কবি আতোয়ার রহমান প্রাকৃত পাখির গানের সুরের আবেশ ছড়িয়ে একেবারে খোলা চোখে দেখেন তাঁর জগতের আশপাশকে। তাঁর এই দেখা বারে বারে আমাদের অন্তরের সাদা চোখকে উম্মোচিত করে দেয় এ পৃথিবীর একাকীত্বের সৌন্দর্য উপভোগ করতে। আতোয়ারের রহমানের হৃদয়ের মধ্যে এক প্রবল প্রেমের দ্যোতনা ঝনঝন করে বেজে উঠে নীরবে। সেই পরম প্রেম তাঁকে অপূর্ব এক লয়ের গতিতে নিয়ে যায় প্রকৃতির কাছে আর প্রেমিক হৃদয়ের উষ্ণতার আস্বাদনে। আমাদের একেবারে নিত্য ব্যবহার্য শব্দ একের পর এক ব্যবহার করে কি করে অপূর্ব সুন্দর সব কবিতা নির্মাণ করা যেতে পারে, কবি আতোয়ার রহমান সেই পথ আমাদের দেখিয়ে দেন। এক প্রচণ্ড শক্তি আছে তাঁর কাব্য নির্মাণে যা আমাদের হৃদয় আলোকিত করে কবিতার কমলা আলোর দিকবিদিক উপচিয়ে পড়া আলোর স্রোতে।

মনিস রফিক

কবি আতোয়ার রহমান-এর জন্ম ১৯৬৪ সালের ১৫ জুলাই বাংলাদেশের রংপুরের মিঠাপুকুরে। কানাডার টরন্টো শহরে বসবাস করছেন দীর্ঘদিন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। বাংলাদেশের কবি নজরুল কলেজ, জগন্নাথ কলেজ ও ইডেন কলেজে দীর্ঘদিন ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক ছিলেন। এক সময় সাংবাদিকতার সাথেও জড়িত ছিলেন। দি নিউ নেশন, অধুনা লুপ্ত মর্নিং সান, দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট প্রভৃতি পত্রিকায় সাব-এডিটর হিসাবে কাজ করেছেন। কলেজ জীবন থেকেই লেখালেখিতে হাতেখড়ি। বাংলাদেশ ও কানাডার বিভিন্ন বাংলা দৈনিক, অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও সাহিত্য পত্রিকায় গল্প, কবিতা ও বিভিন্ন বিষয়ের ওপর নিয়মিত লিখেন। মূলত গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধগুলোতে বার্তাধর্মী নানারকম তথ্য পরিবেশন করে থাকেন। প্রিয় বিষয় মানুষ এবং প্রকৃতি। অবসর সময়ে ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসেন। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ যাপিত জীবন বিভাস প্রকাশনী থেকে বেরিয়েছিল ২০১৫ সালে।

ইতিহাসের কলঙ্ক
(স¤প্রতি কানাডার সাস্কাচুয়ানে অতীতের ঔপনিবেশিক নির্যাতনে নিহত ৭১৫টি আদিবাসী শিশুর কবর আবিষ্কৃত হওয়ার ঘটনা স্মরণে)

আমি সাস্কাচুয়ানের কবরে
শুয়ে থাকা আদিবাসী শিশু,
দারুণ বিষাদ তুষার-প্রান্তরে
গভীর শোকে কাঁদে কানাডার যীশু।

আমি কাউকে বলিনি আমাকে
‘ইনুক’ হিসেবে জন্ম দিতে,
আমি কাউকে বলিনি জোর করে
আমাকে একটি ভিনদেশি ভাষার মাধ্যমে
একটি ভিনদেশি সংস্কৃতি শেখাতে।
ভাগ্যই আমাকে এখানে এনেছে,
যার উপর আমার কোন হাত ছিল না।

গুম হয়ে থাকা ইতিহাস খুঁড়ে খুঁড়ে
বের করো মহেঞ্জোদারোর মত মাটির
নীচে চাপা পড়ে থাকা তোমার
কলঙ্কের কাল পাশবিক অতীত।
ধুয়ে দিতে সে অভিশপ্ত দাগ,
ক্ষমা চেয়ে যাও শত শত বছর ধরে
অনুতাপের আগুনে পুড়ে পুড়ে দগ্ধ হও
ভুলের তালাবদ্ধ ঘর থেকে বের হয়ে এসো।
তা না হলে পাহাড়ি কৃষকের বোনা
শষ্যবীজের মত ক্ষণে ক্ষণে বাগানের
অতিমাত্রায় বেড়ে ওঠা গাছের নিচে শত শত
চিহ্নহীন কবরের মাটি ভেদ করে এসে ছড়িয়ে
দেব হাড়ের মালা, বলে দিব আমাদের
পুঁতে রাখার গল্প। দুর্গন্ধে ভরে যাবে
তোমাদের বৈঠকখানা।
মগজ খুঁড়ে খুঁড়ে কোষ থেকে ঝেড়ে
ফেলে দাও ঘৃণার ভাইরাস।
শুধু পতাকা অর্ধনমিতকরণ, নীরবতা পালন
স্মরণের জুতো খেলনা টেডি বিয়ার
আর ফুলও ফিরে আনবে না কালের
অতলতল থেকে শত শত শিশুর অমুল্য জীবন।

এমন কাউকে চেয়েছিলাম

আমার এমন একজন নারীর প্রয়োজন ছিল
যে শিশিরপরাগের মতো লেগে থাকবে
আমার চোখ মুখ ঠোঁটের সবুজ মাঠে,
যে ধরে রাখবে আমাকে, রাতের আকাশ
যেমন তারাগুলোকে ধরে রাখে।
আমি ভুল মানুষ বেছে নিয়েছিলাম অতীতে।

আমার সত্যিকারের একজন সঠিক বন্ধুর
বড্ড প্রয়োজন ছিল, যার কাছে সহজেই
নিজেকে ময়ূরের পেখমের মত মন খুলে
মেলে ধরতে পারতাম।
আমার এমন কারও প্রয়োজন ছিল
যে সবসময় আমার গদগদ প্রশংসা করবে,
রেডিও টেলিভিশনে মানুষ যেমন
সেলিব্রিটিদের প্রশংসা করে।

আমি ভেবেছিলাম আমার সন্ধান করতে হবে
এমন কাউকে যে বুঝে সম্পর্কটা ড্রাইভ-থ্রæ
বা ফাস্টফুড নয়।
আমি এমন একজনকে খুঁজেছিলাম
যে আমার বকবকানির চেয়ে
আমার নীরবতাকেই বেশি বুঝবে,
আমার শত কোলাহলে ডুবে থেকেও
আমার একাকীত্বের গল্প শুনবে, শুনতে শুনতে
হাসবে, হাসতে হাসতে চোখ মুছবে আঁচলে।

এমন একজনকে আমি খুঁজেছিলাম
যে রেশমের মতো কোমল হাতে আমার
হৃদয়ের বেশবাস খুলবে,
কিন্তু আমি ঠান্ডা অনুভব করব না।
আমি এমন একজনকে খুঁজেছিলাম
যে পাগলের মত অপেক্ষা করবে আমার
জন্য কখন ফিরবো, বেশি রাতে ফিরলে
আঁচল পেতে বৃষ্টি হয়ে এসে
এলোকেশি চুলে দরজা খুলে জড়িয়ে ধরবে,
তৃষ্ণার্ত ঠোঁটের চুম্বনে সিক্ত করবে আমাকে।

এমন কাউকে আমি খুঁজেছিলাম
যে আমাকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করবে
না, আমার স্বভাবজাত দোষগুণ জুড়ে
আমাকে মেনে নেবে।

এমন কাউকে আমি চেয়েছিলাম
যে বিকেল বেলা আমার সাথে হাঁটতে বেরুবে,
নদীর পাড়ে বসে বাদাম খেতে খেতে
প্রেমের সব কথা আমার কাছে উজাড় করে দিবে,
বিলের ঘাটে দেখবে বেগুনি কলমি ফুলের
উপর বসা সবুজ ফড়িং, আমার হৃদয়ের মাঝদরিয়ায়
সাঁতরাতে সাঁতরাতে ঘরে ফিরবে
দুহাতে নিয়ে গোছা গোছা শিউলি শালুক-শাপলা।

এমন কাউকে আমি চেয়েছিলাম
যে আমাকে বাতাসের স্মৃতি ভুলে দিবে,
বাতাসের পরিবর্তে আমি তাকে শ্বাস নিবো।

মতিহার
(রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ‘মতিহার’ নামে পরিচিত)

জ্যোৎস্না রাতে সমস্ত পৃথিবী ঘুমিয়ে পড়লে
ছাদে উঠে চারিদিকে তাকাই, কোনো
এক অজানা স্বর আমাকে কানে কানে বলে,
‘ভালোবাসো আর আমাকে আগের মতো করে’?
হন্তদন্ত হয়ে ভয় পেয়ে ঘরের বাইরে যাই
আর কেবল ছুটি।
উঠে পড়ি এক অজানা জনশূন্য ট্রেনে
সেটা ঊর্ধ্বশ্বাসে ছোটে,
জানালা দিয়ে দেখি এস এম হল, আমির আলি,
লতিফ, জোহা, শের-ই-বাংলা, সোহরাওয়ার্দি,
মাদার বখস, মন্নুজান, রোকেয়া হল
আরো আরো-সারি সারি নি:সঙ্গ
নদীর মত শুয়ে আছে-
বাতাসে দোল খায় হলের বারান্দায় ঝুলে রাখা কাপড়,
ভেসে আসে চোখের বারান্দায়
দেয়াল গজিয়ে ওঠা ফ্যাকাশে রঙ, বিছানার চাদর।
ট্রেনটা অদ্ভুত হুইসেল বাজায়, সুর চড়ায়,
ট্রেন থেকে নেমে সময়ের অদ্ভুত ঘোড়ায়
সওয়ার হয়ে ক্যাম্পাস পরিক্রমা করি, স্মৃতির বারান্দায়
ভ্রমণ করি মোহন প্যারিস রোড, দুপাশে বিবর্ণ মহীরুহ,
নিঃসঙ্গ, নিস্তরঙ্গ, পড়ে আছে একা,
যেখানে আমার প্রজন্ম প্রেমিক ছায়া
হাঁটতো উল্লাসে একদিন!
তবু আমাকে আজ আশ্রয় দেয়, আমাকে
দু’হাতে টেনে নেয় নিজের বুকে,
আমি হাঁটতে থাকি স্মৃতিপথে গোলাপি মেঘ ধরে
স্মৃতিচিহ্ন গোনা সব বিস্মৃত প্রহর।
শরীর থেকে ঝেড়ে প্রাচীন ধুলো,
দু’দন্ড দাঁড়িয়ে পড়ি প্রেমহীন চুম্বনদৃশ্যের সামনে।
শহিদুল্লাহ কলাভবন, ক্লাসরুম…
যেন ক্রমশ হেলে যাচ্ছে নৈ:শব্দ্যের দিকে।
সবুজ ঘাসের গালিচায় ঘাস ফড়িং এর আড্ডায়
গোল হয়ে বসে কারা ওরা ঝগড়া, তর্কাতর্কি করে
অবিরত রোদেলা বিকেলের আবছায়ায়?
আমতলা, সিলসিলা…
ধর্ম অথবা রাজনীতির ছুরিতে ক্ষতবিক্ষত
উপেক্ষায় উপেক্ষায় জর্জরিত, মুখে গাঢ় ক্লান্তির ছাপ,
প্রেমহীন প্রতিবাদহীন উদ্যমহীন যুবকরা ¯েøাগান দিয়ে হারিয়ে যায়।
নিবিষ্ট ছাত্রের মতো তাকিয়ে থাকি লাইব্রেরিতে,
বইগুলো চাপা পড়ে আছে, যেন শবদেহের মত।
নিভু নিভু মানবাত্মার অমর আলোক উজ্জ্বল শিখা।
চেয়ার-টেবিল-বুকসেলফ করছে হাহাকার
ঝাঁকে, ঝাঁকে নামছে অন্ধকার,
এ ক্যাম্পাসে কি এখন জ্যোৎস্না পড়ে না?

দিনদুপুরে স্টেডিয়ামে হাঁটছে দুটি সাদা ঘোড়া
দর্শকশুন্য শহীদমিনারে ম্রিয়মাণ তবলার বাজনা
অদূরে কিছু ছায়াশরীর নাচে।
সবকিছু আছে অথচ কোথাও কিছু নেই…
হেঁটে হেঁটে একটা কবরের পাশে দাঁড়ালাম
এক দমকা বাতাস যেন আমার মাথায়
স্নেহপরশ মাখা হাত বুলিয়ে দেয়,
আমার ঘোরকেটে যায়, ভোরের প্রথম মায়াআলোয়
দেখি, দাঁড়িয়ে আছি শহীদ জোহা স্যারের
কবরের পাশে।

সূর্যাস্ত

অস্তমিত সূর্য দিগন্তের উপর দিয়ে ডুবে যায়
লাল, হলুদ, কমলা, নীল এবং ধূসর রঙের
লম্বা আভার অগণিত আবছা মোহনীয় ছায়া
টুকরো মেঘে প্রতিফলিত হয়ে এক ঝাঁক
রঙের মিছিল আলতো ছোঁয়ায় বেদনার রঙে
আশ্চর্য মায়াবী নকশার আঁকিবুঁকি কাটে,
বিষাদের রঙগুলি কুচি কুচি হয়ে লেগে থাকে
বাতাসের মুখের পরে, এক অধিভৌতিক দৃশ্যের
আয়োজনে বহুমাত্রিক ক্যানভাসে আঁকা এক
বর্ণময় ছবি, যেন ভ্যান গগের আঁকা নিখুঁত
জলরঙ চিত্রও তার কাছে ফ্যাকাশে মলিন।
এটি আমাদের হৃদয়কে উত্তোলন করে
এবং আমাদেরকে প্রকৃতির আত্মার সাথে
সংযুক্ত করে আমাদের মনে করিয়ে
দেয় যে মানুষ কিন্তু মরনশীল।

যেন জীবনের যুগপৎ সুখ এবং দুঃখের
ছিন্নস্মৃতির রক্তিম বাসনা
হেঁটে যাচ্ছে গোধুলির দিকে, দীর্ঘ ছায়া নিয়ে
পূর্ব থেকে পশ্চিমে তার আহ্নিক পথে জমে।
একদা মহিমান্বিত এই আলোর পাতিত চিহ্নগুলি
নেমে আসা রাতের অন্ধকারে গ্রাস করে।

