হিমাদ্রী রায় : পিতা তোমার হাতেই আমার আত্মাকে সমর্পণ করিলাম – যীশু।
ঈশ্বর ভয়ের নয় প্রেমের চৈতন্যদেবের কথা। তারও অনেক অনেক আগে বেথলেহেম শহরে খড়ের বিছানায় মাতৃক্রোড়ে এক শিশু বড় হয়ে উঠলেন ক্ষমা,দয়া,আর প্রেম নিয়ে। সে এক পরম যোগী, পরম প্রেমী, ‘আদিত্য বর্ণং তমস: পরস্তাত’। তিনি হাতে অস্ত্র নিয়ে, দল বড় করে সাম্রাজ্য দখলের চেষ্টা করেননি। তিনি পতিত, পীড়িত, অত্যাচারিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের ভালবাসতে চেয়েছিলেন। তাঁর স্বদেশীরা ভয় পেয়েছিলেন তার সততাকে। তারা দেখলেন দুই হাত দিয়ে দশজনকে একসাথে হত্যা করা যায় না তবে দুই হাত জোড়ে প্রেমের কথা বলে দশ হাজারকেও বসে আনা যায়।
যীশু যে প্রেমের কথা বলেছেন তা চিরো সহিষ্ণু, মধুর যাতে ঈর্ষা নেই, যে প্রেম আত্মশ্লাঘা করেনা, যার গর্ব নেই, অশিষ্টাচারণ করে না, স্বার্থ চেষ্টা করে না, রাগিয়া উঠে না, অপকার গণনা করে না। আমরা কি সেই প্রেম গ্রহণ করতে পেরেছি? আমাদের যাপনে, সমাজ রাজনীতি কিংবা সংস্কৃতিতে অসহিষ্ণুতা বেড়েই চলেছে দিনে দিনে। যে বুকে হিংসার চাষ সেই বুক দিয়ে ক্রুশ আলিঙ্গন করে তাঁর বাণী আবৃত্তি করি পূজাবেদীর সামনে। নিদারুণ লোভে দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার আজো বিদ্যমান। তাই রবীন্দ্রনাথ বলেন আমাদের জীবনে তাঁর জন্মদিন দৈবাৎ আসে কিন্তু ক্রুশে বিদ্ধ তাঁর মৃত্যু সে তো আসে দিনের পর দিন।যীশু যাদের ত্রাণ করতে এসেছিলেন তাদেরি হাতে প্রাণ দিলেন হাসি মুখে। এসেছিলেন যে যন্ত্রণা নিবারনে সেই যন্ত্রনাই ক্ষমা হয়ে, প্রেম হয়ে, শান্তি হয়ে উদ্ভসিত ‘হে পিতা, এদের ক্ষমা করো এরা জানে না কি করছে’।
মাত্র ত্রিশ মূদ্রার বিনিময়ে যীশুকে রোমান সৈন্যদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর শিষ্য যুডাস। সৈন্যরা প্রথমে যীশুকে নিয়ে যায় ইহুদি পুরহিতদের কাছে। প্রহসনের বিচার হলো শুরু। একজন সাক্ষী দিলেন তিনি নিজের কানে শুনেছেন যীশু নাকি জেরুজালেমের সকল মন্দির ভেঙে ফেলতে বলেছেন এ ব্যাপারে যীশুকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি কোন উত্তর দেননি ছিলেন নিশ্চল নিশ্চুপ। এর পরই তাকে বেধে নিয়ে যাওয়া হয় রোমান গভর্নর পন্টিয়াস পিলাতের রাজ দরবারে। তাঁর বিরুদ্ধে আনিত দুটি অভিযোগ তিনি জেরুজালেমের মন্দির ভেঙে ফেলা এবং নিজেকে ইহুদিদের রাজা প্রচার করা এই অভিযোগের ভিত্তিতে তাঁকে মৃত্যু দন্ড দেওয়া যায় এমনটি ভাবতে পারেননি পন্টিয়াস পিলাতের। কিন্তু উন্মত্ত জনতার প্রবল চাপে যীশুকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয় এবং তার পর তাঁর উপর নেমে এসেছিল ইতিহাসের বর্বরোচিত অত্যাচার। ০৩ এপ্রিল মাটিতে পোঁতা হয়েছিল ক্রুশবিদ্ধ কাঠ আর কাঠের উপর বড় গজাল দিয়ে নির্মম ভাবে বিদ্ধ করা হয়েছিল যীশুকে। মাথায় কাটার মুকুট নিয়ে চার ঘন্টা বেঁচে ছিলেন তিনি। মৃত্যুর আগে যীশু মাথা তুলে দেখলেন কয়েকজন অনুগত ভক্ত বিলাপ করছেন আর কেউ পড়ে আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। তখন যীশু স্পষ্ট করে বললেন ‘পিতা তোমার হাতে আমার আত্মাকে সমর্পণ করিলাম’। ক্লেশভার ক্লিষ্ট এক অক্লিস্ট মানুষ দেবতা সংসার বহন থেকে জীবের উদ্ধারের জন্য বুকের রক্ত ঢেলে দিলেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় যীশু খ্রীষ্ট ছিলেন কিনা সে প্রশ্ন সত্য নয়; এ কথা নিশ্চিত যে যীশু খ্রীষ্ট অযুত মানুষের অন্তরে স্থান পেয়েছেন, যীশুর মহত্ত¡ই মানব হৃদয়ে সুপ্রতিষ্ঠিত। সহজ কথা বলে যীশু সাজা যায় আর তাকে ধারণ করতে হলে দয়া থাকতে হয়। দয়া ধর্মের শরীর -মন প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তিতে নিরাসক্ত। সেই পূণ্য হৃদয় কেবল জগতের কল্যাণ কামনা করতে পারে। স্তুতিতে আসক্ত মন যখন কল্যাণ হোক বলে তখন ভাঁড়ামি মনে হয়।