ইয়াসমিন আশরাফ ডোরা : আমাদের প্রিয় শহীদ দিবসটি এখন বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ২১ ফেব্রুয়ারি ইউনেস্কো (UNESCO) দ্বারা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে স্বৃকীতি পেয়েছে আর তাই সাধারণ মানুষ আজ তাদের মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার লাভ করেছে।

টরন্টোবাসীর অনেক দিনের স্বপ্ন একটি শহীদ মিনার যা নির্মীত হয়েছে, বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা ড্যানফোর্থ ও ভিক্টোরিয়া পার্ক রোডের নিকটবর্তী ডেন্টোনিয়া পার্কের এক পাশে, আমাদের আনন্দ আমাদের সাফল্য এই শহীদ মিনার।

কোভিডের প্রভাবে এবারের হয়তো সেই শহীদ মিনারে ফুল দেওয়ার সৌভাগ্য অনেকের হবে না। ফুল দিলাম বা নাই বা দিলাম, সেটা বড় কথা না- বরং শহীদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা, এই প্রবাসেও সম্মানের সাথে বাংলা ভাষাকে জাগিয়ে রাখা, সেই সাথে যদি টরন্টোতে বড় হওয়া নতূন প্রজন্ম মায়ের ভাষায় গর্বের সাথে কথা বলে, এই সবই হবে আমাদের শহীদের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা নিবেদন।

বাংলাদেশ থেকে আগত বাঙালি অর্থাৎ আমাদের একটি দুর্বলতা, আমরা যেকোন পরিবেশে একজন বাঙালি পেলেই বাংলাতে কথা বলতে আরম্ভ করি। কারণ সাচ্ছন্দবোধ করি। অনেক সময় কর্মক্ষেত্রে এ নিয়ে কিছু সমস্যা হয়। তবুও মায়ের ভাষায় কথা বলবার স্বাদই অতুলনীয়, কানাডায় এসে তা মর্মে মর্মে অনুভব করি। কিন্তু ভাবতে হবে এখানে গড়ে উঠা ছেলেমেয়েদের বাংলা ভাষায়, ওদের অবস্থান কোথায়।

আমরা কানাডায় বাস করি, ঘর থেকে এক পা বেড় হলেই ইংরেজি বা ফ্রেঞ্চ ভাষার প্রয়োজন হয়। কিন্তু আমাদের শিকড়ের পরিচয় আমার মায়ের ভাষা, আর তা তো জানতেই হবে। আমি আমার মায়ের ভাষা জানবো না, তা তো ঠিক না। আর এ দায়িত্ব মা-বাবার। শিকড়কে অস্বীকার করে কোন জাতি আত্মমর্যাদা নিয়ে বেশি দিন টিকে থাকতে পারে না। বিশেষ করে কানাডার মত একাট মাল্টি কালচারাল দেশে। যেখানে নিজের ভাষায় কথা বলা, নিজ ধর্ম পালন করা, সাহিত্য-সাংস্কৃতিক চর্চা করা এসবে কোন বাধা নাই। সেখানে যদি আমাদের শিশুরা তাদের মাতৃভাষা শিক্ষা হতে দূরে সরে থাকে, তা দুঃখজনক। মাতৃভাষার চর্চা না থাকলে যে কোন জাতি এই দেশে সহজেই নিজস্বতা হারিয়ে ফেলবে। নিজ জাতিয়সত্তাকে ধরে রাখা জন্য নতূন প্রজন্মকে বাংলা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।

অনেকের কাছে ২১শে ফেব্রুয়ারি একটি উদযাপনের নাম, দিনটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করা, উপরোউপরি করে ফুল দেওয়া বা ছবি তোলা এক প্রকার প্রতিযোগিতা রূপ ধারণ করেছে। বাহ্য লৌকিকতা পরিহার করে, ভাষা আন্দোলনের মূল বার্তা আমাদের বুঝতে হবে।
টরন্টোর অনেক বাড়িতে বাংলা ভাষার চর্চা হয় না, বরং কিছু অভিভাবক বলেও থাকেন “দেশ থেকে এতো দূরে এসেছি বাচ্চাদের বাংলা শিখাতে? এর কোন মানে হয় না”। অন্য দিকে মনোবিজ্ঞানীদের মতে শিশুদের মানসিক বিকাশের জন্য মাতৃভাষা জানা একান্ত প্রয়োজন। যে শিশু ওর মায়ের ভাষা জানে তার জন্য আর একটি ভাষা (second language) শেখা সহজ হয়। আর কানাডার সংবিধানে উল্লেখ আছে minority language education rights, তাই (TDSB) টরণ্টো ডিসট্রিক স্কুল বোর্ডের কোন কোন স্কুলে সপ্তাহের একদিন করে বিভিন্ন ভাষায় ক্লাস হয়। আগ্রহি বাঙালি ছাত্রছাত্রীদের জন্য বাংলা ক্লাস হয়। অন্য ভাষাভাষী ছাত্রছাত্রীদের জন্য ওদের ভাষায় ক্লাস হয়ে থাকে। আমাদের অভিভাবকদের এই সুযোগটার সদব্যবহার করা উচিত।

আমাদের সামনে বড় উদাহরণ ব্লাক হিস্ট্রি মাস। টরন্টোতে ফেব্রুয়ারি মাসটি ব্লাক হিস্ট্রি মাস হিসাবে পালিত হয়। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি মাসব্যাপী ব্লাক হিস্ট্রি মাসের তাৎপর্য সাধারণ মানুষ এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের কাছে তুলে ধরে।
আরো লক্ষণীয় রিম্মেবারেন্স ডে প্রতি বছর অতি সম্মানের সাথে ১১ই নভেম্বর কানাডাবাসী তাদের বীর সৈনিকদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।

একই ভাবে আমাদের ভাষা সংগ্রামের ইতিহাস শুধু বাঙালিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, সাধারণের মধ্যে তা প্রচার করতে হবে এবং এর ফলে মাতৃভাষার শেখার গুরুত্ব বাড়বে।
এখানকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরতে ধরতে হবে।

অভিভাবকরা যদি স্বতঃস্ফূর্তভাবে বাচ্চাদের সাথে ঘরে বাংলাতে কথা বলেন, তবেই এ ভাষা ওদের কাছে প্রিয় হয়ে উঠবে, মা-বাবা ও আত্মীয়স্বজনের সাথে একটা ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠবে, তখন হাতে ধরে নিজস্ব সাংস্কৃতিক শেখাবার প্রয়োজন হবে না।

ড্যানফোর্থ এভিনিউ আশেপাশে বেশ কিছু বাংলা ভাষাভাষীদের সংস্থা গড়ে উঠেছে। প্রতি বছর শিশুদের বাংলা ভাষার প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য উনারা নানান ধরণের উৎসাহমূলক অনুষ্ঠান করে থাকেন। অনেক ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এতে অংশগ্রহণ করে, আমার সেই সব অনুষ্ঠানগুলি উপভোগ করার সুযোগ হয়েছে। এই উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসনীয়। প্রবাসে আমাদের সমবেত চেষ্টা হবে বাংলা ভাষা সংরক্ষণ করা, আর এই কর্মে দ্বারা জানান হবে ভাষা শহীদের প্রতি সালাম ও শ্রদ্ধা।