সাইফুল আলম চৌধুরী
(কিস্তি : ০৪)
দুই. তাঁর সাহিত্য-কর্মের পুনর্পাঠ
অধ্যাপক মমতাজ উদদীন আহমদ ছিলেন হৃদয়বান মানুষ। মহত মানুষের সকল যোগ্যতা আর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য- মহানুভবতা, ভালোবাসা, অন্তরঙ্গতা, ঘনিষ্ঠতা, শ্রদ্ধাবোধ, সাহস, সহাস্যতা, বিনয়, রসবোধ, কৌতুক, বাগ্মীতা, স্নেহ বিতরণ, কাছের-পরিচিত প্রিয়জনের মৃত্যুতে যন্ত্রণাহত- অনায়াসে প্রত্যক্ষ করা গেছে তার মাঝে। দেশ মাতৃকার বৈরী সময়ে, নির্বিচারে গণহত্যায়, স্বাধীনতার পরম আকাক্সক্ষায় উত্থিত গণসমুদ্রের জোয়ারে তিনি যেমন ছিলেন সোচ্চার-উচ্চকণ্ঠ তার সহজাত স্বভাবে-বাক্যে ও কর্মে, তেমনি স্নেহ-ভালোবাসায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত কাছের-পরিচিত কিংবা প্রিয়জনদের অকাল তিরোধানে হন বেদনাহত অথবা যন্ত্রণাদগ্ধ।
তাই তো তার অনবদ্য কলমের মাধ্যমে সাবলীল-সহজ ভঙ্গিতে নির্মিত হয় ব্যতিক্রমী অন্তরঙ্গ স্মৃতি সমৃদ্ধ লেখা, যা সাহিত্যের অনুসঙ্গে পরিণত হতে প্রত্যক্ষ করা যায়।
‘হৃদয় ছুঁয়ে আছে’ :
সতের জন প্রয়াত খ্যাতনামা বাঙালিজনকে নিয়ে তার স্মারক গ্রন্থ। অনন্য মহিমায় তার শিক্ষক, প্রিয়জন, গায়ক, অভিনেতা, চলচ্চিত্র নির্মাতা, পটুয়া, শিল্পাচার্য, শহীদ জননী, নাট্য-ব্যক্তিত্ব, ভিন্ন এক মধুসূদন, সহকর্মী, সাংবাদিক, কবি প্রমুখের স্মৃতিকথা এই গ্রন্থে উপস্থাপিত হয়েছে। ‘হাল্কা হওয়ার পন্থী’ শিরোনামে দৈনিক জনকণ্ঠে আর সর্বশেষ কবি-সাংবাদিককে স্মৃতি লেখাটি দৈনি বাংলায় প্রকাশিত হয়েছিলো পূর্বে।
‘হৃদয় ছুঁয়ে আছে’ স্মারক গ্রন্থের প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয় জানুয়ারি ১৯৯৬ সালে। প্রচ্ছদ : কাইয়ুম চৌধুরী, প্রকাশক : কাশবন প্রকাশন। প্রথম সংস্করণে বারো জন এবং দ্বিতীয় সংস্করণে আরো পাঁচজন, সর্বমোট সতেরজন নিজ নিজ বৃত্তে এবং বৃত্তের বাইরে প্রয়াত উজ্জ্বল নক্ষত্রদের নিয়ে গ্রন্থখানি সমৃদ্ধ।
এক. অজিত কুমার গুহ-
তার ছাত্র জীবনের শিক্ষক। মমতাজ স্যার অধ্যাপক অজিত গুহের কাছে সাহিত্যের ক্লাসে বঙ্কিম চন্দ্র পড়েছেন। তার পূর্ব সময় হতে জানা, বঙ্কিমচন্দ্র রক্ষণশীল হিন্দু আর ঘোরতর মুসলমান বিদ্বেষী। কিন্তু শিক্ষকের নিকট থেকে অন্য সংবাদ আবিস্কার করেন : “… অজিত স্যার বঙ্কিমের সেই সীমাবদ্ধতাকে খন্ডন করে বঙ্কিমকে উদার ঘোষণা করতেন না। কিন্তু বঙ্কিমের যা কিছু আধুনিকতা, যুক্তিবাদিতা ও ঐশ্বর্যময়তা তাকে অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে দিতেন। … … অজিত স্যার বলেছিলেন, সাহিত্য পাঠের জন্য হৃদয়কে উন্মুক্ত রেখ। মানুষের পরিচয় সন্ধান করো তার সমগ্রতা নিয়ে। রক্ষণশীল দুর্গের মধ্যে বন্দী করে মানুষকে চি?িহ্নত করতে যেও না, তাতে গোটা মানুষ উঠে আসবে না।
অজিত স্যারের সে কথা আজও আমার কাছে দীপ্র হয়ে আছে। আমার সামান্য যোগ্যতা নিয়ে যখনই নাটক বা গল্প কথার নায়ক-নায়িকার সন্ধান করেছি তখন কোনো সা¤প্রদায়িক ক্ষুদ্রতা আমাকে বশীভ‚ত করতে পারেনি। …
আমাকে সংশয় ও উদ্বেগের হাত থেকে রক্ষা করলেন অজিত গুহ। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধ যে কদর্য এক নায়কের ষড়যন্ত্র ও ছলনামাত্র, সেকথা বুঝেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। যে কারণে তিনি সে যুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে একবারও মুখ খোলেননি। তেমনি অজিত গুহ সে সময় চট্টগ্রামের একটি সেমিনারে প্রদীপ্ত কন্ঠে বলেছিলেন, যে কোনো যুদ্ধকে আমি ঘৃণা করি। আর সে যুদ্ধ যদি এক নায়ককে রক্ষার ছল হয়ে থাকে তবে তাকে সহস্রবার ধিক্কার দিই। …
আর সেদিনই সন্ধ্যায় হঠাত করে বলেছিলাম, স্যার আমার জন্য পদাবলী, মঙ্গলগীত বা কবি গানের কী এমন প্রয়োজন? আমার জীবন ধর্মে তো এসবের স্থান হারিয়ে গেছে। … বিষন্ন ও তী² কণ্ঠে বললেন, এ তুমি কী বললে মমতাজ! এতো আমি তোমার কাছে কখনই প্রত্যাশা করিনি। ওহে এ দেশের প্রতিটি ধুলিকণাই আমাদের সম্পদ। সবই তো আমার। এখানকার মসজিদ, মন্দির, লালন, হামজা, আলাওল, ভারতচন্দ্র- সবইতো আমার সম্পদ। কাউকে ছাড়তে পার না তুমি। তোমার সম্পদে তুমি এশ্বর্যময় থাকবে, সেখানে তোমার কৃপণ হবার কী দরকার! তোমার সৃষ্টিকর্মে যখন যা দরকার তারই সন্ধান করবে। তোমার ঐতিহ্য, বর্তমান ও ভবিষ্যতের কাছে। তোমাকে বিসর্জন দিয়ে তোমাকে রচনা করতে বসবে তুমি কোন অহংকারে! মুক্ত হও, অন্ধত্বের গৃহ থেকে বের হও তুমি।
সেদিন সন্ধ্যায় অজিত স্যারের সেই অঙ্গীকারাবদ্ধ কথা শুনে আমার হৃদয়ের বন্দীদশা উন্মুক্ত হলো। আমার কাছে বাংলাদেশ, বাঙালি এবং এ দেশের সহস্র নদীর সংগীত আলোকিত হয়ে উঠল। আমি বেঁচে গেলাম।”
পাদটীকা : অজিত কুমার গুহ অধ্যাপক বাংলা ভাষা ও সাহিত্য। জগন্নাথ কলেজের বাংলা বিভাগ প্রধান ছিলেন। পঞ্চাশ দশকের শেষ দিকে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত ড্রামা সার্কেলের প্রথম সভাপতি। ‘মেঘদূত’ ও ‘কৃষ্ণকাে র উইল’ সম্পাদনা করেছেন। জন্ম : ১৯১৪, মৃত্যু : ‘১৯৬৯।
দুই. আবিদ হোসেন-
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের সাধারণ সম্পাদক ১৯৫৭ সালে। মমতাজ স্যারের খুব কাছের অত্যন্ত প্রিয়জন। অনর্গল চমৎকার উচ্চারণে, শব্দ ও বাক্যের বিশেষ বাঁধনে বাংলা এবং ইংরেজি ভাষায় কথা বলতেন, বক্তৃতা করতেন, নাটকে অভিনয় করতেন। অধ্যাপক মমতাজ উদদীনের বয়ানে তার সম্পর্কে জানা যায় : … “মাওলানা ভাসানী যে সম্মেলনে পশ্চিম পাকিস্তানকে আসসালামু ওয়ালায়কুম জানিয়েছিলেন, সেই সম্মেলন থেকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এলেন হেলিকপ্টারে। … মুসলিম হলের মাঠে প্রধানমন্ত্রী পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে বক্তৃতা করবেন। … ছাত্রদের পক্ষ থেকে আবিদ হোসেন প্রধানমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানিয়ে মঞ্চে নিয়ে এলেন। স্বাগত ভাষণ দিলেন আবিদ হোসেন ইংরেজিতে। অপূর্ব সে বক্তৃতা। … ছাত্র শিক্ষখ সকলেই নীরব মনোযোগ দিয়ে তার সেই বক্তৃতা শুনেছি।
… আমি জানি, আবিদ হোসেন কোনো কিছুতে লুকোচুরি করতেন না। এক ধরনের সরাসরি ধারালো বক্তব্য রাখতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আগের জায়গাতে, এখন যেটা মেডিকেল কলেজ, সেখানে আমতলা বেলতলাতে বহু রাজনৈতিক সভায় তাৎক্ষণিক বক্তৃতা করেছেন আবিদ হোসেন।
… আবিদ ভাই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে অনেক ক’টা নাটকে অভিনয় করেছেন। কবয়, মানচিত্র, কেউ কিছু বলতে পারে না, আজকাল ইত্যাদি নাটকে আমি তার প্রাণবন্তু অভিনয় দেখেছি। কবয় নাটকে আধুনিক কবির ভ‚মিকায় আবিদ হোসেনের অভিনয় তুলনাহীন। মানচিত্র নাটকে উদ্ধত ছেলে, দুবির্নীত সন্তান- সবটাতে চমৎকার অভিনয় করেছেন। রবীন্দ্রনাথের বিসর্জন নাটকে জয়সিংহ চরিত্রে তার অভিনয় এখনো আমার সুখ স্মৃতি হয়ে আছে।
… আবিদ হোসেনের বরাবর সব কিছুতে তাড়াহুড়ো। রয়ে সয়ে কথা বলতে পারতেন না। মঞ্চে অভিনয় করতেন, কিন্তু ধীর লয়ে কথা বলার চরিত্র নিতেন না কখনোই। একবার নিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী নাটকে বিশু পাগলের চরিত্র সেটি। … বিশু পাগল খুব শক্ত চরিত্র। তাতে তার মুখে কথায় কথায় গানও আছে। আবিদ ভাই পাকা অভিনেতা। মঞ্চে যখন থাকেন সব কিছু ছাপিয়ে একাই আলো করে রাখেন। কার্জন হলের দর্শকের ক্ষমতা নেই আবিদ হোসেনকে ছাড়িয়ে মমতাজ উদদীনকে দেখে।
ফেব্রæয়ারিতে কার্জন হলে কবর নাটক অভিনীত হবে। মুর্দা ফকির হবেন নুরু ভাই। শাখাওয়াত ভাই হবেন ইন্সপেক্টর আর নেতা হবেন আবিদ ভাই। … নাটক শুরু হতে এক ঘণ্টা দেরি। … ছাত্র শক্তির দু’জন খুবই পরিচিত চেহারার ছাত্রনেতা গ্রীন রুমে হই চই লাগিয়ে দিল। তাদের দাবি হল, কবর নাটক অভিনীত হোক, কিন্তু নেতাকে শেরওয়ানি ও টুপি পরতে দেয়া হবে না। তাতে তমদ্দুন, তাহজীব ও ইসলামী তরিকার ওপর আঘাত আসবে। পাকিস্তানে এমন ইসলাম বিরোধী কাজ করা চলবে না।
… আবিদ হোসেন ধীর স্থির ছিলেন। বললেন, নাটক হবে। কোট প্যান্ট পরেই নেতাগিরী করব। তাতেও তো নেতার মুখে থুথু দেয়া যাবে। নেতাকে ঠিক বানিয়ে দেব আজ। সাহেবি পোশাকে আবিদ হোসেন নেতা হয়ে মঞ্চে উঠলেন। প্রাণ ভরে নেতার ভয়ভীতি, শয়তানীকে পরিহাস করে ছাড়লেন। দর্শকরা কয়েকবার উত্তেজিত হয়ে দু’একটা গালাগালও দিয়ে দিল নেতাকে।
… আবিদ ভাই চীনে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে দেশে ফেরেননি। একেবারে বিলেত। সেখানেই ছিলেন। বার বছর পর এসেছিলেন ঢাকাতে। … সারারাত ধরে আবিদ হোসেনকে টেলিভিশনে দেখলাম। সপ্রতিভ উপস্থাপকের যোগ্যতা নিয়ে আবিদ হোসেন নির্বাচনের ফলাফল ক্ষিপ্রতার সঙ্গে জানিয়ে যাচ্ছেন। সত্তর সালের অবিস্মরণীয় নির্বাচন সেটি। পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কী হবে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা কখন কেমনভাবে উজ্জ্বল হবে, সে নির্বাচনের মাধ্যমে সব কিছু স্থির হয়ে আসছিল।
… সে নির্বাচনের ফলাফলই টেলিভিশনে প্রচার করা হচ্ছে। আবিদ হোসেন অন্যতম প্রধান বাংলা উপস্থাপক হিসেবে সে ফলাফল বাংলাদেশের মনুষকে জানিয়ে দিচ্ছিলেন। আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের সংবাদ বার বার উচ্চারণ করছিলেন বিবিসি’র সংবাদ পাঠক আবিদ হোসেন। তার কণ্ঠে উজ্জ্বল আনন্দ ও সৌরভ গোপন ছিল না।
… পরের দিন আমার সঙ্গে দেখা। মতিঝিল এলাকায়। আবিদ ভাই ছুটে যাচ্ছেন টেলিভিশনের উদ্দেশ্যে। আমার সঙ্গে এক মিনিট কথা, কাল দেখা হবে প্রেসক্লাবে। নিশ্চয় থেকো, অনেক কথা আছে।
… বিবিসির বাংলা সংবাদ পাঠক, তুখোড় অভিনেতা, চমৎকার বক্তা, চিরকুমার (রমণী বিষয়ে তার মনে কোথায় যেন একটা দারুণ ক্ষত ছিল) আর খুব ভাল মনের একজন আহত মানুষ আবিদ হোসেন সর্বশেষ ফিরে এলেন ঢাকায়। তার নীরব শরীর ঘিরে আমরা দাঁড়ালাম। ঘুমিয়ে গেছেন তিনি। ঘুমিয়ে আছেন তিনি। বাংলার মাটিতে, প্রিয় জন্মভ‚মিতে শুয়ে আছেন আবিদ হোসেন।
… এখন যতবার প্রেসক্লাবের সামনে যাই, মনে হয় আদিব ভাই আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। আবিদ ভাই কী প্রসঙ্গে আমার সঙ্গে জরুরি কথা বলবেন? নাটক, প্রেম, দেশ? নাকি কিছুই না। কেবল ছোট ভাই বলে হো হো করে হাসবেন। স্নেহ আর মমতা সেই হাসি।
বুক ভরা দুঃখ না থাকলে অমনভাবে হাসা যায় না।”
পাদটীকা : আবিদ হোসেন- বিবিসির সংবাদ পাঠক, মঞ্চাভিনেতা, বেতার ও নাট্যশিল্পী। জন্ম : ১৯৩৪, মৃত্যু : ১৯৭৩।
তিন. আবদুল আলীম-
‘প্রেমের মরা জলে ডুবে না’সহ হাজারো লোকগীতি, পল্লীগীতি আর মরমিয়া গানে বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ এবং পরিপূর্ণ করেছেন যিনি, তিনি হলেন মুর্শিদাবাদের কাদি মহকুমার সন্তান আবদুল আলীম, ভারতবর্ষ বিভক্ত হলে অল্প বয়সেই পূর্ব বাংলায় স্থানান্তরিত হয়ে বসতি স্থাপন করেন।
মমতাজ স্যার তার স্মারক গ্রন্থে লেখেন : “… এমন সহজ প্রকৃতিজাত শিল্পী প্রতিদিন জনম নেয় না। কোনো জনপদ হয়তা একশ’ বছরে এ রকম একজন কণ্ঠের সুধার সাথে মিলিত হয়। তার কণ্ঠের অমৃত বিস্তার শ্রবণ করে সেই জনপদ। সে গায়ক অতি সাধারণ একজন মানুষও হতে পারেন। সে গায়ক আকাশের নিচে, উদার মাঠে অথবা বণ প্রান্তরে সুরের সন্ধান পেয়ে যেতে পারেন। গাছের ডালে বসে তিনি পাখিদের কাছে অবিনশ্বর সুরের জাদুও জেনে নিতে পারেন।
নদীর নির্জন কুলে বসে তিনি নদীর সঙ্গীতকেই আহরণ করে নেন। অথবা স্বভাব ধর্মের আকর্ষণে ছুটে যান প্রকৃতির উদার মহিমার কাছে। প্রকৃতিও তার কাছে অবারিত হয়ে উন্মোচিত হয়। দু’জনের মধ্যে মিতালী হয়, বন্ধুত্ব হয়। প্রাণের সখা হয়ে যায় একে অপরের।
… আবদুল আলীমকে চোখে দেখে আমি কখনই বিমোহিত হইনি। ঈশ্বর তাকে উজ্জ্বল দেহ এবং রঙ দিয়ে তৈরি করেননি। গোলগাল মানুষটি। ভাসানো দুটি চোখ, পেছনে টানা ঘনকালো চুল। মিশমিশে কালো অন্ধকার তার ত্বকের রঙ। মোটেও মন কাড়ানিয়া দেহ ও শরীরের অধিকারী ছিলেন না আবদুল আলীম। মন মাতানোর মতো কথাও আবদুল আলীম বলতেন া। … সাধারণ একজন মানুষ। সাধারণভাবে জীবন যাপনের সীমাবদ্ধ আয়োজনে নিমগ্ন ছিলেন। সেখানেই তিনি সুখের সন্ধান করতেন। যেমন জানতেন না কত বড় গায়ক তিনি, তেমনি তার সন্তান সন্তুতি বড় মাপের গায়ক গায়িকা হোক, সে রকম কোনো আয়োজন তিনি করেননি। পুত্র কন্যাকে সঙ্গীতের ভ‚বনে আনার কোনো উদ্যোগ নেননি আবদুল আলীম।
… আবদুল আলীম নিরীহ নির্বিরোধ মানুষ। তথাকথিত জ্ঞানীর মতো সব বিষয়ে মতামত দেয়ার উৎসাহ ছিল না। খোসামত করে কণ্ঠের সঙ্গীতকে পণ্য করতে চাননি। হয়তো এ কারণেই কুটিল ব্যবহার হাতে পড়ে আবদুল আলীম উপযুক্ত মর্যাদার সন্ধান পাননি। অভিমানে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন, বাইরে তা প্রকাশ করেননি।
… আমি আলীমের কণ্ঠের শক্তি যত না বুঝেছিলাম, তার চেয়ে অনেক বেশি বুঝেছিলেন বিদেশীরা।
ঊনিশ শ’ সাতান্ন সাল। চীন দেশের প্রথম সাংস্কৃতিক দল এসেছে বাংলাদেশে। তখনকার পূর্ব বাংলায়। ঢাকা স্টেডিয়ামে বিরাট মঞ্চে তাদের অনুষ্ঠান। … চীনা শিল্পীদের সম্মানার্থে একটি অভ্যর্থনা অনুষ্ঠান। … পূর্ব বাংলার বিশিষ্ট শিল্পীরা এসেছেন। অনিবার্যভাবে এসেছেন আবদুল আলীম। … আলীম যখন কণ্ঠ মেলে উদার আকাশ ও ভ‚বনের গান ধরলেন টিচার্স ট্রেনিং কলেজের মঞ্চে। … তার কণ্ঠের জাদু আর উদার বিস্তার ছড়িয়ে পড়ল প্রেক্ষাগৃত জুড়ে। নীরব মুগ্ধতা নিয়ে চীনারা শুনছে আলীমের কণ্ঠের গান। পর পর দুটি গান গাইলেন।
… অবিরাম করতালি চলছে। পর্দা উঠল, আলীমকে দেখা মাত্র সেই করতালি আরো প্রবল হল। … আলীমের কণ্ঠে এবার আরো চারটি গান হলো। চীনারা উঠে এল মঞ্চে। আলীমকে নেড়ে চেড়ে দেখছে, এটি কি মানুষ না কোনো পুতুল। এ কি বিস্ময়, এই জমাট কালো পুতুলের কণ্ঠ দিয়ে এমন সুধা ঝরে যায়।
… আলীম জন্ডিসে আক্রান্ত হলেন। পীর সাহেবের পানি আর দোয়া তাবিজের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। মাসাধিক কাল চলে গেল। পীরের পানি পরিতান দিতে পারল না। আলীম পিজি হাসপাতালে এলেন আরোগ্যের জন্যে।
… দ্রুত এগিয়ে চলেছেন পরিণতির দিকে। তার দেহ অবসন্ন হয়ে চলেছে। ডাক্তার বললেন, আবদুল আলীম বাঁচার জন্য এখানে আসেননি। মৃত্যুর জন্যই তিনি লড়াই করছেন। … মাত্র তেতাল্লিশ বছর বয়সে চলে গেলেন আলীম।
পাদটীকা : আবদুল আলীম কণ্ঠশিল্পী। জন্ম : ১৯৩১, মৃত্যু : ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪। (অসমাপ্ত/ চলবে)
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, গবেষক ও কলামিস্ট। sakil19@hotmail.com