বিদ্যুৎ সরকার : একজন দক্ষ তীরন্দাজের মতো সমস্ত প্রতিশ্রুতি ফিরিয়ে দিতে পারি নির্দ্বিধায় সঠিক ঠিকানায়, অব্যর্থ নিশানায়। আমাকে দেয়া শেষ চিঠির অন্তিম লাইনগুলোর কথা কি একটুও মনে পড়ে তোমার? ডর্মের সফেদ ডিভানে আধ শোয়া হয়ে আমাকে লিখা তোমার শেষ চিঠি। সাথে রুম মেটের তোলা চিঠি লেখারত তোমার একটি মিষ্টি ছবি। সকালের একমুঠো রোদ এসে ছড়িয়ে পড়েছে তোমার সোনালী চুলে। দ্বিতীয় সেমিস্টার পরীক্ষা শেষ। কয়েকটা দিন একটু রিলাক্স মুডে থাকা। বন্ধুদের সাথে বাইরে কোথাও ‘হ্যাংগআউট’, ছবি তোলা, দূরের বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করা এসমস্ত কাজ তখন মূখ্য হয়ে উঠে।
সে চিঠিতেই তুমি জানিয়ে ছিলে এক্সাম শেষে তুমি টরন্টো আসবে বেড়াতে। কই তার তো কোন চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি না। এখন অনেক রাত। চারিদিকে নিরবতা, শুধু তোমার দেয়া ‘উইন্ড চাইম’র মিষ্টি টুং টাং শব্দ রাতের নৈশব্দকে ভেঙ্গে দিচ্ছে মাঝে মধ্যে। একটু হাওয়ায় দোল খেয়ে বাজতে থাকে আপন মনে। এ যেন মনে করিয়ে দেয় বারবার তোমারই কথা। সেবার মন্ট্রিয়েল থেকে নিয়ে এসেছিলে আমার জন্য। জন্মদিনে পাওয়া আমার প্রিয় গিফ্টগুলোর একটি এই ‘উইন্ড চাইম’।
দুপুরের আলতো হাওয়ায় কী দারুন মধুর শব্দে বেজে যায় অবিরাম। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে এর মন জুড়ানো সেই শব্দ শুনতে পাই আমি।
ক্রিং ক্রিং করে বার কয়েক রিং হয়ে হঠাত ফোন কলটি থেমে গেল। কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে আবার বাজতে শুরু করে দিল। এবার আর মিস করিনি, সাথে সাথে রিসিভ করে অবাক হয়ে গেলাম, এতো কুহুর কন্ঠ। অপ্রত্যাশিত, অঘোষিত কুহুর ফোন, তাও আবার অচেনা এক নাম্বার থেকে। ওর ফোনেরই বা কী হলো? কোন ধরনের বিপদ-আপদ হয়নিতো ও’র? না কি ফোন হারিয়ে গেছে কোথাও কিংবা কোনভাবে সেটা ভেংগে গেছে তারই অসাবধানতার কারনে! অতশত ভেবে নিলাম এরই মধ্যে, ছোট্ট এ মুহূর্তে।
– সত্যি করে বল, তুমি মাইন্ড করোনিতো?
– কেন আমি মাইন্ড করবো, কী বিষয় নিয়ে সেটা আগে বলবে তো?
– এই যে কথা দিয়েও আমি কথা রাখতে পারিনি। কথা ছিল আমার এক্সাম শেষ হলে তোমাদের টরন্টোয় আসবো এবং ব্লা পার্ক, উডবাইন বিচে রোদেলা দুপুরগুলো কাটাবো। অন্তত একদিন নায়েগ্রা অন দা লেকের পাবে বসে একটা সুন্দর দুপুর চিল্ড বিয়ারে প্রশমিত করবো। কী সুন্দর একটি পরিকল্পনা শুধু আমার বোকামির জন্য ভেস্তে গেল!
– সমস্যাটা কী সেটাইতো জানা হলো না।
– ব্যাপারটা খুবই সামান্য কিন্তু, সময়মত যোগাযোগ না করতে পারাটা মস্ত মিস্ আন্ডারস্ট্যান্ডিং – এর কারণ হয়ে গেল।
– কিন্তু তোমার ফোনের কী হয়েছে সেটা আগে বল, যার দরুন আমিও তোমাকে বার বার কল করে পাচ্ছিলাম না।
– আরে বলছি। আমার এক স্কুল-মেট বলা নেই কওয়া নেই হঠাত মাঝ রাতে ফোন করে বলে, সে আমার এখানেই আসছে আমাদের ভার্সিটিতে ভর্তিও হোয়ে গেছে একজন ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট হিসেবে। অথচ, আমি এর কিছুই জানি না। আমাকে চমকে দিবে বলেই এ সকল পরিকল্পনার ছক আঁকা হোয়েছিল।
– কিন্তু এতে তোমার ফোন লাপাত্তা হবার কারণ খুঁজে পেলাম কই?
– একটু ধৈর্য্য ধর, বলছি। ওকে রিসিভ করতে বাস স্টেন্ডে যাই, ক্যাব থেকে তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে হাতে থাকা মোবাইল হাত থেকে ছিটকে পরে যায়। আর পড়বি তো পর অপর একটি চলন্ত বাসের চাকার তলায়। ব্যাস্ আমার মোবাইল চুরমার! এই হলো পেছনের কাহিনী। যার দরুন, আমার সমস্ত যোগাযোগ টোটালি ডেড্। আমার রুমমেট ও অন্যান্য সবাই যার যার খুশিমত ছুটি কাটাতে চলে গেছে। এখন কয়েন ঢুকিয়ে তোমাকে কল দিয়েছি। এবার নিশ্চয়ই বুঝতে অসুবিধে হবে না যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হবার আসল কারণটি।
– ফোনের অভাব পূরণ হলো কি তাতে? এতো শুধু এক তরফা সমাধান, তাও আবার ক্ষুদ্র সংস্করণ।
– না কালই এর স্থায়ী সমাধান করছি, একটি ফোন কিনে নেব।
– এর বিকল্প যে নেই তা তুমি হাড়ে হাড়ে বুঝেছো নিশ্চয়ই?
– তা আর বলতে!
– তোমার কাছে বেশ কিছু মেসেজ পাঠিয়েছি কিন্তু তা পাবেই বা কেমন করে, এর আগেইতো তুমি তোমার ফোনের বারোটা বাজিয়ে বসে আছ।
– এতটা রেস্টলেস হলে চলবে কেন, কষ্টটাতো দ্বিপাক্ষিক। সমস্ত দুঃখের বোঝা একাই নিয়ে নিচ্ছ যে?
– তোমার যে কিছু একটা হচ্ছে তা জানবো কেমন করে বল?
শুধু শুধু বিতর্কে অবতীর্ণ হয়ে লাভ কি, সময়ের অপচয় ছাড়া?
– বল আমি কী করতে পারি?
– কাল সক্কাল সক্কাল তোমাকে পাবার উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছি আমার বন্ধু সমেত।
– ‘তোমাকে পাবার জন্য… ’ দারুন বলেছো মাইরি। আমিও কি বলবো ‘এসো এসো আমার ঘরে…. ’?
রিনি ঝিনি চুরির আওয়াজ কানের খুব কাছে। চোখ বুঝেই ভেবে নিলাম ঘুমের ঘোরে, কুহু এরই মধ্যে চলে এসেছে হয়তো! কিছুটা বিস্মিত হলাম বৈকি!
এবার সত্যি সত্যি চোখ মেলে তাকালাম- না কোথাও কেউ নেই…..!!
নিমিষেই আমার ভুল ভেঙে গেল। ঝুলে থাকা উইন্ড চাইমটি থেকে থেকে বেজে উঠছে দখিনা হাওয়ায়। কুহুকে নিয়ে সারাদিনের ভাবনার ফসল বুঝি এক স্বল্প দৈর্ঘের নির্মিত স্বপ্নজাল।
বিদ্যুৎ সরকার : লেখক, আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা