মনিস রফিক : কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।
তের.
ব্রেবিউফ এর দিনগুলিতে ভাষা নিয়ে আমি অন্যভাবে ভাবতে শুরু করি। সার্বভৌমত্ববাদীদের কাছে ভাষা যোগাযোগের মাধ্যমের মতই রাজনৈতিক ফায়দা লুটার এক গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র ছিল। একজন ইংরেজি ভাষী না ফরাসী ভাষী, এর নিরিখে তারা একজনকে বিচার করতো এবং ধরে নিতো সে কি ধরনের মুল্যবোধ ধারণ করে। তারা এমনটাও ভাবতো, কুইবেকে এই দুই ভাষা-ভাষীর মানুষেরা ভিন্ন ধরনের লক্ষ্যকে সামনে রেখে এগুয়। আসলে এমন পরিবেশে পড়ার আগে আমার মাথায় কখনো আসেনি আমার আসল পরিচয়টা কি? আমি ইংরেজি ভাষী না ফরাসী ভাষী? অটোয়ার সেই দ্বিভাষিক পরিবেশে আমার কখনো এই বিষয়টা ভাবার প্রয়োজনই পড়েনি।
ব্রেবিউফ এবং বলতে গেলে কুইবেকেরই পরিবেশটা আমাকে ভাষার ভাবনায় ফেলে দিয়েছিল। কথা বলার সময় কার সাথে বা কি বিষয় নিয়ে কথা বলছি সেটা ভালোভাবে ভেবে তারপর সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ভাষায় কথা বলতে হতো। আমার জীবনের এই নতুন সচেতনায় আমি নিজে নিজেই নিজের চিন্তা চেতনা বা স্বপ্নের কথা বলতে হলেও যথার্থ শব্দ প্রয়োগ করে তার যথাযথ ব্যবহারের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখতাম। ফলে প্রায় সময়ই কথা বলার সময় আমাকে ভাবতে হতো, আমি যে শব্দটা ব্যবহার করছি সেটা কি ফরাসী? অথবা এই জায়গাই ফরাসী শব্দের পরিবর্তে কি ইংরেজী শব্দ ব্যবহার করা উচিত ছিল? শেষ পর্যন্ত এই চর্চাটা আমাকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল যে, আমি লক্ষ্য করতে থাকলাম, কোনো কিছু না ভেবেও যদি আমি কোনো সিদ্ধান্ত নিতাম তাহলে দেখতাম ভাষার ব্যবহারে সেটা আপনা আপনি ঠিক হয়ে গেছে।
ইংরেজি ক্লাসে আমি ছিলাম সবচেয়ে সেরাদের সারিতে। আমার এই সারিতে আর যারা ছিল তাদের সবারই মা অথবা বাবা পারিবারিকভাবেই ছিলেন ইংরেজি ভাষী। আমাদের এই ইংরেজি ভাষার প্রতি দক্ষতায় অনেকের চোখেই আমরা ছিলাম শুধুই ইংরেজি ভাষী। অদ্ভুত ব্যাপার আমাদের কেউ যদি ফরাসী ভাষাতেও ইংরেজির মতই দক্ষ হতাম বা আমাদের মা বা বাবা যতই ফরাসী হোন না কেনো সেটা তারা আমলে নিতো না।
আমি দ্বিভাষিক ছাত্রদের সাথে খুব সহজেই মিশে যেতে পারতাম। সে জন্য এটা কখনোই বলা যাবে না যে, একেবারে আপনা আপনি এমন সব বন্ধুদের সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়ে যেতো, বরং এর পেছনে ভাষা ও চিন্তা-ভাবনার একটা প্রভাব থাকতো। আমার এই বন্ধুদের কাছে আমার নামের শেষ অংশটা খুব দ্রুতই গায়েব হয়ে গিয়েছিল। আর তত তাড়াতাড়িই আমি তাদের কাছে হয়ে গিয়েছিলাম শুধুই ‘জাস্টিন’। ক্লাস থেকেই শুরু হয়েছিল আমাদের এই বন্ধুত্ব। কয়েক দশক পরেও তারা আমার তেমনই বন্ধু আছে। তারা এখনো সেই আগের মতই আমার সাথে সোজা সাপ্টা কথা বলে, এমন কি চ্যাঁচ্যাঁছোলা সত্য বলতেও কখনো ছাড়ে না। তারা আমার এমনই সব বন্ধু যাদের ওপর আমার শত ভাগ আস্থা আছে। আসলে আমাদের সবারই এমন বন্ধুর বড় বেশি প্রয়োজন।
