মনিস রফিক : কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।

পঁচাত্তর…
কানাডার এই সাফল্য কারও কাছ থেকে এমনি এমনি পাওয়া যায় নি, এমনকি এটা স্রষ্টাও আপনা আপনি দেন নি, সেটা অর্থনৈতিক ক্ষেত্র বা অন্য যে কোন ক্ষেত্রেই হোক না কেনো। এটা অতীতে ঘটেছিল, এমনকি এখনও এটার ধারাবাহিকতা চলছে, আর এটা সম্ভব হয়েছে কারণ কানাডার জনগণ এটা বাস্তবায়িত করেছে। যখন এই সামগ্রিক উন্নয়নের বিষয়টা কেউ ভাগ করে দেখতে চায়, তখন হীনমন্য বা স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভেদের বিষয়টাকে সামনে আনে এবং নিজেদের হীন অভিপ্রায়কে বড় করে দেখে। আমি এখন সত্যিই গর্বোবোধ করি এই ভেবে যে, কুইবেকবাসী এখন সত্যি সত্যিই সচেতন হয়েছে এবং দেশটাকে ভাগ করার যে রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিল এবং সেটা যে আমাদের এই দেশটার আধুনিক ইতিহাসে একটা বিরাট ভুল হতে যাচ্ছিল, তা তারা অনুধাবন করতে পেরেছে। আমার সব সময় এমনই বিশ্বাস ছিল যে এমনটাই হবে। বলা হয়, আমাদের স্মরণ রাখা উচিৎ পার্টি কুইবেক এর ‘চার্টার অব ভ্যালুজস’ এর অনেক কিছুই লেখা হয়েছে অর্থনৈতিক এক হতাশা থেকে, বিশেষ করে যা সচারচর দেখা যায় বড় বড় শহরের বাইরের এলাকাগুলোতে। আমাদের অবশ্যই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য ফলপ্রসূ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে, নতুবা ভবিষ্যতে আমরা এমন আরও আরও রাজনীতি দেখবো।

এটা সত্য, সে যাই হোক, কানাডা এখান থেকে বের হয়ে এসেছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ক্ষয়ে যাওয়ার সেই কঠিন বাস্তবতা ভালোভাবে টের পাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কম বহুজাতিক উন্নত দেশগুলো। আমাদের অনেক বেশী প্রাকৃতিক সম্পদ এবং স্বল্প জনসংখ্যা কিন্তু আমাদের নিশ্চিত করেছে, যে কোন খারাপ অবস্থা আমরা মোকাবেলা করতে পারবো। আমরা এটাও দেখি, আমাদের যুগোপযোগী নীতির ফলে কানাডার অসংখ্য মেধাবী নারী কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেছে এবং তারা খুবই ভালোভাবে উপার্জন করতে পারছে। আর এটার ফলে একদিকে যেমন নিজেরা ভালোভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছে, ঠিক তেমনি তারা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি বাড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের অবশ্যই এই ইতিবাচক উন্নয়নের জন্য সামগ্রিক বিষয়টাকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিৎ। আমাদের সর্বোতোভাবে তাদের বুঝা প্রয়োজন এবং তাদেরকে সমর্থন করা প্রয়োজন। কিন্তু অবশ্যই আমাদের এমন কিছু করা উচিৎ নয়, যাতে তারা যে কোন সমস্যার বাস্তবতাকে লুকিয়ে রাখে। ১৯৮০ সালের পর থেকে কানাডার মধ্যম আয় একেবারে বাড়ে নি। তার মানে গত ত্রিশ বছরে কানাডার সাধারণ জনগণের সত্যিকারের উন্নয়ন তেমন হয় নি। এই সময়ে কিন্তু দেশের অর্থনীতি দ্বিগুণ আকার ধারণ করেছে। একবিংশ শতাব্দীতে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জীবন যাপনের সংগ্রাম কিন্তু একটা প্রধান সমস্যা, আর এটা খুব সহজে নিষ্পত্তি হওয়ার নয়। এবং কখনই এটার সমাধান হবে না, যদি এটার বাস্তবতা আমরা লুকিয়ে রাখি, বা ভাব দেখাই এটার কোন অস্তিত্ব নেই, এমনকি যদি আমরা একে অপরকে সব সময় দোষ দিতে থাকি। অথবা এক অঞ্চলের মানুষ অপর অঞ্চলের মানুষকে কেবলই দোষারপ করি।

আমার চারপাশের অনেকেই আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছে, এটা অনেক বড় এক সমস্যা, আর একে সামলানো খুব সহজ একটা ব্যাপার নয়, সে জন্য সহজ কোন বিষয়কে কেন্দ্র করে আমার প্রচারণার কাজ চালিয়ে যাওয়া উচিৎ। যারা এমন কথা বলেছে অর্থাৎ এটা তেমন কোন একটা বিষয় নই, সেটা সরকারের মধ্যে হোক, বা এর বাইরে হোক, আমি শুধু তাদের দিকে আমার ঘাড়টা নাড়িয়েছি। তারা অনেকেই বলেছে, এটা শুধু মাত্র ভোট চাওয়ার জন্য সাধারণ মানুষের অনুভ‚তিকে একটু নাড়া দেওয়া বা আমি একটু হৈ চৈ ফেলার জন্য এমন কিছু করতে চাচ্ছি। এমনকি যারা মনে করেন, বিষয়টা নিয়ে কথা বলা ঠিক আছে, কিন্তু এর সমাধানের জন্য কানাডার করার কিছুই নেই, কারণ বিষয়টা সাথে জড়িয়ে আছে বৈশ্বিক কিছু বিষয়। এর মধ্য প্রথম পক্ষের যারা, তাদের দিকে একটু লক্ষ্য রাখলেই বুঝতে পারি, গত দশ বছর ধরে কনজারভেটিভ’রা ক্ষমতায় আছে, কিছু সাধারণ কানাডাবাসীর চিন্তা থেকে তারা অনেক দূরে। আর দ্বিতীয় পক্ষের কথা বলতে গেলে বলতে হয়, একটা দেশের ঈপ্সিত পরিবর্তনের জন্য তারা তেমন কোন স্বপ্ন দেখারও ক্ষমতা রাখে না। একটা দেশের ঈর্ষনীয় ইতিহাসে আমরা অনেক কম সম্পদ নিয়ে অনেক বড় বড় সমস্যার সমাধান করেছি। আমরা সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে উপযুক্ত মানুষের দ্বারা সুষ্ঠুভাবে এটারও সমাধান করতে পারি। এটাই হচ্ছে, সবার সম্মিলিত অংশগ্রহণের এই ভ‚মিতে সবাই মিলে কাজ করা আর এগিয়ে যাওয়া।

এই আশার স্বপ্ন ও লক্ষ্য নিয়ে আমি আমার যাত্রা শুরু করি এবং সবাইকে মনে করিয়ে দিই, এটার জন্য প্রয়োজন ‘কঠোর পরিশ্রম’। কুইবেকে আমার এই প্রচারণার শুরুর প্রথম সপ্তাহ পর আমি যাই আলবার্টা, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, অন্টারিও এবং আটলান্টিক পাড়ের প্রভিন্সগুলোতে। এই যাত্রা শেষ হবার আগে আমি ১৫৪টি রাইডিংস বা সংসদীয় এলাকায় যাই এবং ঐ এলাকাগুলোর ১৫৫টি ভিন্ন ভিন্ন কমিউনিটির মানুষের সাথে কথা বলি। আর যে সব জায়গায় আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব হয় নি, আমি ঐ সব জায়গার মানুষের সাথে সা¤প্রতিক সময়ের জনপ্রিয় প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করে যোগাযোগ অব্যাহত রাখি। আমি স্কাইপি থেকে গোগোল হ্যাঙ্গোটস আর টুইটার চ্যাটস থেকে সোপবক্স, সব কিছুই ব্যবহার করে ফলপ্রসূ যোগাযোগ চালাতে থাকি। আমি জানতাম, আমি যে প্রার্থীতার জন্য লড়ছি, সেটার জন্য সবার মনোযোগ আকর্ষণ করা খুবই জরুরী ছিল, কিন্তু তারপরও আমি জানতাম যদি সবার সামনে নিজেকে সঠিকভাবে উম্মোচিত করতে না পারি, তাহলে শুধু শুধু মনোযোগ আকর্ষণের কোন মানে হয় না। আমি এও জানতাম, কানাডার মানুষ যদি তাদের বাড়ীর সামনে কি ঘটছে, সেটা যদি পছন্দ না করে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে তারা তাদের দরজা বন্ধ করে ফেলে।

