মইনুল হাসান : যন্তরমন্তর ঘরের কথা আমরা পড়েছি গল্প-উপন্যাসে। দেখেছি সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রেও। সে ঘরে ঢুকলেই মানুষের বোধবুদ্ধি সব লোপ পেত। ‘কর্তৃপক্ষ’ যা বলতে বা শেখাতে চাইত, লোকজন তা–ই বলত বা শিখত। ২০২০ সালে এত ঝঞ্ঝাটে না গেলেও চলবে। এখন যন্ত্র বলে দেবে আপনি কী ভাবছেন, ঠিক এই মুহূর্তে আপনার মনের কথাটি কী? অন্তত সে রকম যন্ত্র নিয়ে যে মোটামুটি সফল গবেষণা হয়ে গেছে, সেটা আমরা জানতে পারছি।
কিছুদিন আগেও যা ছিল কল্পকাহিনির উপজীব্য বিষয় আর অনেকটাই অকল্পনীয়, আজ তা বাস্তবতা হতে চলেছে। নিজের হাতের তালুতে জাঁকিয়ে বসা মুঠোফোনের দিকে তাকালেই এ কথা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। আমাদের অন্দরমহলে ঢুকে যাওয়া মুঠোফোনের পর এবার মনের গোপন বাসনা, ভাবনাচিন্তা, না–বলা কথাকে প্রকাশ করার যন্ত্র উদ্ভাবনের প্রক্রিয়া চলছে।
এই বিস্ময়কর কাজ সম্ভব করেছেন তিনজন বিজ্ঞানী। তাঁরা হলেন সানফ্রান্সিসকোতে অবস্থিত ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক জোসেফ মাকিন, ডেভিড মোসেস ও এডওয়ার্ড চ্যাং। এই তিন আমেরিকান বিজ্ঞানী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে মস্তিষ্কের সংকেতগুলো বোধগম্য করে সঠিকভাবে ভাষান্তর করতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁদের এমন গবেষণালব্ধ বিস্ময়কর ফলাফল গত ৩০ মার্চ নেচার নিউরোসায়েন্সে প্রকাশিত হয়েছে। ফেসবুকের অর্থায়নে এই গবেষণা পরিচালিত হয়। এ কাজ করার তাদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হচ্ছে যাঁরা কথা বলতে অক্ষম, কোনোভাবেই মনের কথা বলতে পারছেন না, তাঁদের সাহায্য করা। যেমন ধরা যাক, একটি হাসপাতালে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন একজন হতভাগ্য রোগী। তিনি খুব তৃষ্ণার্ত অথচ কোনোভাবেই কাউকে বোঝাতে পারছিলেন না তাঁর তৃষ্ণার কথা। এ জন্য আর ভাবতে হবে না, তাঁর এমন জলপানের ইচ্ছার স্নায়ু-বৈদ্যুতিক সংকেত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ঠিকই ধরতে পারবে এবং সরাসরি তা অন্যদের জানিয়ে দেবে।
আরেকটি উদাহরণ, একজন মৃত্যুপথযাত্রী একটি অন্তিম ইচ্ছা তাঁর নিকটজনদের জানাতে খুবই উদ্গ্রীব, তিনি ঠোঁট নাড়ছেন কিন্তু অন্যের শোনার মতো শব্দ করে উচ্চারণের শক্তিটুকুও আর অবশিষ্ট নেই। তখন তাঁর স্নায়ুতন্ত্রে যে উদ্দীপনার সৃষ্টি হবে, তা–ই যথেষ্ট হবে তিনি কী বলতে বা বোঝাতে চাইছেন, তা নির্ভুলভাবে বুঝে নিতে।
এ গবেষণার জন্য তাঁরা বেছে নিয়েছিলেন চারজন মৃগী রোগীকে। প্রতি রোগীর মস্তিষ্কের বিশেষ একটি অংশে (পেরিসাইলিয়ান করটেক্স) ২৫০টি করে ইলেক্ট্রোড অর্থাৎ বিদ্যুদ্বাহক স্থাপন করেছিলেন। এরপর প্রথম পর্যায়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যাতে মস্তিষ্কপ্রেরিত সংকেত সঠিকভাবে চিহ্নিত বা শনাক্ত করতে পারে, সেদিকে খেয়াল রেখে এই চারজনকে ২৫০টি ভিন্ন ভিন্ন শব্দের মধ্যে সীমিত ৩০ থেকে ৫০টি বাক্য উচ্চ স্বরে পাঠ করতে বলা হয়। তাঁরা প্রায় ৪০ মিনিট ধরে তা করেন। এ সময়ের মধ্যেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভিন্ন ভিন্ন শব্দ উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের মস্তিষ্কের সংকেত আদান-প্রদান অর্থাৎ ক্রিয়াকলাপকে শনাক্ত করে এবং তা স্মৃতিতে সংরক্ষণ করে।
