অনলাইন ডেস্ক : ইয়াবা তৈরি হচ্ছে মিয়ানমারের সীমান্ত এলাকায়। সেই বড়ি মাদক কারবারিরা ৩০ থেকে ৩৫ টাকায় কিনে তা বাংলাদেশে আনছে বার্মিজ জুতায়। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে জুতার সোল খুলে ইয়াবা ঢুকিয়ে ফের আঠা লাগিয়ে তা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। আর এসব ইয়াবার দাম মিয়ানমারের কারবারিদের কাছে পাঠানো হচ্ছে হুন্ডির মাধ্যমে।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন কখনো ফল, কখনো মাছ, কখনো কুরিয়ার সার্ভিস ও বিভিন্ন পণ্যের আড়ালে সীমান্ত এলাকা দিয়ে ইয়াবার চালান রাজধানীতে আনা হলেও মূলত তা ঢাকার আশপাশ এলাকার ডিলারদের কাছে চলে যাচ্ছে। আর তাদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে আরও প্রত্যন্ত এলাকায়।
সম্প্রতি ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) একটি দল যাত্রাবাড়ী এলাকায় অভিযান চালিয়ে কক্সবাজারের স্থানীয় চক্রের হোতাসহ দুই ইয়াবা কারবারির কাছ থেকে দুই জোড়া বার্মিজ জুতা জব্দ করে। পরে সেই জুতাগুলোর সোল খুলে উদ্ধার করে সাড়ে চার হাজার পিস ইয়াবা বড়ি।
গ্রেপ্তার হওয়া ইয়াবা কারবারি চক্রের হোতা জিয়াউর রহমান মুন্না গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, সে প্রায় ১০০ টাকা করে ইয়াবাগুলো সংগ্রহ করেছে কক্সবাজারের স্থানীয় এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে। যদিও সেই ব্যবসায়ী ৩০ থেকে ৩৫ টাকা করে সংগ্রহ করেছে মিয়ানমারের কারবারিদের মাধ্যমে। তাদের মতো কক্সবাজার ও টেকনাফের আরও অনেকেই বার্মিজ জুতায় ইয়াবা বহনে জড়িত বলে তথ্য দিয়েছে।
ডিবির ওয়ারী জোনাল টিমের উপকমিশনার আবদুল আহাদ বলেন, যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে দুই জোড়া বার্মিজ জুতাসহ চক্রের হোতা জিয়াউর রহমান মুন্না ও তার সহযোগী হাসানকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা নিজেদের গাড়ি ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দিয়ে উল্টো ধমক দিয়ে চ্যালেঞ্জ করে বসে। পরে তাদের হাতে থাকা শপিং ব্যাগে দুই জোড়া বার্মিজ জুতার সোল খুলে পাওয়া যায় সাড়ে চার হাজার ইয়াবা বড়ি।
তিনি বলেন, এই চক্রের সদস্যরা আগেও একই কৌশলে একাধিকবার ইয়াবার চালান নিয়ে এসেছে। তারা যাদের কাছ থেকে ইয়াবা সংগ্রহ করেছে এবং যাদের কাছে সরবরাহের উদ্দেশ্য ছিল তাদের সবার পরিচয় শনাক্ত হয়েছে, গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তা জানান, প্রতি মাসে উদ্ধার হওয়া ইয়াবার পরিসংখ্যান ব্যবহার করে পাশের দেশ মিয়ানমারে পাচার হওয়া টাকার অঙ্ক সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। এতে দেখা গেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, পুলিশ, র্যাব ও কোস্টগার্ডের ধারাবাহিক অভিযানে প্রতি মাসে গড়ে ২৫ লাখ ইয়াবা বড়ি উদ্ধার হয়। প্রতিটি ইয়াবা বড়ির দাম ৩০ টাকা করে হিসাব করলে মাসে সাড়ে ৭ কোটি টাকা পাচার হওয়ার তথ্য মেলে। বছর শেষে পাচার হওয়া টাকার অঙ্ক দাঁড়ায় ১০৫ কোটি টাকা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) এক কর্মকর্তা বলেন, উদ্ধার হওয়া ইয়াবার সংখ্যা বিচারে বছরে প্রায় শতকোটি টাকার তথ্য হিসাব করলেও মূলত তার প্রায় তিনগুণের বেশি টাকা পাচার হচ্ছে। পাচার হওয়া এসব টাকার অধিকাংশই হুন্ডির মাধ্যমে দেশ থেকে চলে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, এ তো গেল আর্থিক ক্ষতির হিসাব। প্রকৃতপক্ষে ইয়াবা যুবসমাজকে ধ্বংস করে দিচ্ছে, যেই ক্ষতি টাকার মূল্যের কাছে কিছুই নয়।
মাদক মামলা তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, মাদকের বিশেষ করে ইয়াবার ব্যবহার ও সরবরাহ বেড়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী পুরনো কৌশল জেনে যাওয়ায় কারবারিরা নতুন নতুন কৌশল গ্রহণ করে ইয়াবা বহন করে থাকে। সংশ্লিষ্ট সংস্থার তথ্যানুযায়ী ২০২০ সালে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে মাদকবিরোধী অভিযানে শুধু ইয়াবা বড়িই উদ্ধার হয় তিন কোটির ওপর। এর মধ্যে র্যাব উদ্ধার করে প্রায় এক কোটি ইয়াবা বড়ি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর উদ্ধার করে প্রায় ৩০ লাখ, পুলিশ উদ্ধার করে ৮০ লাখ ও বিজিবির হাতে উদ্ধার হয় প্রায় এক কোটি ইয়াবা বড়ি।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, বিভিন্ন মাধ্যমে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী মিয়ানমারের সীমান্ত এলাকায় বেশ কিছু ইয়াবা তৈরির কারখানা রয়েছে। সেখান থেকেই অধিকাংশ ইয়াবার চালান বিভিন্ন মাধ্যমে দেশে ঢুকছে। এসব ইয়াবার সাইজ বা আকৃতি ও কালার বা রংভেদে দামের হেরফের হয়ে থাকে। প্রতিটি ইয়াবা ৩০ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি করে থাকে সেখানকার নাগরিকরা। সেই ইয়াবা আমাদের দেশে জায়গাভেদে ২৫০ থেকে ৪০০ টাকায় বিক্রি হয়ে থাকে।