হিমাদ্রী রয় : প্রদীপ জ্বলে উঠতেই সলতেকে বলে দেখ আমি জগতের আলো, সলতে বলে যতক্ষণ আমি পুড়াই নিজেকে নইলে তুমি আঁধার কালো। আলোহীন কেটে গেছে জীবনের অনেকগুলো বছর। ত্রেতায় রামচন্দ্র ফিরেছিলেন আঁধার তাড়ানিয়া উৎসবের মধ্যদিয়ে এরপর দ্বাপর গেল কলি এল, কালে কালে কত দীপাবলি চলে গেল মনের কালো ঘুচলো নারে। রয়ে গেছি সেই একই জায়গায় ঘুরে ফিরে কলি সে যে ঘোর কলিরে।
বুঝলে শশীকান্ত দিনান্তে তুমি আর আমি সেই এক পৃথিবীর ধুলায় হেঁটে চলেছি। জানি দুদিনের মেহমান তবু ব্যস্ত রই নিজেকে করিতে শুধুই গৌরব দান। হিংসার শস্য বীজ কাঁধে সহিষ্ণুতার উদার জমিন খুঁজি। আমার আমি আর কেবল আমিতে যার সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা যাপন আজকাল তিনিই লালন-রবির সুরে বেশি উচাটন আর সংসারের পরস্পর প্রীতিহীন মানুষগুলো স¤প্রীতি খোঁজে রবি-নজরুলে। অসংযত জিহ্ব বা খুবিয়ার স্বাদ খুঁজে না শুধু কমিয়ার চর্চায় ব্যাস্ত। জ্ঞানে অজ্ঞানে অসংলগ্ন বাক্যবাণে অবজ্ঞা, অবহেলা খোঁচার কাটায় বিদ্ধ কত পায়ের রক্তলেখার আলপনা দেখি প্রতিনিয়ত। সেই আলপনায় প্রদীপ জ্বালবো বলে আমি সলতে পাঁকাই। আমরা নিজের মনের অন্ধকার আড়াল করতেই আলোক প্রজ্জ্বলন করে সংসার আলোকিত করে চলেছি অথচ আমার হিয়ার ঘরে আলো ছড়াইনি “বাহির পানে চোখ রেখেছি হৃদয় পানে চাইনি”। তখন তুমি মাথা উঁচু করে দাঁড়াও রবীন্দ্রনাথ তোমার গান, গপ্প আর কবিতায় করেছি বাজিমাত, দর্শনের পথ মাড়াইনি। মাঝে মাঝে তাই আয়নার সামনে দাঁড়াই দেখি আমার নিজেকে বন্ধুদের দেখি আর বিদ্যাবুঝাই রমন রমনীকে, কিন্তু একি সবই যে মেকি। পায়ের গোঁড়ালি থেকে মাথার চুল পর্যন্ত যিনি অহংকারে চুরচুর তিনিও তার বিনয়ী হওয়ার বাণীর আচমনে শুদ্ধ করেন গৃহপালিত শিষ্যকে।
“ওঁ অজ্ঞান-তিমিরান্ধস্য জ্ঞানাঞ্জন-শলাকয়া”। অজ্ঞানের গভীরতম অন্ধকারে আমাদের জন্ম। জ্ঞানের শালকায় চোখ ফোঁটায় তেমন জ্ঞানী কই। “অন্তরে আজ দেখবো আলোক নাহিরে”। এভাবেই জন্মান্ধের মতো ঘোর অন্ধকারের সাথে বেড়ে উঠছি আমরা, আমার বেড়ে উঠার সাথে সাথে পৃথিবীর অন্ধকার আরো বেড়ে উঠেছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আড়ম্বর আপন আসন পাকাপাকি করতে কত আপনকে করেছি পর।
তবু অন্ধকার জীবনে জোনকির বুক ভরা আলোর মতো আসে দীপাবলি।দিকে দিকে মাটির প্রদীপ আলো রাশি রাশি কিন্তু মনেতে অহংকার সর্বগ্রাসী তবু উৎসবে বাঁচি, উৎসবে ভাসি।
আমাদের সকল ক্লেদ, ক্ষোভ, দুঃখ, পরিতাপের প্রদীপ জ্বেলে ধরি অসীমের পানে ‘হে প্রকাশ তুমি একবার আমার হও, আমাতে তোমার প্রকাশ পূর্ণ হউক’। আমাকে অসত্য হইতে সত্যে, অন্ধকার হইতে আলোতে লইয়া যাও।
অন্ধকার আর আলোর মিলনের ক্ষণ হলো অপাপবিদ্ধ ভোর, আমরা সেই ভোরের অপেক্ষায়। “বিহান হলো জাগোরে ভাই” শুনতে পাই সার্বজনীন সুর। যে সুর দোয়েলের, বাউলের, যে সুর ভোরের আজান, নগর কীর্তন রামপ্রসাদ আর নজরুলের। মঙ্গল শঙ্খ ধ্বনি তুলে সেই সুরে ডুব দেরে মন “কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যারে আলোর নাচন”।
হিমাদ্রী রয় : টরন্টো, কানাডা