মনিস রফিক : কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।

চল্লিশ.
বাবার সাহচর্যে থেকে আমি কখনও ভাবতে পারিনি যে আমি রাজনীতির সাথে জড়িত হবো, বরং বাবার সব কাজ কাছ থেকে দেখে বড় হতে হতে আমি সব সময় ভেবেছি, রাজনীতি থেকে আমাকে দূরে থাকতে হবে। অতএব, বাবার রাজনীতির পথ ধরে রাজনীতিতে আসা বা বাবার নামে রাজনীতিতে জায়গা করে নেওয়ার যে কানাঘুষা আমার আশে পাশে শুনতে পাচ্ছিলাম, তাদের বুঝাতে আমাকে খুবই বেগ পেতে হয়েছে যে, আমি ব্যক্তি মানুষ হিসেবে একেবারে এক নিজস্ব সত্ত¡ার মানুষ আর আমার এই নিজস্ব সত্ত¡াকে আমি গড়ে তুলেছি আমার স্কুল, কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের যাত্রা প্রক্রিয়ায়, আর আমার বলিষ্ঠ গঠনমূলক চিন্তা ও কাজের মাধ্যমে। আমি ভাবতেই পারি না, আমার আহরিত জ্ঞান আর নিজেকে তৈরী করার আমার দীর্ঘদিনের উদ্যম ও শিক্ষাকে কেনো আমি বা কেউ খাটো করে দেখবে। আমি বিশ্বাস করি, আমার জীবনটা আমার মত করে সফলভাবে গড়ে তোলার সমস্ত যোগ্যতা আমার ছিল, ফলে আমার প্রায়ই মনে হতো, তবে এমন কোনো কিছুতে আমি কেনো অংশ নিবো, যেখানে আমার পরিচয় হবে আমার বাবার পরিচয়ে। এমন ভাবনা কিন্তু আমাকে এই রাজনীতির জগত থেকে প্রায় এক দশক দূরে রেখেছিল। আর আমার মনে হয়েছিল এই দূরে থাকাটাতে বাবার সাথে আমার যে অনাকাঙ্ক্ষিত তূলনার বিষয়টা আসে, সেটা থেকে অন্তত আমি কিছুটা মুক্তি পেয়েছিলাম। কনভেনশন যতই এগিয়ে আসছিল, আমার মনের ভিতর এমন চিন্তা বারবার ঘুরে ফিরে আসছিল।

প্যালেস দ্য কংগ্রেসে কনভেনশনের নাটকীয় মোড় ঘুরে যাওয়াও সবকিছুই অন্যরকম হয়ে যায়। আমি আমার মত আরো শত শত লিবারেল পার্টির সদস্যদের সাথে যখন পার্টি ও দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন চিন্তায় মগ্ন, তখনই আবার আমার মধ্যে বাবার সাথে আমার তুলনার বিষয়টা নাড়া দিয়ে উঠেছিল। সম্ভবত, যখন রাজনীতির বিষয় আসে তখন বাবার সাথে আমার তুলনার যে বিষয়টা আসে তাকে যথার্থ বলে ভাবতে পারি না।

বাবা তাঁর রাজনীতির শুরু থেকেই এক ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক মনোভাব নিয়ে সামনে এগিয়েছেন, এমনকি তাঁর রাজনৈতিক প্রচারণার ক্ষেত্রেও তিনি তাঁর এই বৈশিষ্ট্যটা বজায় রাখতেন। তিনি শুধু রাজনৈতিক ফায়দা লুটার জন্য বা সস্তা জনপ্রিয়তা লাভের জন্য হয়তো কোনো এক শিশুকে সবার সামনে স্নেহভরে আদর করার যে চর্চা তা থেকে সব সময় দূরে থাকতেন। মোট কথা, এ সব ক্ষেত্রে তিনি সব সময় সস্তা আবেগকে পরিহার করতেন। কনভেনশনের সেই দিনে এবং সেই জায়গায়, রাজনীতির প্রচারণার বিষয়টা ভালোভাবে অনুধাবন করতে গিয়ে আমার মনে হয়েছিল, প্রচারণার দিক দিয়ে আমি কখনও আমার বাবার মত নয়, বরং এ ক্ষেত্রে আমি আমার নানা জিমি সিনক্লেয়ারের মত। আমার নানা জিমি সম্ভবত জনপ্রিয়তার পেছনে ছুটে চলা রাজনীতিবিদদের মত ছিলেন। তিনি এমন একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন, যিনি মানুষের সাথে মিশতে ভালোবাসতেন, তাদের সাথে হাত মিলাতেন, তাদের কথা শুনতেন, এমনকি তেমন সুযোগ আসলে সবার সামনে কোনো শিশুকে কোলে নিয়ে স্নেহভরে চুমু দিতেন। রাজনীতির মাঠের এই দুই সফল মানুষের রাজনৈতিক প্রচারণার ধরণ ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। আমার কাছে এই বৈপরীত্বের বিষয়টা যত বেশি পরিষ্কার হচ্ছিল, বাবার সাথে নিজের তুলনার ভাবনাটা ততই ধীরে ধীরে আমার মাথা থেকে চলে যেতে শুরু করেছিল।

কনভেনশনে জেরাড কেনেডী’র প্রচারণা

আমি সত্যিই হতবাক আর মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম, যখন লক্ষ্য করলাম সেই কনভেনশনে উপস্থিত পার্টির সদস্যরা আমাকে এত বলিষ্ঠভাবে সমর্থন করেছিল আর আমাকে সম্মান জানিয়েছিল। জেরাড কেনেডী’র সংগঠকরা আমার জন্য একটা আলাদা দলকে তৈরী রেখেছিল যাতে আমি সদস্যদের ভীড়ের মধ্যে দিয়ে সহজে সামনে এগিয়ে যেতে পারি। জেরাডের জন্য যে ঘর রাখা হয়েছিল সেখানে কাজ করতে আমার খুব ভালো লেগেছিল, ওখানে আমি প্রতিনিধিদের সাথে বিভিন্ন বিষয়, বিশেষ করে পার্টির সদস্যদের মধ্যে সম্পর্কের বন্ধনটা আরো কিভাবে সুন্দর ও মজবুত করা যায় সে সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলাম। শুরুতে আমি জেরাডের পক্ষ থেকে সবার উদ্দেশ্যে সংক্ষেপে বক্তৃতা দিয়েছিলাম, আর আমার এই সংক্ষিপ্ত বক্তৃতাটা তাঁকে প্রতিনিধিদের সামনে নিজেকে সুন্দরভাবে তুলে ধরতে সহায়তা করেছিল। প্রতিনিধিদের সামনে জেরাডের বক্তৃতা শেষ হবার পর নির্বাচনের ফলাফলটা কোন দিকে যায় সেটা দেখার জন্য আমি ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম।

প্রথম ব্যালটের ভোট গণনায় ১৪১২ ভোট পেয়ে মি. ইগনাতিয়েফ সবার শীর্ষে অবস্থান করছিলেন। পরবর্তী তিন জনের মধ্যে ভোটের ব্যবধান ছিল মাত্র ১২৩। মি. রে পেয়েছিলেন ৯৭৭, মি. ডিওন ৮৫৬ আর মি. জেরাড দু’জনকে পেছনে ফেলে ৮৫৬ ভোট পেয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত মি. ব্রাইসন, মি. ভোলপে এবং মিজ হাল নির্বাচন দৌড় থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছিলেন। (চলবে)