এই পুরোনো সূর্যের মতো আমিও
আমার দিনটি কাটিয়েছি
এগিয়ে এসেছে শেষ গন্তব্যের যাত্রা
আমার মুখের ওপর দেখছি শেষ রশ্মির ছটা
আমার স্বল্পপ্রজ স্বপ্নমায়া জীবনে নিজের
কান্না হাসির স্মৃতিগুলি শীঘ্রই ¤øান হয়ে যাবে,
ওদের নিশ্চুপ করে দেবে
অমীমাংসিত রহস্যের গাঢ় অন্ধকারের
অতলে হারিয়ে যাবে।

বর্ষা

বৃষ্টিতে ভিজে যায় দিগন্ত, গাছ বন, নদী,
আমন ধানের চারা রোপনে ব্যস্ত সাঁওতাল রমনী।
আকাশের অধর মাঝে থৈথৈ মেঘের গুরু গুরু গর্জন,
বৃষ্টির কোলাজ, টিনের চালে টাপুর টুপুর
শব্দের অনন্য নৃত্যকলায়
বিরহপ্লাবিত মনে বিষাদ উছলায়।
বৃষ্টির জলকণায় আর্দ্র হয়ে ওঠে মনের অলিগলি।
ভিজে যায় হাসি, প্রিয়ার লম্বা চুলের বেনী।
বিরহ বিষাদ বিষন্নতা বয়ে যায় বাতাসে
বয়ে যায় একরাশ অন্ধকার
টিনের চালে বৃষ্টির ঘুংঘুর,
মাতিয়ে তুলেছে নদী খাল পুকুর।
ভাতের হাড়ির মতন উপুড় করা
আকাশ থেকে ঝরে পড়ে রিনিঝিনি
মেঘের কোল থেকে নেমে এল বরষারানি
ঘনকালো মেঘের ডাকে ওঠে চরাচর আনন্দে নাচি।

আমার সাদা-কালো জীবনে তোমার এমন অচেনা,
বর্ণময় রূপ ফিরে ফিরে পাওয়ার জন্যই
আজকাল আমি বৃষ্টির প্রতীক্ষায় থাকি।

বর্ষা এলে আমি কবিতা মনস্ক হয়ে যাই,
বৃষ্টি এলে আমি ডাহুকের বিষন্ন ডাক শুনতে পাই
যা আমার শিরাকে প্রশান্ত করে। এমন দিনে আমার
হৃদয়ের কক্ষে গোপনে সংরক্ষণ করা পুরানো ক্ষতটি
ভালো হয়ে যায়, চাঁদ তার অপমান মুছে দেয়
মেঘের রুমাল দিয়ে।

আমার জানালার বাইরে কাঠগোলাপের
গাছ থেকে বৃষ্টির ফোটা ঝরে পড়ে,
যেমন কোন যুবতী বিধবার অশ্রæ ঝরে।
পুরানো স্মৃতিরা পা টিপে টিপে আসে, যখন
কেউ দেখে না, কেউ খেয়াল করে না পায়ের ছাপ।
শূন্যতা অনুভব করে আমার হৃদয়
এই বৃষ্টির সন্ধ্যায়।
আমি বৃষ্টিতে তোমার বুনো চোখ মিস করছি,
মিস করছি আর্দ্র কপাল, আদিম চেহারা
এই সন্ধ্যায় বৃষ্টি এত নিরর্থক,
তুমি কি আবার আমার শহরে বেড়াতে আসতে পার না?

একাকীত্ব

একটি সঙ্কুচিত বরফের টুকরোর উপর বসা
মেরু ভালুকের মতো নিঃসঙ্গ বসে আছি একা,
শুধু তোমার জন্য,
আষাড়ের তারাহীন আকাশের বিষন্ন চাঁদের মত একা
দাঁড়িয়ে আছি।
নিঃসঙ্গতা এখন আমার সঙ্গে নীরবে কথা বলে
নিঃসঙ্গতা আমার গভীরতায় সাঁতার কাটে,
আমার চুলে জট পাকাচ্ছে,
কালো শাড়ি পরা মেঘের মতো
আমাকে অনুসরণ করছে।

আমি এখন ভিড়ের মধ্যে থেকেও একাকিত্ব অনুভব করি
চারপাশে শুধু জীবন্মৃত মানুষ আর রোবট দেখি
গুরুত্বপূর্ণ সব জিনিসগুলির সাথে যোগাযোগ করতে অক্ষম আমি
আজকাল একাকীত্বের মহাসড়কে দিনরাত ঘুরি,

নাছোড়বান্দা ঘরজামাইয়ের মত একাকীত্ব
আমাকে ছেড়ে যেতে চায় না,
যদিও এটাকে আমি আমার দরজা থেকে লাথি
দিয়ে বের করার চেষ্টা করি,
চাই পুঁতে ফেলতে অথবা কুচি কুচি করে
কেটে ভেসে দিতে যমুনার জলে।

একাকীত্ব একজন মানুষকে স্পর্শ করতে পারে না
যদি সে বিশ্বাসকে পরিধান করতে পারে,
যেভাবে একজন নারী তার
গলায় হীরের মালা পরে,
যদি তার হৃদয়ের পরিত্যক্ত করিডোরে,
বিশ্বাসের পদচিহ্ন এখনও গভীর রাতে প্রতিধ্বনিত হয়।

সৌন্দর্য

আঁধার রাতে তারাভরা নীল আকাশ আর
নিঃসঙ্গ চাঁদের উপচেপড়া হাসি,
গোধুলির শেষ রঙ, লাল মেঘ
তাকে আমি সৌন্দর্য বলি না, আমার
অনুভূতিশুন্য হাত দিয়ে তা ছুঁয়ে দেখিনা।
শান্ত সমুদ্রে সোনালি পাখির ওড়াওড়ির দৃশ্য
আমার কাছে মুগদ্ধতার আবেশ ছড়ায় না।
স্নিগ্ধ গ্রামীন নদীর উভয় পাশে ঢেউ খেলানো
ধানের ক্ষেতে মুগ্ধতায় আমি হাবুডুবু খাই না।
দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ মাঠে আর আমার
চোখ জুড়ায় না। পাথরের ওপর দিয়ে
নিরিবিলি বয়ে যাওয়া নায়াগ্রার ঝর্ণাজলের
গোলকধাঁধায় আমি আত্মহারা হই না।
ভ্যান গগের পেইন্টিং, দা ভিঞ্চির ‘মোনালিসা’
মেলে ধরে না আমার কাছে সৌন্দর্যের ডালা।
অজ গাঁয়ের অচেনা যুদ্ধ ক্ষেত্রের
যে গণকবরে শুয়ে আছে নাম না
জানা বীর সন্তানরা চিহ্নহীন স্মৃতিফলক নিয়ে,
যেখানে দেয়নি কেউ কোনদিন কোন পুস্পমাল্য,
আমার চোখে সেটি বৈভবে মোড়া আইফেল টাওয়ার
অথবা বুর্জ খলিফার চেয়ে নজরকাড়া ভাস্কর্য।

টাকার অভাবে কিনতে না পেরে
গরুর সঙ্গে ভাগাভাগি করে
লাঙ্গল টানা নাগেশ্বরীর শরীর
নুয়ে-পড়া কৃষক সলিম আলি,
যার কপালের ঘামের নোনাজলে
বৃষ্টিহীন শষ্যক্ষেতের তৃষ্ণা মেটে,
তার মুখ সবচেয়ে সুন্দর আমার কাছে।

মৃত্যুপথযাত্রী যে বৃদ্ধ তার নাক-মুখ
থেকে ভেন্টিলেটর খুলে এগিয়ে দেয়
বাঁচার আশা প্রত্যাশী কোন তরুণের
দিকে, তার জন্যই আমার জনমের শ্রদ্ধা।
পর্যাপ্ত সুরক্ষা পোষাক ছাড়াই যে স্বাস্থ্যকর্মী
জীবনের ঝুকি নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য
সকালবেলা হাসিমুখে ঘর থেকে বের হলো,
এ অবাস্তব সময়ে সে-ই সবচেয়ে বড় মুক্তিযোদ্ধা।

আমি অপলক চেয়ে থাকি, ঢেঁকির ওঠানামার দিকে,
কামারশালার হাপরের দিকে, আমি চেয়ে
চেয়ে থাকি মাছধরা জালের দিকে, কাদা জলে
ধান রোয়া সেই সাঁওতাল রমণীর দিকে,
শষ্যবোঝাই গরুর গাড়ির চাকায়,
রাতের জোনাকির আলো, ঝিঁঝি পোকার ডাক
আর মাঠ ভারি হয়ে নামা নীল কুয়াশায়
দিগন্তের ভেঙে যাওয়া প্রাচীরের দিকে।

স্কুলে পড়তে পড়তে যে বালক চায়ের
দোকানে কাজ নিয়েছে, যে যুবক মাথা
কুটেও একটা চাকরি জোটাতে পারেনি,
সে-ই আমার কাছে সৌন্দর্যের উপমা,
অজানা সুর আমার না গাওয়া গানের।
আমার সঙ্গে কীভাবে যেন আত্মীয়তা
গড়ে ওঠে ওদের। দু’হাত প্রসারিত করে
এদের আলিঙ্গনের চেয়ে বড় কোন
আনন্দ নেই আমার।

বারবার বিয়ে ভাঙ্গা কালো মেয়েটি
যেমন তার বাবার কাছে সবচেয়ে সুন্দর,
ওরাও আমার দেখা সবচেয়ে
সুন্দর জিনিস, আমার কাছে তেমনি
আমার চোখের মণি, আলোছায়ায় আমি
ওদের স্বপ্ন গুনি। ওদের জন্যই ধরনী
আজও অসুন্দর হয়ে যায়নি।

মা

রেশমের মতো নরম হাত ধরে
শেখা প্রথম আঁকা, প্রথম হাঁটা,
ফাটিয়ে গলা নামতা শেখা ভোরবেলাতে।
হ্যারিকেন জ্বালিয়ে রাতের পড়া,
একটু দূরে অন্ধকারে মায়ের পাহারা।
ভাত রেঁধে তেল চপচপে মাথায় স্কুলে,
বাড়ি থেকে স্কুল দূরে, মার কথা মনে পড়ে
মনে পড়ে না মার মুখাবয়ব, মুখাকৃতি,
শ্রেণীকক্ষে বসে আঁকি তার মুখচ্ছবি
কিছুটা মুখ, কিছুটা আভাস, ভুল হয় সবি,
অজানা আশঙ্কায় শঙ্কিত হই আমি।
ফণা তোলা গাড় অন্ধকার ভূতের ভয়
মাথায় মায়ের স্নেহমায়া মাখা হাত,
জড়িয়ে গলা সুরা পড়ে ফুঁ দেয় বুকে মুখে,
ভয়ের লিক লিকে শিখা দপ করে নিভে।
সহস্র পরিযায়ী পাখির যাযাবরতা সঙ্গে নিয়ে
ঘুরি আমি দেশান্তরে, হন্যে হয়ে খুঁজি নিজ জন্মভিটে।
মহাদেশ, সমুদ্র ও নদী পার হয়ে ঘরের কড়া নাড়ি,
আমের মুকুলের গন্ধে ভরা পুরনো, ভাঙা পাঁচিলের বাড়ি।
ভোরের প্রথম আলো, দরজা খুলেই মা হেসে বলে,
“কী হল খোকা, এত দিন পরে ফিরলি বাড়ি?”
“ চলে এলাম মা, এখন ছুটি পেয়েছি।”
লুকিয়ে চোখ মোছেন, শুরু হয় রান্নার আয়োজন
বুকভরে মায়ের ঘ্রাণ টেনে হাঁটি ফুলফলের গন্ধভরা উঠোন
পুকুরে জলে হাঁস আর খোলানে লতা ওঠা লাউয়ের মাচান
নিজে না খেয়ে মাছের বড় টুকরোটা তুলে দেয় পাতে
মায়ের হাতের রান্নার স্বাদ লেগে আছে আজও এই জিভে
জীবনের ঝড়ঝাপটায় কাঠ ঠোকরার মতো
মায়ের শরীর আঁকড়ে থেকেছি
মাকড়সার বাচ্চার মতো তার বুকের
সব মাংস কুরে কুরে খেয়েছি,
জরার গ্রাসে দুঃখ গোছাতে গোছাতে কষ্টের
বীজ পুঁতে একদিন চলে গেলেন মা দিয়ে সকলকে ফাঁকি।
বাড়িটা কেমন যেন আজ নিঝঝুম, নিস্তব্ধ, তালাবন্ধ।
রাতের অন্ধকারে জানলার গ্রিল দিয়ে
আবছা আলো এসে পড়ে মার প্রিয় বিছানাটায়,
মাকে ছুঁয়ে, মায়ের গন্ধ বুকে নিয়ে উড়ে যাই দূর অজানায়।
স্বর্গের ব্যালকনি থেকে আঙুলের ইশারায় মা আমায় ডাকে।
গা পোড়া জ্বর না পড়া পর্যন্ত আমার বিছানার পাশে,
একাদশি চাঁদের মতো এখনো বসে থাকে সারারাত জেগে।

একটি নদী ছিল

আমার একটি নদী ছিল, সেই নদীর নাম গিরাই
আমার একটি গ্রাম ছিল, সেই গ্রামের নাম গিরাই
বাড়ির সামনে চচকার বিল, পিছনে ক্ষীনতোয়া নদী,
কখনো সোনালি কখনো সবুজ আবার কখনো রূপালী,
এক চিতল মাছের সাদা পেট সদৃশ হাজির হয়ে
বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত ও উর্বর করে চলেছে সাত পুরুষ পরম্পরায়।
আমি বড় হয়েছিলাম এর ভাঙা পথের রাঙা ধুলায়।
আমি বিষন্ন হলে দুঃখ পেলে ডেকে নিত সে,
স্নেহজলমাখা হাত বুলিয়ে দিতো মাথায়।
নদীর ভালোবাসায় আমার দুহাতে পাখনা গজায়
হই রূপালী রঙের পাখি, আমি উড়তে থাকি,
পিছনে ফেলে মন খারাপের স্টেশন।
আমার কন্ঠ বদলে যায় সবুজে,
সকাল সিক্ত হতো দোয়েলের শিসে।
নদীর ধারে ফুটে থাকে সাদা কাশফুল,
ঢেউ খেলানো ধানের হাসিতে উপচে পড়ে দু’কুল।
শিমুলের গাড় লাল আর সরষে ফুলের হলুদে হৃদয় ব্যাকুল।
অস্তগামি সূর্যের নরম আলোয় গোধুলির শেষ রঙে,
নদীর জলে কেউ যেন আবির ঢেলে দেয়,
গাঙচিলেরা গাছে ফিরে যায়।
রাতের তারার আলো, স্নিগ্ধ জোতস্না, মোহময়
এর থেকে ছড়িয়ে পড়া এক নীল মায়াবি রেখা
ছুঁয়ে দেয় আমার শরীর, হাত পা মাথা
ফলভারে নুয়ে-পড়া পাইয়াল গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা।
কাছেই শ্মশান, কচি প্রান, ভূতের ভয়
মা, ছিলো আমার একমাত্র নির্ভার ও অলৌকিক আশ্রয়
মায়ের স্নেহমাখা হাত মাথায় শ্বাসরুদ্ধ দুঃসময়ে,
সুরা পড়ে বুকে মুখে ফুঁ কে আর আমায় দেবে?
টক আমগাছের ছায়া মাড়িয়ে. বিল পার হয়ে,
সুপারি বাগানের মাঝখান দিয়ে
মাথার সিঁথির মতো সরু আঁকাবাঁকা পথ মাড়িয়ে
ঘুরি হাফ প্যান্টের পকেটে রঙিন মার্বেল নিয়ে,
সুপারি গাছের ফাঁক গলে আসা নরম রোদের আলিঙ্গনে।
ধান-কেটে-নেওয়া কোন জমির ওপর দিয়ে হাঁটা
থেকে থেকে কাঁটা বেঁধে পায়ে, পিঠে এসে লাগে রোদ্দুরের ফলা।
রাখাল বালক বাঁশি বাজাতে বাজাতে হেঁটে
যায় গ্রামের রাস্তা দিয়ে।
সেই বাঁশির সুরেই যদি কেটে যেত জীবনটা।
সারা দুনিয়ায় ঘুরি, কিন্তু পিছে টানে সে মফস্বলি তৃষ্ণাটা।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সন্ধ্যা

‘অদ্ভুত এক’ কুমিরের পিঠে চড়ে
এক ঘন নিকষ আঁধার নেমে
আসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে,
কানের বারান্দায় ভেসে আসে পাম গাছগুলোর দীর্ঘশ্বাস।
যেন পাথরের উপর কারুকাজ করা
ভয়ার্ত পাতাগুলোর ভেতর দিয়ে
একটি বিবর্ণ সন্ধ্যার ক্যানভাস।

গূমোট গরমে হাঁসফাঁস করে প্রাণ,
থেমে গেছে পাখিদের আনন্দ গান।
ক্রুর কালো দৃষ্টির রুদ্রতেজ দর্শনে
পাখিদের কোলাহল গেছে থেমে
আঁধার জমছে ক্রমে ইতিহাসের ময়দানে।

কালো তারারা ঝলমল করছে,
ডাকছে প্যাঁচা কালো জ্যোৎস্নায়।
কালো পাতারা উড়ে যাচ্ছে,
প্রজাপতি, ঝিঁঝিঁরা নিরুপায়।

বাতাস ফুঁপিয়ে কাঁদছে,
বিষন্ন পাখিগুলো কাৎরায়
বৃক্ষ-খেকোর মহা-উল্লাসে
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সন্ধ্যায়।

ওরা তোমার মধ্যে লাভ-লোকসান খুঁজেছে,
উষ্ণতা, স্নেহগন্ধ খোঁজেনি।
ছুটে চলা ঘোড়ার খুরের
প্রাচীন শব্দ শোনেনি।
মন্ত্রমুগ্ধের ল্যান্ডস্কেপ দেখেছে,
প্রতিবাদের হৃদয়বিদারক সৌন্দর্য দেখেনি।

তলাবিহীন ঝুড়ি

হেনরি কিসিঞ্জার, দেখ তোমার অমুলক আশঙ্কাকে সমাহিত
করে তোমার তথাকথিত ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ থেকে রত্নজল
উপচে পড়ছে আজ সিঙ্ঘল সমুদ্রে, প্লাবিত এবং উর্বর করছে
তার তিরবর্তী বিস্তীর্ণ পলিমাটি,
আর তুমি ক্রমশ ডুবে যাচ্ছ ইতিহাসের নদীর পেটের তলানিতে,
যেভাবে, আইউব খান, ইহাইয়া খান, জুলফিকার আলি ভুট্টো
বাংলার স্বাধীনতার অভিযানের দ্বারা ক্ষয?িষ্ণু হয়েছিল।
কারণ তুমি সদ্যজাত দেশের ঝুড়ির ভেতরে
সাময়িকভাবে চাপা পড়ে থাকা বিশ্ব বিপ্লবের
ভ্রæণের সম্ভাবনাকে বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলে।
উচু নাকের আড়ালে ঢাকা পড়া তোমার চোখ
সদ্য যুদ্ধ ফেরত গামছা পরা মুক্তিযোদ্ধার
চোখের মধ্যে সূর্য, হাসির মধ্যে চাঁদ দেখতে পায়নি।

কাকে পেছনে ফেলেছি, কাকে পেছনে ফেলবো
এসব না ভেবে সে সকলকে নিয়ে এগিয়ে যাবে।
দুর্ভিক্ষ, ভাতের ফেন, লঙ্গরখানা, মঙ্গা, সা¤প্রদায়িকতাকে
ইতিহাসের ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে,
আই এম এফ এর সমস্ত সূচকে এগিয়ে,
কুসংস্কার, লুটপাট, দুর্নীতি পেরিয়ে
ক্রিকেটের ব্যাট হাতে জাতিসংঘে শান্তির পতাকা উড়িয়ে
উদারতা ও প্রাচুর্যের বিস্তীর্ণ জমিনে
দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে যাবে সুন্দর বনের সবুজ গোল পাতা
গাছের নিচে বিচরণকারি রাজকীয় বাঘেরা।

