Home কলাম অনিশ্চিত হয়ে উঠছে পৃথিবী

অনিশ্চিত হয়ে উঠছে পৃথিবী

হাসান আমজাদ খান : একটি সম্পূর্ণ অযাচিত অতিমারী থেকে সবেমাত্র স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে শুরু করেছে পৃথিবী। এর মধ্যেই অসত, দ্বাম্ভিক, অগণতান্ত্রিক, অমানবিক, ক্ষমতা লোভী, পিশাচ, অর্থগৃধনু রাষ্ট্র নায়কদের অর্বাচিনতায় গোটা বিশ্ব জুড়ে ধনী, দরিদ্র সকল দেশের অগনিত সাধারণ মানুষ আজ চরম হতাশা আর অনিশ্চয়তার মধ্যে সময় পার করছে।

নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং জার্মানী প্রাচীর অবলুপ্তির পরে সবাই ভেবেছিলেন যে দুই বৃহত পরাশক্তির কামড়াকামড়ি বোধহয় শেষ হল। কিন্তু আদপে তা কখনো হয়নি।

যুক্তরাষ্ট্রের ক‚টকৌশল সোভিয়েত পতনকে তরান্বিত করলেও তাদের নিজেদের অবিমৃষ্যকারী রাজনৈতিক এবং আন্তর্জাতিক নীতিমালার কারনে মাত্র তিন দশকের মধ্যেই তারা সারা বিশ্বে একটি হাস্যরসের দেশে পরিনত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্র নায়কদের কিত্তি-কলাপের ক্রমাবনতিই এর জন্য দায়ী। তবে দেশটির রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান সমূহের দৃঢ়তায় এবং অতি স¤প্রতি রাজনৈতিক পট পরিবর্তন এর পর নতুন আশার সঞ্চার হতে থাকে। এবং বিশ্বজুড়ে তাদের একক দাপটের পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য তারা মরিয়া হয়ে ওঠে। গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের প্রেসক্রিপশনই তারা ব্যবহার শুরু করে। বিশ্ব মোড়লের তকমা তাদের রয়েছে কিন্তু অন্যান্য দেশের বিশ্বাস অর্জন এখনো সুদূর পরাহত।

অন্যদিকে একথা শুধুই মুখরোচক আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল যে ইউনিয়ন ভেঙে যাবার ফলে রাশিয়া বিশ্বমঞ্চ থেকে অপসৃত হয়েছে। মোটেও সেরকমটা ঘটেনি। নব্য নাত্সি নেতা ভ্লাদিমির পুতিন শুধু নিজেকে আজীবন রাষ্ট্র নেতা প্রতিষ্ঠা করেই ক্ষান্ত হননি। তিনি বিরোধী সকল কন্ঠস্বরকে বিষ খাইয়ে দেশ থেকে নিষ্ক্রান্ত করেছেন, রাশিয়ার সকল আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নিজের পারবারিক লোকদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন, প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভুক্ত ছোট ছোট দেশ গুলোকে নিজের করদ রাজ্যে পরিনত করেছেন, সবশেষে ইউক্রেনে আক্রমণ করে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মানবিক বিপর্জয় ঘটিয়ে চলেছেন। দৃশ্যত এখন এমন কোন শক্তি, সংগঠন বা গোষ্ঠী নেই যে এই নব্য হিটলারকে দমন করে। অনেকটা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে যেমন বিরধীদলগুলো শুধু “চেয়ে চেয়ে দেখলাম তুমি চলে গেলে” অবস্থা।
জাতিসংঘের অধিভুক্ত দেশ এখন সম্ভবত ১৯৭টা। এত গুলো রাষ্ট্রের মধ্যে মাত্র হাতে গোনা দশ বারোটি দেশে বা ভূ-খণ্ডে জনগণ শান্তিতে আছে বলে প্রতিয়মান হয়। তবে ঐ সব দেশে জনসংখ্যা খুবই নগন্য এবং তাদের ভূমিকা বিশ্বের অন্যান্য দেশের প্রতি কোনভাবেই উল্লেখযোগ্য নয়।

তাহলে মর্মার্থ এরকম দাঁড়ায় যে ধনি, দরিদ্র, নিম্ন ধনি, মধ্য ধনি ইত্যাদি নাম করণ নিয়ে যে সব দেশ-জাতি এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি সেখানে সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার কোনো না কোনো ভাবে খর্বিত, ভোটাধিকার বিতর্কিত, আইনের শাসন মানে প্রহসন, শিক্ষা ব্যবস্থা মূল্যবোধহীন, ব্যক্তি আচরণ নির্লজজতায় পূর্ণ, রাজনৈতিক ব্যবস্থা দলীয়-ক‚পমন্ডুক-কতৃত্ববাদের দুসহ বিষ-বাস্পে নিমজ্জিত, প্রশাসনিক ব্যবস্থা মেধাহীন এবং ঔপনিবেশিক চরিত্রের, ধর্ম আজ রাজনৈতিক হাতিয়ার।

