Home কলাম অভাগা কাঠবিড়ালি!

অভাগা কাঠবিড়ালি!

সাজ্জাদ আলী : কাঠবিড়ালিটি ক’দিন ধরেই বাড়ির চালার প্রান্তঘেঁষে উদভ্রান্তের মতো দৌড়াদৌড়ি করছিল। বাড়িতে ঢোকা বা বেরুবার পথে ড্রাইভওয়েতে পা রাখলেই ওর অস্থিরতা চোখে পড়ে। আমাকে দেখলেই সে ক্যাচ-ক্যাচ, ঘ্যাগ-ঘ্যাগ ধরণের বিশ্রি শব্দ করে মনোযোগ কাড়ে। ওর দিকে তাকাতেই সে দৌড়ে ছাদের খানিকটা উপরে উঠে যায়, আবার দ্রæতই কিনারায় নেমে আসে, আবারও খানিকটা উঠে-নামে। মনে হয় যেন বাড়ির ছাদের উপরে কিছু একটা সে দেখাতে চায়। পিট পিট চোখে একবার আমার দিকে তাকায়, আবার ছাদের দিকে গলা ঘুরায়, দ্রুত লেজ নাড়তে থাকে। চালার কিনারা ঘেঁষা বৃষ্টির পানি নামার ডোঙ্গায় পায়ের নখ দিয়ে সে আঁচড় কাটে। কাঠবিড়ালিটি ভীষণ উত্তেজিত, পারলে ঘরের চালা, ডোঙ্গা, সব ভেঙ্গে চুরমার করতো!

টরন্টো শহরে মাঝারি সাইজের একটা বাংলো বাড়িতে আমাদের আবাস। এ এলাকায় র‌্যাকুন (বেজি গোত্রীয় প্রাণী), আর কাঠবিড়ালি, এই প্রাণীদুটো হরহামেশাই চোখে পড়ে। কাঠবিড়ালগুলোর এ দেশিয় নাম স্ক্রল, ওরা রাতে চরে না। ৮/১০টি স্ক্রল সারাদিনই বাড়ির ব্যাক-ইয়ার্ডে, গ্যারেজের ছাদে, সামনের বারান্দায় চঞ্চল বিচরণ করতে থাকে। খুব যে ভীতু তা নয়, কাছাকাছি হলেও নড়ে না। তবে ধরতে গেলে দৌঁড়ে পালায়। আমাদের রত্না ওই কাঠবিড়ালিগুলোর উপর বেজায় খাপ্পা। প্রতি গ্রীস্মে তার ব্যাকইয়ার্ডের সবজিবাগান ওরা তছনছ করে দেয়। এ বছরেও ৫টি বেগুণের দুটি ওরা খেয়েছে। গাছের জালি শশাগুলো কামড়ে দিয়েছে, লাউ গাছের গোঁড়াও কেটেছে। তবে আমার জন্য কাঠবিড়ালিগুলো শাপে-বর! সারাক্ষণ রত্না ওদের উপর বিরক্তি ঝাড়তে গিয়ে আমার উপরে ঝাড়া-মোছার তেমন একটা সময় পায় না!

দিন তিনেকের মধ্যে কাঠবিড়ালটি যেন বেপরোয়া হয়ে উঠলো! এখন আর বাড়ির ছাদে নয়, আমাকে দেখলেই সে ড্রাইভওয়েতে ছুটে আসে। ক্যাচ-ঘ্যাগ রকমের গো গো শব্দ করতে করতে আমার পায়ের পাশ দিয়ে লাফাতে থাকে। আমি গাড়ি নিয়ে রাস্তার দিকে যেতে থাকলে সেও পিছু পিছু রাস্তায় নেমে আসে। তার দৌড় লাফের মধ্যে এক ধরণের “আক্রোশ” যেন দিন দিন বাড়ছে। আশ্চর্য কি জানেন, অন্য কাঠবিড়ালিগুলো তাদের স্বাভাবিক স্বভাবেই আছে। শুধু কথিত এই কালচে রংয়ের কাঠবিড়ালিটিই ব্যাতিক্রমী আচরণ করছে।