আগের মতই আছে

সব কিছু আগের মতই আছে
কোনকিছুরই পরিবর্তন হয় নাই,
দেয়ালে ঝুলন্ত জয়নুলের তৈলচিত্র,
ফ্যাকাশে চাঁদের দুঃখী ছায়াচিত্র,
এমনকি রাহুগ্রস্ত আকাশের মুমূর্ষু তারকারাজি,
শিমুল গাছে বসা শালিকের মিষ্টি মধুর গৃহস্থালি ঝগড়া
সিনেমা হলে বিরতিহীন প্রেমের পিকচার
কোনকিছুই পরিবর্তিত হয় নাই।

শহীদ মিনারে পুস্পাঞ্জলির পাহাড়,
গ্রামের স্কুলশিক্ষকের জং ধরা জানালা,
কাজ হারানো শ্রমিকের সাহায্যের আবেদনে
নিশ্চুপ মালিক,
ভন্ড প্রেমিকের হাতে প্রেমিকার পৈশাচিক হত্যাকান্ড
মানবাধিকার বিষয়ে সংবাদমাধ্যমের
কম্বল চাপা নিরবতা,
বিভাজনের দেয়াল তুলে ভোটের মাছ শিকার,
এমনকি ডিসি অফিসের কোটীপতি পিয়নরাও

ঘানিচক্র

ভোর হতে আরও কিছু বাকি।
পা দুখানি প্যাডেলের ওপরে তুলি
খালেক মিয়া বের হলো
নগর নামের অতিকায় এক
মহাজাগতিক অজগরের পেটে
দাঁড়াল এসে গলির গেটে
এক কাপ চা খায় দোকানের বেঞ্চে বসি
আচমকা পিছন থেকে ডাক ‘এই খালি’
আধ-খাওয়া চায়ের কাপ ফেলে রেখে
ঝাপ দিয়ে বসে পড়ে জীবনযুদ্ধে,
বেচে থাকার দুঃসহ ঘানিচক্রে।

সাপের জিহবার মতো লিকলিকে
সূর্যস্নাত তামাটে হাত রিকশার হ্যান্ডেলে
আধপোড়া চেলাকাঠের মতো দুটো পায়ের ভরে
কী করে টেনে নিয়ে যান ভারি ভারি যাত্রীরে!

কনকনে শিতে, ‘বেশ শীত লাগে, একটু আস্তে চালাও তো,’
ঝুম বৃষ্টিতে, “ধুর মিয়া! পর্দা রাখবা না’।
খা খা রোদে, ‘উফ! কি রোদরে বাবা! তুলে দাও তো হুড টা’

গ্রিস্মের দাবাদহ মাথায়, অবিরাম চলতে থাকে দুচাকা
তৃষ্ণায় ফেটে যায় বুকেরর ছাতিটা,
‘ওই ব্যাডা কি চালাছ, টান, পিছের টা ওভারটেক করে ক্যান?”

বেড়ে যায় রিকশার গতি ঝড়ের বেগে
ঘোড়ার কেশরের মতো ফুলে ওঠে
ঘাড়ের লোমগুলি দমকা বাতাসে।
হাতের শিরাগুলি শ্বাস প্রশাসের সাথে
লাফায় ব্যাঙের মতো তরাক তরাক করে।
বোশেখের দাবা দাহে, বুকের রক্ত ঢেলে
সূর্যের দিকে পিঠ করে, হাওয়ার বিপরীতে
সর্বশক্তি দিয়ে ঘাম লেপা শরীরটাকে ক্রিং ক্রিং শব্দে
টানতে টানতে গন্তব্যে ফিরে ভেজা লোনাজলে।

আধ-ময়লা গামছাটা চিলের ডানার মতো
ওড়ে আকাশে, দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে,
চোখের শিরাগুলো হয়ে ওঠে রক্তলাল,
জয়ের নেশা, মুষ্টিবদ্ধ হাত শক্ত চোয়াল।
নখগুলো ধারালো, আঙুলগুলো সব থাবা,
সেখানে ধক ধক করে জ্বলন্ত লাভা,
ধমনীর মধ্যে ছুটছে মদ উষ্ণস্রোতা

সকাল থেকে রাতে নদীর মোহনায় সৃষ্ট স্রোতের মতো ঘোরে।
ভালোবাসায় নতজানু ব্যথায় মোড়ানো শরীর নুয়ে পড়ে,
স্ত্রী কন্যার মমতার ঋণের ভারে।
ফুরফুরে বাতাসে উতফুল্ল আরোহী
খালেক মিয়া যুগপত রথ ও রথী
রৌদ্রঝলসিত চোখে তার খ্যাপ শেষ করার হাসি।