মালেক ইমতিয়াজ : খেয়াল করলে দেখা যায় “ইক্বরা” পড়ো শব্দ দিয়েই ইসলাম ধর্মের সূচনা হয়েছে। আল্লাহর ফেরেশতা জিব্রিলে আমিন নবীকে প্রথমেই আহবান জানান পড়ার জন্য। নবী মুহম্মদ দঃ নিজেও পরবর্তীতে মানব জাতির জন্য শিক্ষাকে ফরজ বা আবশ্যকীয় বলে উল্লেখ করেছেন।

এবার দেখা যাক সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে পড়াশোনা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। ছেলে হোক মেয়ে হোক, প্রাপ্ত বয়সে বিয়ের পিড়িতে বসতে গেলে প্রথমেই প্রশ্ন ওঠে ছেলে বা মেয়ের পড়াশোনা কতটুকু? আসা যাক চাকুরির বাজারে। সে ক্ষেত্রেও একাডেমিক যোগ্যতা অপরিহার্য। এ সব তো গেল জীবনের খুবই মৌলিক ব্যাপার। ধর্মকর্ম ছাড়াও দৈনন্দিন জীবনে রাস্তাঘাটে চলাচল, দোকানপাটে কেনাকাটা সর্বোপরি বাইরের মানুষের সাথে কমিউনিকেশনের ক্ষেত্রেও মিনিমাম পড়াশোনা থাকা জরুরি।

এর বাইরে কন্টিনিউইং এডুকেশন বলে যে কথাটি আমরা প্রায়ই শুনি, তা প্রত্যেকের জন্য নিতান্তই জরুরি। আর এই এডুকেশনটি একেবারেই জীবনঘনিষ্ট। এটার জন্য আলাদা কোন প্রতিষ্ঠানে রেজিষ্ট্রেশন করতে হয় না। ক্লাশ করাও জরুরি নয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে আমাদেরকে পাঠাভ্যাস গড়ে তুলতে হয়। পাঠাভ্যাস না থাকলে হঠাৎ করে কোনকিছু পড়ার প্রতি আগ্রহ গড়ে উঠে না। দীর্ঘদিন পড়াশোনা না করলে একরকম আলসেমি বাসা বাঁধে আমাদের মস্তিষ্কে। অথচ দৈনন্দিন জীবনে পড়ে পড়ে জানার এই অভ্যাস থাকাটা খুবই জরুরি। এই ধরুন, কোনও প্রসেস ফুডের লেবেলে লেখাগুলো না পড়েই নিয়ে এলেন কোনও খাদ্যদ্রব্য। যাতে রয়েছে এ্যানিমেল ফ্যাট (হারাম হালালের ব্যাপার আছে), কোলেস্টেরলের পরিমাণ, সুগারের পরিমাণ অথবা সোডিয়ামের পরিমাণ বেশি। অথচ এ সব আপনার শরীরের জন্য ক্ষতিকর। কিংবা মেয়াদ উত্তীর্ণ কোন খাবার নিয়ে এলেন বাসায়। দৈনন্দিন জীবনে এমন সহস্র জিনিশ হয়তো আছে যা পড়া ও জানা আপনার জন্য জরুরি। উল্লেখিত বিষয়সমূহ ছাড়াও আপনার স্কুলগামী ছেলেমেয়েরা আপনার সম্পর্কে ধারণা করতেই পারে যে, সব বিষয়ে আপনার মোটামুটি নলেজ আছে। একাডেমিক প্রশ্নের বাইরেও আপনার ছেলেমেয়েরা চলমান বিষয়ে কিছু জানতে চাইতে পারে। হয়তো আপনি লেখাপড়া করেছেন ঠিকই। তবে কন্টিনিউইং এডুকেশন না থাকার কারণে আপনার জানাশোনাটা সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। আপনি ছেলেমেয়েদের কোন প্রশ্নেরই জবাব দিতে পারবেন না। আপনার পড়াশোনা ঝালিয়ে নিতে নিয়মিত পড়াশোনার অভ্যাস থাকা জরুরি। একাডেমিক বইপত্রের বাইরে আমরা যে সব বইকে আউট বই বলে জানি, সে সব পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হ’বে। বইপড়ার অভ্যাস থাকলে অনেক স্বাস্থ্য ও সমাজ সচেতন বিষয়ে আমরা এ্যাক্টিভ থাকতে পারি। নিরাপদ থাকতে পারি।

নিয়মিত পত্রপত্রিকা পড়লেও আমাদের কন্টিনিউইং এডুকেশনের লক্ষ্যটা পূর্ণ হয়ে যায়।
এক সময় বাস, ট্রেন ও প্লেনে যাতায়াতের সময় হাতে হাতে বই ও পত্রিকা দেখা যেত। আজকাল মুঠোফোন, ট্যাবলেট ও লেপটপে টেপাটেপিই চোখে পড়ে বেশি। বই বিমুখ হয়ে ওঠেছে সবাই। বইপড়াটা আমরা ক্রমশ ভুলেই যাচ্ছি। বইয়ের ঘ্রাণ আমাদেরকে আর তেমন টানে না। পত্রপত্রিকার প্রতিও আমরা আগেকার সেই একাগ্রতা হারিয়ে ফেলেছি।

প্রযুক্তির সহজলভ্যতার কারণে বই ও পত্রপত্রিকার পাঠক দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। অথচ প্রযুক্তির প্রতি অধিকতর ধাবিত হওয়ায় আমাদের জীবনে প্রযুক্তি আশীর্বাদের চাইতে অভিশাপ কি না সেটাই এখন গবেষণার বিষয়! সোস্যালমিডিয়ায় ডুবে থাকার কারণে প্রতিদিন ঘন্টার পর ঘন্টা আমরা অপচয় করি। অনেক সময় ভালো জিনিসের চাইতে সোস্যালমিডিয়ার মন্দ বিষয়গুলোই আমাদেরকে টানে বেশি। পরচর্চা, প্রোপাগান্ডা, ফেইক খবরাখবরে সয়লাব ফেইসবুকে। এ সব থেকে উপকারের চাইতে অপকারই হয় বেশি।
বর্তমানে দুনিয়াজুড়ে দীর্ঘ লকডাউনের ফলে একধরনের ডিপ্রেশনে ভুগছেন অনেকেই। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এই লকডাউনের প্রভাবগুলো বেশ লক্ষণীয়। সম্ভবত আমাদের জীবনের অফুরন্ত ব্যস্ততার মাঝে হঠাৎ পেন্ডামিকের এই ছেদ পড়াতে জীবনের স্বাভাবিকতা বিনষ্ট হয়ে পড়েছে। দেখা দিচ্ছে বিভিন্ন শারীরিক উপসর্গ। প্রেশার বেড়ে মনমেজাজেও কর্কশ প্রভাব পড়ছে। বাড়ছে পারিবারিক ঝগড়াবিবাদ। এই পরিস্থিতিতে যথাসম্ভব শারীরিক এক্সারসাইজ অব্যাহত রাখা খুব জরুরি। মানসিক বিষণ্ণতা থেকে মুক্তির জন্য বই পড়ার অভ্যাসও গড়ে তুলতে হবে। ডিপ্রেশনমুক্তির পাশাপাশি এই অফুরন্ত সময়টাকে আমরা বই পড়ার কাজে লাগাতে পারি।

বাড়ি বসেও বই কিনতে পারেন রকমারি ও সরাসরি প্রকাশনী এমনকি আমাজন থেকে। তাছাড়া পাবলিক লাইব্রেরি থেকেও বই ধার এনে পড়া সম্ভব।

লকডাউনের এই সুযোগে আমাদের জানার পরিধিটা বাড়াতে পারি। কেননা আমাদের জানার পরিধিটা খুবই সীমিত। এ প্রসঙ্গে কয়েকটি উদাহরণ দেয়া যায়। কয়েকদিন আগে এক মহিলা বাইবেল সম্পর্কে দাওয়াত দিতে আমাকে ফোন করলেন। বলে রাখা ভালো ধর্মগ্রন্থ সমূহের মধ্যে আল কোরআন ছাড়া বাইবেলও মোটামুটি আমার পড়া আছে। তাছাড়া আহমেদ দিদাতের ‘দি চয়েস’ ইসলাম এন্ড ক্রিশ্চিয়ানিটি বইটি পড়ার কারণে খৃস্টান ধর্ম ও বাইবেল সম্পর্কে একটা পরিস্কার ধারণা পাওয়া যায়। তো মহিলা টেলিফোনে আমাকে জিসাস তথা ঈসা আঃ সম্পর্ক বুঝাতে চাইলেন। আমি মহিলাকে প্রশ্ন করলাম তুমি কি জানো একজন মুসলমানকে ঈসা বা জিসাসের উপর পূর্ণ বিশ্বাস রাখতে হয়। নতুবা সে মুসলমান হ’তে পারবে না। সেটা তিনি জানতেন না বলে জানালেন। আমি এবার পাল্টা প্রশ্ন করলাম তুমি কি বিশ্বমানবতার শেষ নবী মুহম্মদকে বিশ্বাস করো। ঈসা আবার পৃথিবীতে নবী মুহম্মদ দঃ এর প্রবর্তিত ইসলাম ধর্মের দিকেই দুনিয়ার মানুষদের আহবান করবেন। মহিলা সরাসরি জানালেন তিনি তাও জানেন না। খুব সুন্দর করে আমাকে বুঝাতে লাগলেন জিসাস আল্লাহর পুত্র। আমি তার এই কথাকে খণ্ডন করে ‘বাইবেল’ ও আহমেদ দিদাদ এর ‘দ্যা চয়েস’ ইসলাম এন্ড ক্রিশ্চিয়ানিটি এর রেফারেন্স দিলাম। কথায় কথায় যেটা জানা গেল মহিলা পুরো বাইবেল কখনও পড়েন নাই। বরং জিসাস আল্লাহর পুত্র, দুনিয়া পংকিলতায় ভরে গেছে খুব শীঘ্রই জিসাস এসে দুনিয়াবাসীকে এই নিশ্চিত বিপর্যয় থেকে রক্ষা করবেন এইটাই ছিল তার দাওয়াতের মুখ্য বিষয়। আমি মহিলাকে বললাম বাইবেলের কোথাও জিসাস নিজেকে আল্লাহর পুত্র বলে দাবি করেননি। অন্যদিকে বর্তমান বাইবেল মূল বাইবেল নয়। এটাতে বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তন আনা হয়েছে। বাইবেল বিশ্বাসীরা শুরু থেকেই তাদের অপছন্দনীয় অংশটুকু বাদ দিয়ে দিতেন। মনে হল মহিলা এবার একটু চিন্তায় পড়ে গেলেন। এ সব সম্পর্ক মহিলার না জানার ব্যাপারটি অকপট স্বীকার করলেন। আমি মহিলাকে বাইবেল, কোরআন ও আহমেদ দিদাদ এর দ্যা চয়েস পড়ার অনুরোধ করলাম। পড়া শেষ হ’লে আমাকে আবার কল করতে বলি। কয়েক মাস হয়ে গেছে এখনও কল আসেনি।

হিন্দু ধর্মের কোন নির্দিষ্ট বই আমার কখনও পড়া হয়নি। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত কিছু বিষয়ভিত্তিক লেখা মাঝেমধ্যে পড়েছি। পারিবারিকভাবে আমাদের এলাকার একটি হিন্দু পরিবারের সাথে খুবই ঘনিষ্টতা ছিল। তাদের বাড়িতে অনেকবার যাওয়া আসা করেছি ছোটবেলায়। তারাও আসতেন। তাদের বাড়ির খাবারদাবার খেয়েছি। পূজাপার্বণেও তাদের প্রাসাদ খেয়েছি। একবার এক শিক্ষিত হিন্দু ভদ্রলোককে হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে একটি মৌলিক প্রশ্ন করেছিলাম। কখনও জবাব পাইনি। উপরন্তু যা বুঝলাম নিজের ধর্মীয় পুস্তকের প্রতি উদাসীনতা রয়েছে। ধর্মীয় বইগুলো কখনোই সম্পূর্ণ পাঠ করেননি তিনি।

মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে স্বনামধন্য একজন শিশু সাহিত্যকের সাক্ষাতকার শুনলাম। তিনি একজন মুসলমান।

কথাপ্রসঙ্গে মিলাদ মাহফিলের দরূদপাঠকে কোরআনের সূরা বলে উল্লেখ করেছেন। তারও কিছুদিন আগে ফেইসুকে একজনের একটি স্ট্যাটাসে উল্লেখিত হাদীসকে কোরআনের সূরা বলে জোরেশোরে মতামত দিয়েছেন একজন কবি। উনিও একজন মুসলমান। নিজ ধর্ম সম্পর্কে নিয়মিত বিদ্বেষ ছড়ান লেখালেখিতে। অথচ নিজ ধর্মের মৌলিক ব্যাপারেও তিনি বহুবার অজ্ঞতা জাহির করেছেন। তারও কিছু আগে ড. জাফর উল্লাহ একটি টকশোতে ধর্ম সম্পর্কে কথা বলতে শেষপর্যন্ত নিজের অজ্ঞতার কথাই স্বীকার করেন। দেখলাম এখন তিনি কোরআন পাঠ শিখছেন।হয়তোবা কোরআন অধ্যয়নও করবেন। উল্লেখিত চিত্রগুলো প্রতিটি ধর্মের বিশ্বাসীদের মাঝে পাওয়া যাবে। দেখা যাবে আমাদের পুরো জীবনই কেটে গেছে একটি ধর্ম বিশ্বাসকে লালন করে। হয়তো কিছু ধর্মীয় আচার আচরণের অনুশীলনও করলাম অথচ পুরো ধর্মগ্রন্থটি কখনও পড়াই হয়নি।বরং অজ্ঞতাবশত ধর্মের পক্ষে বিপক্ষে কথাও বলতে দ্বিধাবোধ করি না আমরা।

আমার এই লেখার মূল উদ্দেশ্য ধর্মের দাওয়াত নয় বরং আমরা যে যার ধর্মীয় গ্রন্থ জীবনে অন্তত একবার হলেও অধ্যয়ন করা জরুরি।মনে রাখতে হবে, যে ভিত্তির উপরই কোনও ধর্মীয় গ্রন্থ প্রবর্তিত হোক না কেন প্রত্যেক ধর্ম-গ্রন্হেই ভালো কথা থাকে। সে বিষয়গুলো অন্তত জানা দরকার। কতটা মানবেন অথবা মানবেন না সেটা আমাদের ব্যক্তিকেন্দ্রিক বিবেক বিবেচনার বিষয়।

মনে রাখতে হবে বইপাঠে শুধু ধর্মীয় জ্ঞান নয় এতে আনন্দ আছে,আলো আছে, জগৎ ও জীবনবোধের চিন্তার খোরাক থাকে।ভালোমন্দ বিচারের দিক নির্দেশনাও থাকে একটি বইতে। সর্বোপরি আমাদের কন্টিনিউইং এডুকেশনের জন্য বই পড়ার বিকল্প নেই। আমাদের চারপাশটা জানতে হ’লে,জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষতা ও নিজেদের ধর্মীয় বিশ্বাসের মূলকথা বুঝতে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা দরকার। আসুন বই পড়ি নিজেকে প্রতিদিন সমৃদ্ধ করি। বই হোক আমাদের জীবন-ঘনিষ্ট বন্ধু।