এমন গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল স্নায়ু বা নিউরোন প্রেরিত সংকেতের অর্থ উদ্ধার করা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা স্নায়ুর মানুষের চিন্তাভাবনা, মনের ভাবের সঙ্গে সম্পৃক্ত সংকেত দিয়েই যন্ত্র চালিত কৃত্রিম কণ্ঠস্বরে কালক্ষেপণ না করেই মনের কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে পারবে। এই যন্ত্রনির্ভর দোভাষীর কাজ হচ্ছে একজন মনে মনে কী বলতে চাইছে, তা ব্যক্ত করা। সোজাভাবে বলা চলে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মনের ভাষাকে কথ্য ভাষায় রূপ দিয়ে একজন দক্ষ দোভাষী হিসেবে কাজ করতে সক্ষম। দক্ষ বলা হয়েছে এ জন্যই যে গবেষকদের উদ্ভাবিত এ পদ্ধতিতে (১) মাত্র ৩ শতাংশ ভুল লক্ষ্য করা গেছে, যা খুবই নগণ্য, ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না এবং (২) প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মস্তিষ্কের স্নায়ু সৃষ্ট তড়িৎ সংকেতকে কথ্য ভাষায় রূপ দিতে সক্ষম। তবে এই কথ্য ভাষা আপাতত ইংরেজিতেই সীমাবদ্ধ।
তবে মনের ভাষা বোঝার চেষ্টা এই প্রথম নয়; যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব বোস্টনের গবেষক ফ্র্যাঙ্ক গেন্টার ২০০৭ সালে লকইন সিনড্রোমে পক্ষাঘাতগ্রস্ত এক ব্যক্তির মস্তিষ্কে ইলেক্ট্রোড স্থাপন করে স্নায়ু উদ্দীপনার পাঠোদ্ধার করার প্রচেষ্টা করেন। এ ছাড়া স্নায়ুবিশেষজ্ঞ ফিলিপ কেনেডিও এমন ধরনের গবেষণা করছিলেন। সে সময় তাঁদের গবেষণায় আজকের এমন বুদ্ধিমান কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নির্ভুল গাণিতিক গণনার সাহায্য পাওয়া যায়নি। আর তাই তা ছিল অনেকটাই প্রাথমিক পর্যায়ের। প্রথম দিকে কথা অর্থাৎ মনের ভাব মস্তিষ্কের যে স্থানে উদ্দীপনা সৃষ্টি করে, সে স্থান অন্য স্নায়ুবিজ্ঞানীরা অনেক আগেই শনাক্ত করে রেখেছিলেন বলেই এই তিন বিজ্ঞানীর কাজ অনেকটাই সহজ হয়েছিল। তাঁরা এ গবেষণায় দক্ষভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অর্থাৎ নির্ভুল গাণিতিক গণনার (অ্যালগরিদম) সাহায্য নিয়েছেন। প্রথম দিকে যাঁরা এমন গবেষণা করেছিলেন, তাঁরা এই সুবিধাটি নিতে পারেননি।
আবারও মুঠোফোনের প্রসঙ্গে ফিরে আসতে হচ্ছে। আরেকজন মার্কিন বিজ্ঞানী ও উদ্ভাবক মার্টিন কুপার চেয়েছিলেন ল্যান্ডসেটকে তারের বাঁধন থেকে মুক্তি দিতে। হ্যান্ডসেট আসার পর ঘরের চৌহদ্দির মধ্যেই ঘুরেফিরে, শুয়েবসে ফোনালাপে বিলাসিতা এল। দেখতে দেখতে সেই সেট ঘরের বাইরে চলে এল। এখন মুঠোফোন দিয়ে অনেক কাজ করিয়ে নেওয়া যায়। তবে মুঠোফোনের নেতিবাচক ব্যবহারও কম হচ্ছে না। অনেক দেশ মুঠোফোনের বদৌলতে তাদের নাগরিকদের সব ব্যক্তিগত খবরাখবর জাতীয় পর্যায়ে সংরক্ষণ করছে। ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ, রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা, কার কার সঙ্গে সখ্য ইত্যাদি একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় আর ব্যক্তিগত থাকছে না। এমনভাবে কাউকে উলঙ্গ করা খুবই অসম্মানের আর সে কারণেই অনেকেই এতে আপত্তি তুলেছেন।
এমনিভাবে আজকের মনের খবর নিতে মাথায় ইলেক্ট্রোড স্থাপন করতে হচ্ছে। এমন একদিন আসবে, তখন আর তার প্রয়োজন হবে না। বিনা তারেই মনোজগতের সঙ্গে সহজেই সব ভাষায় যোগাযোগ করা যাবে। মনের কথা জানার মেশিন মুঠোয় নিয়ে অনেকেই ঘুরে বেড়াবেন। তখন টুপ করে কারও মনের ভেতরে ঢুকে জেনে নেওয়া যাবে তাঁর মনের একান্ত সব কথা। তখন নিজের মন, নিজস্ব ভাবনাচিন্তা বলতে আর কিছু থাকবে না। মানুষের আবেগ-অনুভূতির জায়গাটি খুব বেশি স্পর্শকাতর। তাই মনের কথা বলার মেশিন চিকিৎসার জন্য সীমাবদ্ধ রাখলেই তা হবে অনেক বেশি মঙ্গলের এবং সেটাই করা উচিত হবে। আর তা যদি না করা হয়, তাহলে তা হবে বিজ্ঞানের অপব্যবহার। মানুষ নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে আশ্রয় নেবে ভার্চ্যুয়াল জগতে। ভালোবাসার চিঠি আর লেখা হবে না।
সূত্র: নেচার নিউরোসায়েন্স
লেখক: অণুজীববিজ্ঞানী এবং ফরাসি বিচার বিভাগে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত।