ফরিদুর রহমান : প্রিজনেস ইন্টারন্যাশনাল উত্সব উপলক্ষে ফুটবল খেলা কবে থেকে শুরু হয়েছিল বা কারা এর প্রচলন করেছিলেন তা আমার জানা নেই। তবে সাম্প্রতিক খেলার ব্যাপারে নেদারল্যান্ডসের প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা এবং চলচ্চিত্র বিষয়ক শিক্ষক ইয়ান উইলিয়াম বুল্টের যে বড় ভূমিকা আছে তাতে সন্দেহ নেই। তরুণ বয়সে তিনি হতে চেয়েছিলেন ফুটবলার। কিন্তু আলা রে্যনের ‘হিরোশিমা মন আমুর’ ছবিটি তাঁর জীবনই পাল্টে দিয়েছে। এই ছবি দেখার পরে তিনি চলচ্চিত্র বিষয়ে, বিশেষ করে ছোটদের জন্য প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন এবং নির্মাণ করেছেন বেশ কিছু চমত্কার প্রামাণ্য ছবি। তবে ফুটবল তাঁকে এখনো ছাড়েনি। বয়স ষাটের কাছাকাছি পৌঁছালেও মাঠে খেলেন তরুণদের মতোই এবং সকলকেই মাঠে নামতে উত্সাহিত করেন। দু বছর আগের খেলায় বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রযোজক মাসুদ হাসান খেলায় নেমে এবং চমত্কার খেলে তার দলকে জিতিয়ে দেয়ায় অবদান রেখেছিল।
আমরা যথাসময়ে বিবাদি হোটেলের সামনে পৌঁছালে সেখান থেকে দল ধরে চলে এলাম মিউনিখ প্রধান রেলস্টেশনে। এখান থেকে মেট্রোতে দু তিনটি স্টপেজ পরে নেমে খানি?টা হেঁটে যেতে হবে এসসি অ্যামিসিটা ক্লাবের মাঠে। সেখানেই আজকের প্রতিযোগিতামূলক সকার ম্যাচ! ফুটবলকে ইওরোপ এবং দক্ষিণ আমেরিকায় সকার বললেও জার্মানিতে ফুটবলের একটি প্রতিশব্দ ব্যবহৃত হয়, আর তা হলো ‘ফুসবল’। চর্ম নির্মিত গোলকটি ফুটো হয়ে গেলে ভেতরের বাতাস ফুস…. শব্দ করে বের হয় বলেই জার্মানি, পোল্যান্ড এবং ইউক্রেনসহ আরো কয়েকটি দেশে এই নামকরণ কিনা কে জানে!
মিউনিখের মেট্রোতে এবং ট্রামে একটা গ্রুপ টিকেট কিনলে একসাথে দুই থেকে পাঁচজন একই টিকেটে ঘোরাঘুরি করা যায়। কাজেই একটা গ্রুপে যতো বেশি মানুষ, ততোই তা লাভজনক। পাঁচজন পাঁচজন করে ছোট ছোট দলে ভাগ করে দল থেকে নির্বাচিত একজনের হাতে সেই গ্রুপের টিকেট ধরিয়ে দেয়া হলো। আমাদের টিকেটধারী হলেন গাইয়েদ আন্দ্রিয়া। মিশরের তরুণ চলচ্চিত্র পরিচালক আন্দ্রিয়ার সাথে পরিচয় হয়েছিল দুবছর আগে মিউনিখেই। ঠিক ছয় মাস পরে আবার দেখা কাঠমাণ্ডুতে কিডস নিউজ নেটওয়ার্কের সম্মেলনে। সার্বক্ষণিক হাসিখুশি এবং প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর আন্দ্রিয়ার নেতৃত্বে মেট্রো স্টেশনে নেমে প্রায় জনহীন রাস্তা ধরে মিনিট তিনেক হেঁটে পৌঁছলাম এসসি অ্যামিসিটা ক্লাবে। বিশাল এলাকা জুড়ে তারজাল দিয়ে ঘেরা ফুটবল মাঠ এবং ছোট দর্শক গ্যালারি ছাড়াও অফিস, ফুটবলারদের বিশ্রাম-বিনোদনের ব্যবস্থাসহ রীতিমতো উন্নতমানের ক্রীড়া কমপ্লেক্স। অবশ্য ১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এসসি অ্যামিসিটার শতবর্ষের ঐতিহ্য আছে ফুটবলে। এমনিতে কী আর ইওরোপের মানুষ এমন ফুটবল পাগল!
একদিকে ইওরোপ এবং অন্যদিকে বাকি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নানা বয়সের খেলোয়াড়দের নিয়ে খেলা শুরু হলো। মাঠের ভেতরে এবং বাইরে খেলার চেয়ে বেশি হলো হৈচৈ এবং শেষ পর্যন্ত এক এক গোলে খেলা শেষ হলো। মাঠের বাইরে আড্ডাও বেশ ভালো জমেছিল। গ্যালারি দর্শক শূন্য, আমরা অনেকেই খেলা দেখছিলাম চেয়ার টেবিল পেতে। ক্লাব ঘরের সামনে একটা লম্বা টেবিলে সাজিয়ে রাখা হয়েছিল প্রিজনেসের বিভিন্ন সাইজের কয়েকশ টি-শার্ট। যে যার ইচ্ছে মতো দু চারটা তুলে নিলেই হলো। আমরা দুজনে মিলে দুই সাইজের দুটো করে চারটা নিয়ে ভাবছিলাম বোধহয় বেশি নেয়া হয়ে গেল। পরে দেখা গেল কেউ কেউ একাই গোটা দশ বারো গুছিয়ে নিয়ে ব্যাগে ভরে ফেলেছেন। তবে অনেকেই আবার সুভ্যেনিয়ার হিসাবে একটা নিয়েই সন্তুষ্ট। টি-শার্ট সংগ্রহের পালা শেষ হলে শুরু হলো বিয়ার পার্টি।
বেলজিয়ামের বোর্গ বাদ দিলে মিউনিখই ইওরোপের একমাত্র শহর যেখানে অক্টোবর ফেস্টিভ্যালের সময় পাইপ লাইনে বিয়ার সরবরাহ করা হয়। আমার অতীতের অভিজ্ঞতা হলো প্রিজনেস উত্সবের সময় ব্রাইসার রুন্ডফুংক ভবনের চত্বরে সাজিয়ে রাখা বিয়ার ভর্তি সারি সারি কাঠের পিপার নিচে লাগানো ট্যাপ খুলে জগে জল ভরার মতো করে বিয়ার ঢেলে নিতে হয়। ব্যয় সংকোচনের কারণে কিনা জানি না, কয়েক বছর থেকে ফুটবল ম্যাচ শেষে মাঠেই হয় বিয়ার পার্টির আয়োজন। এখানে ক্লাবঘরের বাইরে ছিল বিয়ারের বোতল সাজানো বিপুল সংখ্যক কেস। বেরসিকদের জন্য ফান্টা কোক জাতীয় হালকা পানীয়ের আয়োজনও ছিল যথেষ্ট পরিমানে। বাইরে যখন দিনের আলো যখন প্রায় নিভু নিভু তখন ক্লাবঘরের ভেতরে বুফে ডিনারের আয়োজন সম্পন্ন। চারিদিকে ছড়ানো ছিটানো চেয়ার টেবিল থাকলেও খাদ্য রসিকেরা নিজেদের প্লেট পূর্ণ করে হাতে হাতে তুলে নিয়েছেন। জার্মান খাবারে এমনিতেই বৈচিত্র্য কম, বিশেষ করে বাঙালি রসনার জন্যে জার্মান রন্ধন প্রণালী বা খ্যাদ্যাভাস মোটেও সুবিধাজনক নয়। তবে নানা জাতের ব্রেড, যাকে আমরা পাউরুটি বলে থাকি তার বিচিত্র আকার-আকৃতি, স্বাদ-গন্ধ এবং প্রকৃত জার্মান নাম মনে রাখাও কঠিন।
প্রেত্জেল, হোল হুইট রাই ব্রেড, ব্রাউন ব্রেড, সানফ্লাওয়ার সিড ব্রেড, বø্যাকব্রেড, সোরডাফ, ফারমার্স ব্রেড, ডার্কব্রেড, রাই লোফ এবং মাল্টি গ্রেইন রাই ব্রেডসহ আরো অনেক রকম রুটি থাকলেও প্রায় সবখানেই দেখেছি নানা চেহারার প্রেত্জেল। দেখতে সুদৃশ্য হলেও বেশ শক্ত এবং কড়া লবনযুক্ত এই রুটি যাদের বেশ মজা করে খেতে দেখি তাদের প্রতি করুণাই হয়। বাটার নান, গার্লিক নান কিংবা কিমা পরোটার কথা কথা বাদই দিলাম নিত্য দিনের খাবার হিসাবে সাধারণ নানরুটি পরটাই বা কম কিসের! মালয়েশিয়া কিংবা ইন্দোনেশিয়া থেকে আসা টুপি দাড়িওয়ালা তরুণ এক হাতে একটি শক্তিশালী আধা খাওয়া প্রেত্জেল নিয়ে অন্য হাতে থাকা বিয়ারের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললো, ‘গুড! ইজন্ট ইট?’ আমি বললাম, ‘সে তো বটেই। কিন্তু তুমি যে বিয়ার খাচ্ছো, এটা কি ঠিক হচ্ছে?’ সে হেসে বললো, ‘ইন ফরেন কান্ট্রি, এভরিথিং ওকে!’ বুঝলাম বিদেশে নিয়ম নাস্তি কথাটা শুধু বাংলা ভাষায় নয়, অন্য দেশেও আছে!’
ফেরার সময় একইভাবে মেট্রোতে পাঁচজনের দলে যুক্ত হয়ে ঠিকঠাক মেইন স্টেশন পর্যন্ত এলেও ট্রামস্টপেজ থেকে উল্টো দিকের ট্রামে উঠে বসলাম। তিন স্টপেজ পার হয়ে যাবার পরেও পরিচিত নির্ধারিত গন্তব্যের দেখা নেই, বুঝলাম ভুল হয়েছে এবং ভুল করার কারণটাও বুঝতে অসুবিধা হলো না। ঝটপট নেমে পড়ে উল্টো দিকের ট্রাম ধরলাম, কিন্তু কার্স্টাডে আসার পরে জানলাম এটা ভিন্ন রুটে চলে যাবে। এখন বেশ খানিটা এগিয়ে এসেছি। অতএব পরবর্তী ট্রামের অপেক্ষা না করে নেমে হাঁটতে শুরু করলাম। ভেবেছিলাম রাত দশটার মধ্যেই ঘরে ফিরবো, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই পৌনে এগারোটাই বাজলো।
পরদিন সকালে ঘরেই নাস্তা করে সাড়ে আটটার দিকে বেরোতে যাচ্ছি, বাইরের মূল দরজার কাছে উইলির সাথে দেখা। বললো, ‘তোমাদের চূড়ান্ত ঘোষণার জন্যে অপেক্ষা করছি। বেস্ট অফ লাক।’
ঠিক এই সময় উইলির উপর তলার প্রতিবেশি সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এলেন। তাঁর হাতে গোটা পাঁচ ছয় ছাতা। আমাদের সাথে সংক্ষেপে পরিচয় করিয়ে দেবার পরে উইলি জানতে জানতে চাইলো, ‘তোমরা ফিরবে কখন?’ বললাম, ‘আজ আর দুপুরে ফিরবো না। বিকেলে একবার আসবো।’ প্রতিবেশি হঠাত করেই বললেন, ‘তোমরা কি ছাতা নিয়ে বেরোচ্ছ? আজ কিন্তু বিকেলে বৃষ্টি হবে।’
বাইরে ঝলমলে রোদ, আকাশে মেঘের ছিটে ফোঁটাও নেই, বৃষ্টি হবে কেমন করে! ইনি কি জ্যোতিষশাস্ত্র জানেন এবং তা জায়গা বিশেষে প্রয়োগও করে থাকেন! আমাদের দেখিয়ে তিনি আবার বললেন, ‘দেখছো না আমি আমার ক্লাবের ছেলেদের জন্যে এতোগুলো ছাতা নিয়ে বেরিয়েছি।’
বুঝলাম ইনিও নিশ্চয়ই কোনো ‘ফুসবল’ ক্লাবের সাথে যুক্ত। বলতেই হলো, ‘আমাদের সাথে তো ছাতা নেই।’
ফুটবল প্রেমিক প্রতিবেশি তাঁর হাতের ছাতাগুলো দেখিয়ে বললেন, ‘এর মধ্যে তোমাদের পছন্দ মতো যে কোনো একটা বেছে নাও। আমি বলছি, বিকেলে কাজে লাগবে।’ বিকেলে বৃষ্টি হোক বা না হোক বড়সড় একটা ছাতা দানের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করতে পারলাম না। এতো আর গরু মেরে জুতা দানের মতো কোনো ব্যাপার নয়। একেবারেই নিঃস্বার্থ নির্ভেজাল পরোপোকার। অতএব সাদা ধবধবে চমত্কার একটা ছাতা হাতে দাতা মহোদয়কে যথাবিহিত ধন্যবাদ জানিয়ে পা বাড়ালাম ট্রাম স্ট্যান্ডের দিকে।
ফেস্টিভ্যাল চত্বরে ঢুকেই চোখে পড়লো গত দিনের কাহিনি চিত্রগুলো নিয়ে আলোচনার সংক্ষিপ্তসার বেশ কয়েটি ডিসপ্লে বোর্ডে সেঁটে দেয়া হয়েছে। আরো অনেকের বক্তব্যের সাথে ‘দ্য সাইলেন্ট লায়ন’ সম্পর্কে বলা আমার আলোচনার সারাংশও বোর্ডে শোভা পাচ্ছে। আমার বক্তব্য ছিল: ‘এই ছবিতে পরিবারের ভেতরে যৌন হয়রানির মতো অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি বিষয় চমত্কারভাবে সতর্কতার সাথে তুলে আনা হয়েছে। কাউকে না কাউকে তো নৈঃশব্দ্য ভাঙতেই হবে। সেদিক থেকে এই ছবিটি একটি দৃষ্টান্তমূলক এবং একই সাথে গুরুত্বপূর্ণ কাজ।’
সকাল থেকেই ছিল ছোটদের নন-ফিকশন ছবির প্রদর্শনী।
কত বিচিত্র বিষয় নিয়ে ছোটদের জন্য প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করা যায়, তা প্রিজনেসে না এলে বোঝা যেতো না। হাস্যরসের ভেতর দিয়ে যে প্রামাণ্য বিষয় উপস্থাপন করা যায় তার একটি চমতকার উদাহরণ দেখেছি ‘দ্য বø্যাকলিস্ট’ ছবিতে। টেলিভিশনের জন্যে তৈরি ধারাবাহিক প্রামাণ্য এই সিরিজে উপস্থাপক টম ওয়েজ শিশুদের সব অদ্ভুত এবং প্রায় অসম্ভব ইচ্ছেপূরণে সহায়তার সাথে সাথে তার বাস্তব চিত্র তুলে ধরেন। ‘দ্য বø্যাকলিস্ট’-এর এই এপিসোডে টম নয় বছর বয়েসী মেরিনের ইচ্ছে অনুসারে তার দশ বছর বয়েসের প্রেমিক ম্যাইথ-এর সাথেতার বিয়ের আয়োজন করেন। আইন অনুসারে নিষিদ্ধ হলেও এই বাল্য বিবাহের জন্য গির্জা থেকে যাজক এবং পৌর কর্পোরেশন থেকে স্বয়ং মেয়রকে হাজির করার ব্যবস্থা করা হয়। কয়েকদিন ধরে বিয়ের পোশাক পরিচ্ছদ যোগাড়, ওয়েডিং ডান্সের মহড়া এবং পার্টির জন্য কেকসহ খাবারের ব্যবস্থাও হয়ে যায়। অবশেষে আসে সেই শুভ দিন এবং শুধু আইনগত কাগজপত্রের বিষয়টি উহ্য রেখে বিয়ের সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে তুমুল হৈচৈ এবং হাস্যরসের মধ্য দিয়ে শেষ হয় চল্লিশ মিনিটের এই প্রামাণ্যচিত্র।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য প্রামাণ্যচিত্র নেদারল্যান্ডসের ‘নিউ’। আট বছর বয়সের তানান জাতিসংঘের উদ্বাস্তু পুনর্বাসণ কর্মসূচির আওতায় মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে উগান্ডা থেকে নেদারল্যান্ডসে এসেছে। ভাষা সংস্কৃতি এবং ইওরোপের জীবন যাপন সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই নেই। নতুন স্কুলে শিক্ষাবর্ষ সবে শুরু কয়েছে, কিন্তু স্কুলে ভর্তি হলেও সে কিছুই বুঝতে পারে না। ক্লাসে তার বন্ধু নেই, পরিবারে কোনো আনন্দ নেই। এক বিচ্ছিন্ন অসহায় পরিবেশে তানান তার নিজের নতুন জীবনের সাথে মানিয়ে নিয়ে চলতে চেষ্টা করে।
আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম লাঞ্চব্রেকে ঘরে ফিরবো না। মূল ফেস্টিভ্যাল ভবনের ভেতরেই ছোট একটা কাউন্টারের মতো করে কুইক লাঞ্চের ব্যবস্থা ছিল। দুপুরের প্রদর্শনী শেষ হবার সাথে সাথে কাউন্টারে লম্বা লাইন পড়ে যায়। আমরা একটু দেরি করে কাউন্টার ফাঁকা হবার অপেক্ষা করি। এতে ধিরে সুস্থে খাবার বেছে নেবার সুযোগ থাকলেও অনেক সময়েই পছন্দের আইটেম শেষ হয়ে যায়। আমাদের জন্য ছিল নুডুলস স্যুপ এবং নিরাপদ কিউকাম্বার স্যান্ডুইচ। লাঞ্চ শেষ করে কফি খাচ্ছি সেই সময় দেখা হলো মিশরের প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা এবং স্টিল ফটোগ্রাফার ফাদি তাহেরের সাথে। বললাম, ‘তোমার কোনো ছবি তো ফেস্টিভ্যালে আছে বলে মনে পড়ছে না।’ ফাদি বললো, ‘আমি তো এসেছি প্রিজনেসের স্টিল ফটোগ্রাফার হিসাবে। মধ্যপ্রাচ্যের শিশুদের নিয়ে স্থিরচিত্রের একটা প্রদর্শনীও চলছে এখানে।’
ফেস্টিভ্যালের পুরো এলাকা জুড়ে সেমিনার, ওয়ার্কশপ, প্রতিযোগিতার বাইরের ছবির প্রদর্শনীসহ কতো কিছু যে ঘটে চলেছে তার সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটতে পারা সত্যিই কঠিন। ফলে ফাদি তাহেরের প্রদর্শনীও চোখে পড়েনি। বললাম, ‘এখনো দেখিনি তবে দেখে নেবো।’ ‘ঠিক আছে। পরে কথা হবে’ বলে ফাদি ক্যামেরা কাঁধে ব্যস্ততার সাথে চলে গেলে আমি ভাবছিলাম, ফাদি নিঃসন্দেহে করিত্কর্মা লোক। স্থির চিত্রগ্রাহক হিসাবে তার যোগ্যতা প্রশ্নাতীত। কিন্তু প্রিজনেসের মতো উত্সবে নিজের জায়গা করে নেয়াটাও বড় যোগ্যতার ব্যাপার। ফেস্টিভ্যাল ডিরেক্টর মায়া গটজের সাথে ওর পরিচয় সেই নেপালেই বছর দেড়েক আগে। বিশ্বব্যাপি যোগাযোগ রক্ষা করে চলাটাও একটা বড় গুণ, যা বাংলাদেশের বাঙালিদের ক্ষেত্রে বিরল বললেও চলে।
বিকেলের অধিবেশনে তাইওয়ানের পরিবেশ বিষয়ক প্রামাণ্য ‘গিভিং ব্যাক হারমিট ক্রাবস দেয়ার হোম’ স্লোভেনিয়ার ‘লেওন এ্যান্ড ইয়ান: ইয়ং ফার্মারস’সহ দেখা হলো বেশ কয়েকটা স্বল্পদৈর্ঘ্য প্রামাণ্যচিত্র। তবে এ দিনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রামাণ্যচিত্রটি ছিল এক কিশোরের চোখে দেখা একটি রিফিউজি ক্যাম্পের জীবন। ‘দ্য বয় অন দ্য বাইসাইকেল’ ছবিতে ষোল বছর বয়েসের আহমদ একটি সাইকেল নিয়ে পাঁচ স্কয়ার কিলোমিটার এলাকা জুড়ে সিরিয়ান শরাণার্থীদের জন্য তৈরি জর্ডানের জাতারি শরণার্থী শিবিরের ভেতরে ঘুরে বেড়ায়। আশি হাজার রিফিউজির বাসবাসের এই ক্যাম্পে দোকান থেকে শুরু করে হাসপাতাল, পড়াশোর জন্য স্কুল এবং খেলার জন্যে ফুটবল মাঠ সবই আছে। কিন্তু বিনা অনুমতিতে ক্যাম্পের বাইরে যাবার কোনো উপায় নেই। এক ধরনের বন্দী জীবনে আহমদ ঘুরে ঘুরে কিছু সংখ্যক উত্সাহী বন্ধু যোগাড় করে ফেলে। শিশু কিশোররা জীবনের কঠিন বাস্তবতাকে কিভাবে নিজেদের জন্য আনন্দময় করে তোলার প্রচেষ্টায় লেগে আছে তা উঠে এসেছে ‘দ্য বয় অন দ্য বাইসাইকেল’ প্রামাণ্যচিত্রে।
প্রত্যেক সন্ধ্যায় কোনো না কোনো দেশের বা প্রতিষ্ঠানের সৌজন্যে জমকালো পার্টির আয়োজন থাকে। রাতে বিবিসির পার্টিতে যোগ দিতে হলে আটটার মধ্যে ফিরে আসতে হবে। কাজেই বিকেলের প্রদর্শনী শেষ হবার সাথে সাথে বেরিয়ে পড়লাম। ব্রাইসার রুন্ডফুংক এলাকা পার হবার আগেই জোর বৃষ্টি শুরু হলো। উইলির প্রতিবেশিকে মনে মনে আবারো ধন্যবাদ জানিয়ে সাদা ছাতা খুলে নিশ্চিন্তে চললাম বাসস্ট্যন্ডের দিকে। (চলবে…)