সে দিন সকালে বাসা থেকে বের হবো বলে গাড়ির দরজা খুলে মাত্রই এক পা ভেতরে ঢুকিয়েছি। বারান্দার চালা থেকে লাফ দিয়ে স্ক্রলটি আমার আরেক পায়ের উপর আছড়ে পড়লো। চমকে উঠে পা টেনে নিয়ে গাড়ির দরজা আটকে দিলাম। এতো দেখছি রীতিমত আক্রমণ! কিন্তু কেন? ভাগ্যিস সে আমার মুখের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েনি! এত্তটুকু একটা প্রাণী, মানুষের শক্তি-সামর্থের তুলনায় সে কতই না তুচ্ছ! তার এমনতর বেয়াদবির সমুচিত শাস্তি তো দেওয়া যেতেই পারে। কিন্তু পরিস্থিতি বিবেচনায় আমার যেন কেন মনে হচ্ছে যে, ওর ঘোরতর কোনো বিপদ হয়েছে! হয়তো অজ্ঞাতেই ওর সে অনিষ্টের কারণও আমি। আমরা দুটি প্রাণী এই জগত্সংসারেই সন্তান, কিন্তু কেউ কারো ভাষা বুঝি না!

ব্যাপারটাকে তো আর হালকাভাবে দেখা চলে না। বাইরে বেরুনো স্থগিত রেখে টরন্টো সিটি কর্পোরেশনের বন্যপ্রাণী বিভাগকে ফোন করে সাহায্য চাইলাম। করিত্কর্মা কর্তৃপক্ষ বললো, এক ঘণ্টার মধ্যে আমাদের এক্সপার্ট টিম আপনার ওখানে পৌঁছাবে। প্রাপ্তবয়স্ক একজন যেন বাড়িতে উপস্থিত থাকে। বুঝে নিলাম যে, আজকের দিনটি কাঠবিড়ালির খেদমতেই যাবে, কাজকর্ম সব লাটে। অগত্যা ওদের অপেক্ষায় রইলাম।

অ্যাম্বুলেন্সের আদলের একখানা গাড়ি নিয়ে তিনজনের একটি দল এসে পৌঁছুল। পেশাদার পোষাক ওদের। পায়ে বুটজুতা, গায়ে-পরনে একই রংয়ের ডোরাকাটা সার্টপ্যান্ট, মাথায় হ্যালমেট, কোমরের হোলস্টারে পিস্তল, পিঠে ঝোলানো ব্যাগ ভর্তি সরঞ্জাম। বন্যপ্রাণীর সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করতে পূর্ণ প্রস্তুতি আছে ওদের। পুরুষ অফিসারটি ড্রাইভওয়েতে দাঁড়িয়ে আমার থেকে পুরো ঘটনাটি শুনলো। কাঠবিড়ালটিও ঘরের চালার কোণায় বসে যেন আমার বিবরণী শুনছে। আমি আঙ্গুল উঁচিয়ে অফিসারকে স্ক্রলটি দেখালাম। তত্ক্ষণাত সে যেন তার জবাবেই ক্যাচ-ক্যাচ শব্দ করে উঠলো।

বাকি অফিসার দুজন আমার দুপাশের প্রতিবেশীদের দরজায় টোকা দিয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে। কান খাড়া করে শুনছি ওদের কথাবার্তা। ৯২ নম্বর বাড়ির জার্মান বংশোদ্ভুত বৃদ্ধা উচ্চস্বরেই বলছে,
আমি শিওর ওরা অ্যানিমেল লাভার। ৩ বছর আগে আমার কুকুরটি মারা গেলে ওরা দুজনেই ফুলের তোড়া নিয়ে দেখতে এসেছিল। আমার বিড়ালটি বলতে গেলে সারাদিনই ওদের বারান্দায় ঘুমিয়ে কাটায়। এমনকি ওদের অ্যাকুইরিয়ামে বেশ কয়েকটি মাছও আছে।
বন্যপ্রাণীদের প্রতি আমাদের আচরণ সহানুভুতিশীল নাকি অত্যাচারী ধরণের, এক্সপার্ট টিম প্রথমেই সেই তদন্তটি শুরু করলো। ওদের প্রাথমিক সন্দেহ যে, স্ক্রলটিকে আমরাই কোনভাবে বিপদাপন্ন করেছি। বেশ বুঝতে পারছি যে, আমি আসামীর কাঠগড়ায় আর আমার পড়শীরা মামলার সাক্ষি! এরপরে প্রায় তিন ঘণ্টাব্যাপী ওদের অনুসন্ধান চললো। বাড়ির সামনের চাতাল, ড্রাইভওয়ে, গ্যারেজ, বারান্দা, ব্যাকইয়ার্ড, গার্ডেন-সেড, সব জায়গা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো, শতাধিক ছবিও তুললো। কমলা রংয়ের আলোক রশ্মি বিচ্ছুরিত হয়, এমন এক ধরনের ছোট যন্ত্র ওদের তিনজনেরই হাতে। ওরা আসলে বোঝার চেষ্টা করছিলো যে, স্ক্রলটির অসুবিধাটা কোথায়?

সব শেষে তিনজনই একসাথে ছাদে উঠলো। ঘন্টাখানেক ধরে ছাদের প্রতিটি অংশের বিছানো সিঙ্গেল (ছাউনি দেওয়ার প্লাস্টিক বিশেষ), বৃষ্টির জল গড়িয়ে নামার স্টীলের পাইপ, ফায়ারপ্লেসের চুল্লি ইত্যাদি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিরীক্ষা করলো। আর এই পুরোটা সময় কাঠবিড়ালিটি সারা ছাদময় লাফিয়ে লাফিয়ে এক্সপার্ট টিমকে সঙ্গ দিলো। এক পর্যায়ে টিম লিডার মহিলা ছাদ থেকে নেমে আবার আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলো,
মি: আলী, ছাদের ছাউনি দেখতে তো নতুন মনে হচ্ছে। কবে বদলেছেন?
এই তো মাত্রই, গত সপ্তাহে।
স্ক্রলটির অস্বাভাবিক আচরণ কি ছাদের সিঙ্গেল বদলাবার আগে থেকে, না কি বদলের পরে আপনার নজরে এসেছে?
জ্বী না, যতদূর মনে পড়ে সিঙ্গেল পাল্টাবার পর থেকেই।

দেখুন ঘটনা বিশ্লেষনে আমরা মনে করছি যে, আপনার পুরোনো রুফ সিঙ্গেলের ভাঁজে স্ক্রলটি বাসা বেঁধেছিলো। খুব সম্ভবত বাচ্চাও প্রসব করে থাকবে। আপনার রুফাররা (ঘরামীরা) তো পুরোনো সব সিঙ্গেল ভেঙ্গেচুরে ট্রাক বোঝাই করে নিয়ে গেছে। এখন নতুন ছাউনি দেওয়া ছাদে স্ক্রলটি তার বাসাটি খুঁজে ফিরছে! তবে আশংঙ্কার কথা হলো সে আরো হিং¯্র হয়ে উঠতে পারে, যা আপনার পরিবারের জন্য বিপদের কারণ। আমরা ওটিকে ধরে নিয়ে যাচ্ছি, দূরের কোনো বনে ছেড়ে দেব।

আচ্ছা, নিয়ম মতো যা করতে হবে তা করুন আপনারা। বিষন্ন মনে বললাম আমি।
সুতোর জালের একটা থলিতে কাঠবিড়ালিটিকে বন্দি করে বাকি দুজন অফিসারও ছাদ থেকে নেমে এলো। হাঁ, উপযুক্ত সমাধানই বটে! কাঠ বিড়ালিটিকে দূরের কোনো বনে ছেড়ে দিলেই সমস্যার নিস্পত্তি! ওর বাসাটি কোথায় গেল, ছানাদের কি হলো; সে খবরে আশরাফুল মাকলুকাত “মানুষের” কি প্রয়োজন?
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডা’র নির্বাহী)

Exit mobile version