Home কলাম ইতি ইলা

ইতি ইলা

ইউসুফ কামাল : দশ.
সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ইলার কর্মজীবনের ব্যাস্ততার মাত্রাও যেন বেড়েই চল্লো। প্রথম দিকে ইচ্ছে করেই কাজের মধ্যে জড়িয়ে থাকতে চেষ্টা করতো যেন পারিপার্শিক সমস্ত ঘটনা থেকে দূরে থাকতে পারে। আর সেটা করতে যেয়ে ধীরে ধীরে পুরোদস্তর একজন কর্মজীবি মহিলা হিসেবে নিজেকে দক্ষ করে তুল্লো। সপ্তাহে তিন দিন ডাবল শিফট্ ডিউটি করা শুরু করলো। কাজ শেষ করে বাসায় চলে আসলে একাকীত্বের মাঝে ফেলে আসা জীবনের চিন্তা মাথায় এসে ভীড় করে তাই ইচ্ছে করেই ডাবল শিফ্ট করা শুরু করলো। প্রকারান্তরে ষোল ঘন্টা কাজের মধ্যে থাকলে বাকী সময়টা আর অন্য কোন রকম চিন্তা মাথায় আসবেই না। এক শুক্রবারে উর্মিলা ফোনে ইলাকে তার রুমে ডিউটি শেষে দেখা করতে বল্লো। আগে এমনিতে সপ্তাহে দু/একদিন দেখা করতো, ডাবল শিফ্ট ডিউটি শেষে আর শরীরেও কুলোতো না। এমনি করেই ওদের দু’জনের দেখা সাক্ষাতও কমে গিয়েছিলো। সময়াভাবে ইলার ডাবল শিফ্টের কথাও উর্মিলাকে বলা হয়নি। উর্মিলা কম্পিউটার সেকশনে ইলার ডিপার্টমেন্টের ডিউটি রোষ্টার আর বেতনের শীটে সই করতে যেয়ে ওর বেতনের অংক দেখে একটু দুর্ভাবনাতেই পরে গেলো। ভাবলো ইলার হঠাত এত বেশি টাকার কি প্রয়োজন পরলো? টাকার প্রতি কখনোই ওর দুর্বলতা দেখেনি তাহলে বিষয়টা কি? ব্যাপারটা উর্মিলাকে একটু ভাবিয়ে তুল্লো। অনুভব করলো ইলাকে সে মনে প্রাণে ভালোবেসে ফেলেছে, নিজের একান্ত আপন জনের মতো! ভাবনায় পরে গেল, ইলা কেন এমন করছে? তাকেও তো কিছু বলেনি! ক্রমাগত এমনি পরিশ্রম করতে থাকলে তো ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পরবে, তখন তো আরো বিপদ। একা মানুষ কে তাকে দেখবে? ম্যানেজমেন্ট কাজে সন্তষ্ট হয়ে দুই বছরের মাথায় ইলাকে সেকশনের প্রধান করে দিয়েছে। আর এতে দায়িত্বের সাথে সাথে ইলার কাজের গতিও অনেক বেড়ে গিয়েছে। অবশ্য পদোন্নতির পিছনে উর্মিলার একটা হাত থাকতে পারে সেটা ইলা নিজেও কিছুটা ধারণা করেছিলো। বুঝেও কিছু না বলে একদিন সুন্দর একটা হাত ঘড়ি এনে ঊর্মিলার হাতে বেধে দিয়েছিলো। সেদিন ঊর্মিলা আদর করে কাছে বসিয়ে বলেছিল, আমার তো নিজের বোন নাই, থাকলে আমি এমনি করতাম। তোমাকে আমি আমার ছোট বোনের মতোই ভালোবাসি।

শিফ্ট শেষে উর্মিলা ইলাকে নিজের বাসায় নিয়ে গেলো, উদ্দেশ্য একান্তে কিছু কথা বলা। উর্মিলার বাসায় ঢোকার সময় ইলা একটু থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো একতলার অবিনাশের সেই পুরনো বাসার সামনে। দোতলায় উঠার সিঁড়ির মাথার এই জায়গাতেই সে রাগে দুঃখে উদ্বভ্রান্তের মতো বসে ছিলো। আর ঠিক তখনই উর্মিলা দেবদূতের মতো এসে অনিশ্চিতময় একটা জীবন থেকে হাত ধরে উদ্ধার করে তাকে নতুন একটা জীবনের সন্ধান দিয়েছিলো। তাই তো উর্মিলাকে সে যেমন ভালোবাসে তেমনি বিশ্বাসও করে। পুরো ঘটনাটা সেলুলয়েডের ফিতায় মোড়ানো দৃশ্যগুলোর মতো হঠাত করেই ওর মনে পড়ে গেলো। অবিনাশ চলে গেছে নিউইয়র্কে, এই বাসা ছেড়ে। অবিনাশ নেই কিন্তু স্মৃতিগুলো অবিকল রয়ে গেছে এখনো ইলার মানস পটে। ইলার মনটা বিষন্নতায় ভরে উঠলো আরো একবার। অবিনাশের ঘরের দরোজার দিকে তাকিয়ে ভাবলো, এই দরজা দিয়ে বের হয়েই তো সে নতুন অজানা এক পৃথিবীতে পা রেখেছে। ধীরে ধীরে নিজেকে সামলে নিয়ে প্রচন্ড আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে উঠেছে, ভেবেছে সামনে এগোতে হবে। বুঝে নিয়েছে কখনোই আর পিছন ফিরে তাকানো চলবে না।

দীর্ঘ দিন পর সারারাত উর্মিলার সাথে গল্প করে কাটিয়ে দিলো ইলা, আর তাতেই উর্মিলা জেনে গেল অর্থের জন্য নয় শুধুমাত্র একাকীত্ব কাটানোর জন্যেই ইলার এই ডাবল শিফ্টের কাজ করা। আর উর্মিলা গল্পচ্ছলে অতি সংগোপনে ঢুকে পড়লো ইলার মনের গোপন কুঠুরীতে, আর তাতেই তার কাছে উন্মোচিত হয়ে গেলো ইলা-শাহেদ উপাখ্যানের না বলা অধ্যায়। উর্মিলা জেনে গেল ইলার কৈশর উত্তীর্ণ যৌবন শুরুর প্রাক্কালের মধুরতম অংশ বিশেষ যা ইলা এখনো সযত্নে রক্ষা করে চলেছে। মনে মনে ইলাকে যেন সে আরো আপন ভাবতে শুরু করলো। একজন দৃঢ় প্রত্যয়দীপ্ত মানুষের সন্ধান যেন নতুন করে খুঁজে পেলো ইলার মধ্যে, জীবনের প্রথম ভালোলাগা মানুষটাকে যে এখনো সযত্নে মনের ভিতরে ধরে রেখেছে এই জন্যে। পরদিন শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন, মোটামুটি সারারাত গল্প করে দু’জনই ঘুম থেকে দেরী করে উঠলো। সারাদিন উর্মিলার বাসায় কাটিয়ে বিকেলে ইলা ফিরে এলো ওর ডরমেটরীতে, কেমন যেন একটু হাল্কা লাগছে ওর। মনের মধ্য একটা অন্য রকম অনুভূতি কাজ করছে যেন, এই প্রথম ইলা কারো কাছে ওর আর শাহেদের প্রসংগ উন্মোচিত করলো। শাওয়ার সেরে কিচেনে ঢুকে ভাবলো আজ নিজের জন্য কিছু রান্না করলে কেমন হয়? কেন যেন আজ অনেকদিন পর ভালো কিছু রান্না করতে ইচ্ছা করছে। ফ্রীজ খুলে মাস খানেক আগের কেনা ফিলিপিনো হাঁসের মাংসের প্যাকেটটা বের করলো। অনেকক্ষণ ভিজিয়ে রেখে পরিস্কার করে মনোযোগ দিয়ে রান্না করলো। অনেকদিন পর পছন্দের খাবার তৈরী করতে যেয়ে ভাবলো জীবনের একটা পরিবর্তন তো দরকার। বড্ড একঘেয়ে লাগছে, এভাবে আর কতদিন চলবে? অনেক দিন তো হলো, হিসেব করলো সামনের মাসের ১২ তারিখে ওর আমেরিকা আসার পুরো তিন বছর পূর্ণ হবে। এতো গুলো সময় কেমন করে পার হয়ে গেল জীবন থেকে? খাওয়ার সময় মা’র কথা মনে হলো, কি করছে মা এখন? অনেকদিন কথা হয় না মা’র সাথে, মা’য়ের কথা মনে হলেই ইলার মনটা বিষন্ন হয়ে ওঠে। ইচ্ছা করেই তাই চিন্তাগুলো সহজে মাথায় আনতে চায় না। তবু ভাবলো কাল রবিবার মা’র সাথে কথা বলতে হবে।

সেল ফোনের রিং এ শব্দে ইলা’র চিন্তা ছুটে গেল, উঠে বেডরুমে ঢুকে ফোন হাতে নিয়ে দেখলো অপরিচিত নাম্বার। তবে এরিয়া কোড দেখে বুঝতে পারলো নিউইয়র্কের নাম্বার। দ্রæত চিন্তা করলো অবিনাশের কল না তো! নিউইয়র্ক থেকে আর কে ওকে ফোন করবে? রিসিভ না করে ফোন টেবিলে রেখে দিল। ভাবলো সাধারণতঃ ওর ফোনে তেমন কল আসেও না, কেই বা ওকে ফোন করবে? আবারও রিং বেজে উঠলো খানিক বিরতি নিয়ে, ভাবলো দেখি না বাবা মা’র জরুরী কোনো খবরও তো হতে পারে! মনে সাহস সঞ্চার করে ফোন রিসিভ করে ঐ প্রান্তে শাহেদের গলার স্বরে ইলা চমকে উঠলো। শাহেদ তুমি? কবে এসেছো নিউইয়র্কে? উত্তেজনায় ইলা কথাও বলতে পারছে না ঠিক মতো। মনে হলো ওর যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে উত্তেজনায়। শাহেদ বল্লো, সকালে জেএফকে’তে নেমেছি। জাতিসংঘের বাত্সরিক একটা প্রোগ্রামে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সদস্য হিসেবে পাঁচ সদস্যের একটা গ্রুপে এসেছি। ইলা আবেগ তাড়িত কন্ঠে বল্লো, খুব ভালো লাগলো শুনে, এখন আমার এখানে কবে আসছো তাই বলো? আমি কি তোমার প্লেনের টিকিট পাঠিয়ে দেবো? এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলো। পাঁচ দিনের প্রোগ্রাম। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে আসতে পারি। প্রোগ্রাম শেষে এখানে আত্মীয় স্বজনদের সাথে কাটিয়ে দেশে ফিরবে আমাদের গ্রুপের কয়েকজন। ভেবেছি, আমি নিজেও ঐ ভাবেই চেষ্টা করবো। শাহেদ যোগ করলো, টিকিট পাঠানোর দরকার নাই আমি দু’একদিনের মধ্যে এ্যামবেসীতে বলে রাখবো, তারিখ বলে দিলে ওরা তোমার বাসার কাছের হোটেলে বুকিং আর প্লেনের টিকিট নিয়ে রাখবে। তোমার দুশ্চিন্তা করার দরকার নাই, সময় মতো আমি তোমাকে জানাবো। ভালো থেকো। (চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, কেটি, টেক্সাস, ইউএসএ

Exit mobile version