নাহিদ কবির কাকলী : (বাংলাদেশের বিশিষ্ট রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী মিতা হক গত ১১ এপ্রিল মাত্র ৫৮ বছর বয়সে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। সংগীতে অসামান্য অবদানের জন্য ২০২০ সালে তিনি ‘একুশে পদক’ এ ভূষিত হন। মিতা হক এর ঘনিষ্ঠজন এবং তাঁর কাছে সংগীতে তালিম নেওয়া টরন্টোর পরিচিত রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী নাহিদ কবির কাকলী স্বল্প পরিসরে স্মৃতিচারণ করেছেন মিতা হক’কে নিয়ে।)

সেই কবে তোমার সংগে পরিচয় বলতো মিতা আপা? ধূর পরিচয় হবে কেন? তুমি তো আমার বিনি সূঁতোর মালায় গাঁথা বোন। ওয়াহিদুল হকের আনন্দধ্বনি পরিবারের যেদিন থেকে সদস্য হলাম, সেদিন থেকেই মিতা আপার বোনও হলাম। নাগরিক কমিটির গ্রীন রোডের অফিসে শতরঞ্জিতে বসে আমরা আনন্দধ্বনির ক্লাস করতাম। জয়িতা মুখে দুধের বোতল নিয়ে এপাশ থেকে ওপাশ গড়াগড়ি করত। কখনো আমাদের শেখাচ্ছেন ওয়াহিদ ভাই, কখনো নীলোত্পল দা। মাঝে মাঝে ওয়াহিদ ভাই বলতেন, মিতা আজ তুমি করাও।
আচ্ছা বড়দা কাকা, বলে শুরু করতেন। তাঁর সুরে ডুবে যেতাম আমরা। কী চমত্কার তাঁর শেখাবার ধরণ। কী চমত্কার তাঁর সুর প্রক্ষেপণ। আমি তাঁকে যত দেখি, ততই মোহিত হই। পারিবারিকভাবে আমার বড় ফুপুর শশুর বাড়ির আত্মীয় মিতা আপা। কিন্তু সব ছাপিয়ে সুরের টানে তাঁর কাছে বাঁধা হয়ে গেলাম চিরদিনের মত। ভালোবাসাটা একদম চুম্বকের মত কাজ করে তাঁর মধ্যে। তাঁর সংস্পর্শে যারা এসেছে তারা সবাই জানে যে মিতা হক কতটা মানবিক মানুষ। কতটা উজাড় করে ভালোবাসতে পারেন সবাইকে।

আনন্দধ্বনি যখন একটু ভাটার দিকে যাচ্ছে মিতা আপার গ্রীন রোডের এর বাসায় শুরু হলো সুরতীর্থ। সকালে যেদিন ক্লাস থাকত সেদিন গেলে দেখতাম বাড়ি ভর্তি মেহমান। যুবদা’র পরিবার ছিল বড়। ভাইবোনদের কেউ না কেউ ঐ বাড়িতেই থাকতো। হাসিমুখে বাবার একমাত্র মেয়ে অত বড় শ্বশুর বাড়ির দায়িত্ব মাথায় তুলে নিলো। সেই বসন্ত উত্সব, শহীদ মিনারে অনুষ্ঠান, এখানে সেখানে আনন্দধ্বনি পাশাপাশি চলতে লাগলো সুরতীর্থ। মনে মনে ভাবতাম ওয়াহিদ ভাইর আনন্দধবনি যদি নাও থাকে মিতা আপার সুরতীর্থ তো আছে। গানের ক্লাসের পাশাপাশি চলতো আমাদের আড্ডা। মিতা আপার বাড়িতে না খেয়ে এসেছি এমন দিন মনে পড়ে না। সারাদিন চুলো জ্বলছে স্রোতের মত মানুষ আসছে যাচ্ছে শুধু এই মানুষটির টানে। বাড়ি ফিরলাম আবার কল আসত মিতা আপার কাছ থেকে, কাকলি চলে আয় জামদানী ওয়ালা এসেছে তুই না শাড়ি কিনবি। আবার ছুটে যেতাম।

মিতা হক (বামে) এবং নাহিদ কবির কাকলী

কানাডা চলে আসবার পরও নিয়মিত যোগাযোগ হতো। দেশে যাবার আগে বলতাম, মিতা আপা কী আনব। বলতো শোন Clinic এর lotion আনবি আর পারফিউম। যতবার গিয়েছি মনে করে সেটাই নিতাম। ২০০৬-এ উদ্যোগ নিলাম মিতা আপাকে টরন্টো আনার। কলকাতা কেন্দ্রীক টরন্টো সংস্কৃতি সংস্থার সংগে যোগাযোগ করলাম। মিতা আপার সিডি দিলাম। কমিটি সিদ্ধান্ত নিলো মিতা আপাকে আনা হবে সন্মানী দিয়ে তবে হোটেল দিতে পারবে না। সেবার আনা হল শ্রীকান্ত আচার্যকে পুরো টিমসহ। এত বললাম অন্তত আমাদের তবলা শিল্পী এনামুল হক ওমরকে আনা হোক, ওনারা রাজী নন। আমি বললাম ঠিক আছে, মিতা আপা একাই আসবে, আর আমার বোন আমার বাড়িতেই থাকবে। আসলো মিতা আপা, কী আনন্দ আমার। টরন্টোর পথে-ঘাটে ঘুরে বেড়াই, দুই বোনে খাই গল্প করি আর জড়াজড়ি করে এক বিছানায় ঘুমাই। কত মজার স্মৃতি- মিতা আপা চুল straight করবে তখনও straightener বের হয়নি। আমাকে বলে শোন, আমি বিছানায় শুই তুই ইস্ত্রী দিয়ে চুল সমান কর। আমি ভয়ে মরে যাই, বলি তুমি পুড়ে যাবে তো। বলে না রে এমন করেই করতে হয়। নায়াগ্রা ঘুরতে যাই- কত কী করি। অনুষ্ঠানের দিন এলো। ভারতের কিছু মানুষ ভেবেই নিলো আমরা আবার কী রবীন্দ্রসংগীত গাই? মঞ্চে এলেন মিতা হক। টানা দেড় ঘন্টা শুধু রবীন্দ্রনাথের গানে মাতিয়ে রাখলেন তিনি। এ পরবাসে কে রবে হায় – চোখে জল এনে দিল দর্শকদের। মাথা উঁচু করে বোনকে নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। দেখিয়ে দিলাম বাংলাদেশের মিতা হক কী। অনুষ্ঠান হল কালী বাড়িতে, বাংলাদেশ সেন্টারে সব জমজমাট।

একদিন আসগর ভাই ফোন করলেন। বললেন, মিতা KFC Chicken আনছি তোমাদের জন্য। মিতা আপা বলে, শোন তুই সাদা ভাত আর ডাল রান্না কর। সেই KFC দিয়ে দুইবোন কী মজা করে ডাল ভাত দিয়ে খেলাম। শুনে সবাই হাসে। আমরা বললাম, Western food এর সাথে দেশি synchronization করলাম। চলে গেল Toronto তে এক মাস থেকে। মনটা খারাপ, আবার কবে আসবে কে জানে। ২০০৮-এ আবার এলেন পূঁজোর অনুষ্ঠানে গান করতে। যেদিন আমার বাড়িতে থাকতে এলেন টরন্টোর সব বন্ধুরা স্রোতের মত ভরিয়ে ফেলল আমার বাড়ি। রাইস কুকারে ভাত রান্না করি শেষ আবার করি। সবাইকে নিয়ে কী যে আনন্দ করলেন মিতা আপা।

যুবদা তখন অসুস্থ। সমস্ত দায়িত্ব টেনে চলছেন হাসি মুখে। এর মাঝে চলে গেলেন মিতা আপার বাবা। রাজন, খালাম্মা, যুবদা, জয়িতা শ্বশুর বাড়ি, এনাম, মিষ্টিকে আগলে রেখেছেন মিতা আপা। এরপর চলে গেল যুবদা, তারপর খালাম্মা। মিতা আপার ধরা পড়ল কিডনির সমস্যা। তবুও ভেংগে পড়েননি। কতবার যে ICU তে যেতে হলো। হাসপাতালে দেখতে গেলে বলতো দাঁড়া একটা টিপ দেই তারপর ছবি তুলি। ভাই রাজন বোঝে না এ জটিল পৃথিবী। বাবা-মা চলে যাবার পর মিতাই তার সব। মুখে তুলে খাওয়ায় মিতা আপা। জয়িতার বিয়ে হলো। মিতা আপা দিন দিন অসুস্থ হতে লাগলো। আবার ঠিকও হয়ে যায়। ঢাকাতে যখন গিয়েছি ডায়ালিসিস-এর দিন বসে থেকেছি হাত ধরে।

