রাশেদ নবী : সুজাতার প্রেমিক লোকেন বোস একজন ব্যস্ত নাগরিক। এতই ব্যস্ত যে সুজাতাকে সে এখনও ভালবাসে কি না এই সামান্য ভাবনা ভাববার অবসর তার নাই। বিকেলে তাকে যেতে হবে টেনিস খেলতে; টেনিস থেকে ফিরে এসে রাতে যেতে হবে ক্লাবে। দিনের অন্য সময় শ্রী বোস কি করে তা আমাদের অজানা। তবে আমরা জানি সে অত্যন্ত বিদগ্ব ব্যক্তি; তার বইয়ের তাকে চার্বাক, ফ্রয়েড, প্লেটো ও পাভলভ শোভা পায়। সে কারণে আমরা ধরে নিতে পারি সে কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তি। হেমন্তকাল আসার আগে বিদগ্ধ বোসের সময় হবে না সুজাতাকে নিয়ে ভাববার। কেন হেমন্তকাল, কেন বর্ষা বা শীতকাল নয় সেটাও আমাদের অজানা।
পঞ্চাশ দশকের কলকাতায় লোকেন বোসের মত পাতি-বুর্জোয়া রোমান্টিক বাবুদের সংখ্যা খুব বেশি ছিল না। জীবনানন্দের মত আত্মমগ্ন কবি কিভাবে এরকম বাবুশ্রেণির সদস্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে “লোকেন বোসের জর্নাল” লিখেছিলেন তা ভিন্ন আলোচনার বিষয়। যা এখানে প্রাসঙ্গিক তা হল, অবসর যাপন সম্পর্কে লোকেন বোসের দৃষ্টিভঙ্গি। ব্যস্ততা তার কাছে অবসর উপভোগ করার চেয়ে বেশি মূল্যবান। তার ব্যস্ততার বিবরণ শুনলে মনে হয় তার বাস সত্তুর বছর আগের মন্থর গতির শহর কলকাতায় নয়, একবিংশ শতাব্দীর আমেরিকা বা কানাডার কোনো বন্য গতির শহরে, যেখানে অবসরের চেয়ে ব্যস্ততার সামাজিক ম্ল্যূ বেশি, যেখানে নিজের আবেগ মূল্যায়নের জন্যও নির্দিষ্ট সময়সূচির দরকার হয়।
ভালভাবে বেঁচে থাকবার জন্য আমরা যেমন কাজ চাই, তেমনি অবসরও চাই। সুস্থ জীবনযাপনের জন্য, সামাজিক সুসম্পর্ক বজায় রাখবার জন্য, প্রেম-ভালবাসা ও দুঃখ প্রকাশের জন্য অবসরের প্রয়োজন। অবসর মানে সেই সময় যখন আমাদেরকে জীবিকা অর্জনের কাজে নিয়োজিত থাকতে হয় না। এই সময় আমাদের নিজের। এই সময় আমরা আমাদের ইচ্ছানুযায়ী ব্যয় করতে পারি। আমরা টিভি দেখে, বই পড়ে, লোকেন বোসের মত টেনিস খেলে বা ক্লাবে গিয়ে আড্ডা দিয়ে এই সময় কাটাতে পারি, অথবা কিছুই না করে শুয়ে-বসে কাটাতে পারি।
লোকেন বোসের যে ব্যস্ততার বিবরণ আমরা পাই, তা এই অবসর সময়ের ব্যস্ততা। অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীরা এই সময়ের ব্যবহার বিশ্লেষণ করতে বিশেষ আগ্রহী কারণ এই বিশ্লেষণ থেকে কারা সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে কত ভাল আছে তার একটা তুলনামূলক চিত্র পাওয়া সম্ভব। এই তথ্য নীতি-নির্ধারকদের প্রভাবিত করতে সাহায্য করে, বিশেষত সবেতনে ছুটির দিনের সংখ্যা বাড়াতে, বেতন বা মজুরি বাড়াতে, অথবা অন্যান্য ভাতা বাড়াতে। এটা ঠিক যে যারা স্বচ্ছল, যাদের রোজগার করবার জন্য দিনরাত খাটতে হয় না, তাদের এই অবসর উপভোগ করবার সুযোগ বেশি। তারা ইচ্ছে করলে লোকেন বোসের মত টেনিস খেলতে যেতে পারে, ঘরে বসে প্লেটোর আদর্শবাদ বা ফ্রয়েডের মনোবিশ্লেষণ নিয়ে মাথা ঘামাতে পারে, বা পুরোনো প্রেমের স্মৃতি রোমন্থন করতে পারে। কিন্তু আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকলেই যে মানুষ সবসময় এই অবসর উপভোগ করে তাও ঠিক নয়। সম্পদশালী দেশগুলির মধ্যে তুলনা করলে দেখা যায়, অবসর সময় যাপনের উপর সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির একটা বিপুল প্রভাব আছে। যেমন আমেরিকা বা কানাডার চেয়ে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলিতে দৈনন্দিন অবসরের প্রতি মূল্যারোপ করা হয় বেশি, যে কারণে সেখানে সাপ্তাহিক কাজের ঘন্টা তুলনামূলকভাবে কম। আমেরকান বা কানাডিয়নার যেখানে কাজ করে সপ্তাহে ৪০ ঘন্টার বেশি, পশ্চিম ইউরোপীয়রা কাজ করে ৩৮ ঘন্টার কম; ফরাসিদের ক্ষেত্রে তা আরো কম – ৩৫ ঘন্টা। কম সময় কাজ করে বলে পশ্চিম ইউরোপীয়রা আমেরিকান বা কানাডিয়ানদের তুলনায় কর্মবিমুখ নয় এবং তাদের উৎপাদনশীলতা আমেরিকান বা কানাডিয়ানদের তুলনায় কম নয়। তারা কাজের সাথে জীবনের ভারসাম্য বজায় রাখতে অধিক আগ্রহী। শুধু ভোগ নয়, জীবনকে উপভোগ্য করে তুলতে পারে যে সব কর্মকান্ড, সে সব কর্মকান্ড তাদের কাছে কাজের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সে কারণে, প্রতিদিনের কাজের শেষে তাদের অবসরের সময় আমেরিকান বা কানাডিয়ানদের চেয়ে বেশি।
সুস্থ ও সুষম জীবনযাপনের প্রতিও ইউরোপীয়রা আমেরিকান ও কানাডিয়ানদের চেয়ে অধিক যতœশীল। একজন ফরাসি বা ইতালিয়ান পান ও আহারের জন্য প্রতিদিন ব্যয় করে গড়ে দুই ঘন্টার বেশি সময়। আর অস্বাস্থ্যকর “ফাস্ট ফুড” এর সংস্কৃতিতে আসক্ত আমেরিকান বা কানাডিয়ানরা ব্যয় করে এক ঘন্টা বা তার চেয়ে কম সময়। পৃথিবীর অপরপ্রান্তে “স্লো ফুড” আহারকারি ভাতে-মাছে পুষ্ট বাঙালিরাও আমেরকিানদের থেকে পিছিয়ে নেই; তারাও আমেরিকানদের মতই ব্যস্তসমস্ত হয়ে তাদের পানাহার শেষ করে।
সবচেয়ে নিবিড় বিশ্রামের মাধ্যম হচ্ছে ঘুম। এ ক্ষেত্রেও বহু ইউরোপীয়, বিশেষেত ফরাসিরা, আমেরিকান ও কানাডিয়ানদের চেয়ে বেশি সময় বরাদ্দ করে।
আমরা কে কতক্ষণ প্রাত্যহিক অবসর ভোগ করছি তা নিয়ে সাধারণত কথা বলতে তত আগ্রহী নয় যত আগ্রহী এককালীন অবকাশ যাপন নিয়ে কথা বলতে। এককালীন অবকাশ মানে নিজের বাড়ি থেকে অন্যত্র গিয়ে, বিশেষত কোনো পর্যটন এলাকায় গিয়ে একটানা কয়েকদিন সময় কাটানো। এরকম অবকাশ যাপন ব্যয়সাপেক্ষ এবং তা বহু মধ্যবিত্ত পরিবারের সামর্থ্যের বাইরে। যারা সমর্থ তাদের অনেকে অবকাশ যাপন নয় বরং অবকাশ যাপন করবার আর্থিক সামর্থ্য জাহির করতে ব্যস্ত। স¤প্রতি সামাজিক মাধ্যম তাদের এই অরুচিকর আচরণের সুযোগ আরো বৃদ্ধি করেছে।
মানসিক ও দৈহিক স্বাস্থ্যের উপর এককালীন অবকাশ যাপনের প্রভাব প্রাত্যহিক অবসর যাপনের প্রভাবের চেয়ে বেশি নয়। প্রতিদিন শরীরচর্চা করা ও বছরে একবার শরীরচর্চা করার মধ্যে যে পার্থক্য, প্রাত্যহিক অবসর যাপন আর এককালীন অবকাশ যাপনের মধ্যেও সেই পার্থক্য। আমরা সবাই জানি যে বছরে কয়েকদিন একটানা শরীরচর্চা করার চেয়ে প্রতিদিন শরীরচর্চা করার উপকারিতা অনেক বেশি।
প্রকৃত অবসর কি সে সম্পর্কে গত শতাব্দীর ইংরেজ লেখক জি কে চেস্টারটন (১৮৭৪-১৯৩৬) এর বিশ্লেষণ বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। একশ বছর ধরে তা বিভিন্ন রকমের আলোচনা ও বিতর্কের রসদ জুগিয়ে আসছে। চেস্টারটন এর মতে অবসর আমাদের জন্য তিন ধরনের সুযোগ সৃষ্টি করেঃ কিছু করার, যা ইচ্ছে তাই করার, এবং কিছুই না করার। শেষোক্তটি, তার মতে, প্রকৃত অবসর যাপন, তবে তা দুর্লভ; দ্বিতীয়টির সদ্ব্যবহার করতে পারে শিল্পী বা সৃষ্টিশীল পেশার লোকেরা; আর প্রথমটি সবচেয়ে সুলভ। এই প্রথম ধরনের অবসর যাপনের জন্য, অবসর সময়ে একটা কিছু করতে পারার জন্য তৈরি হয়েছে জন্য বিভিন্ন ব্যবসায়িক বিনোদন কর্মকান্ড। চেস্টারটনের মতে, কাউকে যদি বাধ্য হয়ে বা সামাজিক চাপে এরকম কোনো বিনোদেনে অংশগ্রহণ করতে হয় তাহলে তা হয় এক ধরনের দাসত্বের সামিল। আমরা জানি না লোকেন বোসকে এরকম দাসত্বে বশীভূত হয়ে প্রেমের আবেগ উপেক্ষা করে টেনিস খেলে বা ক্লাবে গিয়ে অবসর কাটাতে হত কি না। যদি তাই হয়, তাহলে চেস্টারটন এর সাথে একমত হয়ে আমরা বলতে পারি, তার হাতে অবসর ছিল, কিন্তু তার অবসর যাপনের স্বাধীনতা ছিল না। এরকম পরাধীন অবসর থেকে আমরা উপকৃত হতে পারি না। আমরা অবসর চাই এবং সেই অবসর ভোগ করবার স্বাধীনতাও চাই।