ভজন সরকার : (৮)
তবুও বিশ্বাস করি বা না-করি, প্রত্যেকের জীবনেই প্রচলিত ধর্ম ও ধর্মবিশ্বাসীদের আঁচ এসে লাগে ইচ্ছেয় বা অনিচ্ছায়। কারণ, সমাজ বিবর্তণে প্রচলিত ধর্মকে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই ব্যবহার করা হয়েছে। কেউ স্ব-স্ব ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে আবার অনেকেই নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থের কারণেও। এক সময় ছিল যখন দূরের কোনো প্রভাবশালী ধর্মবিশ্বাসের আঁচ অন্যপ্রান্তে পৌঁছুতে অনেক সময় নিতো। তখন বিশ্বাসের সাথে বিশ্বাসের কিংবা ধর্মের সাথে ধর্মের যে সংঘাত বা দ্বন্ধ তার প্রভাব পড়তে পড়তে অনেক বছর বা যুগ গড়িয়ে যেতো। কিন্তু এখন আর সেটা নেই, পৃথিবীর একপ্রান্তের দাবানলের তাপ নিমিষেই ছড়িয়ে পড়ে অন্যপ্রান্তে।
তাই এখন প্রায় প্রতিটি প্রচলিত ধর্ম ও ধর্মবিশ্বাসীরা একে অন্যের শুভ-অশুভের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে পড়েছে। এতে অসুবিধে যেমন আছে, সুবিধেও তেমনি। শুধুই বিশ্বাস দিয়ে কোনো ক্ষতিকর ও যুগের সাথে সাংঘর্ষিক ধারণাকে প্রতিষ্ঠা করা সহজেই আর সম্ভব হচ্ছে না এবং হবেও না। নিজের ধর্মবিশ্বাসকে যখনই ঘর থেকে বাইরে বের করার চেষ্টা হবে, তখনি সে বিশ্বাস প্রশ্ন ও মূল্যায়ণের মুখোমুখী হবে। তাকে টিকিয়ে রাখতে হবে যুগের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েই।
তাই ষোড়শ শতাব্দীতে ইউরোপে এবং অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে খ্রিস্টান ধর্মকে আন্দোলনের মুখে পড়তে হয়েছে। হিন্দু ধর্মকে বেদ পরবর্তী সময়ে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে অনেক সংস্কার ও পরিবর্তন করতে হয়েছে। এমনকি এই ঊনবিংশ শতাব্দীতেও বাংলায় হিন্দু ধর্ম অনেক মনীষীদের দ্বারা সংস্কারের চেষ্টা হয়েছে।
কেননা, প্রত্যেক ধর্মের ধর্মসংস্কারকগন হয়ত চেষ্টা করেছিলেন ধর্ম বিশ্বাসকে কিছু অর্থহীন সংস্কার, যুক্তিহীন নিয়মনীতির বাতাবরণ, ইচ্ছে বা লোভ পূরণের ভরসা এবংনা-দেখা এক শক্তিমানকে বশ করে নিজের স্বার্থ –সিদ্ধির উপায় থেকে বের করে আনতে। কিন্তু কাজের কাজ বিশেষ কিছু কি হয়েছে? এখনো দেখি ধর্ম পালন মানেই হয় জাগতিক বিষয়-সম্পদ লাভ ও বৃদ্ধির ইতর লোভ, নয়তো বা মৃত্যুর পরে না-দেখা এক জগতে নিজের ইন্দ্রীয় সুখ ও তৃপ্তির আকাঙ্ক্ষা।
(৯)
অথচ এই বংগদেশে মাত্র কিছু দিন আগেও রামমোহন রায়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ সবাই হিন্দু ধর্মকে এক ভিন্ন ধারায় ও স্রোতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছিলেন। হিন্দু ধর্মে কিছু যে সংস্কার হয়নি , সেটা বলা যাবে না। কিন্তু এ কথা বলাই যায়, বিষয়লিপ্সার ইতর লোভ থেকে বুদ্ধিবৃত্তিরচর্চায় ধর্মকে উন্নীত করার যে চেষ্টা ঊনবিংশ শতাব্দীতে হয়েছিল, তার সবিশেষ কার্যকারীতা এখনো সমাজে বিরল। কিন্তু ব্রাহ্ম সমাজের সংস্কার প্রচেষ্টা সফল না হলেও তার রেশ যে হিন্দু ধর্মের গোঁড়ামিতে আঘাত করেনি একথা বলা যাবে না।
ঠিক এরকম চেষ্টাই করেছিলেন প্রোটেস্টান্ট ধর্মবিশ্বাসীদের পক্ষে লুথার,ক্যালভিন সহ নানা ধর্মসংস্কারকগন। ক্যাথলিক ধর্মবিশ্বাসীদের, এমনকি ইভাঞ্জেলিস্ট ও এংলিক্যানদের পক্ষেও ষোড়শ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে এক সংস্কারের জোয়ার এসেছিল। এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, আজ যতটুকু সহনশীলতা ও যুগের সাথে তালমিলিয়ে চলার চেষ্টা এই সব ধর্মবিশ্বাসীদের, সে সবের শুরু ওই সময়েই।
এ কথা নিঃসন্দেহে ও নিঃসংঙ্কোচে বলাই যায়, সময়ের সাথে মানুষ বদলায় এমনকি বদলায় প্রকৃতিও। অথচ প্রাচীনকালে প্রচলিত এক বিশ্বাস বা মতবাদ বদলাবে না, সেটা শুধু যুক্তিহীন মূঢ় ধারণাই নয়, এক প্রকার গোয়ার্তুমিও বটে। এই একবিংশ শতাব্দীতে অনেকেই সে মূঢ? সংস্কার ও গোঁড়ামির বেড়াজালেই আবদ্ধ হয়ে নিজেকে তো বটেই অন্যের জীবনকেও বিপন্ন ও বিপদসঙ্কুল করে তুলছে।
যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নিই যে, প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসের মাধ্যমেই অনেকে জীবন যাপনের মহত্ত¡ , ত্যাগ – প্রত্যয় এবং এমনকি নিজেকে বিকশিত করার উপায় খোঁজার চেষ্টা করে থাকেন। অথচ আমাদের চারপাশে লক্ষ্য করলে যা প্রত্যক্ষ করা যায়, তা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। এখন ধর্মাচারণ বা ধর্ম-পালনের উদ্দেশ্য ইহলৌকিক এবং তথাকথিত পারলৌকিক লোভ-লালসার প্রার্থণা ছাড়া অন্য কিছু নয়!
ধর্মাবতার বা ঈশ্বর যদি হোন নিস্পাপ ও নির্লোভ এক মহাশক্তির প্রতিভূ,ধার্মিকেরা তবে সেই নির্স্পাপ ও শক্তিশালী ঈশ্বরের কাছে নিজেকে না নিয়ে বরং নিজেদের পঙ্কিল স্বার্থের কাছেই ঈশ্বরকে নামিয়ে এনে ঈশ্বরের অস্তিত্ব ও শক্তিমত্ত¡াকেই প্রশ্নের মুখে ফেলছেন। এতে ঈশ্বরের অসারতাই প্রমানিত হচ্ছে; যা অবশ্যই ঈশ্বরবিশ্বাসের সাথে দ্বান্দিক।
(১০)
পরিণত বয়সে মানুষ একটু বেশী ধর্মকর্ম ক’রে থাকেন। আর এ কথা সব প্রচলিত ধর্মেই উল্লেখ আছে যে, ধর্ম যতটা ইহজাগতিক তার চেয়েও বেশী পারলৌকিক।
অর্থাৎ এ পৃথিবীতে সবাই কমবেশী দুঃখ-কষ্টে জীবন অতিবাহিত করে থাকে; অর্থের কষ্ট, প্রভাব-প্রতিপত্তি-যশ-খ্যাতি না-পাওয়ার কষ্ট এবং সর্বোপরি প্রিয়জন বিয়োগের কষ্ট।
তাই যখন কোনো ধর্ম গ্রন্থে এক অনাবিল সুখ-শান্তি-ভোগ-বিলাসের অফুরন্ত প্রলোভন থাকে, মানুষ স্বভাবতই সে দিকে আকৃষ্ট হয়।
আর সে না-দেখা জগতের জন্য ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত সব কিছু পালন শুরু করে। অথচ একবারও মানুষ ভাবে না যে, এ সকল প্রলোভন কতটুকু ফ্যান্টাসি আর কতটুকু বাস্তব!
আমি মাঝে মাঝে বিভিন্ন দেশের আধ্যাত্বিক গুরুদের কথা (অমৃত বাণী) শুনি। অনেকদিন পরে ভারতীয় এক যোগী ও আধ্যাত্বিক গুরুকে পেলাম, যিনি অনেকের চেয়েই বাস্তববাদী ও যুক্তিবাদী।
যা হোক, ওই আধ্যাত্বিক গুরুর নাম –যশ প্রচার করা আমার উদ্দেশ্য নয়, আর করবও না। শুধু পরলোক সম্বন্ধে তার কিছু কথা এখানে উল্লেখ করবো যা আমারও ভালো লেগেছে।
এ গল্পটা আমেরিকার। ধর্ম ক্লাশে শিক্ষক ছাত্রদের জিজ্ঞেস করছে, “বলতো স্বর্গে যেতে হলে কী করতে হবে?”
এক ছাত্র বললো, “যদি চার্চের বেঞ্চ ও ফ্লোরের ধুলোময়লা পরিষ্কার করি, তবে স্বর্গে যেতে পারবো”।
আরেক ছাত্র বললো, “যদি গরিব মানুষের সাথে নিজের খাবার ভাগ করে খাই, তবে স্বর্গে যেতে পারবো”।
আরেকজন বলল, “যদি ভালো মানুষ হই, তবে অবশ্যই স্বর্গে যেতে পারবো”।
দশ বছর বয়সের টম দাঁড়িয়ে বললো, “কিন্তু স্বর্গে যেতে হলে প্রথমে মৃত্যু বরণ করতে হবে, তারপর স্বর্গে যেতে হবে”।
আসলে পরলোকে বা স্বর্গে যাবার প্রথম ও প্রধান শর্ত হলো মৃত্যু।
মানুষকে দৈহিকভাবে প্রথমে মরতে হবে। অর্থ্যাৎ কেউই পৃথিবীর এ অবয়ব বা দেহ নিয়ে স্বর্গে যেতে পারবে না। আর সেটা সম্ভবও নয়।
কারণ, প্রতিটি প্রচলিত ধর্ম মতেই মানুষের দেহকে হয় মাটিতে পুঁতে রাখা হয় কিংবা আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে ফেলা হয়। আর সেই পচা-গলা কিংবা ভস্মীভূত দেহ তো আর ফিরিয়ে এনে পূনর্গঠন করা সম্ভব নয়।
তাই এ পৃথিবীর কোনো মানুষ যদি স্বর্গেও যায়, তবে এ দেহ পৃথিবীতে রেখেই যেতে হবে। আর কোনো প্রচলিত ধর্মেই মৃত্যুর পরে মানুষ কিভাবে কোন আকৃতি ধারন করবে তার বিশদ বর্ণনা নেই।
আর যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেই, মানুষ এ পৃথিবীতে যে আকৃতি বা দেহাবয়ব নিয়ে জন্মেছিল, স্বর্গেও সেটাই নিয়ে যাবে। তবেই মহামুষ্কিল।
কারণ, যে ভদ্রলোক আশি বছর বয়সে ডায়াবেটিস নিয়ে মারা গেল, সে স্বর্গে গিয়ে কিভাবে সুস্বাদু খাবার খাবে।
কিংবা যে ভদ্রলোকের প্রোস্টেট ফেলে দেয়া হয়েছে, এতো সুন্দরী হুরপরী তার কি কোনো কাজে আসবে?
তাই দেখা যায়, সব প্রচলিত ধর্মেই স্বর্গের সব কিছুই অফুরন্ত, সতেজ, কুমারী কিংবা ভার্জিন। কারণ, দেহই যদি না থাকে তবে হুরপরীদের ভার্জিনত্ব নষ্ট হবে কিভাবে?
মোদ্দা কথা হলো, অবৈজ্ঞানিক বা অযৌক্তিক সব কিছুর ভিতরই ফাঁক-ফোকর থাকে। তথাকথিত স্বর্গ বা নরকের কথিত বর্ণনাতেও এ রকম গাঁজাখোরি সমস্ত কাহিনি লেখা আছে।
অথচ এই সব গোলমেলে বা অবাস্তব কথা না ব’লে যদি প্রতিটি ধর্ম গ্রন্থে এ পৃথিবীতে মানুষের শান্তিতে বসবাস করার এক সার্বজনীন ও মানবিক কথা বলা হতো, তবে এ পৃথিবীতে এতো হানাহানি থাকতো না।
ধর্মগ্রন্থে না থাকলেও আমাদের বাংলাদেশেরই এক কবি একশ’ বছর আগে বলে গেছেন এই স্বর্গ-নরক বা বেহেস্ত-দোজগ নিয়ে এক বাস্তবসম্মত গুরুত্বপূর্ণ কথা।
তাঁর নাম শেখ ফজলুল করিম ( জন্ম ১৮৮২ খ্রিঃ- মৃত্যু ১৯৩৬ খ্রিঃ)।
স্বর্গ ও নরক
শেখ ফজলল করিম
কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর?
মানুষেরি মাঝে স্বর্গ নরক, মানুষেতে সুরাসুর!
রিপুর তাড়নে যখনই মোদের বিবেক পায় গো লয়,
আত্মগ্লানির নরক-অনলে তখনি পুড়িতে হয়।
প্রীতি ও প্রেমের পূণ্য বাঁধনে যবে মিলি পরষ্পরে,
স্বর্গ আসিয়া দাঁড়ায় তখন আমাদেরি কুঁড়ে ঘরে।
তিনি একশ’ বছর আগে যে চিন্তা করে গেছেন, আমরা সেখান থেকেও পিছিয়ে এসেছি; এটাই আমাদের দুর্ভাগ্য ও দুর্ভাবনা।
(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হামিল্টন, কানাডা )