মিতা আপা ২ বছর আগে চলে গেলেন বাবার বাড়ি কেরানীগঞ্জে। প্রকৃতির কাছে থাকবেন pollution ফ্রি জায়গায়। কি যে ভাল লাগলো ঐ বাড়িতে গিয়ে। নিজের হাতে কতকিছু রান্না করল। আনন্দধ্বনির বন্ধু আল্পনা আর আমি গেলাম। মিতা আপা খবর দিল ওমর ভাইকে। সারাদিন ধরে সে কী আড্ডা। গত বছর শেষ দেখা তাঁর সংগে। গেলাম কেরানীগঞ্জ, আমার Mandatory visit এর জায়গা আমার মিতা আপার বাড়িতে। নিজে হাতে রান্না করে খাওয়ালেন আবার বক্সে দিয়ে দিলেন। এইতো কদিন আগে কল করলাম, বললাম মিতা আপা তোমার সেই মাসকলাইর ডালের রেসিপি বলতো। ভিডিও কলে বলল, এমন করে রান্না কর। হঠাত করে কয়েক দিন অসুস্থ হল মিতা আপা, করোনা হলো আবার নেগেটিভও হলো। আজ সকালে এনাম মিষ্টি বলল, ডায়ালিসিসের সময় প্রেসার কমে গিয়েছে, কথা বলছি না। আবার হাসপাতাল। পরে জানা গেল স্টোক করেছে, হার্টও ভাল না। লাইফ সাপোর্ট এ দিলো। বিকেলে এনাম বলল, কাকলি আপা কিছু কাজ করছে না। মিষ্টি শাহীন হাসপাতাল গেল।

শাহীন খান, মিতা আপার দেবর বলল শেষ মুহূর্তগুলোর কথা। আইসিইউ’র বাইরে মেয়ে জয়িতা, জামাই মোস্তাফিজ শাহীন আর দেবর শাহীন খান। জয়িতা বলল, আমি নিতে পারব না তোমরা যাও। ভেতরে ডক্টর বললেন, পালস নাই, তবুও আমরা ইসিজি করব। ইসিজি’র লাইনগুলো সমান্তরাল হয়ে গেল। ডক্টর বলল, মেশিন লাগিয়ে রেখে লাভ নাই, সে চলে গিয়েছে। শাহীন ভাই ডক্টরকে বললেন, খুলে দেন সব। ৫৮ বছর বয়সে চলে গেলেন অসীম পারাবারে মিতা হক। একটু পর মিষ্টি লিখলো মিতা আপা নাই।

আমার বোন নাই, আমার গুরু নাই- আমার প্রাণের পরে চলে গেল মিতা আপা। একটা সময় ছিল মিতা আপা না বাজালে গান করতে পারতাম না। সুর মনে পড়ছে না। হারমোনিয়ামে মিতা আপার হাত কোথায় দেখলেই মনে পড়তো আবার সব। টরন্টোতে যখন এসে গান করি, অনেকে প্রশ্ন করত মিতা হক আপনার কী হয়। আমি বলতাম কেন? বলতো আপনি কথা বলেন তাঁর মত, গানের স্টাইল তাঁর মত, সাজ পোষাকও। আমি বলতাম, ও তো আমার বোন। একদম আপন বোন… সেই বোনটি আজ আমার চলে গেল। প্রথমে ওয়াহিদ ভাই, তারপর নীলোত্পলদা আর আজ আমার বোন মিতা আপা। শূন্য হয়ে গেলাম, নিঃস্ব হয়ে গেলাম। সুরের খোঁজে, প্রাণের টানে যাবার শেষ জায়গাটাও আজ হারিয়ে ফেললাম।