ইউসুফ কামাল : তিন.
ইলার দ্বিতীয় বার এই চলে যাওয়াটা নতুন করে শাহেদের মনে আলোড়ন তুলে আবার ধীর লয়ে মিলিয়ে গেলো। কম্পন মিলিয়ে গেলে কি হবে, ঠিকই রেখে গেল কৈশোর-উত্তর সদ্য যুবক শাহেদের মনের পুরনো আঘাত। সেই সাথে আবার নতুন করে এক প্রশ্ন, কেন আবার দেখা হলো ইলার সাথে? দেখা না হলে কি ক্ষতি হতো? ভুলেই তো গিয়েছিলো সে, তবে কেন আবার পুরনো স্মৃতি নিয়ে ফিরে এলো? ইলাও তো ভোলেনি, সেটা তার কথা আর ব্যবহারেই পরিস্কার হলো। তা হলে? বিষাদময় গভীর এক প্রশ্ন, তাহলে এর শেষ কোথায়? যে ফুল ফোটার আগেই ঝড়ে পরেছিলো তা এই দ্বিতীয়বারের স্বল্প পরিসরে নতুন করে যেন ফুটতে শুরু করছিলো। আর সেটা যে একতরফাও ছিল না সেটা শাহেদেরও বুঝতে দেরী হয়নি। খুব সহজেই ইলার ব্যবহারে সেটা অনুমান করতে পেরেছিলো।

ইলার প্রথম দিনের সহজ ব্যবহারে শাহেদ খানিকটা হতভম্বই হয়ে পড়েছিলো, ঠিকমতো পরিবেশটা মিলিয়ে নিতেও পারছিলো না। পরে নোমানের মাধ্যমে সব কিছু জানতে পেরে বুঝে ফেলেছিলো কেন এই পরিবর্তন। কলেজ জীবনে আবেগের যে ধারা টা সারাক্ষণ তাড়িয়ে বেড়াতো সেটার সাথে আজকের এই কথাবার্তার মধ্যে বিরাট একটা ফারাক অনুভব করলো। ইলার মধ্যে সেই লজ্জা সুলভ ব্যবহারগুলো অনুপস্থিত। মফস্বল শহরের সেই প্রথম কলেজ জীবনের দুরন্ত সময়ের স্মৃতিটা আবারো যেন ফিরে এলো। ইলার বান্ধবীর অযাচিত কিছু তথ্য ইলার মা জেনে যাওয়ায় ভীত সন্ত্রস্ত ওর বাবা উপরে তদ্বির করে অত্যন্ত স্বল্প সময়ের মধ্যে কাউকে না জানিয়ে সংগোপনেই চলে গিয়েছিলেন পরবর্তি নতুন চাকুরীস্থলে। এমনকি কোথায় যাচ্ছেন সেটাও ইলার মা ছাড়া আর কেউই জানতে পারেননি। শাহেদ তো ঈদের ছুটির পর কলেজে যেয়েই জানতে পেরেছিলো যে ওরা সপরিবারে চলে গেছে। কেন চলে গেল তা শাহেদের কাছে অজানাই থেকে যেতো যদি এই সুদীর্ঘ পাঁচ বছর পরে নিউমার্কেটে ইলার সাথে দেখা না হতো। ইলার বাবা বদলী হয়ে সিলেটের কোনো এক মহকুমা শহরে চলে গেছে এটুকুই জেনেছিলো, এর বেশি আর কোন তথ্যই শাহেদ তখন যোগার করতে পারে নাই। কোথায় গেল একটুও কি জানিয়ে যেতে পারতো না, ভেবেই ভিতরে ভিতরে বরং একটা অভিমানই কাজ করেছিলো শাহেদের মনের মধ্যে। ইলার আকস্মিক চলে যাওয়া আর কোন যোগাযোগ না হওয়ার মধ্য দিয়ে দুজনের মধ্যেকার ভালোলাগার প্রথম পাঠটা যেন এক ফুত্কারেই নিভে গিয়েছিলো। ‘আউট অব সাইট আউট অব মাইন্ড’ কথাটার যথার্থতা কয়েক মাসের মধ্যেই প্রমাণিত সত্য হয়ে গেলো ওর কাছে।