পশ্চিমা দেশগুলোতে সামাজিক আইন কানুন মানবিক এবং নিরপেক্ষ বলেই অনুন্নত দেশগুলোর স্বাবলম্বী মানুষ মাইগ্রেশানে এসব দেশে এসে কিছুটা স্বস্থির নিশ্বাস ছাড়ে। কিন্তু তারা তাদের নিজের দেশের প্রতি কোন মমতা বা আকর্ষণ বোধ করে না। যদিও দেশ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তারা সহসাই বিতর্ক শুরু করেন।

এমতাবস্থায়, ধনী রাষ্ট্র গুলো তাদের ক্ষমতা বজায় রাখার জন্য একে অন্যের প্রতি হিংসা বিদ্বেষ ছড়িয়ে একে অপরকে আক্রমণ করতেও কুন্ঠা বোধ করছে না, ফলে সেসব দেশের মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অশান্তির মধ্যে আছে। যেমন আমেরিকার মানুষ জালানি এবং খাদ্য মূল্যে এখন নাভিশ্বাস। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর হটকারিতায় সে মানুষ এখন লজ্জিত এবং ক্লান্ত, রাশিয়ার বর্তমান নাতসি বাদের উত্থানে সে দেশের সাধারন জনগণ ভীত, বিরক্ত, উদ্বিগ্ন এবং লজ্জিত; চায়নার চরম স্বার্থপর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক নীতিমালার জন্য সারা বিশ্ব তটস্থ এবং ভীত,সর্বোপরি বার বার ভাইরাস জাতীয় অসুস্থ উপাদানের জন্ম এবং বিস্তার সে দেশে হওয়ার কারনে বিশ্বজুড়ে একটা ঘৃণার জন্ম দিয়েছে।
ইউরোপের ছোট ছোট দেশগুলো তাদের স্বকীয় অস্তিত্ব বজায় রাখতে হিমসিম খাচ্ছে কারন ন্যাটো এবং রাশিয়ার স্বচ্ছাচারিতা চরম অশান্তির কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের সার্বভৌমত্ব বজায় রাখাই দুরুহ হয়ে উঠেছে।

মধ্য এশিয়া, আরব সাগরের তীরবর্তী দেশ সমূহ, ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলোতে কোথাও মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অধিকার এবং সামাজিক ন্যায় বিচার নেই, ফলে মানুষ অস্থির সময় পার করছে।

ঘনবসতি পূর্ণ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে মানুষের অশান্তি চরমে পৌঁছেছে। বৃহত দেশ ভারতে একটি চরম মৌলবাদী দল বার বার ক্ষমতায় আসায় দেশটির গণতন্ত্রের ইতিহাস ভূলুণ্ঠিত, সামাজিক ন্যায়বিচার দলবাজিতে পরিনত, অবন্ধুসুলভ এবং কর্ত্বত্ববাদি ভূরাজনৈতিক নীতিমালার কারণে পাশের দেশগুলোতে সামাজিক এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজমান। যেমন বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার সবার সাথেই দাদাগিরি প্রতিষ্ঠিত করেছে।

শ্রীলঙ্কা আধুনিক যুগের প্রথম দেউলিয়া রাষ্ট্র হিসেবে নিজেকে ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছে, এখন কোন দেশই তাদের ঋন দিতে চায় না। মানুষের খাদ্য এবং চিকিতসা সেবা দেবার কোন তৌফিক নেই।
মায়ানমার সামরিক জান্তার জাতাকলে পিস্ট হছে বহুদিন ধরে, নিজের দেশের মানুষকে বাংলাদেশের মধ্যে ঠেলে পাঠিয়েছে।

বাংলাদেশের একান্ন বছর পার হলেও মানুষ হয়তো স্বাধীন হয়েছে কিন্তু ন্যায় বিচার, সামাজিক সাম্য, মূল্যবোধ, রাজনৈতিক অধিকার তথা প্রকৃত মুক্তি মানুষের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। অবিমৃষ্যকারী এক দলীয় কর্তৃত্ববাদি সরকার গুলোই এজন্য এককভাবে দায়ী।
যদিও কৃষি উন্নয়ন, তৈরি পোশাক শিল্পের রপ্তানি এবং বৈদেশিক রেমিট্যান্স এর কারণে দেশের মানুষের হাতে অগনিত টাকা, দেখে মনে হবে মানুষ চরম সুখে আছে। কিন্তু মানুষ কথা বলতে, লিখতে ভয় পায়, হত্যাকাণ্ডের বিচার তারা চায় না, ব্যংকের টাকার লোপাট হবার ঘটনা নৈমিত্তিক হয়ে গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি রাজনৈতিক দলের অংগসমূহের প্রধান হবার লালসা প্রকাশ করছে।

সুতরাং কোন দেশেই মানুষ শান্তিতে আছে বলে মনে করার কোন কারণ নেই। আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় সবাই ভাল আছে কিন্তু কেউই সুস্থ, স্বাভাবিক, শান্তি পূর্ণ জীবনে নেই।
এই আলোচনায় শুধু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ে দৃষ্টি দেয়া হয়েছে। ব্যক্তিগত এবং আচরণগত বিষয় আরও অশান্তির কারন উন্মুক্ত করতে পারে।
নোট : যে কোন মতামত এর প্রতি সম্পুর্ণ শ্রদ্ধা রইল।
হাসান আমজাদ খান
সম্পাদক, বাফেলো টাইমস।

Exit mobile version