মণিজিঞ্জির সান্যাল : মংপু, নামটা শুনলেই মনটা আনন্দে ভরে ওঠে। এখানে আমি অনেকবার এসেছি। আসলে জীবনের কিছু কিছু মুহূর্ত যেমন কখনোই ভোলা যায় না, তেমনি কিছু জায়গা এবং সেই জায়গাকে ঘিরে কিছু ভালোলাগা, আমার জীবনের মতোই মূল্যবান। কেন যে যাই এক-ই জায়গায় বারেবারে আমি জানি না । আসলে যতোবার যাই অনুভূতির রংটা অদ্ভুত ভাবে পালটে যায়। ভীষণ এক শান্তি অনুভব করি শরীরে আর মনে।
প্রতিটি মানুষের জীবনেই কিছু স্বপ্ন থাকে, আর সেই স্বপ্ন পূরণ হবার আনন্দই আলাদা। আমার জীবনেও টুকরো কিছু স্বপ্ন ছিল, আর সেই স্বপ্নকে আমি নীরবে লালন করেছি। একা একাই সেই স্বপ্নের সাথে কথা বলা, সেই স্বপ্নের সাথে খেলা করা। খুব বড় কিছু স্বপ্ন নয়। কিন্তু এই স্বপ্নের মধ্যেই আমার বেঁচে থাকা।

তারই দু, একটা স্বপ্নের মধ্যে হঠাৎ কিছু স্বপ্ন যে এই ভাবে সত্যি হতে পারে তা ভাবিনি কখনও। আসলে আমাদের জীবনে কিছু স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়, কিছু স্বপ্ন আবার সত্যি হয়ে ধরা দেয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে যেন ঠিক সেই ভাবেই অনুভব করলাম যা আমি স্বপ্নে দেখতাম প্রতিনিয়ত। বৈশাখ মাসে আমার জন্মদিনকে ঘিরে ছোট থেকেই এক দারুণ উন্মাদনা, কারণ কিন্তু অন্য কিছু নয়, ঐ একটাই কারণ, পঁচিশে বৈশাখ কবিগুরুর জন্মদিন আর আমারও জন্মদিন বৈশাখের শেষেই।

ঝিরিঝিরি বৃষ্টি অদ্ভুত ভাবে এসে ধরা দিল বৈশাখের সেই সকালে। কি অদ্ভুত কান্ড! বৈশাখ মাস শেষের পথে। এই সময় তো কাঠফাটা রোদ্দুরে ভরে থাকে প্রকৃতি। তাহলে এখন বৃষ্টি কেন? জানালার কাছে এসে দাঁড়াতেই মনটা ভরে গেল। ঝমঝমে বৃষ্টি নয়, এ বৃষ্টি হলো ঝিরঝিরে বৃষ্টি।

আহা! কি আরাম মনে আর শরীরে। ঐ গরমে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি মনকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল সেই সুদূরে, দার্জিলিং জেলায় অবস্থিত ছোট্ট সুন্দর শহর মংপুর উদ্দেশ্যে, শিলিগুড়ি থেকে যা ৫২ কিমি দূরে অবস্থিত। অন্যদিকে দার্জিলিং থেকে মংপুর দূরত্ব মাত্র ৩৩কিমি।
আঁকাবাঁকা পাহাড়ী রাস্তার গা বেয়ে ঠিক সেখানে গিয়ে পৌঁছলাম, যার একদিকে কুইনাইন ফ্যাক্টরী আর ঠিক তার উলটোদিকে রবীন্দ্র বাসভবন।
১৮৬২ ব্রিটিশরা প্রথম সিঙ্কোনা চাষের জন্যে ডুয়ার্সের দুটো অঞ্চল মংপু আর লাটপাঞ্চরকে বেছে নিয়েছিল।সিঙ্কোনা গাছের ছাল বা বাকল জাহাজে করে পাঠানো হতো ব্রিটেনে কুইনাইন প্রস্তুতির জন্যে।

আমাদের সকলের প্রিয় সাহিত্যিক “ন হন্যতে খ্যাত” মৈত্রেয়ী দেবীর স্বামী ডক্টর মনমোহন সেন কাজের সূত্রে এই মংপুতে থাকতেন। তিনি মংপুতে ইংরেজদের প্রতিষ্ঠিত সিঙ্কোনা কারখানার প্রধান রসায়নবিদ (বৈজ্ঞানিক) ছিলেন।