এবং যদি বন্ধ নাও করে, তবে কিছু কিছু জায়গায়, ঐ দরজা শুধু ক্ষণিক সময়ের জন্য ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ করে একটু খোলা হয়।

প্রচারণায় জাস্টিন ট্রুডো

একটি বিশেষ কারণে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আমার এই প্রচারণার যাত্রায় প্রথম থামবো ক্যালগেরীতে। যদিও আমি চেয়েছিলাম আমার এই নিরবিচ্ছিন্ন প্রচারণায় আমি মূলত দৃষ্টি দিবো কানাডার ভবিষ্যতের দিকে, কিন্তু আমি কানাডার জনগণকে জানাতে চেয়েছিলাম, আমার দলের কাঁধে যে সব ভ‚তগুলো চেপে বসেছিল আমি তাদের মুখোমুখি হতে একটুও ভয় পাই না। বিশেষ করে এটা সত্য, এই ভ‚তগুলো এক সময় আমার বাবার খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। প্রায় ত্রিশ বছর আগের ‘দ্য ন্যাশনাল এনার্জী প্রোগ্রাম’ এর অস্বস্তিকর স্মৃতি এখনও আলবার্টার লিবারেলদের মনে গেঁথে আছে, এবং সেটা আরও প্রকট হয়ে উঠে যখন কোন লিবারেল সদস্যের নামের সাথে ‘ট্রুডো’ থাকে।

সেজন্য আমি চেয়েছিলাম, আমি খোলাখুলিভাবে সবাইকে এই বিষয়টি নিয়ে কথা বলবো, এমনকি আমি তাদের জানাবো, এর যে সব নেতিবাচক প্রভাব ছিল সেগুলো সম্পর্কে আমি সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল। সেই প্রোগ্রামের উদ্দেশ্য যতই ভালো হোক না কেন, সেটা একটা বিভক্তির মধ্যে দিয়ে শেষ হয়েছিল, যে বিভক্তির অবসানের জন্য বাবা তাঁর সারা জীবন ধরে কাজ করেছিলেন, বিশেষ করে কুইবেকের সাথে অন্যান্য অঞ্চলের। সেই দিন আমি আলবার্টায় একটা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, আমার নেতৃত্বে যদি কখনও লিবারেল পার্টি ক্ষমতায় আসে, তবে আমি কখনোই পশ্চিমের সম্পদ ব্যবহার করে পূর্বের ভোট কিনবো না।

‘দ্য ন্যাশনাল এনার্জী প্রোগ্রাম’ আসলেই একটা ইস্যু ছিল, কিন্তু বাস্তবে ওটা এমন কোন বিষয় ছিল না। কানাডার পশ্চিমের মানুষকে এমনভাবে বুঝানো হয়েছিল, লিবারেলরা কখনোই পশ্চিমাদের নিয়ে খুব একটা ভাবে না। আর এটা আমাদের রাজনৈতিক বিপক্ষ সেটা ব্রায়ান মুলরোনি থেকে স্টিফেন হার্পার পর্যন্ত সবাইকে একটা সুযোগ করে দিয়েছিল, আর এতে তাঁরা যতটুকু পেরেছে আমাদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে খেপিয়ে তুলেছে আর পরবর্তী প্রজন্মকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছে লিবারেল পার্টি কখনও তাদের নিয়ে ভাবে না। তাঁদের এই প্রচারণাটা এমন ছিল যে, আমরা কখনও তাদের প্রতিনিধিত্ব করবো না, এবং আমাদের কাছে তাদের কোন স্থান নেই। ত্রিশ বছরের এই প্রচারণায় এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল, যে সমস্ত মানুষের বিষয় নিয়ে লিবারেল পার্টি কাজ করে, তারাও এই পার্টি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। ফলে তাদেরকে লিবারেল পার্টি অব কানাডায় যোগ দেওয়ার চিন্তা করায় যেত না। (চলবে)…