তাসরীনা শিখা : পৃথিবীটা বদলে গেছে সাথে সাথে পৃথিবীর মানুষগুলো। এই ছোট জীবনের হাজারো গল্প। মনে হয় এইতো সেদিন কিশোরী ছিলাম। আনন্দে ভরা জীবন ছিলো। তরুণ জীবনের উচ্ছলতা ছিলো, প্রেম ছিলো, ভালোবাসা ছিলো, আন্তরিক বিশ্বাসী প্রাণের বন্ধুরা ছিলো। সময়ের প্রবাহে সবাই কোথায় কোথায় হারিয়ে গেছে জানি না। জীবনের একেক অধ্যায়ে একেক ব্যস্ততায় হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের কথা মনে হলেও তাদের খুঁজে বের করতে পারিনি।
ফেসবুকের গুনে আমার বন্ধুদের খুঁজে বের করার বন্ধ দরজাটা হঠাৎ করে আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে থাকা বন্ধুদের সরবে বের করে আনলো। আমার হৃদয় ময়ূরের মতো নেচে উঠলো। আমার প্রাণের ভালোবাসার পাখিটা এক নিমিষে আমাকে উড়িয়ে নিয়ে চলে গেলো আমার কিশোর আর তরুণ জীবনে। তার জন্য আমার মতো একজন ক্ষুদ্র লেখকের লেখা আমার বন্ধুদের পৃথিবীর একেক প্রান্ত থেকে আমার সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে। এযে আমার জীবনের পরম পাওয়া।
এইতো সেদিন সকালের সূর্য নতুন প্রভাতের সুরে আমার প্রাণে দোলা লাগিয়ে গেলো। সকালেই ফোন বেজে উঠলো আমার সেল ফোনের মেসেঞ্জারে। ওপার থেকে ভেসে এলো আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু লিজের গলা। লিজ আর আমি আমরা সমাজ বিজ্ঞানের সাথীই শুধু ছিলাম না আমরা ছিলাম একই হলে থাকা বন্ধু। কতো শত স্মৃতি জড়িয়ে আছে লিজের সাথে আমার। ভালোবেসে বিয়ে হয়েছিলো বাবলু ভাইয়ের সাথে। ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সুদর্শন যুবক বাবলু ভাই হলের গেটে আসতো লিজের সাথে দেখা করতে মাঝে মাঝে এক সাথে বেড়াতে যেতো ওরা। বাবলু ভাই লিজ দুজনই অসাধারণ গান করতো। পড়া শেষে বিয়ে হয়েছিলো দুজনের। সুখের সংসার বেঁধেছিলো দুজনে কিন্তু সে সংসার বেশি দিন রইলো না। বাবলু ভাই খুব অসময়ে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে লিজ ও ছোট দুটো বাচ্চা রেখে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছিলেন। সে খবর আমি অনেক পরে দেশে গিয়ে আমার বন্ধু শামার কাছে জানতে পারি। স্বামীর চাকুরীর সূত্রে নানা দেশে বাস করে কোন বন্ধুদের সাথে আমার যোগাযোগ রাখা হয়নি। দেশে গিয়ে শামার সাথে গিয়েছিলাম লিজের সাথে দেখা করতে। লিজকে দেখে আমার চোখে মুসল ধারে শ্রাবণ ধারা ঝরে পড়েছিলো। আহা এই কচি বয়সে বন্ধুটি আমার স্বামী হারা হয়ে গেলো। তারপর আর বহু বছর কোন যোগাযোগ ছিলো না। মাঝে একবার সমাজ বিজ্ঞানের অনলাইন প্রোগ্রামে কিছুক্ষণের জন্য এসেছিলো লিজ। আবারো চুপচাপ। হঠাৎ করে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আসলো লিজের কাছ থেকে আমরা ফেসবুক বন্ধু হলাম। লিজ মাঝে মাঝে আমার লেখা পড়ে দুষ্টামি করে ছাত্র জীবনের না না কথা মনে করিয়ে দিয়ে কমেন্ট দেয়। ব্যাস এতোটুকুই। কথা হয় না আর সে ভাবে। হঠাৎ করে ঘুম থেকে উঠেই লিজের ফোন মনটা আনন্দে ভরিয়ে তুললো। অনেকক্ষণ কথা হলো দুই বন্ধুর। লিজ অনেক ভালো আছে। ছেলেমেয়েরা আমেরিকার নাগরিক। যার যার স্থানে প্রতিষ্ঠিত। লিজ অর্থনৈতিক সচ্ছলতায় ভরপুর। ছেলেমেয়েদের কাছে, লন্ডনে ভাইবোন, নানা দেশে আত্মীয় স্বজনের ওখানে বেড়াতে যায়। সময়ে মানুষকে সব কিছু সহায়ে দেয়। লিজকেও দিয়েছে। এটাই জীবন।
