নাদিরা তাবাসসুম : শীতের কাঁপন শুরু হয়েছে। গাছের পাতারা বাতাসের জোরের সাথে তাল মিলিয়ে মর্মরিয়ে ঝরতে শুরু করেছে শোঁ শোঁ আওয়াজে। আহারে পাতাদের ঝরে যাওয়ার সাথে বুকের ভেতরে কান্নার এ কেমন মিল- যেন হৃদয় হতে উৎসারিত কষ্ট চোখের পানি হয়ে উথলে পড়ে। কি স্বপ্ন ছিল স্বামীর প্রেম-ভালোবাসাপূর্ণ শান্তিময় একটা সুখের সংসার; অথচ কি ঘটলো, কি জীবন কাটাতে হচ্ছে। রাশিদা আর যেন সইতে পারছে না। এত ভোরে বাচ্চাটা উঠেই ‘মা’ ‘মা’ ডাক শুরু করে, সংগে সংগে জেগে না উঠলে জোরে কান্না আর চুল ধরে হাত ধরে টানাটানি। প্রতিদিন এরকম চোখে ঘুম লেগেই থাকে, ঘুম ভাংতে চায়না অথচ ছেলেটার কান্না টানাটানিতে ঘুম থেকে উঠে পরতে হয় সেই ভোরে। আজ রাগ করে তাই ছেলেকে মেরেই বসেছে। এতে কান্না আরও বেড়েছে। সলিম দিব্যি অঘোরে ঘুমাচ্ছে ডাকলে বলবে ‘সারাদিন বাইরে কাজ করি, তোমার মতো ঘরে থাকি না, তুমি ঘরে থাকো তুমি বাচ্চা সামলাও, এটা তোমার কাজ’। সুতরাং সলিমকে ডেকে লাভ নেই। মেয়ে হয়ে জন্মেছি, ঘরের সমস্ত কাজ সামলাচ্ছি তারপরেও ছেলেমেয়ে একাই আমাকে সামলাতে হবে। সলিমের ব্যবহার মাঝে মাঝে ভালো তো বেশির ভাগ সময়েই শত্রæর মতো আচরণ। এই কি নিয়তি! মাঝখানে বাচ্চা ছেলেটা মার খেলো। নাহ রাগের মাথায় ছেলেটাকে মারা ঠিক হয়নি। মনে খুব আফসোস হচ্ছে এখন ছেলেটাকে মারার জন্য। বাবা-মায়ের সংসারে মাকে কষ্ট করতে দেখেছে ছেলেমেয়েকে নিয়ে। বাবা ভীষণ রাগী মানুষ ছিলেন। নিজের ব্যবসা নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকতেন আর কোন কিছুর খেয়ালই রাখতেন না। মা সংসারের খুঁটিনাটি সবদিক সামলাতেন। তিনি পরিবারের জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন অথচ সেই মাকে মৃত্যুর সময় শেষ দেখাটাও দেখতে যাওয়া হলো না কারণ স্বামী বারণ করেছে।

নিজের মেয়ে এত কান্না দেখে বলেছে ‘মা আমি কখনই বিয়ে করবো না কারণ তোমার মৃত্যুর সময় আমি তোমাকে দেখতে যেতে পারবো না’। মেয়ে হয়ে জন্মানোর জন্য নিজের উপরেই ঘৃণা হয় রাশিদার। ছেলেকে উঠিয়ে খাবার দিয়েছে আর ভাবছে কত কথা।
বিদেশে কার কাছে দুঃখের কথা বলবে, কারো কাছে বলতে পারলে হয়তো বুকের ভেতরের যন্ত্রণাটা কিছুটা হালকা করা যেত। সেদিন পাশের বাসার ভাবি বলেছিল যে, মহিলাদের একটা সংগঠন আছে যেখানে মনের সব কথা খুলে বলা যায়। তারা সবকিছু শুনে পরামর্শ দেয় কিভাবে সমাজে-সংসারে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া যায়। রাশিদা ভাবছে সেখানে যাবে স্বামীর অজান্তে।

ঘণ্টা খানেক পর সলিম ঘুম থেকে উঠেছে, রাশিদাকে বকাঝকা ‘কতবার বলেছি তারপরেও তোমার কানে কথা ঢোকে না। যখন ছেলে কাঁদে তখন সংগে সংগে কোলে তুলে কান্না থামাবে। তা কখনই করো না বরং জোরে জোরে কান্না করাও ইচ্ছা করে যাতে আমার ঘুমটা তাড়াতাড়ি ভাংগে তাই না? সারাদিন কত পরিশ্রম করে ঘরে ফিরি, একটু শান্তিতে ঘুমাতে দাও না। তুমি সারাদিন ঘরে থাকো তাই বুঝো না আমার কষ্ট’।

‘তুমি মনে করো আমি ঘরে বসে থাকি তাই না? তাহলে ঘর বাড়ি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, রান্না-বান্না, ছেলে-মেয়েকে স্কুলে আনা-নেওয়া ইত্যাদি কাজ কে করে- এ গুলি কোন কাজ নয়? -কি বলতে চাও তুমি’!

‘ এগুলি তো সহজ কাজ, ঘরে বসেই করো। আমি বাইরে যে কাজ করি সেগুলি কঠিন কাজ’।
‘বুঝেছি তুমি কখনই আমার কাজের মূল্য দাও না, তুমি যদি একদিন আমার এই ঘরের কাজগুলিই করতে তাহলে বুঝতে পারতে আমি ঘরে কত পরিশ্রম করে বাচ্চা-কাচ্চা সামলাই। তুমি ঘরে ফিরে শুধু খাও আর ঘুমাও। আমাকে কাজে সহযোগীতা করার সময় পাওনা অথচ সময় পাও ঠিকই দেশে নিজের বাবা-মা, ভাই-বোনের সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলতে, তাদেরকে নিয়মিত টাকা পাঠাতে, ভালমন্দ খোঁজখবর নিতে। আমি তোমার স্ত্রী আমার কি হক নাই তোমার টাকাপয়সার উপর? আমার কি হক নাই তোমার ভালোবাসা পাবার। আমার ব্যাংক ব্যালেন্স টাকাপয়সা সবই তুমি জানো আর ব্যবহার করো, কিন্তু তোমার ব্যাংক ব্যালেন্স টাকাপয়সা কিছুই আমি দেখবো না জানবো না- এটা কি অন্যায় নয়? তোমার বাবা-মায়ের শিখানো কথায় তুমি স্ত্রীকে শাসন করে যাবে যেমন- ‘স্ত্রীকে বাইরে কাজ করতে দিবি না’, ‘বেতনের টাকা হাতে দিবি না’- ‘এতে স্ত্রী মাথায় উঠে যাবে’, ‘তোকে মানবে না’, ‘তুই বাইরে কাজ করিস, সংসারের কাজ-কর্ম, ছেলে-মেয়ে দেখা-শুনার জন্য তোর স্ত্রী আছে’ ইত্যাদি ইত্যাদি।

‘বুঝেছি আজ আর নাস্তা এই ঘরে খাওয়া সম্ভব হবে না’। কাজে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে তাড়াতাড়ি বাসা থেকে বেড়িয়ে পড়ে সলিম। আজ বাসের জন্য অপেক্ষা করতে হবে অনেকক্ষণ কারণ বাস আসার সময়ের চেয়ে অনেক আগে চলে এসেছে রাগ করে। ভাবছে পাশের হোটেল থেকে কিছু নাস্তা করবে। হোটেলে ঢুকে টেবিলে বসে নাস্তা করছে এমন সময় দেখে কানাডিয়ান এক ভদ্রলোক একটি ছোট্ট বাচ্চাকে কোলে নিয়ে ঢুকছে আর স্ত্রীকে বলছে ‘হানি ইউ গো ফার্স্ট এন্ড অর্ডার হোয়াট এভার ইউ ওয়ান্ট টু ইট প্লীজ’। আর স্ত্রী বলছে ‘ওকে হানি, থ্যাংকস’। সলিম আশ্চর্য হয়ে যায় ওই ভদ্রলোকের জায়গায় সলিম হলে কী করতো ওর স্ত্রীর সাথে। স্ত্রীকে ধমক দিয়ে বলতো ‘যাও যাও তাড়াতাড়ি ঢুকে টেবিলে বসো। ভালো করে কথাটা পর্যন্ত যেন বলতে নেই। বাপ-দাদা যেভাবে স্ত্রীকে শাসন করতো সেভাবে শাসন না করলে স্ত্রী মাথায় উঠে যাবে। কই এদের স্ত্রীরা তো মাথায় উঠে না। বরং ভালো ব্যবহার ও সুন্দর কথার মধ্যে সম্পর্কটা মধুর হয় এবং পরিবারে শান্তি বজায় থাকে। কানাডায় তো মা-বাবা, ভাই-বোন কেউ নেই তারপরও স্ত্রীর সাথে খারাপ ব্যবহার আর রাগারাগি করে সংসারে অশান্তিই শুধু বাড়ে। কাজে-কর্মে উৎসাহ থাকে না, মানুষের সাথে কথা-বার্তা সহজভাবে বলা যায় না। সারাক্ষণ কি একটা টেনশন লেগে থাকে। একটি পরিবারে স্বামী-স্ত্রী, ছেলেমেয়ে নিয়ে এক ছাদের নীচে যদি শান্তিতে বসবাস করতে না পারি তাহলে বিশ্বজগতের কত বর্ণ-গোত্রের মানুষ আমরা বিভিন্ন দেশের এই পৃথিবীতে একটা আকাশের নীচে কিভাবে বসবাস করবো? কানাডায় কত দেশের কত মানুষ আমরা বসবাস করছি একসাথে। মানুষে মানুষে একে অপরের প্রতি প্রেম ভালোবাসা দিয়ে বন্ধুত্বমূলক সহাবস্থান করতে পারলেই যেমন এক আকাশের নীচে একমাত্র পৃথিবীর মানুষগুলোর সাথে শান্তিতে সহাবস্থান করা সম্ভব হয় তেমনই এক ছাদের নীচে স্বামী-স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, মা-বাবা, ভাইবোন সকলে মিলে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য প্রয়োজন প্রেম-ভালোবাসাময় সহানুভূতিসম্পন্ন মন মানষিকতার। আর এ ধরনের মন মানষিকতা আমাদের পারিবারিক, সামাজিক, পারিপার্শ্বিক অবস্থান এবং অর্জিত শিক্ষা-দীক্ষার প্রভাব দ্বারা গঠিত হয়।

সলিমের বন্ধু মোর্শেদ পত্রিকায় একটি আর্টিকেল থেকে সেদিন সলিমকে পড়ে শুনিয়েছে। সা¤প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, বিবাহিত সুখী দম্পতি অবিবাহিত মানুষের তুলনায় স্বাস্থ্যগত ও আধ্যাত্মিক দিক থেকে বেশি সুস্থ। ভালোবাসা মানুষের শারীরিক, আত্মিক, সামাজিক এবং মানষিক স্বাস্থ্যের উন্নতি করে বলে প্রমাণিত হয়েছে। যখন দুজনের আন্তরিক ভালোবাসা দুজনে ভাগাভাগি করে তখন শরীর এক ধরনের ‘ডিহাইড্রোএপিয়ান্ড্রোস্টেরন’ (ডিএইচইএ) নামক হরমোন নির্গত করে যা চাপ কমানোর কাজ করে। ভালোবাসার বন্ধন সকল প্রকারের ‘নেগেটিভ’ শক্তিকে কমিয়ে দেয়, ভালো থাকার অনুভব ঘটে এবং উত্তেজনা ও দুশ্চিন্তা মুক্ত করে। এই ‘ডিএইচ ইএ’ হরমোন নার্ভ-এর কাজ উন্নত করতে সাহায্য করে যা স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করে। তাছাড়া ভালোবাসা ব্রেইনের এমন একটি অংশকে কার্যকরী করে যা ব্যথা-বেদনা কমায়। এজন্য জরীপে দেখা গেছে যে, সুখী দম্পতি ক্রনিক ব্যথা-বেদনায় কম ভোগেন। সুখী বিবাহিত দম্পতিদের মধ্যে ক্যান্সার অথবা অন্য যেকোন রোগের হার কম অবিবাহিত মানুষের তুলনায়। ইউনিভার্সিটি অফ আইওয়ার গবেষণায় দেখা গেছে যে, যেসব মহিলাদের ওভারিয়ান ক্যান্সার ছিল এবং বিবাহিত সম্পর্ক সন্তোষজনক ছিল তাদের অনেক বøাড সেল দ্রæত ক্যান্সারের সেলগুলোকে ধ্বংস করে দেয়। সঙ্গীর সংগে ভাবের আদান-প্রদান কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়। আর কোলেস্টেরল-এর মাত্রা কমার অর্থ হলো হার্ট সম্পর্কিত বিভিন্ন ধরনের রোগের ঝুঁকি কমায়। সুতরাং ভালোবাসার উপকারীতা অনেক যেমন- ভালোবাসা মানসিক চাপ কমায়, মানসিক স্বাস্থের উন্নয়ন ঘটায়, ব্যথা-বেদনা কমায়, ক্যান্সার প্রতিরোধক এবং হার্টের অসুখের ঝুঁকি কমায়।

পরিবার-এর ভালোবাসা আরও গুরুত্বপূর্ণ। বিখ্যাত দার্শনিক, কবি ও ঔপন্যাসিক জর্জ সান্তায়ানা বলেছেন- “দি ফ্যামিলি ইস ওয়ান অফ নেচারস মাস্টারপিসেস। আফ্রিকান প্রচলিত কথায় আছে যে, একটি শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য একটি পুরো গ্রামের প্রয়োজন হয়।
সলিম কত চেষ্টা করেছে স্ত্রী-ছেলেমেয়েকে সাথে নিয়ে ঘুরবে বেড়াবে, সুন্দর হাসিখুশিময় সংসার গড়ে তুলবে কিন্তু পুরনো অভ্যাসগুলো কেমন যেন মাথায় এসে সবকিছু ওলট পালট করে দেয়। এভাবে সংসারে অশান্তি লেগেই আছে। ছেলেমেয়েরাও সবসময় মন খারাপ করে থাকে ও কান্নাকাটি করে। সলিম চিন্তা করেছে এভাবে আর চলতে দেয়া যায় না। এখন থেকে নিজের দৃষ্টিভঙ্গী বদলাবে। প্রবাসে স্ত্রী এবং ছেলেমেয়ে ছাড়া আর আপন কে আছে? তাদের সাথে হাসিখুশী ব্যবহার করবে, মাঝে মাঝে বাইরে বেড়াতে নিয়ে যাবে। বন্ধু মোর্শেদ অত্যন্ত নম্র ভদ্র একজন মানুষ। ওর ব্যবহার আচরণ দ্বারা ঘরে বাইরে সকল মানুষ নিরাপদ থাকতে পারে। এদিক দিয়ে ওর সুখী পরিবার। ও জানে সলিমের অশান্তিময় সংসারের গল্প। তাই প্রায়ই নানাভাবে সলিমকে পরামর্শ দেয় যদি ওর কোন উপকার হয়। সেদিন হাসতে হাসতে মোর্শেদ বলে ‘বুঝলে বন্ধু, ঘর হলো সকল সুখ শান্তির কেন্দ্রবিন্দু। যে ঘরে শান্তি নাই সে ঘর নরক সমান। যারা ঘরকে পর করেছে তার চেয়ে দুর্ভাগ্যবান আর কেউ নাই’। এভাবে মোর্শেদের পরামর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সলিম নিজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর পরিকল্পনা করে। চিন্তা করে, স্ত্রী ছেলেমেয়েদের সাথে মাঝে মাঝে সময় দিবে তাদের সাথে গল্প করার, তাদের সুবিধা-অসুবিধাগুলো শোনার এবং সাধ্যমতো তাদের সাহায্য ও সহযোগিতা করার। একদিন অফিস থেকে ফিরেই রাশিদাকে ডেকে বলে ‘চলো আজ আমরা সবাই মিলে শপিং-এ যাবো। কার কি প্রয়োজন লিস্ট করে নাও। ছেলেমেয়েরা শুনে খুবই খুশী; কিন্তু রাশিদা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না। বার বার ভাবছে ‘সলিমের হঠাৎ কি হল কে জানে’। ছোট ছেলেটা ভীষণ চঞ্চল। বাইরে দোকানে গেলে যা দেখে তাই কিনতে চায়। ওকে সামলানো কঠিন হবে তাই রাশিদা যেতে আগ্রহ দেখায় না। সলিম রাশিদাকে বুঝিয়ে বলে যে সে নিজেই ওকে সামলাবে। রাশিদা প্রশ্ন করে ‘তোমার কি কোন প্রমোশন কিংবা কোন খুশীর খবর আছে নাকি? থাকলেই বা কি তুমি তো এত ভালোভাবে কখনই কথা বার্তা বলো না। কি ঘটেছে সত্যি করে বলোতো’। সলিম খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে ‘দেখো আমার স্ত্রী ছেলেমেয়েদের নিয়ে শপিং-এ যাবো, তাদের জন্য প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করবো’।
‘কিন্তু আগে এমন করে আমাদের প্রয়োজন, সুবিধা অসুবিধা, সমস্যা কোন কিছুই খেয়াল করোনি, দেখনি তাই’।

‘পূর্বে করা হয়নি কিন্তু এখন থেকে করবো’।
‘আলহামদুলিল্লাহ, সকল প্রশংসা মহান আল্লাহতায়ালার। তিনি তোমায় সুমতি দিন’।
‘হয়েছে এবার চলো আমরা যাই’।
– টরন্টো, কানাডা