীমায় প্রবেশ করে ভিনদেশি একটি জাহাজ, নোঙর ফেলে সাগরতীরে। ওলন্দাজ এই জাহাজ থেকে অনেক কিছুর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে নামে ২০ জন ‘দাস’, যা ছিল তৎকালীন আমেরিকানদের জন্য একেবারেই অভূতপূর্ব ব্যাপার।

এরপর ১৬৮০-১৭০০ সালের দিকে দক্ষিণ আমেরিকার জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ লোকই ছিল ক্রীতদাস। আফ্রিকার বিভিন্ন স্থানীয় গোত্র থেকে দাস হিসেবে মানুষকে ধরে আনা ছিল খুব সহজ ব্যাপার। ১৭৮৮ সালে আমেরিকার নতুন সংবিধানের মাধ্যমে দাসপ্রথাকে আইনসম্মত করে দেওয়া হয়। ফলে নতুন উদ্যমে দাস ব্যবসা শুরু হয়ে যায়। ১৮৬২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর তারিখে আব্রাহাম লিংকন দাসদের স্বাধীনতার ব্যাপারে প্রাথমিক একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেন। অবশেষে ১৮৬৩ সালের ১ জানুয়ারি তিনি দাসত্ব মোচনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে এই কুপ্রথার পাকাপাকিভাবে বিলুপ্তি ঘটান। তিন মিলিয়নের বেশি কৃষ্ণাঙ্গ দাসকে মুক্তি দেওয়ার মাধ্যমে এ ঘোষণা সার্থকতা লাভ করে।

১৯৬৪ সালের দিকে আমেরিকায় কালোদের জন্য নাগরিক অধিকার আইন আর ১৯৬৫ সালে ভোটাধিকার আইন পাস হয়েছিল। ১৯৬৮ সালে কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক অধিকার আন্দোলনের নেতা মার্টিন লুথার কিংয়ের হত্যাকাণ্ডের পর বর্ণবাদের বিরুদ্ধে এমন জনরোষ ও বিশৃঙ্খলা আর দেখা যায়নি মার্কিন মুলুকে। এরই মধ্যে গত দুবার কৃষ্ণাঙ্গসন্তান বারাক ওবামা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। বারাক ওবামার বিজয় প্রমাণ করেছিল, মার্কিনিরা বর্ণবাদমুক্ত। কিন্তু ভাইরাল হওয়া ডার্নেলা ফ্রেজিয়ার ভিডিও জানিয়ে দিল, আমরা যা দেখি তার সবটুকু সত্যি নয়।

বাংলাদেশে বসবাস করা জনগণের অনেকেই দেখছি বর্ণবাদ নিয়ে কথা বলছেন। দেখে ভালো লেগেছে যে দেশের মানুষ সচেতন হচ্ছেন, আমেরিকার নির্মাণে কৃষ্ণাঙ্গদের ইতিহাস, অবদান জানছেন। অস্বীকার করছি না যে বর্ণবাদ পৃথিবীর সব জায়গাতেই কমবেশি আছে। তবে আমাদের বাংলাদেশি সমাজে সেটা অন্য সমাজের চেয়ে অনেক বেশি।

একজন কালো বা শ্যামলা মেয়েকে জিজ্ঞাসা করুন সে বলে দেবে, ‘ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি’ ঝকঝকে উজ্জ্বল রঙের বাণিজ্যিক ফায়দা লাভের বিজ্ঞাপনের পেছনে কত হতাশা–যন্ত্রণা গুমরে কাঁদে। মানুষের বাহ্যিক রূপ-রঙে মানুষকে বিচার–বিবেচনা করা হয়, মানুষের গুণ দিয়ে নয়। আবার পাত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে আর কিছু থাকুক বা না থাকুক পাত্রীকে সুন্দরী হতেই হবে। আর নারী–পুরুষের ভেদাভেদ, যা শুরু হয় নিজ গৃহে ছেলে ও মেয়েসন্তানের মধ্য দিয়ে আর শেষ হয় করপোরেট অফিসের উচ্চপদের অযোগ্যতা প্রমাণ করে অথবা পিতা-মাতার সম্পদ থেকে নারীকে বঞ্চিত করে।

আপনি কি আপনার নিজের দেশের (বাংলাদেশের) ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে ২০২০ সালে এসেও সম্মান নিয়ে বসবাস করতে দিচ্ছেন? আপনি কি তাদের কৃষ্টি, ধর্মকে শ্রদ্ধা করতে শিখেছেন? করোনাকালে অন্তত ৩৬টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নির্যাতন ঘটেছে। আপনি কি এসব অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন কখনো? যদি না করেন, তবে দয়া করে কান্না বন্ধ করেন। মায়ের জন্য আগে কাঁদেন, তারপর মাসির জন্য কাঁদবেন। পাশের দেশে হলে কাঁদবেন আর নিজের দেশে হলে ঘুমাবেন, কেন রে ভাই! এসব হিপোক্রেসি করলে আমি শতভাগ বর্ণবাদী, যা বর্তমান যুগে একটি অপরাধ।

বর্ণবাদ বা ধর্মবাদ যা–ই বলুন, দুটোই মুদ্রার এ পিঠ আর ও পিঠ। আজকের আমেরিকার যে আন্দোলন, সেটা শুধু কালো মানুষের নয়, সেটা পুরা আমেরিকার আন্দোলন। যেখানে শ্বেতাঙ্গরা দলে দলে যোগ দিয়েছেন।

আমি যখন মার্কিন মুলুকে অনুমোদন সূত্রে একজন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী নাগরিক, আমি আমার রাইটস জানি। কেউ আমাকে অথবা আমার ধর্মকে কটাক্ষ করলে বা সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট করলে আমি মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াই আর বলি—‘আই হ্যাভ ইকুয়্যাল রাইট, দ্যাট ইউ হ্যাভ।’

কিন্তু সেই আমি যখন জন্মসূত্রে বাংলাদেশি নাগরিক তখন ইকুয়্যালিটি, রাইট ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীদের কথা বেমালুম ভুলে যাই। কারণ, আমি তখন যে সংখ্যাগুরু।

মার্টিন লুথার কিং বলেছিলেন, ‘আইন করে কারও কাছ থেকে ভালোবাসা আদায় করা যায় না ঠিকই, কিন্তু তার নিপীড়ন থেকে আইন আমাকে বাঁচাতে পারে।’

আইন আমাদের মতো স্বল্প উন্নত ও স্বল্প শিক্ষিতদের দেশে থাকলেও তার প্রয়োগ নেই। তাই আমাদের একমাত্র অবলম্বন ভালোবেসে মানবতাবাদী হওয়া। আগামী প্রজন্মকে জাতি–ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে সত্যিকারের মানবিক গুণাবলীসম্পন্ন একজন মানুষ করতে হবে। আর সেই প্রজন্ম গড়তে হলে, সবার আগে নিজেকে সব রকমের রেসিজমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে অথবা মন থেকেই সমর্থন করে যেতে হবে।

কী যায়–আসে
মোড়ানো চামড়ায়
সাদা না কালো
হিন্দু কি মুসলিম,
হৃদয়খানা তো সবারই
টকটকে লাল
টিকটিক শব্দে
গেয়ে যায় ভালোবাসার গান।