সে রাতেই একটা ফেসবুক ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আসলো “সিরিয়া বেগম বীণা” নামে । কোন বীণা জানার জন্য ছবিতে ক্লিক করলাম কিন্তু চেহারা দেখে চেনা গেলো না। সাথে সাথে ম্যাসেজ আসলো, শিখা চিনতে পেরেছিস আমি তোর স্কুল কলেজের প্রাণের বন্ধু বীনা। ফোন করিস তোকে অনেক কথা বলার আছে শোনারও আছে। বীণা আমার স্কুল কলেজ জীবনের বন্ধু। দুই কুড়িরও বেশি সময় বীণার সাথে আমার কোন ধরনের যোগাযোগ নেই। কলেজে পড়তে পড়তে প্রেম করে বাড়ি থেকে পালিয়ে অত্যান্ত সুদর্শন তরুণ সোহাগকে বিয়ে করে ফেলে। সোহাগের বাবা মা বীণাকে গ্রহণ করেনি। তাঁরা কুমিল্লা ছেড়ে চিটাগাং চলে গিয়েছিলো ছেলের এই কাজ মেনে না নিতে পেরে। আমি আর আমার আরেক বন্ধু ঠিকানা যোগাড় করে দেখতে গিয়েছিলাম বীণাকে। বীণা ওদের বাসার কাছে একটা টিনের ঘর ভাড়া নিয়ে সংসার শুরু করেছে। খুবই দিনও হীন অবস্থা। খুবই মন খারাপ হয়েছিলো বীণাকে দেখে। আমরা রিকসাতে বসে বসে আলোচনা করছিলাম কেন বীণা এই কাজটা করতে গিয়েছিলো? পরে অবশ্য বীণার বাবা মা তাদের বাড়িতে নিয়ে এসেছিলো বীণার এমন অবস্থা দেখে। ব্যাস এতোটুকুই আমি জানতাম। এর পর বীণার সাথে আমার আর দেখা হলো না। আমি চলে এলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছুটি ছাটাতে কুমিল্লা গেছি। কিন্তু বীণার খোঁজ নেবার কোন তাগিদ অনুভব করিনি। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের নিয়ে আমার জীবন। তারপর আমার বিয়ের পর স্বামীর সাথে বিদেশ গমন। এর পর আর কোন দিন বীণার খবর রাখিনি।
আমার সে বন্ধু বীণা যার সাথে স্কুল মাঠে ছুটাছুটি করে খেলাধুলা করেছি। কলেজে আড্ডা দিয়েছি। কলেজ ক্যান্টিনে বসে চা সিঙ্গারা খেয়েছি, অহেতুক কথা নিয়ে বন্ধুরা হেসে গড়িয়ে পরেছি।
সে বীণা আমার লেখা নিয়মিত পড়ে। সে লেখা দিয়েই আমার বন্ধু আমাকে খুঁজে বের করেছে। আমার আর তর সইলো না। সময় জ্ঞান হারিয়ে আমাদের রাত আর বাংলাদেশের ভোরে আমি বীণাকে ফোন করে বসলাম। ঘুম কাতর চোখে বীণা ফোন ধরলো। আমি বেশ নাটকীয় ভঙ্গিতে বীণাকে বললাম, আমাকে চিনতে পেরেছেন? আমার কথা শুনে বীণা হো হো করে হেসে উঠলো। আমাদের দুজনের হৃদয়ে একসাথে জলতরঙ্গ খেলে গেলো। আনন্দে যেনো আমাদের দুজনের মন গোলা ভরা ধানের মতো ভরে গেলো। কই আমাদেরতো মনে হচ্ছে না দুই কুড়ি বছরের উপর আমাদের কথা নেই দেখা নেই। মনে হলো আমরা যেনো প্রতিনিয়ত কথা বলি। আমরা সেই কিশোরী-তরুণী শিখা বীণাই রয়েছি। জীবন এগিয়ে যায়। মনটা থেকে যায় সবুজ। বীণা ওর জীবনের গল্প করলো অনেক সময় নিয়ে। জীবনে প্রচুর সংগ্রাম করেছে। শ্বশুর বাড়ি অবশেষে বীণাদের মেনে নিয়েছিলো। কিন্তু ওদের সংগ্রাম চলছিলো নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। বীণা ওর স্বামীকে বলতো, আমরা কি এমন একটা বাড়িতে থাকতে পারবো না যেখানে দখিন হাওয়া ঘরে ঢুকবে। রোদের আলো এসে ঘর ভরিয়ে দেবে?
