মনিস রফিক : কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।

মনিস রফিক

একষট্টি.
বাবার সম্মানে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে হাইদা’রা আমাকে এবং আমার ভাইদেরও সম্মান জানিয়ে আমাদের নামে সেই অঞ্চলে কিছু জমি বরাদ্দ করেছিল, যদিও আমাদের কেউ’ই সেখান থেকে কোন রকম উপার্জন করার চিন্তা করি নি। তারা আমাদের সেই র‌্যাভেন এর সন্তান এর মর্যাদা দিয়েছিল। আমাদের প্রতি তাদের এই ব্যবহার নিঃসন্দেহে ছিল তাদের খোলা মন, সদিচ্ছা আর বন্ধুত্বের বহিঃপ্রকাশ। সেই জন্য সেই গ্রীষ্মে আমার সন্তানদের নিয়ে আমি সেই পশ্চিম উপক‚লে কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। তখন আমার জীবনের এক গভীর সিদ্ধান্ত নেবার সময়, আমার মস্তিষ্কে তখন আমার ভবিষ্যৎ জীবনে এগুনোর নতুন গতিপথ ঠিক করার সময়। আমার তখন বারবারই মনে হয়েছিল আমার জীবনের গতিপথ এমন দিকে নিয়ে যেতে হবে যা আমার জীবনের এক দীর্ঘস্থায়ী পথ হবে আর যে পথেই আমি সারা জীবন হেঁটে চলবো। জীবনের এই স্থায়ী পথের গতিপথ ঠিক করবে আমার আগামী জীবন। সেই সাথে আমার বারবার মনে হয়েছিল, পশ্চিম উপক‚লের সেই আদিবাসীদের সাথে সময় কাটিয়ে আমি আত্মিকভাবে উপলব্ধি করি কিভাবে তারা হাজার হাজার বছর ধরে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি আর মূল্যবোধের পথে হেঁটে চলেছেন। সাড়ে তিন দশক পূর্বে যে সংস্কৃতি আর মানুষদের চিন্তাচেতনা আর জীবনধারায় আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম তাদের সেই উপস্থিতিকে আমি আমার সাথে সব সময় ধরে রাখার জন্য আমি আমার কাঁধের বাম পাশে হাইদা র?্যাভেন ট্যাটু গ্রোথিত করেছিলাম। রবার্ট ডেভিডসন এর আঁকানো পৃথিবীকে মুড়িয়ে রাখার সেই নকশাটা আমি আমার সেই আদিবাসীদের স্থায়িত্বের প্রতীক হিসেবে রেখে দিয়েছি আমার শরীরে।

আমি আদিবাসীদের প্রতি তোমাদের আবেগায়িত করার জন্য এই গল্প করছি না। আমি একেবারে দূরবর্তী এমন অনেক আদিবাসীদের সাথে প্রচুর সময় কাটিয়েছি এবং আমি বারবারই একেবারে কাছ থেকে দেখা এই মানুষগুলো যেমন মেটিস এবং ইনুইট’রা বর্তমানে কি ধরনের সব চ্যালেঞ্জ এর প্রতিনিয়ত মুখোমুখি হচ্ছেন, সেটা উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছি। আমার সামনে এগুনোর চিন্তায় সে কারণে বারেবারে আমার সেই অতীত সময়টা ফিরে ফিরে আসছিল। এবং যথার্থই এটা হচ্ছে কানাডিয়ান জীবনের এক মৌলিক বিষয় যেখানে আমরা সেই সব আদিবাসীদের সাথে সম্মানজনক ও কার্যকরী সম্পর্ক উন্নয়নে সব সময় ব্যর্থ হয়েছি। হয়তো কানাডার যতগুলো প্রশ্নের এখনো সমাধান হয় নি, এটা হচ্ছে তার অন্যতম প্রধান একটা।

সত্যি বলতে কি, আমি তারচেয়েও আর একটু বেশী বলতে চাই। আদিবাসীদের প্রতি আমরা যারা এই ভূ-খণ্ডে নতুন অভিবাসী তারা যে আচরণ করেছি এবং করছি, আর তাদের প্রতি যে অবিচার করছি এবং দিনে দিনে তাদেরকে যে কঠিন দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছি, সেটা কিন্তু কানাডার নৈতিকতায় একটা বড় কালো দাগ। এই যে অবিচার আর অনৈতিকতার মোটা কালো দাগ বিরাজ করছে তা আরো বেশি জ্বলজ্বল করে যখন আমরা জানতে পারি কানাডায় এগারো’শরও বেশি আদিবাসী নারী নিখোঁজ হয়েছেন বা খুন হয়েছেন। এমনকি সরকার এগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত করতেও অপরাগতা জানিয়েছেন, সত্যি বলছি, কানাডার মত একটি সভ্য দেশের কাছে এর চেয়ে লজ্জার আর কিছুই থাকতে পারে না।

