জেমস এ রিসচার, অনুবাদ: কোরবান আলী : (প্রতিটি মানুষের মধ্যে রয়েছে এক অপার শক্তি। এই শক্তিতে নিজেকে রাঙিয়ে নিতে গেলে একজনের প্রয়োজন একান্তে নিজের ভেতরে প্রবেশ করা, নিজেকে উপলব্ধি করা আর নিজের শক্তি বৃদ্ধির চর্চায় নিজেকে নিমগ্ন করা। মানুষের এই নিমগ্নতা মানুষকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যায়, যা অন্যদের মুগ্ধ করে। ‘স্পিরিচুয়াল লিডারশীপ’ বিষয়ক গ্রন্থের লেখক এবং ‘অর্গানাইজেশন ট্রান্সফরমেশন নেটওয়ার্ক’ প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা জেমস এ রিসচার সু²ভাবে আলোচনা করেছেন মানুষের মধ্যে লুকিয়ে থাকা এই পরম শক্তি নিয়ে এবং কিভাবে এই শক্তিকে ব্যবহার করে সত্যিকারের নেতৃত্ব অর্জন করা যায়। জেমস এ রিসচার এর আলোচনার আধ্যাত্মিকতা ও নেতৃত্ব বিষয়টি সাপ্তাহিক ‘বাংলা কাগজ’ এ ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করছেন উন্নয়ন সংগঠক ও অনুবাদক কোরবান আলী।)
তিন.
পরিবর্তন ঘটাতে পারে এমন নেতৃত্ব মূলতঃ অভিপ্রায়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত। প্রতিষ্ঠানের দর্শন থাকাটাই বড় কথা নয় বরং দর্শনকে বাস্তবায়ন করার জন্য যথেষ্ট মাত্রায় অভিপ্রায় ক্রিয়াশীল কিনা সেটা গুরত্বপূর্ণ বিষয়। যে কেউ দর্শন সৃষ্টি করতে পারেন। কিন্তু খুব কম সংখ্যক মানুষ আছেন যারা দৃঢ় সংকল্পের ভিত্তিতে নিরবিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টার মাধ্যমে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদান করতে পারেন। কর্মময় জগতে অভিপ্রায়ের বসবাস। আপনার দর্শন থাকতে পারে যার উপর আপনি কাজ করবেন। দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি যদি খাঁটি হয় তবে সাহসিকতাপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন, দর্শন তথা স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হবে। দৃঢ় ইচ্ছাশক্তির নির্ভেজাল কর্ম প্রক্রিয়াই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদান করতে পারে।
বিশ্বাসহীন অবস্থায় একটা সিদ্ধান্ত হাতে নেওয়ার অর্থ আঁধারে ঝাপ দেওয়া। এক্ষেত্রে নিজের উপর ও সংশিশ্লষ্টদের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা অপরিহার্য। অসাধারণ বিশ্বাসবোধ অপরিহার্য। এটা উত্সাহব্যঞ্জক যে, প্রাণী মাত্রই কাজ করে। মানুষ আমাদের ইচ্ছাশক্তি ও নির্দেশনা মোতাবেক কাজ করবে। একজন ব্যক্তি যিনি উচ্চমাত্রায় ইচ্ছাশক্তি সমৃদ্ধ তিনি সত্যিকার অর্থে আধ্যাত্মিক শক্তিতে বলীয়ান। (আমরা মানুষের গুণে মুগ্ধ হই, আকৃষ্ট হই, মনে হয় এটা আমার সাধ্যের বাইরে বা অভিজ্ঞতার বাইরে)।
সংস্কারবাদী নেতৃত্ব দমন-পীড়ন নীতি অবলম্বনের পরিবর্তে মানুষকে আকৃষ্ট করেন এবং শৃংখলাবদ্ধ করেন। ফলে নেতৃত্ব কার্যকর হয়। এ ধরনের দর্শন ও অভিপ্রায়ে মানুষ আকৃষ্ট হয়। নেতৃবৃন্দ মানুষের খুব গভীরে স্পর্শকাতর এলাকায় হালকাভাবে আঘাত করে তাদের মধ্যে দর্শনের সাথে সম্পৃক্ত হবার ইচ্ছা জাগ্রত করেন। এই বিশেষ চেতন অবস্থা মানুষকে দর্শন বাস্তবায়নের কাজে অনুপ্রাণিত করে। যখন দর্শন আকর্ষণীয় ও সময়ের দাবী পূরণ করতে সক্ষম এবং মহত্প্রাণ মানুষ দর্শন অর্জনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন তখন অংশগ্রহণ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। মানুষ ঐ দর্শন ও নেতৃত্বের প্রতি আকৃষ্ট হয়।
কাজে অংশগ্রহণ করে দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি ও সংকল্প প্রভৃতি গুণাবলী অর্জন করতে হয়। এ সমস্তগুণাবলী অর্জনের লক্ষ্যে প্রতিনিয়ত কাজ করা প্রয়োজন। নেতৃত্বের সাথে সংশ্লিষ্ট জটিলতা নিয়ে কাজ করলে চারিত্রিক দৃঢ়তা সৃষ্টি হয়। আবার নিজেরদের দর্শন যখন সত্যে পরিণত হয় তখন ইচ্ছাশক্তি ও সংকল্প সৃষ্টি হয়। এ গুণাবলী অর্জন করতে হলে নিজেদের খুব গভীরে প্রবেশ করতে হবে। এ গভীরতা অর্জিত হলেই মানুষ আকৃষ্ট হবে এবং স্বপ্ন বা দর্শনকে বাস্তবে রূপ দান করবে।
৪. কম অহংবোধ
মানুষের মনে দীর্ঘকালের একটা ভুল ধারণা প্রচলিত আছে, তা হচ্ছে “মহান নেতারা বড় ধরনের ফলাফল বের করে আনতে সক্ষম। বড় কিছু অর্জন করতে হলে অহংবোধের মাত্রা বেশি হওয়া আবশ্যক।” এ ভুল ধারণা পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গীকে সংকুচিত করেছে। আসলে এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গী সত্য নয়। এ দৃষ্টিভঙ্গী আমাদের ফলাফল বের করে আনার ক্ষমতাকে ধ্বংস করেছে। এ ধারণা কিছু সুনির্দিষ্ট পরিবেশে এখনও ক্রিয়াশীল যা গোপনে ব্যাপক অনিষ্ঠের কারণ। দম্ভ এবং অহংবোধে পরিপুষ্ট মানুষ অনেক সময় ফলাফল বের করে আনেন। এটা সত্য হতে পারে, কিন্তু এ ফলাফলের পিছনে অহংবোধ কোন কার্যকর ভূমিকা রাখে না।
মোট কথা শক্তি এবং অহংবোধের মধ্যে তেমন কোন সম্পর্ক নায়। উভয়ের অবস্থানগত পার্থক্য বিশাল। মানুষ কেন যেন বুঝতে চাই না, ভুল বুঝে। একজন নেতার অভ্যন্তরীণ শক্তিই হচ্ছে আসল চালক। দৃঢ় ইচ্ছা শক্তি ও সংকল্পের মধ্যে থেকে শক্তির উত্পত্তি ও ক্রমবিকাশ। বিভিন্ন ধরনের বাধা বিপত্তি সফলভাবে মোকাবেলা করার জন্য চাই শক্তি যা নেতাদের ফলাফল অর্জনে অগ্রগামী করে। কিন্তু কারো শক্তি থাকার অর্থ এই নয় যে সে দম্ভ ও অহংবোধে পরিপূর্ণ হবে। অহংবোধ বলতে আমি যা বুঝি তা হচ্ছে নিজেকে মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়া। কাজেই অহংবোধের একটা বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি, মুনাফা অর্জন, ধন সম্পদের মালিক হওয়া ইত্যাদি ললুপ মনোভাব। অহংবোধ হচ্ছে আমি আমার অংশ পাবো এতে কার কি বলার আছে। অহংবোধ হচ্ছে একটা উপায় যা দ্বারা প্রত্যেক পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং সর্বদা আমি বেশি পাবো, অন্যান্যরা কম পাবে। অহংবোধ হচ্ছে প্রতিটি পরিস্থিতিতে নাক গলানো যাতে করে আমি সবচেয়ে বেশি পাই এবং অন্যান্যরা কম পায়। বেশি পাওয়ার বিষয়টি হতে পারে স্থূল কোন বিষয় অথবা আবেগ তাড়িত কোন বিষয়। অহংবোধ প্রতিনিয়ত ঘটনাগুলোকে এবং ঘটনার বাইরের মানুষগুলোকে নিপুণভাবে পরিচালনা করে যাতে করে তারা সকলেই তোমার বদলে আমাকে বেশি গুরত্ব দেবে। অহংবোধ হচ্ছে আমি বনাম তুমি।
রূপান্তর বা পরিবর্তন আনতে সক্ষম নেতৃত্ব সংকীর্ণতা, অহংকারী মনোভাব পরিত্যাগ করতে উত্সাহিত করেন এবং বৃহত্তর স্বার্থে দর্শন বা স্বপ্ন বাস্তবায়নে প্রেরণা দেয়। একজন নেতা অবশ্যই প্রতিষ্ঠানের লোকজনকে দর্শনের পক্ষে উত্সাহিত করেন এবং উদাহরণসহ বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন। অন্য একজনের উদাহরণ টেনে বিষয়টির উপর স্বচ্ছতা আনেন যিনি দর্শনকে সম্মুখভাগে সমুন্নত রাখেন এবং অহংবোধকে পশ্চাত দিকে সরিয়ে রাখেন। যে নেতার নিজের স্বার্থহীন অবদান নাই, মানুষকে সম্মান করতে জানেন না তিনি কখনই সম্মান পাবেন না এবং নিঃস্বার্থ অবদান আশা করতে পারেন না। অহংকারী মানুষ প্রতিষ্ঠান থেকে সম্পদ নিয়ে ব্যত্তিগত লাভের জন্য ব্যয় করেন। বিনয়ী মানুষ বলেন, “সুষ্ঠুভাবে বন্টন কর” অহংকারী লোক বলেন “আমার সম্পূর্ণটাই দরকার”। কোন সময় যদি কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরবর্তীতে অন্যকে ছোট করি এবং নিজেকে বড় করে তুলে ধরি তবে ভাল ফলাফলের জন্য সেখান থেকে আমি কোন সহযোগিতাই পাবো না। যদি আমি আমার সেক্রেটারীকে ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে সমালোচনা করি যার পরিনতি স্বরূপ আমি কখনই প্রতিষ্ঠানের ভালোর জন্য তার কাছ থেকে উত্কৃষ্ট কোন কাজ আশা করতে পারবো না। আমি কাউকে প্রতিযোগী ভেবে যদি তার কাজের ক্ষতি সাধন করি তবে আমি শুধু কাজটিরই ক্ষতি করলাম না বরং এর সাথে সম্পর্কটিও ধ্বংস করলাম। কোন একটা গুরত্বপূর্ণ সভায় কোন নির্বাহী আমাকে দাওয়াত না দেওয়ার কারণে ক্ষুদ্ধ হলাম কিন্তু আমার রাগান্বিত হওয়ার কারণে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে না। বরং এটা প্রতিপক্ষের কানে পৌঁছাবে এবং ঠান্ডা লড়াই শুরু হবে, শান্তি বিঘিœত হবে। অহংবোধের বিপরীত চরিত্র হচ্ছে আগ্রহশীল, সেবা দানের মানসিকতা, নিঃস্বার্থ অবদান রাখার আগ্রহ ইত্যাদি কাজের ক্ষেত্রে অন্যকে ছাড়িয়ে যাবার ক্ষমতা ও যোগ্যতা। যখন লোকজন দেখেন তাদের নেতা নিঃস্বার্থভাবে কাজ করছেন তখন বাকীরাও সমান অবদান রাখতে বাধ্য হন। পরিবর্তনক্ষম নেতার বৈশিষ্টই হচ্ছে কম অহংবোধ, বেশি লাভ। অন্যভাবে পরিবর্তনক্ষম নেতৃত্বের বৈশিষ্ট হচ্ছে সেবা, সহযোগিতা, প্রতিশ্রুতিশীল এবং একাগ্রতা। কম অহংবোধ এবং উচ্চ ফলাফল কথা দুটি এক সুত্রে গাঁথা। যদি কোন প্রতিষ্ঠানের লোকজন ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতে ব্যস্ত থাকে এবং অহংবোধ রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন তবে প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্থ হবে। অন্যদিকে আপনি যদি দেখেন কোন প্রতিষ্ঠানের ফলাফল মোটেই সন্তষজনক নয় তবে মনে করতে হবে প্রতিষ্ঠানটি নিশ্চয় অহংবোধ জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। এটা দৃঢ়চেতা ব্যক্তিবর্গের ভূমিকা এবং প্রতিযোগিতাকে নিচে নামাতে পারে না।
প্রতিষ্ঠানে দৃঢ় মানসিক শক্তি সম্পন্ন কর্মী অত্যাবশ্যক, তদ্রুপ সীমিত প্রতিযোগিতারও প্রয়োজন আছে। কিন্তু পরিবর্তনক্ষম নেতৃত্বকে অবশ্যই কর্মীবৃন্দের মাঝে সহযোগিতা ও টিম ওয়ার্কের চেতনা জাগ্রত করতে হবে। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের সমস্যা হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত অহংবোধ যার ফলে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানিক শক্তি ব্যক্তি স্বার্থে ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে প্রতিষ্ঠানের দর্শন বাস্তয়নে খুব কম শক্তি প্রবাহিত হচ্ছে। কোন প্রতিষ্ঠানে মাত্রাতিরিক্ত সহযোগিতা ও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ জনিত সমস্যা কখনই সৃষ্টি হয় না। কাজের গতি সৃষ্টির জন্য নেতা সহযোগিতা করেন। নেতার কর্ম চঞ্চলতা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কম অহংবোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। নেতা যদি কম অহংবোধের উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারেন অর্থাত সেবা, ত্যাগ, সমর্থন ও উদ্বেগের উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারেন তবে অন্যান্যরাও এ ধরনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করবেন। নেতৃত্বের প্রধান ভূমিকা হচ্ছে কাঠামো সৃষ্টি করা যাতে করে কর্মীবৃন্দ সম্মিলিত কর্ম প্রচেষ্টার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের প্রত্যাশিত ফলাফল বের করে আনতে পারেন।
৫. অবিচ্ছিন্নতা
ধারণাটি স্ববিরোধী মনে হলেও সত্য বর্জিত নয়। যেমনটি পূর্বে বলা হয়েছে- দুটি পক্ষ সৃষ্টি করার প্রবল প্রবণতা নেতৃত্বের মধ্যে কাজ করে। বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ উভয় ক্ষেত্রেই এটা সত্য। বাহ্যিক স্তরে ক্ষমতার সমস্ত ফাঁদগুলো বিভাজন সৃষ্টি করে। নেতারা বেশি ক্ষমতাধর এবং তাদের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা আছে, যা অন্যান্যদের নেই। অভ্যন্তরীণ স্তরে নেতৃত্ব ও দায়িত্ববোধ ক্রিয়াশীল যা একজন নেতাকে সাধারণ লোকজনের চেয়ে আলাদাভাবে বাস্তবতাকে বিচার করে কাজ করতে অনুপ্রাণিত করে। যার ফলে অন্যান্যরা যখন পালাক্রমে নেতার সাথে অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে যান তখন তারা নেতার মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া লক্ষ্ করেন। নেতৃত্বের সাথে অভিজ্ঞতা বিনিময়ের পরে তারা চটুল ভঙ্গিতে বলেন “তিনি আমাকে পাত্তাই দিলেন না” অথবা “তিনি আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন বলে মনে হয় না।”
নেতৃত্বের মধ্যে এ ধরনের ব্যাপক পার্থক্য পরিলক্ষিত হওয়ার কারণে পরিবর্তনক্ষম নেতৃত্ব শিক্ষাগ্রহণ করেন কিভাবে এ পার্থক্য কমিয়ে আনা যায়। যখন আপনি এ ধরনের পরিবর্তনক্ষম নেতৃবৃন্দের সাথে অবস্থান করবেন। তখন আপনার মনে হতে পারে তারাই আপনার সাথে অবস্থান করছেন। এ ক্ষেত্রে যে পরস্পর বিরোধী অর্থ বিদ্যমান তা হচ্ছে আপনি জানেন স্বভাব সুলভভাবেই একজন নেতা আর দশজন থেকে আলাদা তথাপি তিনি আপনার অন্তরঙ্গ হয়ে উঠেছেন, আপনাদের মধ্যে একটা স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এটাই পরিবর্তনক্ষম নেতার অলৌকিক ক্ষমতা। এ মিশ্র অনুভূতি সম্মিলিতভাবে