ভজন সরকার : একেক সময় ভাবি আসলে বড় কে? মানুষ? মানুষের কর্ম? নাকি, ওই মানুষটার প্রতি সমাজে যে কোনোভাবে রটে যাওয়া যে অনুভূতি সেটি? অনেকে বলেন, ব্যক্তি মানুষই বড়। কারণ, সমাজে এবং তার আশেপাশে বাস করা মানুষের প্রতি যে মমত্ববোধ বা সহমর্ম সেটিই আসল। আবার অনেকে বলেন, না, ওই মানুষটি তাঁর যাপিত জীবনে যে কাজটি করে গেলেন সেটিই আসল কথা।
তা হলে কি ব্যক্তি জীবনে জঘন্য মানুষটিও কিছু ভালো কাজ রেখে গেলেই তা পরবর্তীতে তিনি নমস্য হবেন? কিংবা সেই ভালো মানুষটি, যিনি তাঁর কর্ম জীবনে কল্যাণের পথেই থাকলেন কিন্তু কিছুই রেখে গেলেন না। আবার এমন মানুষও তো আছেন, কী ব্যক্তি, কী তাঁর কাজ, সে সবের হয়ত কিছুই জানি না, তবুও মানুষটিকে সমীহ করতেই হয়। কারণ, তাঁর খুব পরিচিতি আছে সমাজে। এটাকে বলে, রব বা কোলাহল শুনে প্রশংসা করা।
বেশ আগে এক আড্ডায় তেমন কিছু অভিজ্ঞতা হলো। বাঙালির আড্ডা মানেই তো রাজনীতি আর ধর্ম নিয়ে আলোচনা; বিশেষকরে প্রবাসে বাঙালির যে আড্ডা হয় সেখানে তো অবশ্যই। এ দু’টো অনুপস্থিত থাকলে, পরনিন্দা-পরচর্চা। সেদিনও এর ব্যক্তিক্রম ছিল না।
দীর্ঘ বছরের বিরতিতে তখন সবে লেখালেখি শুরু করেছি। তাই সীমিত গন্ডিতেই প্রচার-প্রকাশ। আয়োজক ভদ্রলোক আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন লেখালেখি করি এ হিসেবে। এক ভদ্রলোক তাচ্ছিল্য সহকারে বললেন, পড়িনি তো কোথাও আপনার লেখা।
আমি বিনীতভাবে বললাম, খুব সামান্যই লিখেছি। তাই চোখে পড়েনি।
ভদ্রলোক আমার বিনয়কে দুর্বলতা ভাবলেন। আরো এক ধাপ এগিয়ে বললেন, আপনার লেখা পড়িনি, তাই আপনি লেখক সেটা বোঝা মুশকিল।
আমি হেসে উঠলাম। ভদ্রলোক তাকিয়ে রইলেন বিরক্তের সাথে। আমি একজনের নাম বলে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি এই ভদ্রলোককে চেনেন?
মাথা ঝাঁকিয়ে উনি বললেন, হ্যাঁ উনি তো খুব বড় কবি।
আমি বললাম, আপনি উনার কবিতা পড়েছেন? উনার লেখা যে কোনো একটা বইয়ের নাম বলতে পারবেন?
ভদ্রলোক হা করে তাকিয়ে রইলেন। আমি বললাম, উনার একটা লেখাও পড়েননি অথচ উনাকে আপনি খুব বড় কবি মনে করেন। কারণ, আপনি শুনেছেন যে, উনি বড় কবি। তাই শুধু লেখালেখিই বোঝায় না যে, কে বড় কবি বা লেখক। মূল কথাই হলো, কে প্রচারের আলোতে কত উজ্জ্বল কিংবা কোন্ বিখ্যাত মানুষ কা’কে নিয়ে কী বলেছেন কিংবা কতো জোরে বলেছেন? তাই আপনি কিছুই ভুল বলেননি।”
ভদ্রলোকের মুখ দেখে মায়া হলো; বিনা মেঘে এমন বজ্রাঘাত পাবেন সেটি হয়ত কল্পনার অতীতই ছিল।
স¤প্রতি প্রয়াত হয়েছেন কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক। খুব ছোটবেলা থেকেই শুনছি, খুব শক্তিশালী লেখক হাসান আজিজুল হক। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বন্ধুরাও সে কথা বলতেন।
একজন জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুই পড়েছিস হাসান আজিজুল হকের কোনো লেখা?
বন্ধু হা করে তাকিয়ে থেকে কাঁচুমাচু হয়ে বললো, মানে আমি পড়িনি। সবাই বলে তো তাই বললাম।
বন্ধুকে সেদিন বলেছিলাম, যতোদিন না হাসান আজিজুল হকের কোনো লেখা পড়বি, ততোদিন আমার সামনে বলবি না উনি খুব বড় লেখক। আর যদি বলতে হয় তবে বলবি, অমুকে বলেছেন উনি খুব বড় লেখক।
হাসান আজিজুল হককে নিয়ে একটা বিশেষ সংখ্যায় লেখার অনুরোধ পেয়ে আমিও হাসান আজিজুল হকের লেখালেখির খোঁজাখুঁজি শুরু করলাম। দীর্ঘদিন প্রবাসে থেকে বই-সঙ্কটে ভুগছি। তবুও খুব যে কম পড়েছি হাসান আজিজুল হককে তা নয়। ২০০৬ সালে হাসান আজিজুল হকের প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হলো; নাম ‘আগুন পাখি’। বইটি আমি পরের বছরই সংগ্রহ করে পড়েছি। তার আগে হাসান আজিজুল হক মূলত গল্পকার হিসেবেই সাহিত্যাংগনে পরিচিত ছিলেন। তাছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবেই তাঁকে আশি-নব্বই দশকে চিনতাম।
যা হোক, অনুরোধে ঢেঁকি গেলার মতো করেই হাসান আজিজুল হক অনুবীক্ষণ শুরু করেছি। অনেকের সাথে আলাপও করছি। সব মিলিয়ে এ কথাটা বলতেই হচ্ছে যে, আমার মতো অনেকের কাছেই হাসান আজিজুল হকের নাম যতো পরিচিত, হাসান আজিজুল হকের লেখালেখি ততোটা পঠিত নয়। তবুও হাসান আজিজুল হক উঁচু স্তরের লেখক। এ কথা সত্যি, যারা তাঁকে পড়েছেন তাঁদের কাছে তো অবশ্যই, যারা পড়েননি তাঁদের কাছেও তিনি গুণী লেখক। একজন লেখককে না পড়েই এমন মূল্যায়ন একজন লেখককে কতটুকু সম্মান দেওয়া হয় জানি না, তবে একজন পাঠক হিসেবে আমাদের এমন মানসিকতা খুব লজ্জার।
এ লজ্জা মনে হয় হাসান আজিজুল হক নিজেও পেয়েছেন অনেকবার। এক সাক্ষাৎকারে হাসান আজিজুল হক বলেছিলেন, আরেক বন্ধু ও লেখকের অনুরোধে তিনি প্রবাসী এক লেখকের লেখা নিয়ে প্রশংসাসূচক মন্তব্য লিখে কেমন বিব্রত হয়েছিলেন। সংবাদপত্রের এক ধণাঢ্য মালিক ও শিল্পপতির লেখা নিয়ে লিখেও পরে বিব্রত হয়েছিলেন।
উভয় ক্ষেত্রেই হাসান আজিজুল হক লেখাগুলো না পড়েই লিখেছিলেন ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে। হাসান আজিজুল হক নিজেই বলেছেন, “ৃওই কানাডায় যাওয়া, ওই ইমিগ্রেশন? ওটা আত্মকাহিনীও নয়। ও আবার একটা অদ্ভুত জিনিস।”
প্রশ্ন জাগেই, ওই “অদ্ভুত জিনিস” নিয়ে তা হলে কেনো লিখলেন? এ কথাগুলো বললাম এ কারণে যে, সোস্যাল মিডিয়ার যুগে অনেক সময় প্রচারেই প্রসার ঘটে। লেখক হিসেবে তো বটেই একজন পাঠক হিসেবেও এগুলো খুব হতাশার কারণ। অথচ এই হতাশা চলে এসেছে যুগযুগ থেকেই। কত নি¤œ-মাঝারি লেখক খ্যাতি কুড়িয়েছেন আবার অনেক উঁচু মানের লেখকও প্রচারের আলো থেকে দূরে থেকে অখ্যাতই রয়ে গেছেন।
তাই যে কথাগুলো বলে এ লেখাটি শুরু করেছিলাম, আসলে বড় কে? প্রয়োজনীয় কোনটা? ব্যক্তি মানুষের মূল্যবোধ? নাকি, খন্ডকালের অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ যে লেখালেখি সেগুলো? নাকি দু’টোই? কিংবা, প্রচারের আলোতে বিজ্ঞাপনময় যে খ্যাতি সেই খ্যাতির অন্তঃসারশূন্যতা?
সময় বড় ভয়ঙ্কর। মহাকালের অতল গহীন অন্ধকারে সবাই নিমজ্জিত হবো একদিন। হয়ত এই পৃথিবী, এই সৌরজগত, এই মহাবিশ্বও একদিন হারিয়ে যাবে। তারপর হয়ত আবার নতুন কিছু। হয়ত কিছু না থেকেই লক্ষ-কোটি বছর কেটে যাবে; এই মহাবিশ্ব সৃষ্টির আগে যেমন ছিল। চারিদিকে সর্বগ্রাসী নশ্বরতার ভিতরেও আমাদের অবিনশ্বর হওয়ার কী ব্যর্থ প্রচেষ্টা?
(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা)