শর্মা বনাম কানাডা : পোস্ট গ্রাজুয়েট ওয়ার্ক পারমিট এর জন্য আদালতের শরণ
মনীষ পাল : পুরো নাম করন শর্মা, ভারতের নাগরিক। ২০১৬ সালে উচ্চ শিক্ষার জন্য কানাডায় আসেন। কুইবেকের একটি কলেজে দু বছরের এক প্রোগ্রামে ভর্তি হন তিনি। ক্লাস শুরু হয় ২০১৭ সালের ফেব্রæয়ারিতে, শেষ হবার কথা ২০১৮ সালের অক্টোবরে। কোর্স চলাকালীন হঠাৎ করে তিনি টাইফয়েডে আক্রান্ত হন। উপায় না দেখে ২০১৭ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৮ সালের ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত কয়েক মাসের জন্য তিনি পড়াশোনা থেকে বিরতি নেন। তিনি আদালতকে বলেন, বিরতির জন্য তিনি তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে মৌখিক অনুমতি নেন, তাছাড়া ইমেইলের মাধ্যমেও তিনি তাদেরকে তার অনুপস্থিতির কথা জানান। তবুও তাকে তার প্রতিষ্ঠান থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়, যদিও পরবর্তীতে সেই আদেশ তুলে নেয়া হয়। ফলে তিনি পাঁচ মাস দেরিতে হলেও ২০১৮ সালের পরিবর্তে ২০১৯ এর মে মাসে তার প্রোগ্রাম শেষ করতে সক্ষম হন।
পড়াশোনার পাঠ শেষ হলে সেই বছরের জুলাই মাসে তিনি পোস্ট গ্রাজুয়েট ওয়ার্ক পারমিট এর জন্য আবেদন করেন। দু দুবার চেষ্টার পরও তাকে অনুমতি দেয়া হয়নি। বরং দ্বিতীয় বার আবেদনের পর তাকে বহিস্কার আদেশ দেয়া হয়। এবার প্রার্থী আর উপায়ান্তর না দেখে আদালতের শরণাপন্ন হন।
এবার প্রার্থী কানাডার কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে দুটো সিদ্ধান্তের প্রতিকার চেয়ে বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার আবেদন করেন। একটি সিদ্ধান্ত হচ্ছে, কানাডার সীমান্ত কর্মকর্তা সীমান্ত দিয়ে ঢোকার মুখে তাকে পোস্ট গ্রাজুয়েট ওয়ার্ক পারমিট দিতে অস্বীকৃতি জানান এবং তাকে কানাডায় অগ্রহণযোগ্য বলে ঘোষণা করেন, আবার এরই জের ধরে আরেক কর্মকর্তা তার বিরুদ্ধে বহিস্কার আদেশ আরোপ করেন। অভিবাসন আইনের আওতায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি একনাগাড়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাননি, যদিও স্কুল কতৃপক্ষ তাকে বিরতির পর পড়াশোনা চালিয়ে যেতে অনুমতি দেন এবং তিনি শেষ পর্যন্ত পড়াশোনার যাবতীয় বাধ্যবাদকতা পূরণ সাপেক্ষে কর্মসূচি শেষ করতে সক্ষম হন।
প্রার্থীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি বিচারক দুটো বিষয় একসাথে পর্যালোচনার আদেশ দেন।