অনেক সংগ্রামের পর ওদের সংসারটা উঠে দাঁড়িয়েছিল কিন্তু বীণার স্বামী সেটা ভোগ করে যেতে পারেনি। এক ছেলে এক মেয়ে আর বীণাকে রেখে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হঠাৎ করেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। বীণা আবারো আকুল সাগরে পরে। বাবা মা শ্বশুর শাশুড়ির সহযোগিতায় ছেলে মেয়েদের প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। নিজের পড়াশুনাও শেষ করেছে স্কুলে শিক্ষকতার কাজ করেছে। সবাই ভালো আছে, বীণাও ভালো আছে। বাবার দেয়া জমিতে ছয় তালা বিল্ডিং বানিয়েছে এক তালায় বীণা থাকে পাঁচ তালা ভাড়া দেয়। ছেলে মেয়েরা মায়ের অনেক খোঁজ খবর রাখে।
বীণা খুশী আছে শুধু দুঃখ তার স্বামী এই সুখ দেখে যেতে পারলো না।
সেদিন বীণাকে খুঁজে পেয়ে আমার হৃদয়ে যে আনন্দ হিল্লোল জেগেছিলো তার বর্ণনা আমি দিতে পারবো না। সেদিন দুজন বন্ধুর সাথে কথা হলো দুজনই খুব অল্প বয়েসে স্বামীকে হারিয়েছে। তবে দুজনই ভালো আছে। লিজ অনেক বেশি ভালো আছে। জীবন বহমান নদী, কোথা থেকে কোথায় ভেসে যায় তারপর তাদের মিলন হয় সমুদ্রে গিয়ে। আমাদেরও তাই হলো। নানা দিক থেকে নানা নদী বয়ে এসে আমাদের ভাটার সময় মিলন হলো। আমার আর বিনার এই প্রাণ ভরা খুশী আমাদের আবার ভাসিয়ে নিয়ে গেলো আমাদের তরুণ জীবনে। বন্ধুরা আমাদের যেনো আর কোনোদিন বিচ্ছেদ না হয়। দেশে এলে কুমিল্লা আসবো তোর সাথে দেখা করাটাও একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে। ভালো থাকিস আমার সকল বন্ধুরা যাদের সাথে ফেসবুকের কৃপায় আবার যোগাযোগ হয়েছে। বিশেষ করে আমার লেখা পড়ে তোমরা আমাকে খুঁজে পেয়েছো।
এখন শুধু মনে পড়ে,
কতো কিছু মনে পড়ে,
মনে পরে আনন্দ ধরার মতো বয়ে যাওয়া আমদের তরুণ জীবন।
যাক না বয়ে অনেক বেলা,
তাতে কি আমিও তো ছিলাম তোমাদের সাথে,
মনে রেখো, বেলা শেষ হলেও মনে রেখো ।
মিলটন, টরন্টো, ক্যানাডা