Home কলাম অভিবাসী মন, অভিবাসী জীবন : স্টাডি পারমিট প্রত্যাখ্যান – যে রায়ে আদালত...

অভিবাসী মন, অভিবাসী জীবন : স্টাডি পারমিট প্রত্যাখ্যান – যে রায়ে আদালত ভিসা কর্মকর্তার সিদ্ধান্তের বিপক্ষে

মনীষ পাল : এটি খুবই সা¤প্রতিক একটি বিষয়। এ বছরের জুলাইয়ের ২৫ তারিখে আদালত রায় ঘোষণা করেন। ঘটনার সূত্রপাত আরো আগে। এক ইরানি ছাত্রী উচ্চ শিক্ষার জন্যে কানাডায় আসবার অনুমতি চান। ভিসা কর্মকর্তা যথাযথ কোনো কারণ ছাড়া সেই আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন। তার পুরো নাম মাহতাব খানলার মতলাঘ। পঁয়ত্রিশ বছর বয়েসী এই ইরানি দু সন্তানের জননী। মিস মতলাগ ইরানের একটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে পড়াশোনা করেন, ২০১১ থেকে তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটা স্কুলে গণিতের শিক্ষক হিসেবে কাজও করছেন। স্বামীও আরেক মন্ত্রণালয়ে কর্মরত। উচ্চতর শিক্ষা আর গবেষণা কাজের জন্য এবার তিনি কানাডার একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবার চেষ্টা করেন, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভর্তির অনুমতিও পেয়ে যান, কিন্তু দূর্ভাগ্য তার, অভিবাসন বিভাগ তার স্টাডি পারমিট বা অধ্যয়নের অনুমতি দেয়নি। তিনি সেই নেতিবাচক সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য অভিবাসন বিভাগে আরেকবার আবেদন করেন। এবার সেটিও নাকচ করে দেয়া হয়। এই মামলার সূত্রপাত এখন থেকেই। তিনি উপায়ান্তর না দেখে ফেডারেল আদালতে বিচারবিভাগীয় পর্যালোচনার আবেদন করে বসেন। আদালতকে তিনি জানান, ভিসা কর্মকর্তার সিদ্ধান্তে কোনো যৌক্তিকতা নেই আর তাই সেই সিদ্ধান্ত বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার দাবি রাখে।

মিস মতলাগ তার স্টাডি পারমিট এর আবেদনে উল্লেখ করেন, লেকহেড বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার সুযোগ কাজে লাগাতে তিনি এই প্রতিষ্ঠানে আসতে চান। তিনি তার পছন্দের বিষয়ে পড়বার কারণ দেখিয়ে বলেন, পড়াশোনা শেষে তিনি শিক্ষক হিসেবে আরো কর্মদক্ষ হয়ে উঠবেন। ইরানের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় একই মানের গবেষণার সুযোগ নেই বলে তিনি আবেদনে উল্লেখ করেন । পাঠদানের সাথে সম্পর্কিত সমাজবিজ্ঞান এবং দর্শন বিষয়ে উচ্চতর পড়াশোনার আগ্রহের কথা তিনি তার আবেদনে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেন।
তিনি আরো লিখেন, দুর্ভাগ্যবশত ইরানের শিক্ষা ব্যবস্থা এখনো পুরোনো ধাঁচের, যদিও সা¤প্রতিককালে সরকার শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে গবেষণার উপর জোর দেয়াসহ বিভিন্ন পরিকল্পনা হাতে নেয়। তাই ভবিষ্যতে শিক্ষা খাতে প্রতিশ্রুতিশীল বিভিন্ন পরিকল্পনায় যাতে অবদান রাখা যায়, সেইজন্য তিনি নিজেকে প্রস্তুত করবার জন্য কানাডার মতো উন্নত দেশে উচ্চতর শিক্ষার সুযোগ নিতে চান। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, অভিবাসন বিভাগ বরাবরই খতিয়ে দেখে – অস্থায়ীভাবে কানাডায় বসবাসের জন্য যারা আসছে, তারা ভিসার মেয়াদ শেষে ফিরে যাবে কিনা। তাই সরকারের সেই সংস্থাকে আশ্বস্ত করবার জন্য মিস মতলাগ তার আবেদনে উল্লেখ করেন, দেশে তার স্বামী এবং দু সন্তানকে তিনি রেখে আসছেন, বর্ধিত পরিবারের অন্য সদস্যরা তো রয়েছেই। যেহেতু তার স্বামী এবং সন্তানেরা তার সাথে কানাডায় ঢুকছে না, তাই তার কানাডায় দীর্ঘমেয়াদি থেকে যাবার কোনো পরিকল্পনা নেই। তাছাড়া তিনি দেশে তার রেখে আসা সম্পত্তি, বাড়ির লিজ, ব্যাংকের যাবতীয় কাগজপত্র, অন্যান্য সঞ্চয়, বিনিয়োগ ইত্যাকার সব দলিলের কপি আবেদনের সাথে সংযুক্ত করেন। তাছাড়া, তার এবং স্বামীর সরকারি চাকুরী, নিজের কর্মস্থল থেকে সাময়িক ছুটির অনুমতিপত্র এবং তার সন্তানের ইরানের স্থানীয় স্কুলে পড়াশোনা সংক্রান্ত যাবতীয় কাগজপত্রও আবেদনের সাথে জমা দেন।