সরকার পক্ষ দাবি করেন, প্রাথমিকভাবে প্রার্থীর এই আবেদনের কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই, এর সপক্ষে তারা বলেন, প্রার্থী ইতিমধ্যেই কানাডা ছেড়ে চলে গেছেন, তার মানে তাতে তার বহিস্কার আদেশ ইতিমধ্যেই কার্যকর হয়ে আছে। তারা বলেন, বহিস্কার আদেশ বহাল থাকায় প্রার্থীর কানাডায় আবার ফিরে আসা বা পোস্ট গ্রাজুয়েট ওয়ার্ক পারমিট এর অনুমোদন দুটোই আর প্রাসঙ্গিক নয়। কিন্তু বিচারক সরকার পক্ষের অবস্থানের বিপরীতে বলেন, ‘প্রার্থীর কানাডা ছেড়ে যাওয়া কোনোভাবেই তার আদালতের কাছে প্রতিকার চেয়ে যে আবেদন, সেগুলোকে অর্থহীন করে তুলেনি, তাই আমি সরকারের এই উপস্থাপন গ্রহণ করতে পারি না’ ও এই বলে তিনি সরকারের প্রাথমিক যুক্তিতর্ক নাকচ করে দেন। সরকারের আদেশকে পদ্ধতিগত ন্যায় বিচারের লঙ্ঘন বলে আদালত মত দেন। তাই সরকার পক্ষের আদেশকে তিনি বাতিল বলে সিদ্ধান্ত দেন এবং প্রার্থীর আবেদন পুনঃনিরীক্ষার জন্য অন্য আরেক কর্মকর্তার কাছে প্রেরণের নির্দেশ জারি করেন।
প্রার্থীর পক্ষে তার আইনজীবী আদালতে পেশ করেন, সরকার পক্ষের যুক্তিতর্ক অনুমাননির্ভর। তিনি বলেন, যদি বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার আবেদন সফল হয়, তার মানে এটি নয় যে, প্রার্থীকে আবারো ভিসার জন্য আবেদন করতে হবে, এবং যদি আবেদন দরকারও পড়ে, তার মানে এই নয় যে, ভিসার আবেদন সময়মতো করা সম্ভব হবে না বা আবেদন অনুমোদন পাবে না।
তাই প্রার্থীর আবেদনের কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই, সরকার পক্ষের এই যুক্তি ধোপে টেকে না।
আদালত প্রার্থীর যুক্তির সাথে একমত প্রকাশ করেন এবং বলেন, প্রার্থীর কানাডা ছেড়ে যাওয়া মানে এই নয়, প্রার্থীর পক্ষে বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা আবেদন চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব অথবা প্রার্থীর পক্ষে পোস্ট গ্রাজুয়েট ওয়ার্ক পার্মিট এর আবেদন অকিঞ্চিৎকর একটি বিষয়। আদালত আরো বলেন, ‘কানাডায় ঢুকবার জন্য প্রার্থীর যদি আবারো ভিসার দরকার পড়ে , আমি মনে করি না ,কেবলমাত্র ভিসার বিষয়টা প্রার্থীর পুরো আবেদন পরিস্থিতি এমন জটিল করে তুলতে পারে যাতে বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার রায় একেবারে অর্থহীন পর্যবসিত হয়’। আদালতের এই পর্যবেক্ষণ সরকার পক্ষের আইনজীবী স্বীকার করে নেন। তাই আদালত মত দেন, বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার রায় যদি ইতিবাচক হয়, তাহলে প্রার্থীর ভিসার আবেদন এবং পরবর্তীতে পোস্ট গ্রাজুয়েট ওয়ার্ক পারমিট এর আবেদন দুটোই প্রাসঙ্গিক। তাই আদালতের মতে, প্রার্থীর আবেদনের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে সরকার পক্ষের যুক্তি তর্ক মেনে নেয়া যায় না, আর তাই এই ক্ষেত্রে বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার আবেদন বিবেচিত হওয়া উচিত।
পোস্ট গ্রাজুয়েট ওয়ার্ক পারমিট প্রত্যাখ্যান এর কারণ হিসেবে ভিসা অফিসার প্রার্থীর অননুমোদিত ছুটির কথা উল্লেখ করেন। এই অননুমোদিত ছুটির বিষয়টি কেবল স্কুলের অফিস সহকারীর সাথে ভিসা অফিসার এর কথোপকথন উপর ভিত্তি করে আদালতে উপস্থাপন করা হয়। প্রার্থীর আইনজীবী সাক্ষ্য প্রমানের মাধ্যমে তুলে ধরেন, ভিসা অফিসার কখনোই স্কুলের অফিস সহকারীর সাথে তার কথোপকথনের কথা প্রার্থীর সাথে শেয়ার করেননি। প্রার্থী বলেন, তিনি কথিত অফিস সহকারীকে চেনেন না বা স্কুলে তার কি ভ‚মিকা, সেটা সম্পর্কে ও অবগত নয়। বা এমনকি সেই কথিত সহকারী স্কুলের যাবতীয় রেকর্ড বা নথি সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত আছেন কিনা, সেটা ও নিশ্চিত নয়। প্রার্থী দাবি করেন, অফিস সহকারীর সাথে ভিসা অফিসার এর আলোচনার ধরণ বা কাজের আওতায় তার কতটুকু ভ‚মিকা, সেটির উপর নির্ভর করে অফিস সহকারী ছাত্রদের বিষয়ে কতটুকু অবহিত। আর তাই ভিসা অফিসার এর সাথে তার কথোপকথন পুরো চিত্র তুলে ধরে না। প্রার্থী উল্লেখ করেন, যদি ভিসা অফিসার অফিস সহকারীর সাথে তার কথোপকথন বা অনুসন্ধানের বিষয়টি শেয়ার করতেন, তবে তিনি অফিস সহকারীর কাছে কতিপয় প্রশ্ন তুলে ধরতেন, যার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হতো, যদি তার বিরতির অনুমতি নাই বা থাকতো, তাহলে তাকে পরবর্তীতে বাকি কোর্স সম্পন্ন করার সুযোগ দেয়া হয় কিভাবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, প্রার্থী বিলম্বে হলেও তার কোর্স পুরোটাই সম্পন্ন করেন।
প্রার্থীর আবেদন প্রত্যাখান থেকে এই বিষয়টি পরিষ্কার, ভিসা অফিসার স্কুলের অফিস সহকারীর সাথে কথোপকথন থেকেই তার সিদ্ধান্তে উপনীত হন। তাছাড়া, সেই কথোপকথন এর বিষয়টি প্রার্থীকে অবগত করা হয়নি, আর সেই ব্যর্থতা পদ্ধতিগত ন্যায়বিচারের লঙ্ঘন। হতে পারে, অফিসার অফিস সহকারীর সাথে কথা না বলেও প্রার্থীর বিষয়ে একই উপসংহারে আসতে পারতেন কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ায় অন্য কোনো বিবেচনার প্রমাণ ভিসা অফিসার দেখতে পারেননি। আদালত ভিসা অফিসার এর সাথে একমত পোষণ করেন, প্রার্থী স্কুল থেকে শিক্ষা বিরতির অনুমোদন পেয়েছেন, সে বিষয়টি প্রমান করতে পারেননি। তাই অভিবাসন আইনের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রার্থী পূর্ণকালীন ছাত্র হিসেবে গণ্য হতে পারেন না আর সেই ক্ষেত্রে পোস্ট গ্রাজুয়েট ওয়ার্ক পারমিট এর আবেদনের যোগ্যতা ও রাখেন না। কিন্তু যেহেতু প্রার্থীর কাছে অনুসন্ধানের কিছু বিষয় শেয়ার করা হয়নি, তাই আদালত মত দেন, ভিসা প্রত্যাখানের বিষয়টি পদ্ধতিগতভাবে প্রার্থীর প্রতি ন্যায়বিচারের লঙ্ঘন। তাই তিনি প্রার্থীর পক্ষে বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার অনুমতি দেন। তাই আদালত অন্য বিষয়গুলো আর বিবেচনায় নিতে চাননি, প্রার্থীর পোস্ট গ্রাজুয়েট ওয়ার্ক পারমিট এর আবেদন পুনঃনিরীক্ষার জন্য ভিন্ন এক অফিসারকে নিয়োগ দেবার জন্য কানাডা বর্ডার সার্ভিসেস এজেন্সিকে নির্দেশ দেন।
মনীষ পাল – লেখক ও অভিবাসন উপদেষ্টা, টরন্টো