ফরিদুর রহমান : পিরগস নগরীর মেয়র বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ গ্যাভরিল লিয়াতসিস মধ্যাহ্নভোজের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। মৌখিক দাওয়াত নয়, রীতিমতো আনুষ্ঠানিক নিমন্ত্রণ! অলিম্পিয়া ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের কর্মকর্তা, জুরি সদস্য, বিদেশি চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি মিলিয়ে প্রায় সত্তুর আশিজন বেলা একটায় হাজির হলাম মিউনিসিপ্যালিটি অফ পিরগসের দপ্তরে। প্রথমে মেয়র মহোদয়ের কার্যালয় পরিদর্শন, তারপরে পিরগস আর্কিওলজিক্যাল মিউজিয়াম ঘুরে ভোজসভায় যোগদান। আশঙ্কায় ছিলাম, পৌরসভার দপ্তরে যদি স্থানীয় দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, ফেস্টিভ্যাল ডিরেক্টর, বিদেশি অতিথি অভ্যাগত এবং স্বয়ং মেয়র মহোদয় সংক্ষিপ্ত শুভেচ্ছা ভাষণ শুরু করেন, তবে দুটোর লাঞ্চ কয়টায় ঠেকবে কে জানে! আমাদের অবাক করে দিয়ে শুধুমাত্র দপ্তরের সভাকক্ষ, লাইব্রেরি এবং একটি ছোট সংগ্রহশালা ঘুরে দেখাবার পরেই পৌর কর্তারা আমাদের নিয়ে চলে এলেন সংলগ্ন আর্কিওলজিক্যাল মিউজিয়ামে।

প্রত্নতাত্বিক জাদুঘরে প্রবেশের পরপরই হাতে এলো মিউজিয়ামের ক্যাটালগ এবং সম্পর্কিত আরো দুটি প্রকাশনাসহ একটি প্যাকেট। তাত্ক্ষণিকভাবে একটি পুস্তিকা থেকে এই প্রথমবারের মতো জানলাম গ্রিসের প্রাচীন এবং প্রকৃত নাম হেলেনিক রিপাবলিক! কী আশ্চর্য! পিপলস রিপাবলিক নয়, ইসলামিক রিপাবলিকের মতো খ্রিস্টিয়ান রিপাবলিক নয় বরং হেলেনিক রিপাবলিক। আঞ্চলিক অস্থায়ী সরকারগুলো নিয়ে গ্রিসের স্বাধীনতা যুদ্ধের কালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রথম হেলেনিক রিপাবলিক। ১৮২২ থেকে প্রতিষ্ঠিত এই রিপাবলিক টিকেছিল মাত্র দশ বছর। ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপের পরাশক্তিগুলো গ্রিসকে রাজ্য ঘোষণা করে প্রিন্স অফ ব্যাভারিয়াকে এর রাজা হিসাবে অভিসিক্ত করে। এশিয়া মাইনরে তুর্কিদের সাথে যুদ্ধে হেরে যাবার পরে ১৯২৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দ্বিতীয় হেলেনিক রিপাবলিক। রাজা প্রথম কনস্টানটাইনের নির্বাসন ও মৃত্যুর পরে অনুষ্ঠিত এক গণভোটে হেলেনিক রিপাবলিক পুনপ্রতিষ্ঠিত হলেও এর আয়ুষ্কাল ছিল মাত্র এগার বছর। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত আরেকটি গণভোটে শতকরা ৯৭ ভাগ মানুষ রাজতন্ত্রের পক্ষে ভোট দিয়েছিল। গ্রিসের মানুষ বোধহয় ভেবেছিল রাজা মশাইরা ফিরে এলেই দেশের দুঃখ দুর্দশা দূর হবে। প্রকৃতপক্ষে রাজা দ্বিতীয় জর্জকে এ সময় সিংহাসনে বসিয়ে দিয়ে সামরিক বাহিনি ক্ষমতা দখল করে। মাঝে মধ্যে গণভোটের নাটক মঞ্চস্থ করে সামরিক সরকার ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত টিকেও ছিল। তুরস্কের সাইপ্রাস অভিযানের পরে রাজকীয় সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে তৃতীয় এবং সর্বশেষ হেলেনিক রিপাবলিকের যাত্রা শুরু ১৯৭৪ সালে। এখন পর্যন্ত এই ব্যবস্থাই টিকে আছে, তবে বড় রকমের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে ভবিষ্যতে গ্রিসে কী ঘটতে যাচ্ছে কে জানে!

পিরগস সেন্ট্রাল স্কয়ার

স্থানীয় বিশিষ্টজন এবং ফেস্টিভ্যাল সংশ্লিষ্টরা ছাড়াও জুরিদের অনেকেই এর আগে এই জাদুঘর পরিদর্শন করে গেছেন বলেই মনে হলো। কাজেই আমরা যারা পিরগসে নতুন এসেছি তাদের সবার জন্যেই এটি ছিল দারুণ অভিজ্ঞতা। পিরগস ইলিয়ার অতীতকালের প্রত্নতাত্বিক বৈচিত্র্য তুলে ধরার জন্যে প্রতিষ্ঠিত আঞ্চলিক জাদুঘরটি প্রধানত তিনটি নৃ-তাত্বিক বৈশিষ্ট্য কেন্দ্রীক এক সমৃদ্ধ সংগ্রহশালা। বসতি, ধর্মাচরণ এবং মানুষ ও তার নির্মাণসামগ্রী দিয়ে সাজানো পিরগসের এই ছোট্ট জাদুঘরটি রীতিমতো বিস্ময় জাগায়। প্রাগৈতিহাসিক, ঐতিহাসিক, বাইজেন্টাইন এবং পোস্ট-বাইজেন্টাইন সময়ের নানা নিদর্শন রয়েছেন এই যাদুঘরে। এ দেশের নগরে- গঞ্জে, পাহাড়ে-বনাঞ্চলে, পথে-প্রান্তরে জনজীবনের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে ইতিহাস। মানুষের সভ্যার ইতিহাসের বিশাল অংশ তো আসলে গ্রিসেরই ইতিহাস। তাই গিসের যে কোনো প্রান্তে একটা জাদুঘর খুলে বসলে প্রদর্শনযোগ্য সামগ্রীর কোনো অভাব কখনোই হবে বলে মনে হয় না। এখানেও প্রাগৈতিহাসিক প্রস্তরখণ্ড থেকে মধ্যযুগের অস্ত্রশস্ত্র, পোড়ামাটির ফলক, তামার মুদ্রা থেকে ধাতব অলঙ্কারসহ ইতিহাসের দীর্ঘ সময়ের নানা নিদর্শন দেখে বলা যায় সংক্ষেপে জাদুঘর পরিভ্রমণ শেষ করলাম।

আর্কিওলজিক্যাল মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে আমরা দল ধরে সেন্ট্রাল স্কয়ারের শেষ প্রান্তে মেমোরিয়াল পার্কের ইপারেস্কিয়ঁ ক্যাফে রেস্টুরেন্টের দিকে এগোচ্ছি। চত্বরের ঠিক মাঝ বরাবর পৌঁছাতেই একটা বিয়ের অনুষ্ঠানের শোভাযাত্রার মুখোমুখি হলাম। মনে হলো সদ্য বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে বর-কনেসহ অতিথি অভ্যাগতেরা আমাদের মতোই দল বেধে কোনো রেস্তোরাঁয় খানাপিনার আয়োজনে যোগ দিতে যাচ্ছে। শোভাযাত্রার সামনে শ্বেত শুভ্র পোশাকে সজ্জিত বর-কনে পরস্পরের হাতে হাত রেখে বেশ হাসি খুশি মুখে হেঁটে যাচ্ছে, কনের পোশাকের প্রান্ত সেন্ট্রাল স্কয়ারের বাধানো চত্বরে লুটাচ্ছে। আমি দাঁড়িয়ে নতুন দম্পতির সঙ্গীসাথী বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের আনন্দ কোলাহল দেখছিলাম। আমার পাশে থেকে বেশ বয়স্ক একজন, সম্ভবত বিদেশি জুরিদের কেউ হাসতে হাসতে বললেন, ‘বেচারা নতুন বৌ নিয়ে বেশ আনন্দের সাথে মিছিল করে যাচ্ছে। কিন্তু তার জীবন সে কি সমস্যা টেনে নিয়ে এসেছে, আগামীকাল থেকে টের পাবে!’

আমি বললাম, ‘তোমার নিজের অভিজ্ঞতা কী তাই বলে?’ তিনি উত্তর দিলেন, ‘শুধু আমার কেন, আমি জানি না, তুমি বিবাহিত কি না, বিবাহিত হলে আমার কথা তোমার অভিজ্ঞতার সাথে মিলিয়ে নিতে পারো।’

পিরগস জাদুঘরে

বর বা কনেযাত্রীদের মিছিল আমাদের পেরিয়ে গেলে আমার আগে দেখা জাতীয় প্রতিরোধ মনুমেন্ট এবং মুখে চুন-কালিমাখা প্রস্তর মূর্তি পেরিয়ে ঢুকে পড়লাম বিশালায়তন ইপারেস্কিয় ক্যাফে রেস্তোরাঁয়। ভেতরে বাইরে মিলিয়ে বেশ বড় রেস্তোরাঁটির ভেতরেই মাঝখানের বারের অংশটুকু বাদ দিয়ে তিন দিক ঘিরে আট দশটা লম্বা টেবিলে অতিথিদের বসার ব্যবস্থা। আমি একটা চক্কর দিয়ে এসে পাঁচ নম্বর টেবিলের এমন জায়গায় বসলাম যেখান থেকে বাইরের তাকালে আবাসিক ঘরবাড়ি এবং সবুজ গাছপালার ওপর দিয়ে দেখা যায় দূরের দুই সারি পাহাড়।

টেবিলে পরিচিতদের কেউ নেই, তবে ঠিক আমার মুখোমুখি বসেছে ছোট্ট একটি মিষ্টি মেয়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার নিঃসঙ্গতা ঘুঁচিয়ে দিতে আমার পাশের খালি আসনটিতে এসে বসলেন এক দশাসই ভদ্রমহিলা। সাজগোজের কারণে তাঁর বয়স অনুমান করা কঠিন, হয়তো তিনি আমার চেয়ে পাঁচ-সাত বছরের বড়ই হবেন। পার্শ্ববর্তিনী যেমন তাঁর নিজের পরিচয় দেয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি, তেমনি আমারও পরিচয় জানতে চাননি। তবে তিনি যে পিরগস নগরীর প্রত্যেক খ্যাতিমান এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সম্পর্কিত একটি চলমান তথ্য ভাণ্ডার তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পাঁচ নম্বর টেবিলে বসেই তিনি তিন নম্বর টেবিলের কাউকে দেখিয়ে বললেন, ‘ওই যে দেখছো, উনি হচ্ছেন পিরগসের একজন ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট। ত্রিপোলি এবং এথেন্সেও তাঁর কলকারখানা আছে। তবে রেসেশনের কারণে বেচারা একটু সমস্যায় পড়েছে।’ অথবা আট নম্বর টেবিলে এক সুন্দরী তরুণীকে দেখিয়ে বললেন, ‘ওই যে লাল জ্যাকেট পরা সোনালি চুলের মেয়েটা, ও হচ্ছে পিরগস ইলিয়ার বেস্ট সিঙ্গার, খুব মিষ্টি গলা। কিন্তু হলে কী হবে, আজকাল গ্রিক গানের কোনো বাজার নেই।

মানুষ যে কী শোনে কে জানে!’
ইউরোপিয় পরিবেশনা পদ্ধতি এবং পার্টিতে ধীরে চলার রীতি অনুসারে আস্তে ধীরে খেতে খেতেই বিভিন্ন পর্যায়ে আমার সামনের ছোট মেয়েটির কীর্তিকলাপ দেখছিলাম। চার পাঁচ বছর বয়সের মেয়েটির মা অন্য কোনো টেবিলে বসেছেন। মাঝে তিনিএকবার এসে মেয়েকে কিছু নির্দেশনা দিয়ে এবং একই সাথে আমাদের কোনো সমস্যা হলে তার জন্যে দুঃখ প্রকাশ করে গেছেন। মেয়েটি তার ছোট্ট হাতে দিব্যি চামচ কাঁটা ধরে খেতে পারে। তবে সব খাবারে তার মন নেই। তার পছন্দের তালিকায় কোল্ডড্রিংক এবং আইসক্রিম ছাড়াও ছিল ব্রাউন ব্রেড, একেবারেই রসকষহীন শুকনো রুটি।

এখানেও লাঞ্চের শুরুতে বা শেষে কোনো ভাষণ ছিল না। আমার কানের কাছে সার্বক্ষণিক ধারা বিবরণী দেয়া অভিজাত ভদ্র মহিলার বিশেষ যত্নআত্তি ছাড়া তেমন কোনো সমস্যা ছাড়াই নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হলো মেয়র মহোদয়ের মধ্যাহ্নভোজ। তবে একেবারে শেষে কয়েকটি ছোট দলে বিভক্ত হয়ে ছবি তোলা হলো। উত্সব পরিচালক দমিত্রিস স্পাইরোউএবং মেয়র গাব্রিল লিয়াতসিসকে বাদ দিলে আমাদের গ্রুপ ছবিতে তিয়েনলিন ছাড়া আর পরিচিতদের কেউ ছিলেন না।

মধ্যাহ্নভোজ শেষে

সন্ধ্যায় আমলিয়াদায় তিয়েনলিন ঝুর প্রামাণ্যচিত্র ‘কামিং এ্যান্ড গোয়িং’ দেখতে একসাথেই রওনা দিলাম। এই দিন আবহাওয়া ভালো ছিল এবং গাড়িতে জুরিদের কেউ ছিল না। ছবি শুরু হবার অনেক আগেই আমলিয়াদায় পৌঁছে গেলাম। যথারীতি লিনা গিয়ান্নোপউলু অভ্যর্থনা জানালো। লিনা আগেই জেনেছিল আমি কিঞ্চিত লেখালিখি করি। সম্ভবত সেই কারণেই সে ইংরেজিতে অনুদিত একটা গ্রিক কবিতা সংকলন আমার হাতে দিয়ে বললো, ‘ফিল্ম মেকারদের পছন্দের তালিকায় কবিতা নেই, এটা হতেই পারে না।’ বললাম, ‘নিশ্চয়ই। কবিতা লিখতে না পারি, পড়তে ভালো অবশ্যইলাগবে।’ আমি লিনার জন্যে একটা স্যুভেনিয়ার নিয়ে গিয়েছিলাম, তবে বই-পুস্তক নয়, আড়ং থেকে কেনা বাধানো ছোট্ট নকশি কাঁথা। লবিতে বসে কফি শেষ করার পরেও বেশ খানিকটা সময় ছিল। তিয়েনলিন তার মোবাইল ফোন বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘এই প্রাগৈতিহাসিক সিনেমা হলের এন্টিকগুলোর সাথে আমার কিছু ছবি তুলে দাও।’ ছবি তুলতে সমস্যা নেই, কিন্তু মোবাইল ফোনে আমি ছবি তুলতে পারি না। অগত্যা আমার ক্যামেরায় তিয়েনলিনের ছবি তুললাম আমি এবং আমার ছবি তুললো তিয়েনলিন।

আমরা যখন হলের ভেতরে ঢুকলাম, তখন প্রথম ছবি দ্য স্কাই শেষ হয়ে গেছে। এরপর শুরু হলো সুইডেনের ছোট ছবি ‘দ্য বডি ইজ এ লোনলি প্লেস’। সত্যি কথা হলো শরীরের ভেতরের পরিপাক যন্ত্রের কাজের সচিত্র প্রতিবেদনের মতো এই প্রামাণ্য ছবিটি ভালো লাগেনি। এরপরই শুরু হলো তিয়েনলিনের চীন-জার্মান যৌথ প্রযোজনার দীর্ঘ প্রামাণ্যচিত্র ‘কামিং এ্যান্ড গোয়িং’। চীনের প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রাম ছেড়ে কর্মসংস্থানে বড় শহরে চলে যাওয়া মানুষ যখন ভাগ্য অন্বেষণে ব্যস্ত, তখন গ্রামে তার সন্তানদের দীর্ঘ প্রতীক্ষার মানবিক কাহিনি এই প্রামাণ্য ছবি। নগর জীবনে প্রাণান্ত পরিশ্রম করে পরিবারের অভিভাবক হয়তো বাড়িতে টাকা পাঠায়, কিন্তু বছরের পর বছর সে আর বাড়িতে ফিরে আসে না। কেউ কেউ পেছনে ফেলে যাওয়া পরিবার পরিজন, ছেলে মেয়ের কথা ভুলে শেষ পর্যন্ত শহরেই নতুন ঘর সংসার করে থিতু হয়। প্রতীক্ষায় থাকা শিশুরাও এক সময় বড়হয়ে ওঠে, তারাও অর্থ উপার্জনের তাগিদে ঘর ছেড়ে পা বাড়ায় নাগরিক সা”ছ্যন্দের সন্ধানে। এ যেনো অনেকটাই বাংলাদেশের গ্রাম থেকে মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি দেওয়া ভাগ্য সন্ধানী মানুষ ও দেশে রেখে যাওয়া তাদের শিশু সন্তানদের গল্প। সমাজতান্ত্রিক চীনের গ্রামীণ বাস্তবতার এই ছবি দেখে বিস্মিত হতে হয়। আমাদের চোখে ব্যবসা বাণিজ্যে সমৃদ্ধ সম্পদশালী চীনা অর্থনীতির প্রকৃত চেহারা এবং জনজীবনের দারিদ্র ও দুর্দশার সত্যিকার ছবি বাইরের পৃথিবীকে জানতে দেয়া প্রয়োজন। সেদিক থেকে তিয়ানলিন নিঃসন্দেহে একটি গরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে। অবশ্য এই প্রামাণ্যচিত্রের সম্পাদনাসহ শেষ পর্য়ায়ের কাজ জার্মানিতে না করা হলে কী হতো বলা যায় না। হয়তো এই ছবির কারণে তিয়ানলিন আর দেশে ফিরতে পারবে না।

তিয়েনলিন ঝু

আমরা যখন পিরগসে ফিরে এলাম তখন রাত সাড়ে দশটা। ফেরার পথে আমাদের সঙ্গী ছিলেন তিনজন গ্রিক তরুণ তরুণী। হোটেলের কাছে নেমে যাবার পরে তিন গ্রিক আমাদের নৈশ্যভোজে আমন্ত্রণ জানালেন। আমি ভেবে দেখলাম এ ধরনের অনানুষ্ঠানিক আমন্ত্রণে এক সাথে খেতে গেলেও সাধারণত নিজের বিল নিজেরই পরিশোধ করতে হয়। যেহেতু কুপন আমাদের হাতে ছিল সেটিও অকারণে নষ্ট হবে, কাজেই আমি একটু আপত্তি জানিয়েছিলাম। কিন্তু তিয়েনলিনকে দেখলাম বেশ উত্সাহের সাথে রাজি হয়ে গেল। অতএব একযাত্রায় তো পৃথক ফল হতে পারে না। আমরা গ্রিকদের অনুসরণ করে যে রেস্তোরাঁয় প্রবেশ করলাম সেখানে খাদ্যের চেয়ে পানীয় বেশি, টেবিলে গ্লাসের চেয়ে বোতল বেশি এবং পুরো রেস্তোরায় পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা বেশি। একবার যখন মুঘলের হাতে পড়েছি, তখন খানা খেতে আর কোনো সমস্যাই সমস্যা বলে মনে রাখিনি। আমি তিয়ানলিনকে বলে রেখেছিলাম, অন্তত আমাদের দুজনের বিল আমি পরিশোধ করবো।

আড্ডায় আলোচনার কোনো নির্ধারিত বিষয়বস্তু থাকে না। কাজেই তিয়ানলিনের বর্তমান চীন এবং মাও সেতুংয়ের কমিউনিজম থেকে জার্মান সিনেমা, গ্রিসের মঞ্চ নাটক থেকে সারা বিশ্বের টেলিভিশন মিডিয়ার ভবিষ্যত কোনো কিছুই বাদ গেল না। রাত প্রায় বারোটার দিকে রেস্টুরেন্ট ছাড়ার সময় হলে আমি যখন বিল নিয়ে আসতে বললাম তখন আমাদের অবাক করে দিয়ে গ্রিক নাটকের কোরাসের মতো জলদ গম্ভীর কণ্ঠে শশ্রুমণ্ডিত তরুণ ঘোষণা করলেন, ‘ইট হ্যাজ অলরেডি বিন পেইড!’

ইওরোপের অনেক দেশেই এ ধরনের এশিয়ান সৌজন্য আমি খুব একটা লক্ষ করিনি। তাই বিস্ময়ের সাথে আরো একবার ধন্যবাদ ও সময় দেবার জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বিদায় নিয়ে হোটেলের পথ ধরলাম।

পরদিন সকালে আমাদের অলিম্পিয়া যাবার কথা। যিশুখ্রিস্টের জন্মেরও হাজার বছর আগে থেকেই জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন ও নীতিশাস্ত্র এবং চিরায়ত সাহিত্য-সংস্কৃতির দীর্ঘ অগ্রযাত্রায় যে গ্রিক সভ্যতা বিশ্বকে পথ দেখিয়েছিল, তার কেন্দ্রবিন্দু অলিম্পিয়া। খ্রিস্টপূর্ব ৭৭৬ অব্দে যেখানে সূচনা হয়েছিল আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতা সেই অলিম্পিয়া। হোটেলে নিজের ঘরে ঢুকে যাবার আগে তিয়ানলিন বললো, ‘ব্রেকফাস্টের পরে তুমি ঘরে থেকো, আমি যাবার আগে ডেকে নিয়ে যাবো।’
উত্তরে বললাম, ‘ঠিক আছে, তাহলে শুভরাত্রি।’ চলবে…