কিন্তু বিধি বাম ও ভিসা কর্মকর্তা গত বছরের জুনের তিন তারিখে তার আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন। কর্মকর্তা তার নথিতে লিখেন, আবেদনকারীর স্টাডি প্ল্যান বা অধ্যয়ন পরিকল্পনা যুক্তিসংগত মনে হয় না, কেননা আবেদনকারীর এই প্ল্যানের সাথে আগেকার পড়াশোনার সামঞ্জস্য নেই; তাছাড়া, আবেদনকারীর কানাডায় পড়াশোনার খরচ চালিয়ে যাবার মতো সামর্থ তার পরিবারের আছে বলে প্রতীয়মান হয় না। ভিসা কর্মকর্তার মতে, আবেদনকারী যে বিষয়ে পড়তে আগ্রহী, সে বিষয়ে পড়াশোনার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। কারণ হিসেবে তিনি তুলে ধরেন, উচ্চমূল্য ব্যয়ে কানাডায় পড়াশোনা শেষে চাকুরীতে সমমানের উপকারিতা লাভের কোনো নিশ্চয়তা নেই। সবশেষে তিনি বলেন, ‘আমি নিশ্চিত নই যে, আবেদনকারী ভিসার মেয়াদ শেষে দেশে ফিরে যাবেন। তাই এসব কারণে আমি তার আবেদন প্রত্যাখ্যান করছি’।

এবার আবেদনকারী অভিবাসন বিভাগে তাদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন করেন। কিন্তু পুনর্বিবেচনার আবেদনে ও ভিসা কর্মকর্তা বিস্তারিত কারণ না দেখিয়ে শুধু লিখেন, আগের সিদ্ধান্তে তথ্য বা আইনের কোনো ভুল নেই। আবেদনকারী নতুন আবেদনে জোরালো কোনো নতুন তথ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করেননি, তাই আগের সিদ্ধান্তের পরিবর্তন সম্ভব নয়। এবার আবেদনকারী ছাত্রীটির আর কোনো গতি থাকে না। তিনি সেই সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতার বিরুদ্ধে বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার আবেদন জানান।

প্রতীকী ছবি : শিক্ষা ভিসার আবেদন

এক্ষেত্রে আদালতের বিবেচ্য বিষয়, ভিসা কর্মকর্তার সিদ্ধান্ত কি যুক্তিসঙ্গতার আইনি মাপকাঠিতে উর্তীর্ণ কিনা। আদালত পর্যালোচনা করেন, এই সিদ্ধান্ত আইনের দৃষ্টিতে কি ন্যায্য, বোধগম্য এবং স্বচ্ছ। আদালত সেই বিষয়গুলোতেই হস্তক্ষেপ করেন, কোনো সিদ্ধান্তে যখন এই তিনটি নিরিখে যথেষ্ট ঘাটতি থেকে যায়। ন্যায্যতা, বোধগম্যতা আর স্বচ্ছতা তখনই নিশ্চিত হয়, যখনই কোনো সিদ্ধান্তের পেছনে যুক্তিসঙ্গত প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায় আর সেই সিদ্ধান্তের পেছনে আছে তথ্য আর আইনের সমর্থন।

মিস মতলাগ তুলে ধরেন, তার স্টাডি প্ল্যান যথেষ্ট যুক্তিসংগত এবং ভিসা কর্মকর্তা তার সিদ্ধান্তের সপক্ষে পর্যাপ্ত কারণ দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন। এই প্রসঙ্গে মিস মতলাগ ফেডারেল আদালতের সা¤প্রতিক আরেক মামলার প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলেন, সেই মামলায় আদালত রায় দেন, কারণ যতই সংক্ষিপ্ত হোক না কেন, স্টাডি প্ল্যান প্রত্যাখ্যানের কোনো সিদ্ধান্ত যদি দেয়া হয়, তবে তার সপক্ষে ভিসা কর্মকর্তার পর্যাপ্ত কারণ উল্লেখ করা প্রয়োজন। মিস মতলাগ যুক্তি দেখান, তার স্টাডি প্ল্যানে অস্বাভাবিক এমন কিছু নেই যা সম্ভবের অতীত মনে হতে পারে। সেই স্টাডি প্ল্যান নিয়ে ভিসা কর্মকর্তার নেতিবাচক উপসংহার তার কাছে একেবারেই বোধগম্য নয়। মিস মতলাগ আরো বলেন, তার পরিবারের অস্বচ্ছলতা নিয়ে ভিসা কর্মকর্তার বক্তব্যের পেছনে কোনো প্রমাণ নেই। এই বিষয়ের সপক্ষে তিনি যথেষ্ট দলিলপত্র জমা দিয়েছেন।

মিস মতলাগ আদালতকে জানান, ২০১৯ এর এক মামলায় আরেকটি আদালত ভিসা কর্মকর্তার সিদ্ধান্ত পাল্টে দেন এই বলে যে, ভিসার মেয়াদ শেষে আবেদনকারী কানাডায় অবৈধ ভাবে থেকে যাবেন, তার পক্ষে ভিসা কর্মকর্তার কাছে কোনো তথ্য প্রমাণাদি নেই বরং যা আছে, তাতে উল্টোভাবে প্রতীয়মান হয়, মেয়াদ শেষে আবেদনকারী স্বদেশে ফিরে যাবেন। তাছাড়া, আবেদনকারীর নিজের দেশে একই মানের উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে বলে ভিসা কর্মকর্তা যে উপসংহার টেনেছেন, তার পক্ষেও কোনো প্রমাণ ওই কর্মকর্তা দেখাতে পারেননি।

আদালত মত দেন, ভিসা কর্মকর্তার নথিতে সংক্ষেপে যে কারণ দেখানো হয়, তাতে মিস মতলাগের আবেদন প্রত্যাখানের কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। আবেদনকারী তার আবেদনে কানাডায় উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্য বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। তাছাড়া, ইরানে শিক্ষক হিসেবে তার দীর্ঘ চাকুরী সত্তে¡ও তার পড়ার বিষয়বস্তু অফিসার কেন অপ্রয়োজনীয় বা অযৌক্তিক বিবেচনা করেন, আদালতের কাছে সেটিও বোধগম্য নয়। ইরানের সেকেলে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে মিস মতলাগের বিস্তারিত ব্যাখ্যা সত্তে¡ও ভিসা কর্মকর্তা স্থানীয়ভাবে একই মানের শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ আছে বলে মত দেন কিন্তু সেই মতের সপক্ষে কোনো তথ্য প্রমাণ জোগাতে পারেননি। তাছাড়া, মিস মতলাগ তার আর্থিক সামর্থের সপক্ষে প্রমাণসহ এক বছরের যাবতীয় খরচ সংকুলানের বন্দোবস্ত করেন।

দীর্ঘ এক বছর পর মিস মতলাগের পক্ষে আদালতের রায় আসে। দুই পক্ষের জমা দেয়া কাগজপত্র পরীক্ষা করে আদালত রায় দেন। আবেদনকারী বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার জন্য যে আবেদন করেন, সেটি গৃহীত হয় এবং স্টাডি পারমিট বা অধ্যয়ন ছাড়পত্রের আবেদন আবারো পুনর্নির্ধারণের জন্য অন্য আরেক ভিসা কর্মকর্তার কাছে ন্যস্ত করা হয়।
অভিবাসন আইন নিয়ে যারা কাজ করছেন, তারা এই রায়ের উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখছেন। এই রায়ে আদালতের কিছু পর্যবেক্ষণ আছে যা ভবিষ্যত মামলার ক্ষেত্রে নজির হিসেবে কাজ করবে। বিশেষ করে স্টাডি পারমিট নিয়ে অভিবাসন বিভাগের সিদ্ধান্ত যদি নেতিবাচক হয়, তাহলে সেই ক্ষেত্রে ভিসা কর্মকর্তার উচিত তথ্য প্রমাণাদির উপর নির্ভর করে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া। সাধারণ বা মনগড়া কারণ দেখিয়ে কানাডায় পড়তে আসতে ইচ্ছুক আবেদনকারীকে নিরুৎসাহিত করবার যুক্তিসংগত কোনো কারণ থাকতে পারে না। আদালতের পর্যবেক্ষণে এটিও উঠে আসে, জনবল বা আর্থিক স্বল্পতার কারণে আবেদনকারীর পক্ষে বা বিপক্ষে অভিবাসন বিভাগের যেনতেন সিদ্ধান্ত নেয়ার কোনো সুযোগ নেই।

মনীষ পাল – লেখক ও অভিবাসন উপদেষ্টা, টরন্টো

Exit mobile version