আমার বয়স যখন প্রায় সতেরো, তখন একদিন আমরা বন্ধুরা সবাই মিলে হৈ চৈ করতে করতে মন্ট্রিয়লের ডাউন-টাউনের এক নামকরা রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছিলাম। সতেরো বছরের ছেলেরা যেমন করে তেমনি আমাদের এই আয়োজন করে খেতে যাওয়ার প্রধানতম কারণ ছিল মেয়েদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। সেদিন আমি অর্ডার দিয়েছিলাম ‘ক্যানার্ড উ ভিনেগরে ফ্র্যামবোইস’ এবং আমি যখন মুখ থেকে এই শব্দগুলো বের করে ওয়েটারকে এই খাবারের অর্ডার দিচ্ছিলাম, তখন একটা গভীর নিঃশ্বাস নিয়েছিলাম। আমার ভাবটা এমন ছিল যে, খাবারটার স্বাদ এত বেশি জিহ্বায় পানি এনে দেয় যে এই খাবারটার নাম উচ্চারণ করতেই আমি এর গন্ধ পেতে শুরু করেছিলাম। সেই দিনের পর থেকে অর্থাৎ সেই ‘ক্যানার্ড’ অর্ডারের পর থেকে আমি যদি কোনো জিনিস খুবই গভীরভাবে মাথায় ঢুকাতে চেষ্টা করি আর সেটা যদি আমার বন্ধুরা টের পায়, তাহলে তারা আমাকে লক্ষ্য করে চেঁচিয়ে বলে উঠে, ‘লাথি মেরে জাস্টিনের কাছ থেকে ‘ক্যানার্ড’কে খেদিয়ে দাও’। তাদের সাথে আমার বন্ধুত্বের সেই গভীরতা ও অমলিনতা অনুভব করি যখন আমি দেখি তারা আমার প্রতি এখনো সেই আচরণ করে। আমার এই বিগত বছরগুলোতে তারা আমার প্রতি তাদের সেই ব্যবহার অক্ষুন্ন রেখেছে আমার সমস্ত অবস্থান আর পরিচয়ে।
আমি ছাত্র বা শিক্ষক আবার ক্যাম্প পরামর্শক বা দলের নেতা যাই হই না কেনো, আমার এই সুন্দর বন্ধুরা আমার সাথে সবসময়ই তেমনই ব্যবহার করে থাকে, তাদের কাছে আমি বর্তমানে বা ভবিষ্যতে শুধু ‘জাস্টিন’ হিসেবেই বিবেচিত হবো।
আমি সব সময় এই দুটো ভাষাকেই ভালোবেসে এসেছি, কিন্তু আমি ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছি এই দুই ভাষা একে অপরের থেকে কত বেশি আলাদা, এই পার্থক্যটা কিভাবে এই ভাষা দুটো একজনকে তার চিন্তা বা মনের ভাব বা চিন্তা প্রকাশে সাহায্য করে তাতে নয়, বরং আলাদাটা হচ্ছে, কিভাবে এই ভাষা দুটো একজনের চিন্তার বহিঃপ্রকাশকে নিয়ন্ত্রণ করে। উদাহরণ হিসেবে আমি বলতে পারি, একজন কথা বলা বা লেখা শুরু করার পূর্বে সেটা কিভাবে শেষ করতে হবে সেটার জন্য ফরাসী ব্যাকরণের বিশেষ নিয়মাবলী তাকে জানতে হবে। নিঃসন্দেহে এটা একজনের সাবলীল ভাব প্রকাশে একটা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যদি একজন তার বাক্য একভাবে শুরু করে, তবে সেটা শেষও করতে হবে সেই ভাবেই। হয়তো এই কারণেই অধিকাংশ ফরাসী বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের ভিতরের বৌদ্ধিক সত্ত¡াকে সুষ্ঠুভাবে প্রকাশ করতে গিয়ে একটু সাবলীলহীন হয়ে পড়েন, এমনকি যখন তাঁরা খুবই সাধারণ ভংগিতে সাধারণ মানুষ বা টেলিভিশিন এ কথা বলে থাকেন তখনও।
পক্ষান্তরে ইংরেজির ক্ষেত্রে আমি সব সময়ই লক্ষ্য করেছি, ব্যাকরণ তোমাকে তোমার ইচ্ছেমত যে কোনো উপসংহারে যেতে সাহায্য করে, তুমি কিভাবে বাক্য শুরু করলে সেটা কোনো বিষয় নয়। এমনকি বাক্যের মাঝামাঝি গিয়েও কোনো নিয়ম না ভেংগেই তুমি তোমার মত গন্তব্য পরিবর্তন করতে পারো। ইংরেজির মধ্যে হয়তো বিশেষ এলোমেলো কিছু থাকতে পারে যেটা ফরাসীতে পাওয়া যায় না। ফরাসীতে শব্দ আর বাক্যাংশের মধ্যে যে সু² মিল আছে সেটা ধরতে হলে বিশেষভাবে মনোযোগ দেবার প্রয়োজন পড়ে। হয়তো এই ব্যাপারটার জন্যই বাবা হয়তো কখনো প্রতিটি শব্দ কেটে কেটে বিশ্লেষণের দিকে না গিয়ে বরং বলতেন আমি ফরাসীর তুলনায় ইংরেজিতে কম যুক্তিবাদী। বাবার এই মন্তব্যটা অনেক বছর পর আমি ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারি যখন আমি ম্যাকগিল ডিবেটিং ইউনিয়ন এর বিতর্কে অংশ নিই। বলা দরকার, ঐ বিতর্কগুলো হতো ফরাসী ভাষায়। যাইহোক, আমার বিতর্কের বন্ধুরা সব সময়ই বলতো, আমি ইংরেজির চেয়ে ফরাসী ভাষাতেই অসম্ভব ভালো বিতর্ক করতে পারতাম। আমি উপলব্ধি করতাম, এর মূল কারণ ছিল আমার ইংরেজি ভাষার সেই সাবলীল জ্ঞান, যার ফলে আমি অনেক বেশী পিঠ চাপড়ানিও পেতাম।
অন্যান্য দ্বিভাষিকদের মত আমি মাঝে মধ্যেই কোন যুক্তি ছাড়াই এক ভাষা থেকে আরেক ভাষার মধ্যে ঢুকে যেতাম। উদাহরণ হিসেবে এখানে বলা যেতে পারে, আমি যখন অংক করতাম, সেটা করতাম শুধুমাত্র ফরাসী ভাষায়। এর কারণ ছিল, আমার জীবনে অংকের যত সব ক্লাস করেছি, সেগুলো করেছি ফরাসী ভাষায়। আমি যখন সেই পশ্চিমে ফরাসী পড়াতাম, তখন প্রতিনিয়ত আমি যে বৈরী অবস্থার মুখোমুখি হতাম তা হচ্ছে, ভ্যাংকুভারের সেই কিশোর ছেলেমেয়েদের এমন একটা ভাষা পড়াতে হতো যা তাদের প্রাত্যহিক জীবনে তারা ব্যবহার করতো না। ফলে আমি চেষ্টা করতাম, ফরাসী ভাষার রোমান্টিক বিষয়গুলো তাদের সামনে তুলে ধরতে, যাতে তারা খুব সহজেই এ ভাষার সাথে একাত্ব হতে পারে। আমি যখন কাউকে বলতাম, তাদেরকে তোমার মনে পড়ছে, তুমি তখন বলো, ‘তু মে মানকিউইস’। এ বাক্যের কর্তা ‘তুমি’। ইংরেজীতে এটার বিপরীতার্থক বাক্য হচ্ছে, তোমাকে আমার মনে পড়ছে, যেখানে আমার নিজের অনুভূতি নিয়ে কথা বলা হচ্ছে। যদিও এ দুটোর মধ্যে একেবারে সু² পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়, কিন্তু মানুষের স্বাভাবিক প্রকৃতিগত কারণের জন্য এটা কিশোরদের খুবই উদ্দীপ্ত করতো।
ভালোবাসার ভাষা নিয়ে আমার এই যে বিভিন্ন মতবাদিক চিন্তা ভাবনা সেটা কিন্তু ব্রেবিউফ এর প্রথম দিনগুলোতে আমার জন্য একজন মেয়ে বন্ধু যোগাড় করতেন খুব একটা সাহায্য করে নি। আর এই মেয়ে বন্ধু যোগাড়ের ক্ষেত্রে আমার বিকাশ একটু দেরীতেই হয়েছে।
আমি যখন মন্ট্রিয়লে আসি তখন আমি কেবল যৌবন রাজ্যে প্রবেশ করেছি এবং সেই শহরে আমি কোনো মেয়েকেই চিনতাম না, তারপর আমি ভর্তি হলাম এক ছেলেদের স্কুলে। অবশেষে যখন উপর ক্লাসে আমরা মেয়েদের সাথে ক্লাস শুরু করলাম, দেখা গেলো, অটোয়ার দশ বছরের আমি যেভাবে মেয়েদের সাথে মিশেছি এবং তাদের মধ্যে যে সামাজিকতা, আচার ব্যবহার বা শান্তভাব দেখেছি, হঠাৎ এখানে ষোল বছরের মেয়েদের কাছে সেটা আর খুঁজে পেলাম না, আর আমি তাদের সাথে খুব সাবলীলভাবে মিশতেও পারলাম না।
সেকেন্ডারী ফিফথ বা গ্রেড ইলেভেন এর আগ পর্যন্ত ব্রেবিউফ থাকে শুধুমাত্র ছেলেদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে। যখন মেয়েরা ভর্তি হয়, তখন রাতারাতি এক’শ চল্লিশ জন ছেলের দলে ষাট জন মেয়ে ঢুকে পড়ে। যখন এই নিয়মটা চালু হয়েছিল, তখন নিশ্চয় ভাবা হচ্ছিল এটা খুবই সুন্দর আর প্রগতিশীল এক ধারণা। কিন্তু আসলে এটা ছিল একটা সামাজিক গবেষণা কার্যক্রম যাতে গবেষকরা দেখতে চেয়েছিলেন, কিশোর-কিশোরীরা একসাথে পড়লে সেটা কি ধরনের ফল বয়ে আনে।
আমার একটা মেয়ের কথা মনে পড়ছে, তার নাম ছিলো জেনেভিএভি। তার সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল অটোয়ার লাইসী ক্লাউডেল ফরাসী স্কুলে, যেখানে আমি সামান্য কিছুদিন পড়াশুনা করেছি। তখন আমাদের দুজনের মধ্যে ভালোই বন্ধুত্ব ছিল। সে আমার গার্লফ্রেন্ড ছিল না, তবে অবশ্যই সে এমন একজন মেয়ে ছিল যে আমার বন্ধু ছিল। যদিও আমাদের শেষ দেখা হবার পর চার বছর কেটে গিয়েছিল, কিন্তু ঐ যে বছরগুল অর্থাৎ বারো থেকে ষোল, সেটা আমাদের বেড়ে উঠা জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা অধ্যায় ছিল, কারণ ঐ সময়ের মধ্যেই আমাদের জীবনে পরিপক্কতা আসে আর ব্যক্তিত্বের একটা উন্নয়ন ঘটে। অনেকদিন পর আমি যখন তার দিকে একটু হেঁটে গিয়েছিলাম, আমি বুঝতে পেরেছিলাম, তার সাথে স্বাভাবিক মেলামেশার যে ক্ষমতা সেটা আমি হারিয়ে ফেলেছি। তার সাথে শুরুতে কথা বলতে গিয়ে আমার মনে হয়েছিল, আমার জিহŸা আড়ষ্ট হয়ে আসছে। আমি তার সাথে সেই আগের মত সেই খেলাধুলার যে পরিবেশ তা তৈরী করতে পারলাম না, এমনকি তার প্রতি কোনো দৃষ্টি আকর্ষণ করার মত কিছুই আমি করতে পারলাম না, নিদেনপক্ষে আমি পারলাম না তার কাছে আমার ইতিবাচক অভিব্যক্তিটি তুলে ধরতে। (চলবে)
মনিস রফিক ঃ চলচ্চিত্রকর্মী, টরন্টো, কানাডা