একটা কিছু ইঙ্গিত করছে। এ দুটো ধারণার যে কোন একটা এককভাবে আকর্ষণীয় নয়। মানুষকে আলোড়িত করে না। যদি একজন সম্ভাবনাময় নেতা বলেন আমি তোমাদের নেতা হতে চাই। এর মধ্যে কোন আবেগঘন উষ্ণতা নেই। এ ধরনের আচরণে জনগণের দূরে সরে যাবার সম্ভাবনা দেখা দেবে। অপর পক্ষে যদি একজন স্বভাব সুলভভাবে মানুষের প্রতি উষ্ণ এবং আন্তরিক, কিন্তু তিনি নেতা নন। এ ক্ষেত্রে লোকজন তাকে পছন্দ করবে সন্দেহ নায়। কিন্তু এও সত্য যে তার মধ্যে কোন পরিবর্তনক্ষম নেতার অনুরূপ ক্ষমতা এবং অলৌকিকতা প্রকাশ পাবেনা।
অবিচ্ছিন্নতা শক্তিকে অনুভব করার একটা পথ হচ্ছে কথাটির শিকড় খুঁজে বের করা। এ কথাটি মূলতঃ পরিবর্তনক্ষম মনসতত্ত¡ থেকে উদ্ভূত। বিভেদ বা বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কে আমাদের যে সাধারণ অভিজ্ঞতা তার একটা উদাহরণ হচ্ছে “তুমি আর আমি এমনই ভিন্নতর ধাতুতে গড়া যে আমরা একে অপরকে বুঝতে পারিনা। পারস্পরিক সম্পর্ক বজায় রাখতে পারিনা।” পরিবর্তনক্ষম মনসতত্ত¡ মতে এ ধরনের অনুভূতি সম্পূর্ণভাবে অলীক, অবাস্তব । এটা সত্য যে আমাদের প্রায়ই এ ধরনের অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের মধ্যে একটা সুগভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। আমরা যখন বড় ধরনের বিচ্ছেদ অনুভব করি, যেমন দীর্ঘ ভালবাসার বিচ্ছেদ অথবা একটা ঘনিষ্ট সম্পর্কের চুড়ান্ত অবনতি ঘটে তখন আমরা রাগ বা ঘৃণা অনুভব করি। সত্যিকার অর্থে এটা ঘনিষ্ট সম্পর্কেরই বহিঃপ্রকাশ। যার সাথে আমাদের তেমন কোন সম্পর্ক নায়, তার উপর আমরা সাধারণত রাগ করিনা।
মানুষের মধ্যে এ ধরনের পারস্পারিক সম্পর্ক নিয়ে পরিবর্তনক্ষম নেতৃত্ব কাজ করে। এটা সেই সম্পর্ক যা একদল মানুষকে সংঘবদ্ধভাবে কাজ করতে অনুপ্রাণিত করে। সমাজবদ্ধভাবে বসবাসের অভিজ্ঞতা অর্জন করে। একটা সাধারণ দর্শন বাস্তবায়নের তাগিদে দলবদ্ধ হয়। একটা উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন সংগঠন সৃষ্টি করা, স্যুপ তৈরি করার অনুরূপ। একের ভিতর অনেকগুলো উপাদান মিশানো যাতে করে একটা ভিন্ন স্বাদ বা ফলাফল পাওয়া যায়। পরিবর্তনক্ষম নেতৃত্ব এ মৌলিক সম্পর্কের নিগুড় রহস্য বোঝেন। বুদ্ধি দিয়ে নয়, সরাসরি এবং অভিজ্ঞতা অর্জনের মাধ্যমে এ অনুভূতি অর্জিত হয়েছে। আপনি যখন এ ধরনের মানুষের সংস্পর্শে থাকবেন, তখন কখনই দুরত্ব অনুভূত হবে না বরং দীর্ঘ দিনের জানাশোনা লোকের সাথে কথা বলতে অনেক সময় দূরত্ব মনে হতে পারে। আপনার সব সময় মনে হবে লোকটি আপনার সাথে আছে যিনি সব সময় আপনার খোঁজ খবর রাখছেন, যাতে আপনার কোন অসুবিধা না হয়। মনে রাখা প্রয়োজন এ স্নেহশীল অনুভূতি প্রথম প্রেম মনে করার কোন কারণ নেই। অনেক মানুষ হবু সমর্থকদের স্নেহাশীষ নিয়ে নেতৃত্বে যেতে চেষ্টা করেন। আমি যে স্নেহাশীষের কথা বলছি এটা আপনি ও আপনার বান্ধুর মধ্যে এক ধরনের ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ। আপনি যখন ক্ষতিকর কিছু করবেন তখন আপনার বন্ধু আপনাকে এর মুখোমুখি করবেন। প্রাচ্যদেশীয় ধর্মে এ ধরনের আচরণ নির্মম সমবেদনা হিসাবে পরিচিত। (চলবে)