Home কলাম আকাশ যানে আকাশ পথ

আকাশ যানে আকাশ পথ

ড: বাহারুল হক : কত রকমের যে অভিজ্ঞতা! বিকাল পাঁচটায় আমরা বের হলাম বাসা থেকে। ট্রাফিক জ্যামে পড়ে টরন্টো এয়ারপোর্টে পৌঁছতে পৌঁছতে অনেক সময় চলে গেল। এয়ার কানাডার বিমানের যাত্রী আমরা। তাই চেক- ইন-এর জন্য দাঁড়ালাম এয়ার কানাডার একটা ডেস্কের সামনে। আমি আর আমার স্ত্রী দুই জনের দুইটি পাসপোর্ট টিকেট সহ ডেস্কে কর্মরত মহিলার হাতে ধরিয়ে দিলাম। তিনি পাসপোর্ট দুইটি দেখতে দেখতে হয়রান। ভ্যাক্সিনের সার্টিফিকেট দেখলেন। এবার বললেন- তোমাদের পিসিআর টেস্টের সার্টিফিকেট দাও। আমি বললাম- সার্টিফিকেট কোথায় পাব, আমরাতো টেস্ট করাইনি। তিনি আঁতকে উঠে বললেন- করাওনি, কেন করাওনি? আমি বললাম- লাগবে না তাই করাইনি। তিনি বললেন – কে বলেছে লাগবে না? আমি বললাম- বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করেছে। এই বলে আমি বাংলাদেশ সরকারের ঘোষণা পত্রের কপি দেখালাম। তিনি বিশ্বাস করেন না। আমি বললাম- এখন এটা তোমার দায়িত্ব আমাদের যে টেস্ট করা লাগবে এটা প্রমাণ করার। আমার কিছু করার নাই। তিনি এবার আমাদের পাসপোর্ট দুইটি নিয়ে কোথায় যেন গেলেন। সেখান থেকে সবক নিয়ে ডেস্কে ফিরে এলেন এবং আমাদের দুইজনের নামে দুইটি বোর্ডিং পাস ইসু করলেন। পাস দুইটি নিয়ে বললাম- এতো এয়ার কানাডায় চড়ে দুবাই যাওয়ার পাস। দুবাই থেকে তো বাংলাদেশ বিমানে চড়ে আমরা ঢাকা যাব, সে বিমানের পাস কোথায়? তিনি বললেন- ওটা অন্য এয়ার লাইনস। সে বিমানের বোর্ডিং পাস আমরা দিতে পারব না। আবার কথা; কথার পৃষ্ঠে কথা। না হেরে গেলাম। ঢাকাগামী বাংলাদেশ বিমানের বোর্ডিং পাস পেলাম না।

এরপর ছেলে চলে গেল বাসায় আমরা চলে গেলাম সিকিউরিটি চেকিং-এ। ক্যারি- অন, পার্সোনাল আইটেম তো আছে সাথে দিলাম কোমরের বেল্ট, ল্যাপটপ, ইত্যাদি। তারপর বিমানের পাখার মত দুই হাত মেলে যেই না মেটাল ডিটেক্টরের ভিতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম অমনি ক্যাঁ ক্যাঁ করে উঠলো ডিটেক্টর। কি ব্যাপার? হাঁ, বুঝেছি, পকেটে চাবি ছিল। ওগুলো তাদের হাতে দিয়ে আবার হেঁটে গেলাম। না, এবার ডিটেক্টরে কোন শব্দ নাই। সিকিউরিটির ট্রে থেকে সব মালপত্র কালেক্ট করে এবার হাঁটা দিলাম গেটের দিকে। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত। হঠাৎ মনে পড়ে গেল হেমন্তের সে বিখ্যাত গান-
“পথের ক্লান্তি ভুলে স্নেহ ভরা কোলে তব
মা গো, বলো কবে শীতল হবো।
কতদুর আর কতদুর বলো মা,
কত দুর আর কত দুর বলো মা”।

অনেক পথ হেঁটে শেষে পৌঁছলাম গেটে। এবার বিমানে উঠার জন্য অপেক্ষা।
সময় হলে সবার সাথে আমিও উঠলাম এয়ার কানাডার বিশাল ড্রীমলাইনার ৭৮৭ বোইং বিমানে। বিমানের ভিতরটা দেখে বুঝলাম নতুন বিমান। উজ্জল আলোয় মনে হচ্ছিল বিমানের ভিতরটা হাসছে। বিমানে আমার আর আমার স্ত্রীর সিট পাশাপাশি ছিল না। এই ব্যাপারটা ছিল একেবারে অপ্রত্যাশিত। আমি আমার স্ত্রী সহ বহু বার বিমানে ভ্রমন করেছি, কিন্তু কখনো আমরা এভাবে বিমানের ভিতর দূরে দূরে দুই সিটে বসিনি। এবারই প্রথম। বিষয়টা বিমান বালার নজরে আনলে হৃদয়বান বিমান বালা আমাদের আশ্বস্থ করলেন এবং আপাতত নিজ সিটে বসে যেতে বললেন। বিমান আকাশে উঠলে বিমান বালা সক্রিয় হলেন। তিনি আমাকে আমার স্ত্রীর পাশে বসানোর ব্যাবস্থা করলেন। যাক একটা গুরুতর সমস্যার মিহি সমাধান হয়ে গেল। এখন সমস্যা হলো তার কোট ওভারকোট নিয়ে; এগুলো এখন রাখবে কোথায়? আমার গুলো আমি ছেলেকে দিয়ে দিয়েছি। ছেলে বাসায় নিয়ে গেছে। আমার স্ত্রী আমার কথা শুনেনি। ঠান্ডার ভয়ে সে এ গুলো গায়ে দিয়েই বিমানে উঠেছে, অথচ এখন সে বুঝতে পারছে বিমানের ভিতরে অত ঠান্ডা নেই। তাই কোট ওভার কোট লাগছে না; বরং সেগুলো এখন সমস্যা হয়ে উঠেছে। যাই হোক, ওভার হেড কেবিনে একটু জায়গা পেলাম এবং তাতে সেগুলো রাখার একটা বন্দোবস্ত করলাম।

বিমান আকাশে উঠলে বিমানের ভিতরটাতে রাতের পরিবেশ এসে গেল। আমি একটু অবাক হয়ে গেলাম এয়ার কানাডার এই ব্যাবস্থা দেখে। রাতের খাবার না দিয়ে ঘুমাবার পরিবেশ উপহার দেওয়ার কি মানে বুঝলাম না। এরকম ভাবতেছি, এর মধ্যে হঠাৎ বিমানের ভিতরটা আলোকিত হয়ে গেল; বিমান বালারা কর্ম তৎপর হয়ে উঠলো। মনে মনে ভাবলাম কিছু একটা হবে। হাঁ, তাই, বিমান বালারা খানা পিনা – র ট্রলী নিয়ে যাত্রীদের দিকে এগোচ্ছেন। দেখে খুব ভালো লাগলো। আমাদের দুইজনকে দিল ভিন্ন রকমের দুইটি খাবারের বাক্স। দেখি বাক্স দুইটির গায়ে লেখা আছে – মুসলিম মিল। গরম সব খাবার; খেয়ে তৃপ্তি পেলাম। এরপর,আসলো নানারকম জুস- আপেল, লেমন, অরেঞ্জ, টম্যাটো, ইত্যাদি। আকাশে টম্যাটো আমার প্রিয় জুস; আমি তাই নিলাম। খাওয়া দাওয়া শেষ হলো। রাত অনেক হয়েছে। বিমান ঘন্টায় প্রায় ৮০০ মাইল বেগে ভুপৃষ্ঠের ৩৯০০০ ফিট উপর দিয়ে পুর্ব দিকে ছুটছে। বিমানটি নাক বরাবর ছুটে আটলান্টিক পাড়ি দিচ্ছে না। বরং কিছুটা উত্তর দিক চেপে পুর্ব দিকে যাচ্ছে। ফলে আমারা পথার মধ্যে পেয়ে গেলাম আইসল্যান্ডের মত একটি দেশ। আইসল্যান্ড হয়ে বিমান এবার যাবে যুক্তরাজ্যের দিকে। লন্ডন ব্রীজ, হাইড পার্ক, বাকিংহাম প্যালেস, মাদাম তুষো ওয়াক্স মিউজিয়াম,বৃটিশ মিউজিয়ামের মত দর্শনীয় স্থানের ডাক উপেক্ষা করে বিমান যাচ্ছে আইফেল টাওয়ারের দিকে। এভাবে একে একে অতিক্রম করে যাচ্ছে নানা দেশ; ছুটছে বালুকাময় মরু দেশের রুপালি শহর ডুবাইর দিকে। দুই চার ঘন্টা নয়; বিমানের এই ছুটে চলা অভ্যাহত থাকবে টানা চৌদ্দ ঘন্টা। চৌদ্দ ঘন্টা পর এই বিমান পৌঁছবে ডুবাই। একটানা চৌদ্দ ঘন্টা বিমানে বসে থাকা যে কি যন্ত্রনা তা যে ভ্রমন করে সে-ই বুঝে ভালো। আমি একদম পারিনা ; তাই দু চার ঘন্টা পর আমি হাঁটা হাঁটি করি । কখনো কিচেনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকি। সে এক বিশ্রী অবস্থা; ভালো লাগে না। তবু ও যেতে হয়, চড়তে হয়, বসে থাকতে হয়; এ ছাড়া যে কোন বিকল্প নাই। আমি তো কানাডা গুজ পাখি নই যে উড়াল দেব; উড়ে উড়ে দেশের পর দেশ অঞ্চলের পর অঞ্চল অতিক্রম করে পৌঁছে যাব প্রিয় মাতৃভুমি বাংলাদেশে। দীর্ঘ চৌদ্দ ঘন্টার লম্বা আকাশ পথ ভ্রমনের সমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে। এয়ার কানাডার ঢাউস সাইজের বোইং বিমানটি এখন ধীরে ধীরে নিচের দিকে নামছে, বিমানের গতি ও কমে অসেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে বিমান ডুবাইর আকাশে।তারপর ধীরে ধীরে বিমানটি ডুবাই এয়ার পোর্টে অবতরন করলো। যাত্রীদের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। বিমান থেকে নেমে দেখি ডুবাইর আকাশে ডুবন্ত সুর্যের সোনালী আভা। লাউঞ্জে এবার সাত সন্টা বসে বসে অপেক্ষা করতে হবে ঢাকা গামী বিমানের জন্য। ঢাকা কিভাবে গেলাম সে কথা পরে লিখবো।
লেখক : কানাডা

Exit mobile version