ধীরে ধীরে ইলার নামটাও যেন স্মৃতির পাতায় ধুসর বিবর্ণ হয়ে গেলো। জেগে রইলো কিছু দীর্ঘশ্বাস আর টুকরো টুকরো কিছু স্মৃতি। ইলার চলে যাওয়ার কষ্টটা ওর মনের ভিতর প্রচন্ড রেখাপাত করেছিলো। পরোক্ষভাবে সেই কষ্টটা ভোলার জন্যেই হয়তো পড়াশুনার প্রতি একটু বেশিই মনোযোগী হয়ে পড়েছিলো শাহেদ। সব মিলিয়েই নিজের প্রতি ও পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধটাও যেন বেড়েই গিয়েছিলো। ফলে পরীক্ষার রেজাল্টও ভালো হতে শুরু করলো, সেই সাথে জীবনের ভবিষত নিয়ে নতুন কিছু উচ্চাকাংখার সৃষ্টি হলো। মনের ভিতরে সংগোপনে থাকা ইলা সংক্রান্ত স্বর্ণালী মুহূর্ত্তের দিনগুলো যেন মন থেকে একটু দূরে সরে গেল। পরবর্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের এক বছর পার হওয়ার পরেই অকস্মাত নিউমার্কেটে ইলার সাথে দেখা হওয়ার পরে শাহেদ অনুভব করলো পুরনো সম্পর্কটা তাহলে হারিয়ে যায়নি। এক বছর একই ভবনে দুইজন ভিন্ন ভিন্ন ডিপার্টমেন্টে ক্লাস করেছে, অথচ আসা যাওয়ার পথেও কোনদিন সামনা সামনি দেখা হয়নি। শুরুর দিকে দেখা হলে পরিস্থিতিটা হয়তো ভিন্ন পথে চলতে শুরু করতো। নোমানের মাধ্যমেই জানতে পেরেছিলো ওর বাবার গরজেই বিয়েটা তাড়াতাড়ি হয়ে গিয়েছিলো। ভদ্রলোক হয়তো বা ইলার কলেজ জীবনের ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে তখনো একটা আতংকেই ছিলেন। গত বছরের বিয়ের অনুষ্ঠানের পর ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে ‘ইলা’ লসএ্যন্জেলস্ এ স্বামীর কাছে চলে যাবে এটাই নির্ধারিত ছিলো। আর সেই পূর্ব নির্ধারিত সময়টাও যেন অবধারিতভাবেই এসে গেল পরীক্ষার পর পরই।

ইলার চলে যাওয়ার পাঁচ/ছয়দিন আগে কয়েকজন বন্ধুদের ‘ম্যান্ডারিন’ চাইনিজে একটা গেট টুগেদার এর আয়োজন করেছিলো ইলার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু নোমান। চার/পাঁচ জনের ছোট্ট পরিসরে আনুষ্ঠানিক বিদায়ের সময় ইচ্ছে করেই শাহেদ সময়ের একটু পরেই ওখানে যেয়ে উপস্থিত হয়েছিলো। অনুষ্ঠানে পরিচিতদের মধ্যে ইলা ছাড়া আর ছিলো একমাত্র নোমান। ঘন্টা খানেকের অনুষ্ঠান শেষে সবাই চলে গেলে ইলা শাহেদকে বল্লো, চলো একটু বসি। নোমান বিষয়টা বুঝতে পেরে একটু দূরে যেয়ে ওদের কথা বলার সুযোগ করে দিলো। ইলা টেবিলে সামনা সামনি বসে গভীর ভাবে শাহেদের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলো, মনে হয় ফিরে গেলো সেই হারানো দিনগুলোতে। মিনিট কয়েক পরে উঠে এসে শাহেদের পাশের চেয়ারে একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলো। হয়তো ওর হাতটা অনিচ্ছা সত্বেই শাহেদের হাতের সাথে লেগে থাকলো সারাক্ষণ। ইচ্ছে করেই যেন হাতটা সরালো না, ঈষত চাপা কন্ঠে বল্লো, সেই তোমার দেখাই যদি পেলাম তো এক বছর আগে এলে না কেন? একটু থেমে ধরা কন্ঠে বল্লো, সত্যিই আগে দেখা পেলে এবার আর তোমাকে আমার থেকে কেউ বিচ্ছিন্ন করতে পারতো না। তুমি হয়তো জানো না ধর্মের বাঁধা আমাকে এবার তোমার কাছ থেকে কোন মতেই দূরে রাখতে পারতো না। ভালোবাসার তুলনায় ধর্ম আমার কাছে কখনই বড়ো কোন অন্তরায় আগেও ছিলো না এখনো নয় । তুমি বোধ হয় খেয়াল করোনি আমি সিঁদুর পড়ি না, শুধু আজকেই নয় আসলে কখনই পড়ি না অথচ আমাদের পরিবারের সবাই রক্ষনশীল মানসিকতার। প্রথাগতভাবে যেটা উচিত ছিল আমি সেটায় বিশ্বাসী নয় এর মূল কারণ আমি সনাতনপন্থী মানুষ না। তোমাকে যে আমি কখনই ভূলতে পারিনি, তুমিই তো আমার জীবনের প্রথম ভালোলাগা। ভালোবাসা কেমন হয় ঐ সময় সেটা আমি বুঝতে পারিনি। তোমার কাছ থেকে দূরে যাওয়ার পরই বুঝলাম সম্পর্কের বেড়াজাল কি ভাবে আষ্টেপৃষ্টে বেধে ফেলে মানুষকে। ভাবলাম ভালোলাগাই মনে হয় ভালোবাসার পূর্বরাগ। তোমাদের ওখান থেকে বাবা নিয়ে আসার পর কলেজেও ভর্তি হইনি প্রায় দু’মাস। একবার মনে হয়েছিলো লেখাপড়া আর করবো না। পরে চিন্তা করে দেখলাম জীবনটা তো অনেক লম্বা, চলতে শুরু তো করি- দেখি কি হয়। পথে তো একসময় আমাকে নামতেই হবে। কেন যেন মনে হতো তোমার সাথে আমার দেখা হবেই, কত যে তোমাকে খুঁজেছি। আর সত্যিই সেটা একদিন হয়ে গেলো। নিউমার্কেটে আমিই তোমাকে প্রথম দেখেছি, বিশ্বাস করবে কিনা জানি না সব সময় আমি আশে পাশে তাকাতাম, খুঁজতাম হয়তো তোমাকেই। আমাকে চলে যেতে হচ্ছে তবে মনে রেখো। এটা ঠিক যেখানে যে পরিবেশেই থাকি তুমি আমার থেকে দূরে থাকবে না কখনোই। আগে বিশ্বাস করতাম না কিন্তু এখন করি, জীবনের প্রথম প্রেমকে ভোলা যায় না। ভাবতাম ঠিকই তোমার সাথে আবার ও আমার দেখা হবে, ইলার কন্ঠে আত্ম প্রত্যয়ের সুর। তুমি আমি কখনোই বিচ্ছিন্ন হবো না, আমার বিশ্বাস কখনোই মিথ্যে হয় না যেমনি এ বার হয়নি। ইলার কথাগুলো গভীরভাবে ঢুকে গেলো শাহেদের মনের মধ্যে। ম্যান্ডারিনের আলোআধারি পরিবেশে পাশে বসা ইলাকে শাহেদের অনুজ্জ্বল এক দুখী মানুষের চেহারা বলে মনে হলো। উপরের চেহারার সাথে নতুন এই চেহারার মধ্যে বিস্তর একটা ফাঁক। দেখলো ইলা গভীর দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে শাহেদের দিকে হয়তো বা পুরনো সেই ভালোলাগার পথটাই যেন নতুন করে খুঁজে পেতে চেষ্টা করছে।

কি বলা যায় শাহেদ কোন কথাই খুঁজে পেলো না, নতুন জীবনে প্রবেশ করতে যাওয়া এক মানুষকে সে কি বলবে? দ্বিতীয়বার আবার সেই হারিয়ে যাওয়ার পথে ইলা’কে সে কি বলবে? এখন কি বলা উচিত! নিজের ভাবনার সাথেই শাহেদের মনে হলো, ইলা কি দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছে অথবা নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না? হয়তো তাই। তবে এটা বুঝতে পারছে পুরনো সম্পর্ক সে একটুও ভোলেনি। কিন্তু এমন তো হবার কথা না, স্বামীর সংসার করতে আমেরিকা যাচ্ছে ওর তো মনে আনন্দ থাকার কথা। নতুন জীবনের সাফল্য কামনা করে কিছু বলাটাই সংগত কিন্তু অবচেতন মনে শাহেদ সেটা কেন যেন বলতে পারছে না? একটা বাঁধা যেন কোথা থেকে তার বাক শক্তিকে রহিত করে রেখেছে। তবে কি ইলার অনাগত সুখময় দাম্পত্য জীবন তার কাম্য নয়? সে কি ঈর্ষান্বিত হয়ে পরেছে? তাই বা কেমনে হয়? ইলার কথায় তো তাকেও নতুন জীবনে প্রবেশের পথে আনন্দিত মনে হচ্ছে না, কেমন যেন দ্বিধান্বিত মনে হচ্ছে। বিদায়ের মূহুর্তে নতুন এক চিন্তা শাহেদকে যেন বিচলিত করে তুল্লো। নোমানের ডাকে সম্বিত ফিরে পেল শাহেদ, বিদায়ের আবহ সৃষ্টি হয়ে এলো যেন নোমানের তাড়াতে।
ইলা কন্ঠে বিষাদের সুর নিয়ে বল্লো, নোমানকে ওখানে যেয়ে ঠিকানাসহ বিস্তারিত খবরাখবর জানিয়ে চিঠি দেবো। ও তোমাকে আমার ঠিকানা পৌঁছে দেবে, আমি বলে দেবো। তুমি যেখানে যেভাবেই থাকো আগের বারের মতো এবার আর আমাদের যোগাযোগ যেন বিচ্ছিন্ন না হয়। আমাকে আর দুশ্চিন্তার মধ্যে রেখো না কিন্তু।

এর ছয়দিন পরে সত্যিই ইলা চলে গেলো ওর নতুন ঠিকানায়, নোমান ওঁকে প্লেনে তুলে দিয়ে আসলো। শাহেদ ইচ্ছা করেই বিমানবন্দরে বিদায় জানাতে গেল না। পরদিন বিকেলে নোমানের সাথে দেখা, অদ্ভুত রকমের একটা সৌহাদ্যমুলক হাসি দিয়ে বল্লো, না যেয়ে ভালো করেছেন ওঁকে তুলে দিতে ওর বাবা মা এসেছিলো। আপনাকে দেখলে পরিবেশটা হয়তো ভিন্নতর হয়ে যেত। পকেট থেকে ছোট্ট স্লিপ প্যাডের ভাজ করা একটা কাগজ শাহেদকে দিয়ে বল্লো, মনে হয় বাসা থেকে লিখে এনেছিলো আপনাকে দেওয়ার জন্যেই। মুখে বল্লো, আপনার সাথে আমি যেন সব সময় যোগাযোগ রাখি। ইলার দুঃখী চেহারাটা আবার শাহেদের চোখের সামনে ভেসে উঠলো। নতুন করে মনে হোল সত্যি ইলাকে ভুলে যাওয়া ওর পক্ষে মোটেই না। নোমানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শাহেদ উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটা ধরলো, হাতের মুঠোয় ধরে রাখা কাগজের ভাজটা খুলে চোখের সামনে মেলে ধরলো। হাতে লেখা ছোট্ট কিন্তু হিমালয়ের মতো ভারী কয়েকটা শব্দ। তোমার কাছে আমার প্রথম স্বীকারোক্তি, ভালোবাসি তোমায় ….

হাঁটতে হাঁটতে শাহেদের মনে হলো, তা হলে আমার অনুভূতির প্রকাশ কি ইলার কাছে উন্মোচিত হয়নি? আমার স্বীকারোক্তি, ও কি সঠিক ভাবে বোঝেনি? তাই বা কেমন করে হবে? (চলবে)
লালমাটিয়া, ঢাকা