সিঙ্কোনা প্রজেক্টের বাংলোতেই ছিল তাদের বাস। পরোবর্তীতে মৈত্রেয়ী দেবীর আন্তরিক আহ্বানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বাংলোতেই থাকতে শুরু করলেন এবং কবিগুরু নিজের মতো করে তার ঘরগুলোকে সাজিয়ে তুললেন যা কিনা আমরা প্রত্যক্ষ করলাম। এই বাংলোটিই তারপর দীক্ষিত হলো নতুন রূপে, যার নাম দেওয়া হলো “রবীন্দ্রভবন”।
১৯৩৮ থেকে ১৯৪০ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেশ কয়েকবার এই বাস ভবনে এসে থেকেছেন।
কালিম্পং কবির খুব প্রিয় জায়গা। বিশেষ করে এই মংপু। সেখানে তিনি মৈত্রেয়ী দেবীর বাড়িতে অতিথি। সারাদিন কবি সেখানে বসে প্রকৃতির শোভা দেখতেন আর লিখতেন। আর প্রতি সন্ধ্যাবেলা কবি সেখানে কবিতা, গল্প পাঠের আসর বসাতেন। সেখানে যেমন কবিতা পাঠ হতো, তেমনি কবি মাঝে মাঝেই গান গেয়ে শোনাতেন। গল্পগুচ্ছ থেকে গল্প পাঠ হতো, কবি কোন্ কোন্ লেখা কতবার বদলেছেন এবং কেন বদলেছেন সে’সব নিয়েও আলোচনা করতেন। এছাড়া মজার মজার সব গল্প এবং রসিকতায় ভরে উঠত সেই সব সন্ধ্যা।
মংপু থেকে ৪ কিমি ওপরে “সুরেল কুঠিতে” কবিগুরু রচনা করেছিলেন তাঁর “ক্যামেলিয়া” কবিতাটি। এরপর বহুবার তিনি আকৃষ্ট হয়েছেন এই ছোট্ট পাহাড়ী শহর টিতে।১৯৮৬ সালে যদিও সুরেল কুঠি ধংস হয়ে যায়।

মংপুতে কবিগুরুর বাসভবনের সামনে লেখিকা

আজকের এই রবীন্দ্র ভবনও ভূমিকম্পের ফলে বেশ অনেকটাই ধ্বংসপ্রাপ্ত । কিন্তু কিছু অনুভূতিপরায়ণ নেপালি মানুষের ভালোবাসায় আজও তার টুকরো কিছু অবশিষ্ট।
বাসভবনটিতে আমি যখন প্রবেশ করলাম তখনও ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। গন্ধরাজ ফুলের গন্ধ সারা বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। বাংলোটিকে দু’চোখ ভরে দেখছিলাম। লম্বা লম্বা সবুজ ঘাসের ওপর দিয়ে যখন হাঁটছিলাম, তখন প্রতি মুহূর্তে আমি শিহরিত হচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল কবিগুরু যেন প্রতিটি জায়গা জুড়ে অবস্থান করছেন, আর ঠিক তার পাশেই ধীর লয়ে হাঁটছেন মৈত্রেয়ী দেবী। সামনের বাগানটিতে শুধু গন্ধরাজ ফুলের সমারহ, পেছনে ক্যামিলিয়া। আহা! ওই দূরে সবুজ পাইন গাছ, চারদিকে সবুজ পাহাড়। মনটা যেন এক অদ্ভুত আবেগে দোলা দিয়ে উঠল। একজন নেপালি ভদ্রলোক ছুটে এসে তালা খুলে মিষ্টি হেসে আমাদের আপ্যায়ন করলেন। চটি জুতো খুলে সিঁড়িতে প্রণাম করে কাঁচের দরজাটা খুলতেই প্রশস্ত বারান্দা, আর সামনের চেয়ারেই কবির ছবি, যেন অতিথিদের সাদরে আহ্বান করছেন অন্দরে প্রবেশের জন্যে। আমার সারা শরীরে কাঁটা দিচ্ছিল।কবির চোখ দুটো এতো জ্বলজ্বলে যেন মনে হচ্ছে আমার মনের সব কথা তিনি বুঝে যাচ্ছেন কতো সহজেই। সামনে সুন্দর আলপনা আর ছবির চারপাশে গন্ধরাজ ফুল যেন আরো বেশি জীবন্ত করে তুলেছে ওই দুটো চোখকে। আমার চোখে কেন জানি তখন জল টলটল করছে।আমি ভাবতে পারছি না এই বারান্দায় কবি হাঁটতেন, বসতেন।আমি অভিভূত। এরপর ক্রমান্বয়ে আমরা কবির বসার ঘর, শোবার ঘর, স্নানের ঘর, লেখার ঘর, ছবি আঁকার ঘরকে প্রত্যক্ষ করলাম। আমি যেন বহুবছর আগের সেই দিনগুলোতে পৌঁছে গেছিলাম সেই মুহূর্তে, যেখানে কবি ছবি আঁকছেন, কখনও লিখছেন একের পর এক চিত্রকথা, তাঁর শব্দমালায় ভরে যাচ্ছে সুন্দর পাতাগুলি। কখনো বা কবি হেলান দিয়ে বসে ওই দূর পাহাড়ের দিকে চেয়ে সৃষ্টি করে চলেছেন একের পর এক চরিত্র।
কাঁচের জানালা খুলতেই কবির পড়ার ঘরে প্রবেশ করল একরাশ সূর্যরশ্মি, গন্ধরাজ ফুলের গন্ধ। চোখের সামনে এসে ভিড় করল ওই উড়ে যাওয়া মেঘ গুলো, সবুজ পাহাড়, ক্যামেলিয়া ফুল আর পাহাড়ী নদী।

স্নান ঘরে গিয়ে দেখলাম বাথটাব, শিহরিত হলাম তাঁর শৌখিনতা দেখে। শোবার ঘরে বক্স খাট, ভাবা যায় সেই সময় বক্স খাট! তাঁর হাতে আঁকা ছবি চারদিকে সাজানো। অন্য একটি ঘরে রং তুলি ঠিক আগের মতোই সাজানো। নীল, কমলা, সবুজ রংগুলো ছোট্ট ছোট্ট শিশিতে স্তরে স্তরে সাজানো। অন্য একটি ঘরে একটি সেলফে ছোট্ট ছোট্ট শিশিতে আবার হোমিওপ্যাথি ওষুধ, এখনো ওষুধের কিছু অংশ পড়ে আছে। আমি স্পর্শ করলাম শিশিগুলো, যেখানে কবিগুরুর স্পর্শ আমি যেন পরিষ্কার উপলব্ধি করছিলাম।
পড়ার ঘরে লেখার টেবিলে প্রবেশ করে আমি আমার চোখের জলকে কিছুতেই ধরে রাখতে পারছিলাম না। কবি এই চেয়ারে বসে লিখতেন! ভাবতেই আমি যেন আবার অন্য জগতে চলে গেলাম। চোখে আবার জল চলে এলো। টেবিলে কাঁচের তলায় ইংরেজী দৈনিক পত্রিকা যা কবি নিয়মিত পড়তেন। আমার হৃদয়ের অন্তঃপুরে কে যেন বলছে “এই তো আমি আছি প্রতি মুহূর্তে তোমারই কাছে।”

ফেরার সময় গন্ধরাজ ফুলের গন্ধকে সারা শরীরে মেখে সামান্য স্পর্শ করলাম কবির প্রিয় ফুলকে, যেন মনে হলো কবি গুরুর চরণ স্পর্শ করলাম। হঠাৎ কে যেন আমায় বলল
“হ্যাপি বার্থ ডে ম্যাম।”
আমি চমকে উঠলাম, দেখলাম আমাদের সারাক্ষণের নেপালি বন্ধুটি কখন যেন জেনে গিয়েছে আমার আজ জন্মদিন। আমি জলভরা চোখে হাসলাম। বন্ধুটি আমার একটি কাব্যগ্রন্থ ওখানকার গ্রন্থাগারে রেখে দিলেন আর বললেন “যতদিন পারব আমরা এই বাসভবনটিকে বাঁচিয়ে রাখব সরকারি সাহায্য পাই বা না পাই।”
আমি শুধু মনে মনে বললাম “ঈশ্বর ভূমিকম্পের হাত থেকে একমাত্র তুমিই পারো একে বাঁচাতে।”
আমি নেমে আসছি পাহাড়ের গা বেয়ে। আমি যেন পরিষ্কার শুনতে পেলাম কবি গাইছেন “মনে কি দ্বিধা রেখে গেলে চলে …”।

মণিজিঞ্জির সান্যাল, কথাসাহিত্যিক, শিলিগুড়ি, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত