ফরিদুর রহমান : প্রিজনেস ইন্টারন্যাশনাল একটি আন্তর্জাতিক উত্সব হলেও ইওরোপের বিশেষ করে ইওরোপিয় ইউনিয়নভুক্ত দেশের অংশগ্রহণ অনেক বেশি। শেষ দিন সকালের অধিবেশনে ছয় বছর বয়েস পর্যন্ত শিশুদের জন্য নির্মিত চলচ্চিত্র এবং টেলিভিশন অনুষ্ঠান উভয় ক্ষেত্রেই তার প্রতিফলন দেখা গেল। অন্যান্যদিন ইওরোপের দেশগুলোর অংশগ্রহণ বেশি থাকলেও উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, এমন কি এশিয়া থেকেও স্বল্প সংখ্যক প্রতিনিধিত্ব দেখা যায়। কিন্তু এ দিন তাইওয়ানের একটি বাদ দিলে বাকিগুলো ছিল আয়ারল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, ইংল্যান্ড, জার্মানি এবং মেসেডোনিয়ার। এ সব ছবির বেশিরভাগই আবার এ্যানিমেশনে তৈরি কাহিনি ছবি। অনেক গবেষণা এবং পরীক্ষা নিরীক্ষার পরে ছোটদের জন্য নির্মিত আকর্ষণীয় এ সব ছবি তৈরি যেমন ব্যয়বহুল তেমনি প্রযুক্তিগত উত্কর্ষ বা টেকনিক্যাল এ্যাক্সিলেন্স না থাকলে এ ধরনের কাজ করা সম্ভব নয়। কাজেই ইওরোপের অংশগ্রহণ বেশি বলে উদ্যোক্তাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। আমরা এখনো সাধারণ আন্তর্জাতিক মানের কোনো চলচ্চিত্র নির্মাণে সক্ষমতা দেখাতে পারিনি। কাজেই এদেশে ‘কার্টুন’ নামে পরিচিত শিশুদের জন্যে বিশেষায়িত এ্যানিমেশন ছবি নির্মাণ আমাদের জন্য এখনো স্বপ্নের ব্যাপার।

লাঞ্চব্রেকের পরপরই গত কয়েকদিন ধরে দেখা সবগুলো প্রামাণ্যচিত্র, স্বল্পদৈর্ঘ্য কাহিনি চিত্র এবং টেলিভিশন অনুষ্ঠানের বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন ঘোষণা করা হলো। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক দর্শকের ভোটে নির্বাচিত পুরস্কার, শিশু জুরি পুরস্কার, প্রিজনেস হার্ট প্রাইজ, ইউনিসেফ পুরস্কার এবং প্রিজনেস ইয়ুথ প্রাইজসহ বেশ কয়েকটি মনোনয়নের মধ্যে ‘অশ্বারোহী তাসমিনার’ নাম নেই। প্রতিটি মনোনয়নের জন্যে তিনটি করে নাম ঘোষণা করে মঞ্চে আহবান জানানো হচ্ছে। দীর্ঘ সারিতে দাঁড়ানো পরিচালক প্রযোজকেরা যখন মঞ্চের প্রায় পুরোটাই দখল করে নিয়েছে এবং ধরেই নিয়েছি আমাদের মঞ্চে ডাক পাবার কোনো সম্ভাবনা নেই তখন ঘোষণা এলো জেন্ডার ইকুইটি পুরস্কারের প্রথম নাম ‘হাউ কাই টার্ন ইনটু নিলস’ দ্বিতীয় মনোনয়ন ‘তাসমিনা দ্য হর্সগার্ল’। আমাদের প্রযোজক মাহবুবা বেগম ছবির পরিচালকে মঞ্চে যেতে বলছিলেন। কিন্তু আমি তাকে এক রকম জোর করে মঞ্চে পাঠিয়ে দিলাম। ঠিক এর পরপরই ঘোষণা এলো প্রিজনেস থিম প্রাইজের। প্রথম মনোনয়ন ‘তাসমিনা দ্য হর্সগার্ল।’ এবারে আর পরিচালকের মঞ্চে আরোহনে সমস্যা রইল না। মনোনয়নের স্মারক হিসাবে দুজনের গলায় ঝুলিয়ে দেয়া হলো দুটি যথেষ্ট ওজনদার মেডেল।

ভোকস থিয়েটারে সমাপনী অনুষ্ঠান শুরু হবে রাত আটটায়। তবে যাঁরা পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়েছেন তাঁদের উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে একঘণ্টা আগে। আমাদের হোটেল থেকে ব্রিয়েনার স্ট্রাসার ভোকস থিয়েটারের দূরত্ব দশ মিনিটের বেশি নয়। তারপরেও সাড়ে চারটার দিকে হোটেলে ফিরে সাড়ে ছয়টা বাজার আগেই আবার বেরিয়ে পড়লাম। পুরস্কারের চূড়ান্ত ঘোষণার ব্যাপারে আগ্রহ সবারই একটু বেশি। তাই আমরা পৌঁছাবার আগেই আরো অনেকেই হাজির হয়ে গেছেন। কিছু পরেই ফেস্টিভ্যাল কো-অর্ডিনেটর ক্রিস্টিন স্নেইডের নির্দেশনায় শুরু হলো ‘এ্যাওয়ার্ড সেরেমনি’র মহড়া। হলের ভেতরে কে কোন সারিতে বসবেন, পুরস্কারের জন্য মনোনীতদের মধ্যে পুরস্কার বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা হলে কোন পথে মঞ্চে উঠতে হবে, কোথায় দাঁড়িয়ে পুরস্কার গ্রহণ করতে হবে এবং রোস্ট্রামে দাঁড়িয়ে পুরস্কার প্রাপ্তির অনুভূতি বা অন্যকোনো কথা থাকলে তাও বলা যাবে, তবে তা অবশ্যই দুই মিনিটের বেশি নয়। আমি হাসতে হাসতে ক্রিস্টিনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মনোনয়ন পেয়েছি দুটো, পুরস্কার যদি একটাও না পাই তাহলে কী হবে?’ ক্রিস্টিন সব ব্যাপারেই সিরিয়াস। বললো, ‘আশা করি তেমনটা ঘটবে না।’

একাধিকবার রিহার্সাল শেষ হবার পরে আমরা যখন বাইরে বেরিয়ে এলাম ততোক্ষণে সবার পানপাত্র কানায় কানায় পূর্ণ! কি আশ্চর্য গত কয়েকদিনে একবারও যাঁর চেহারা দেখা যায়নি, বাংলাদেশের তেমনি একজন প্রতিনিধি রেড ওয়াইনের গ্লাস হাতে নিয়ে দিব্যি বিভিন্ন দেশের নির্মাতা কলাকুশলীদের সাথে খাতির জমিয়ে গল্প করছেন। লবি ছাড়িয়ে থিয়েটারের বাইরের বিস্তৃত প্রাঙ্গণ জুড়ে ছয়টি উপমহাদেশের বাষট্টি দেশের ফিল্ম ও টেলিভিশনের প্রায় সাড়ে চারশ সৃজনশীল মানুষের গল্প-আলাপ আর হাসি ঠাট্টার পাশাপাশি অভিজ্ঞতা বিনিময়ের আড্ডায় সমাপ্তি টেনে থিয়েটার হলে প্রবেশের ঘণ্টা বেজে উঠলো। একে একে নির্ধারিত আসনে বসে পড়ার পরে আরম্ভ হলো জাকজমকপূর্ণ সমাপনী অনুষ্ঠান। সঙ্গীত, শিশুদের পরিবেশনা, অসাধারণ কোরিওগ্রাফি, ম্যাজিক শো এবং চোখধাঁধাঁনো ইলেক্ট্রো-টেকনো ডান্স এর মাঝে মাঝেই ফেস্টিভ্যাল ডিরেক্টর মায়া গটজের স্বাগত বক্তব্য, মডারেটরের মন্তব্য, ইউনিসেফ প্রতিনিধি এবং ব্যাভারিয়া সরকারের প্রতিনিধির সংক্ষিপ্ত শুভেচ্ছা ভাষণের পরে শুরু হলো পুরস্কার প্রাপ্তদের নাম ঘোষণার পালা।

অনুভূতি প্রকাশের বক্তব্য

প্রাথমিক মনোয়নের ভেতর থেকে পুরস্কৃত ছবির নাম ঘোষণার পরে কুড়ি-পঁচিশ সেকেন্ডের একটি নির্বাচিত অংশ প্রদর্শন এবং কেন এই ছবিটিকে পুরস্কার প্রদান করা হলো সে সম্পর্কিত ‘সাইটেশন’ পাঠের সাথে সাথে পরিচালক, প্রযোজক বা তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত বিশেষ অতিথির হাত থেকে পুরস্কার নিয়ে সংক্ষেপে কিছু বলে নেমে আসেন। প্রচুর করতালির মধ্যে অনেকটা সময় ধরে একের পর এক পুরস্কারের নিয়ে যাচ্ছেন নির্মাতারা। আমাদের মনোনয়ন পাওয়া জেন্ডার ইক্যুইটি পুরস্কারও চলে গেল ‘হাউ কাই টার্নড ট্যু নিলস’এর হাতে। যখন ভাবছি পুরস্কারের ঘোষণা তো প্রায় শেষ! ঠিক তখনই ছয়টি ক্যটাগরির শ্রেষ্ঠ পুরস্কার ঘোষণার ঠিক আগে ঘোষণা শুনলাম, ‘প্রেস্টিজিয়াস প্রিজনেস থিম প্রাইজ গোজ টু এ নন-ফিকশন, ‘তাসমিনা দ্য হর্স গার্ল’!

‘অশ্বারোহী তাসমিনা’র একটা অংশ দেখাবার পরে সাইটেশনে বলা হলো, “Tasmina the Horse GirlÓ follows 11-year old Tasmina in Bangladesh living her passion: competing in pony races. The stand-alone documentary shows how, even in a very male-dominant environment, girls can make their way through competitions are sometimes not fair. By giving Tasmina a voice, letting her tell her story openly, it not only reveals all the little details of gender inequality in everyday life, but offers a perspective on how an individual can find her own way. This is a documentary that encourages girls to find their own way, and parents to let girls develop towards more gender equality.
জেন্ডার ইক্যুইটি পুরস্কারই শুধু নয় নন-ফিকশন ক্যাটাগরিতে শেষ্ঠ পুরস্কারও পেলো ‘হাউ কাই টার্নড ট্যু নিলস’। ফিকশনে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পেলো ‘স্লিপিং লায়ন’। এরপরের বয়স ভিত্তিক প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ প্রামাণ্যচিত্র ‘দ্য বয় উইথ দ্য বাইসাইকেল’ এবং কাহিনি চিত্র ‘লিটল লাঞ্চ’। ফ্রি প্রেস আনলিমিেিটডের ‘কুনমি দ্য নেটিভ থান্ডার’ পেলো নন-ফিকশনে রানার্স আপ পুরস্কার। শ্রেষ্ঠ পুরস্কার ছাড়াও প্রিজনেস হার্ট প্রাইজটাও ছিল ‘দ্য বয় উইথ দ্য বাইসাইকেল’এর। আমার ব্যক্তিগত পছন্দের ‘নিউ’ ‘সুপারস্যান গাননা’ ‘উইশ ফিশ’ এবং স্কেলেটনও একেবারে বাদ পড়েনি। পুরস্কার প্রাপ্ত সকলকে নিয়ে ফটো সেশনের সময় স্থিরচিত্রগ্রাহক সকলকে জোরে একটা চিত্কার দিতে বলেছিলেন। চিত্কারটা না শোনা গেলেও প্রায় সকলের দুই হাত তোলা সেই ছবিটিই পরে দেখা গেল প্রিজনেসের ওয়েবসাইটে। ফটো সেশনের পরে মঞ্চ যখন প্রায় খালি হয়ে এসেছে তখন বিসিসিবি’র নির্বাহী প্রযোজক কেজ মার্গরি তাঁর হুইল চেয়ারে বসেই হেনাকে কাছে ডেকে নিয়ে তাসমিনা সম্পর্কে তাঁর ভালো লাগার কথা জানালেন। অনুুষ্ঠান শেষে যখন কয়েকজন এক সাথে হাঁটতে হাঁটতে হোটেলে ফিরলাম তখন রাত এগারোটা। প্রিজনেসের উপদেশক ডেভিড কিম্যান মঞ্চে তাঁর তোলা ছবিগুলো রাতেই পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

পরদিন ভোরে ঘুম ভাঙতেই মনে হলো আজ ফেস্টিভ্যালের দিকে যেতে হবে না, আজ আর কোনো ছবির প্রদর্শনী নেই। প্রজেকশন হলে, লবিতে বাইরের চত্বরে পরিচিত মুখের ‘হাই- হ্যালো’ নেই, দিনের ব্যস্ততা এবং রাতের পার্টি সব কিছুই এবারের মতো শেষ। কিছুক্ষণ এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করেছিলাম। ধিরে সুস্থে ব্রেকফাস্ট শেষ করে বেরিয়ে পড়লাম মিউনিখ নগর দর্শনে। আমাদের মুনশেন গ্লাডবাখ যাবার ট্রেন বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে।

মিউনিখের পুরোনো নগর কেন্দ্র ঘুরে আসবার মতো যথেষ্ট সময় আছে হাতে। একাধিকবার মিউনিখে আসার ফলে এই শহরের উল্লেখযোগ্য স্থাপনা, প্রাসাদ, মিউজিয়াম এবং উদ্যানের বেশিরভাগই আমার দেখা। তবে প্রযোজকের জন্যে মিউনিখ নতুন। আমাদের হোটেল থেকে হেঁটেই চলে যাওয়া যায় নগর কেন্দ্র মারিয়ান প্লাজসহ চারশ বছরের পুরোনো সব ঐতিহাসিক ভবন এবং গির্জায়। ইতিহাসের প্রাচীন স্মৃতিচিহ্নগুলোর পাশাপাশি আধুনিক শপিংমল এবং উন্মুক্ত বাজার কেউ কারো সৌন্দযর্কে আহত না করে চমত্কারভাবে জায়গা করে নিয়েছে।

কার্লসপ্লাজ বাসস্টপ পেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমরা অষ্টদশ শতকে চার্লস থিওডরের উদ্যোগে নির্মিত কার্লসপ্লাজ ফাউন্টেন ঘিরে রাখা বড় বড় পাথর খণ্ডের একটিতে বসে পড়ি। অবিরাম ঝরতে থাকা ঝরনার ঠাণ্ডা জলের ছিটেফোঁটা ঝিরঝির করে শরীর স্পর্শ করে যায়। ব্যাভারিয়ার জননিন্দিত ডিউকের জন্য দুর্ভাগ্যজনক হলো, মৃত্যুর দুশ বছর পার হয়ে গেলেও কার্লসপ্লাজ স্কোয়ার এবং কার্লসপ্লাজ ফাউন্টেন এখন পর্যন্ত ‘স্টাচুচ’ নামে পরিচিত। কোনো এককালে এখানে ‘স্টাচুচ’ নামে একটি বার ছিল। গণরোষ এমনই এক জিনিস এখনও বাসস্ট্যান্ড, ঝরনা এবং চত্বরের নাম হিসাবে মানুষ অতীতের সেই নামটিই ব্যবহার করে।
একটু সামনে এগিয়ে পুরোনো শহরে ঢোকার মুখে পার হতে হবে ষোড়শ শতকের কার্লস্টর তোরণ। মধ্যযুগে মিউনিখ নগরের প্রতিরক্ষা দেয়ালের পাঁচটি তোরণের একটি এই কার্লস্টর। পুরো এলাকাটা ট্যুরিস্ট আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হলেও সকালের দিকে তেমন জনসমাগম নেই। পথের দুপাশে সেইন্ট মাইকেল চার্চ, সম্রাট লুডউইগের সাংস্কৃতিক বিশ্ববিদ্যালয় ভবন ওল্ড এ্যাকাডেমি এবং ছোট ছোট ভাস্কর্য দেখতে দেখতেই পৌঁছে যাই ফ্রাউন-কির্চ বা মহিলাদের চার্চ নামে খ্যাত মিউনিখের ল্যন্ডমার্কে। পেঁয়াজের মতো দুটি ডোম বিশিষ্ট এই গির্জার ইংরেজি নামকরণ করা হয়েছে ক্যাথেড্রাল অফ আওয়ার ডিয়ার লেডি। মা মেরির নামে প্রতিষ্ঠিত বলেই সম্ভবত এর নাম ফ্রাউন-কির্চ। ১৪৯৪ সালে নির্মিত গির্জাটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবার পরে সংস্কার এবং পুনঃনির্মাণ করে এর প্রাচীন রূপ ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। পুরো সংস্কার কাজে সময় লেগেছে প্রায় পঞ্চাশ বছর। এসব দেশে যে কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক বা ঐতিহাসিক নিদর্শন সংরক্ষণের কাজে যে গুরুত্ব দেয়া হয়, যে পরিমাণে অর্থ ব্যয় করা হয় এবং যে নিষ্ঠার সাথে কাজটি সম্পন্ন করা হয় তার দশভাগের একভাগও যদি আমরা দিতে পারতাম তাহলে আমাদের ইতিহাসের অনেকটাই সংরক্ষণ করা সম্ভব হতো। নিরানব্বই মিটার উঁচু মিউনিখের এই গির্জার লাল রঙের চূড়া দুটি বহু দূর থেকেই চোখে পড়ে, তারপরেও আমরা কাছাকাছি এসে আরো একবার দেখে যাই ব্যাভারিয়া রাজ্যের এই পরিচিত প্রতীক।

পাঁচশ বছরেরও বেশি সময় আগের নগর কেন্দ্র কেমন করে আধুনিক মিউনিখের সাথে সম্পৃক্ত করে নতুনভাবে সাজানো হয়েছে তা সত্যিই বিস্ময়কর। নতুন পুরাতনের এই বিন্যাসে কোথাও কোনো অসামঞ্জস্য চোখে পড়ে না। নিউ টাউন হল নামের গথিক স্থাপত্য শৈলীর সুদৃশ্য বিশাল ভবনটি বর্তমানে সিটি কাউন্সিল, মেয়রের কার্যালয়সহ স্থানীয় প্রশাসনের সদর দপ্তর। এলাকাটিতে যানবাহন চলাচল পুরোপুরি নিষিদ্ধ, যন্ত্রচালিত কোনো গাড়ি এখানে কখনোই চোখে পড়েনি। মিউনিখের মেয়র মহোদয় এবং তাঁর কর্মকর্তাবৃন্দ কিভাবে এখানে অফিস করতে আসেন ভেবে আমি একটু চিন্তিত হলাম। এইসব গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা কি ‘পেডাস্ট্রিয়ান অনলি’ চিহ্নিত এলাকা পায়ে হেঁটে দপ্তরে আসেন?

পুরস্কার পাওয়া সকল নির্মাতা

এলাকা জুড়ে বিস্তৃত সড়কের দুপাশে বাঁধানো কেয়ারিতে গ্রীষ্মকালীন ফুলের সমারোহ, উঁচু পতাকা দণ্ডে উড়ছে ব্যাভারিয়ার পতাকা, পথের মোড়ে বেহালা কিংবা পিয়ানো এ্যাকোর্ডিয়ানে সুর তুলছে বাদ্যযন্ত্রী, বিচিত্র মেকআপ অথবা মুখোশে মুখ ঢেকে নানা রঙের পোশাক পরা বহুরূপিরা তাদের কসরত শুরু করেছে। সবকিছু মিলিয়ে নিউ টাউন হলের সামনে দৃশ্যপট জমজমাট। বেলা বাড়ার সাথে সাথে রোদের তাপও বাড়তে শুরু করেছে। আমরা রঙিন ফুলের কেয়ারির পাশে পাথরের আসনে বসে খানিকটা জিরিয়ে নিই। অভিজাত রেস্তোরাঁর সামনের ফুটপাথ ছাড়িয়ে বিশাল ছাতার নিচে পাতা টেবিলে ট্যুরিস্টদের ভিড় বাড়তে শুরু করলে মনে হয় আমাদের এবারে ফিরতি পথ ধরতে হবে। কোনোভাবেই ট্রেন মিস করা যাবে না।

মিউনিখের শেষ দিনের লাঞ্চটা একটা ভালো রেস্তোরাঁয় করা যেতে পারে ভেবে ফেরার পথে পারশিয়ান রেস্টুরেন্ট শালিজারে ঢুকে পড়লাম। খাবারের নাম তেমন পরিচিত না হলেও খাবার ছিল আমাদের পরিচিত বিরিয়ানি, কাবাব এমন কি বোরহানির কাছাকাছি কিছু একটা। দুপুরের এই সময়টা এখানে যথেষ্ট ভিড় থাকার কথা, কিন্তু বেশিরভাগ টেবিলই খালি। আমরা যখন লাঞ্চ শেষে বেরিয়ে আসছি, তখন সম্ভবত রেস্তোরার মালিক মহিলা হেনার সাথে একটা ছবি তোলার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন। মিউনিখের পথেঘাটে প্রচুর শাড়ি পরা ভারতীয় নারীর দেখা যায়। তারপরেও তিনি কেন এই ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন জানি না। আমার শুধু মনে হয়েছিল ইরানি নারীরা দেশে হিজাব নিকাব বোরকার কড়াকড়ি মেনে চললেও দেশের বাইরে এসেই এদের একটা বড় অংশ এসব জঞ্জাল ঝেড়ে ফেলে। অর্থাত দেশে তারা স্বেচ্ছায় নয় আইন প্রয়োগের ভীতি থেকেই নিজেকে হিজাব নিকাবে ঢেকে রাখে। আমি নিজেও আমার ক্যামেরায় দুজনের একটা ছবি তুলে রাখলাম।

আগে থেকেই সব কিছু গোছানো ছিল। কাজেই হোটেল থেকে বেরিয়ে পায়ে হেঁটে পাঁচ মিনিটে মিউনিখ হফতবান হফে পৌঁছে গেলাম, কোনো সমস্যা হলো না। মিউনিখ প্রান্তিক স্টেশন হলেও ট্রেনটা নির্ধারিত প্লাটফর্মে আগে থেকে দাঁড়িয়ে না থাকায় প্রথমে একটু বিভ্রান্তিতে ছিলাম। ফলে যাত্রীদের ভিড় না থাকলেও ট্রেনটা এসে দাঁড়াবার পরে একটু তাড়াহুড়ো করেই উঠে পড়লাম। কামরার মাঝামাঝি নিজেদের সিট পর্যন্ত সবগুলো লাগেজ টেনে নিয়ে গুছিয়ে বসতে না বসতেই ট্রেন চলতে শুরু করলো। হঠাত মনে হলো উইলির প্রতিবেশির দেয়া সেই সাদা ছাতাটা কোথায়! প্লাটফর্মের যে বেঞ্চে ট্রেনের অপেক্ষায় বসে ছিলাম ছাতাটা সেখানে ফেলে রেখেই ডয়েসবান তখন দ্রুতগতিতে ছুটে চলেছে । (চলবে…)