আমার খুব খারাপ লাগে যখন জানতে পারি, কনজারভেটিভ সরকার মনে করে যে, তারা যে রাজনৈতিক পরিবেশে নিজেদের কাজকর্ম করে চলেছে তাতে তারা যদি এমন সব বিষয়ে তেমন কোন উদ্যোগ গ্রহণ নাও করে, তবুও এর জন্য তারা শাস্তি পাবে না বা এর জন্য তাদের তেমন কোন জবাবদিহিতা করতে হবে না। মি. হারপারের কাছে এটা নিছক একটা সাদামাটা বিষয়। তবে এ ক্ষেত্রে পল মার্টিন ব্যতিক্রম ছিলেন। কেলোওয়ানা চুক্তির মাধ্যমে তিনি একটা কাঠামো তৈরী করেছিলেন এবং নীতিগতভাবে এই সব সমস্যার সমাধানে ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তবে আমাদের অধিকাংশ প্রধানমন্ত্রী’রাই এর একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য কাজ করে গেছেন।

তবে প্রধান যে পরিবর্তন ঘটে সেটা হয়েছে কোর্টের মাধ্যমে। আদিবাসীরা নিজেদের অধিকার রক্ষায় সাংবিধানিকভাবে এগুনোর জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে এবং তাদের অধিকার সংক্রান্ত চার্টার বাস্তবায়িত করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছে। ফলে একটা পরিবর্তন অবশ্যই ঘটেছে। আদিবাসীদের সাথে বর্তমান কানাডার সম্পর্কের বিষয়টা শুধু সংজ্ঞায়িত করার মধ্য রেখে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে এবং আসল সমস্যা আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায় যখন মনে করা হয় আমরা কি আবার পূর্বে ফিরে যাবো। তারপরও কোর্ট আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেয়, সারা কানাডার অধিবাসীদের নিজেদের অধিকার নিয়ে বাঁচার সব অধিকার আছে আর তারা তাদের মত করে সামনে এগুনোর সব অধিকার রাখে। আমরা যেহেতু তাদের সম্পদের ওপরই আমাদের উন্নয়নের ঝাণ্ডা বহন করে সামনে এগিয়ে চলেছি, সেখানে তারা যেন কোনভাবে বঞ্চিত না হয় এবং কোনভাবেই যেন তাদের নিজস্ব মূল্যবোধ আর সংস্কৃতিকে হেয় বা অবজ্ঞা করা না হয়।

আমরা যখন শুনলাম জ্যাক লেটন মারা গেছেন তখন আমরা ভ্যাংকুভার আইল্যান্ডে আমাদের সময় কাটাচ্ছিলাম। জ্যাক এর মত হওয়া সত্যিই একেবারে অসম্ভব ছিল। আমরা যদিও বিরোধী দলে ছিলাম, কিন্তু আমার নিজ প্রদেশ কুইবেক নিয়ে তিনি যে ইতিবাচক কাজ করেছিলেন তার জন্য আমি তাঁকে সমীহ না করে পারতাম না। অনেকেই মনে করেন, আমাদের ‘অরেঞ্জ ওয়েভ’ এর সাফল্য আমরা রাতারাতিই পেয়ে গেছি, কিন্তু এমন সাফল্যের পেছনে ছিল দীর্ঘ বছরের পরিকল্পনা আর পরিশ্রম। তাঁর নেতৃত্বের একেবারে শুরু থেকেই জ্যক লেটন কুইবেক’কে তাঁর চিন্তাভাবনা আর কাজকর্মের এক গুরুত্বপূর্ণ স্থানে রেখেছিলেন। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি তাঁর অনেক ঘনিষ্ঠজনই তাঁকে এই বিষয় নিয়ে ওতবেশী ওতপ্রোতভাবে কাজ করতে মানা করেছিলেন, কিন্তু তিনি যেটা বুঝেছিলেন আর ধারণ করেছিলেন, সেটার সাথেই আঁকড়ে লেগেছিলেন। তিনি একেবারে শৃংখল আর সততার সাথে এটার সাথে লেগে ছিলেন যতক্ষণ না পর্যন্ত তাঁর সেই মোক্ষম সময় আসে। আর যখন সেই সময়টা তাঁর জীবনে এসেছিল, তখন তিনি ছিলেন পুরোপুরিভাবে প্রস্তুত। আমার মনে হয়, তাঁর জীবন থেকে যে শিক্ষাটা আমাদের সবার নেয়া উচিৎ, সেটা হচ্ছে কাজের প্রতি একাগ্রচিত্ততা এবং যে কোন পরিকল্পনা সফল করার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাওয়া। কিন্তু যেটা হল, ক্যান্সার তাঁর জীবনকে হঠাৎ করে থামিয়ে দিল আর তাঁর এমন সফলতার পর তাঁর এমন মৃত্যু আমাদের সবাইকে গভীরভাবে নাড়া দিয়ে গেল। আমি তাঁর সাথে মাত্র কয়েকবার কথা বলেছি, যেমন কারো সাথে কোথায় দেখা হলে যেমন কথা হয়। আমি সব সময় তাঁর আশীর্বাদ আর বন্ধুত্বের উষ্ণতার স্পর্শ করতাম। কানাডার মানুষ এখনো জ্যাক লেটন এর অভাব অনুভব করে।

লিবারেল পার্টি’র প্রচারে জাস্টিন ট্রুডো

হতে পারে হঠাৎ এমন এক দুঃসংবাদ আমাকে নেতৃত্বের পথে না দৌড়ানোর জন্য এক ধরনের সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। তারপরও এ ব্যাপারটা আমি ঠিক করতে পারছিলাম না। আমার ভিতর যা ঘটছিল, তা হচ্ছে আমি যে সিদ্ধান্তই নেয় না কেন সেটা যেন আমার ভিতর থেকে এক’শ ভাগ সন্তুষ্টির সাথে আসে, এখানে যেন কোন ফাঁক না থাকে। আমার বারবারই মনে হচ্ছিল, আমি যদি ঐ মুহূর্তে নেতৃত্বের দিকে দৌড়ায় তাহলে অনেক লিবারেল’রাই মনে করবে আমাদের সামনে যে বিশাল কাজের পাহাড় জমা পড়ে আছে তাকে পাশ কাটিয়ে আমি ও ধরনের কোন পরিশ্রম না করে আমি নেতা হতে চাইছি। কিন্তু আমি সত্যি সত্যিই কঠোর পরিশ্রম আর প্রয়োজনীয় কাজ করতে চাচ্ছিলাম। ফলে সেপ্টেম্বরে পার্টির ককাশ মিটিং এ আমি আমার সহযাত্রীদের বলেছিলাম, আমি নেতৃত্বের পথে যেতে চাই না, তবে আমি সত্যিই আমার জামার হাতা গুটিয়ে আমার আংগুলের নখে কাদা ঢুকিয়ে কাজ করে যদি পার্টির মঙ্গল বয়ে আনতে পারি তবে সেটাই করতে চাই।

সেই সময়ে অনেক, আক্ষরিক অর্থেই অনেকেই বিশ্বাস করতো লিবারেল পার্টির আর কোন ভবিষ্যৎ নেই। তখন অনেক আমলে আনা লেখকই লিখতে শুরু করে দিয়েছিলেন খুব দ্রুতই লিবারেল পার্টি শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমরা যারা কুইবেক এ থাকতাম, আমরা বুঝতে পারছিলাম লিবারেল পার্টি কোন তলানিতে এসে ঠেকেছে। কুইবেকের বাইরে একেবারে অল্প কিছু কানাডিয়ান ধরতে পেরেছিলেন, আমার নিজ প্রদেশের গোমারী কমিশন এর ব্যর্থতার বিষয়টি। তোমরা লিবারেল পার্টির অভ্যন্তরীণ কোলহের জন্য কাকে কাকে দায়ী করো বা এর কারণ যেভাবেই অনুসন্ধান করো না কেন, কিন্তু লাখ লাখ কুইবেকবাসী টের পাচ্ছিল লিবারেল পার্টির ভিতরের শক্তি যে একেবারে ক্ষয়ে গেছে। সবার কাছেই তখন মনে হচ্ছিল, এখান থেকে উঠে দাঁড়ানোর আর কোন শক্তি এই পার্টির নেই, কোনভাবেই নেই। যতই নতুন কাউকে নেতৃত্বে নিয়ে আসা হোক না কেন। আমরা তখন এক গভীর খাদে পড়ে গিয়েছিলাম। আর এই খাদ থেকে বের হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে আবার কুইবেকবাসী আর কানাডার অন্য সব মানুষদের কাছে পার্টির সেই বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে তখন একটা কাজই ছিল, সেই কাজটা হচ্ছে গ্রহণযোগ্য আর ইতিবাচক পরিকল্পনা নিয়ে সেগুলোকে সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়িত করার জন্য কঠোর এবং কঠোর পরিশ্রম চালিয়ে যাওয়া। (চলবে)