শুজা রশীদ : (পর্ব ১৪)
১৯.
উকিলের ছড়াছড়িতো চারদিকে কিন্তু তার ভেতর থেকে বিশ্বস্ত কাউকে পাওয়াটা সহজ নয়। এঞঅ বাংলাদেশী বংশদ্ভুত সব উকিলকেই পিন্টু মোটামুটি চেনে, কয়েকজনকে সে বন্ধু বলেও বিবেচনা করে, কিন্তু তাদের কাউকে পারিবারিক কোন গোপনীয় তথ্য সে কখনই জানাবে না। এই শহরে সতর্ক থাকার প্রয়োজন আছে। ওদের অর্থনৈতিক অবস্থার যে কত দ্রুত অবনতি হচ্ছে এই সত্যটা কোন অবস্থাতেই কাউকে জানাতে চায় না ও। উকিল এবং মক্কেলের মাঝে বিশেষ ধরণের কনফিডেনশিয়ালিটি এগ্রিমেন্ট থাকলেও সাবধানের মার নেই। এই শহরে সব বাংলাদেশী বংশদ্ভুতদের মধ্যে মনে হয় মাত্র দুই ডিগ্রীর দূরত্ব আছে। যার অর্থ কোন গর্দভ উকিল যদি তার স্ত্রীর সাথেও কোন গোপন তথ্য ফাঁস করে সম্ভাবনা আছে সেই তথ্য সারা শহরের কোন বাংলাদেশীর জানতে বাকি থাকবে না।

খুব বেশি দিন আগের ঘটনা নয় যখন এই শহরের মানুষেরা আহমেদ পরিবার এবং তাদের ব্যাবসায়ীক সাফল্য নিয়ে মুখরোচক আলাপ করত, বিশেষ করে তাদের রেস্টুরেন্টটা সবার আলাপের বিষয় ছিল। কিন্তু সেই সুনাম বেশ কিছুদিন হল গত হয়েছে কিন্তু তারপরও মানুষ তাদের পরিবারকে যথেষ্ট সম্মানের চোখে দেখে এবং তাদেরকে ধনবান এবং যথেষ্ট ক্ষমতাশালী বলেই বিবেচনা করে বাংলাদেশে ফেলে আসা কিছু রাজনৈতিক যোগাযোগের সূত্র ধরে। মিন্টুর আত্মহত্যার পর সেই পারিবারিক শ্রদ্ধাবোধটা বোধহয় কিছুটা কমে গেছে, তাদের সম্বন্ধে নানা ধরনের গুজব ছড়িয়ে পড়েছে।

বেশ চিন্তা-ভাবনা করে পিন্টু শেষ পর্যন্ত তার স্ত্রীর বড় ভাই আবুল মিয়াকেই উকিল হিসাবে নেবার সিদ্ধান্ত নিল। তার বয়েস চল্লিশের সামান্য বেশি, প্রধানত রিয়েল স্টেটের উকিল, কিন্তু উকিলতো উকিলই।
ড্যানফোর্থ এভেনিউতে একটা দোতলা মার্কেটের উপরের তলায় ছোট একটা অফিস আছে আবুল মিয়ার। তার মক্কেলদের প্রায় সবাই বাংলাদেশী। যে কারণে বাংলা টাউনে অফিস খোলার তাগিদ অনুভব করেছিল সে। ছোট চারকোণা কামরাটাকে সুন্দর একটা ডেস্ক, কিছু গদি আঁটা চেয়ার আর আইনের বই ভর্তি খান দুই বিশাল বুক শেল্ফ দিয়ে সাজিয়েছে সে। দেয়ালে দেশ থেকে আনা কয়েকটা হাতের কারুকাজ করা বস্তু ঝুলছে। তার ডেস্কের ঠিক মাঝখানে দুইটা ছোট ছোট পতাকা রাখা, একটা কানাডার, অন্যটা বাংলাদেশের।

সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে গেছে। খুব ব্যাস্ততায় গেছে দিনটা। অফিস বন্ধ করে বাসায় ফিরবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল আবুল ঠিক সেই সময় পিন্টু এসে ঢুকল। ব্যাপারটা আশাতীত। এর আগে তার অফিসে পিন্টু আর কখন আসেনি। একটু দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল সে। লোকটাকে সে খুব একটা পছন্দ করে না। সে শুধু যে বদমেজাজী তাই নয়, মানুষের মুখের উপর অভদ্র কথাবার্তা বলে, ধমকা-ধমকি করে। কোন এক বান্ধবীর সূত্র ধরে মরিয়মের পরিচয় হয়েছিল এই বেয়াদপের সাথে। তারপর কেন যে সে একেই বিয়ে করবার জন্য এতো পাগল হয়েছিল কে জানে কিন্তু বোনের আগ্রহ উদ্দীপনা দেখে সেই বিয়েতে অমত দিতে পারেনি আবুল। ভালোর মধ্যে একটাই, এগারো বছর আগে তাদের বিয়ে হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত তেমন বড়সড় কোন সমস্যা হয়নি। পিন্টু নিজেকে অপেক্ষাকৃত ভালো স্বামী এবং বাবা হিসাবে প্রমাণিত করতে পেরেছে এবং মরিয়ম কখন সেসব নিয়ে নালিশ করে না। আবুল নিজের বোনকে খুব ভালোভাবে জানে। এই বিয়ে টিকে গেছে কারণ মরিয়ম যে কোন মূল্যের বিনিময়েই হোক এটাকে টিকিয়ে রাখতে চেয়েছে। নিজের বোনের প্রতি সেই কারণে তার অগাধ শ্রদ্ধাবোধ আছে। যে ধরনের মানুষই হোক পিন্টু, মরিয়ম নিজে তাকে বেছে নিয়েছিল, তার কষ্ট হলেও সেই মানুষটার সাথে সে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে চলছে।

পিন্টু কোন বাক্য বিনিময় না করে ধপ করে একটা চেয়ারে বসল, তারপর আবার হঠাত উঠে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এলো। বসল।
আবুল তার দিকে একটু ঝুঁকে বসে জানতে চাইল, “কোন সমস্যা হয়েছে?”
পিন্টু মাথা নাড়ল। “সমস্যা কিছু না। আপনার সাথে একটু কথা বলা দরকার।”
“বল।” আবুলের মাথার মধ্যে চিন্তার ঝড় চলে। মরিয়মকে নিয়ে কিছু নয়ত?
“আপনার সাথে আমার যে আলাপ হবে সেটা আপনি কাউকে বলতে পারবেন না,” পিন্টু থমথমে মুখে বলল। “ভাবীকে নয়, মরিয়মকে তো নয়ই।”
“কি হয়েছে বলত?” আবুল তার কন্ঠে দুশ্চিন্তার ছাপটুকু লুকাতে পারে না।
“আপনাকে সব কিছু খুলে বলার আগে আমার জানা দরকার ব্যাপারটা আপনি গোপন রাখতে পারবেন কিনা।” পিন্টু তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে।
“আমি যদি তোমার উকিল হই তাহলে এটর্নি-ক্লায়েন্ট কনফিডেনশিয়ালিটি এগ্রিমেন্ট অনুযায়ী সব কিছু আমি গোপন রাখতে বাধ্য,” আবুল ইতস্তত করে বলে।
“তাহলে আপনি এখন থেকে আমার উকিল,” পিন্টু ঘোষণা দিল। “আমাকে কি কোন কন্ট্রাক্ট সাইন করতে হবে?”

আবুল মাথা নাড়ল। “না। কি ঘটনা তাই বল। আমি কাউকে কিছু বলব না।”
পিন্টু সরাসরি প্রসঙ্গে গেল না। এটা সেটা নিয়ে কথা বলতে লাগল। মিন্টুর অকস্মাত মৃত্যু নিয়ে কিছুক্ষণ বকবক করল, তারপর এক পর্যায়ে তার ভাইয়ের মৃত্যুতে রিমার সন্দেহজনক ভূমিকার প্রসঙ্গে চলে গেল, তার অতীত ঘেটে সে কি কি বের করেছে সেগুলো একে একে জানাল, অবশেষে প্রায় মিনিট দশেক পরে সে আসল বিষয় পাড়ল। “মিন্টু ভাইয়ের একটা লাইফ ইনস্যুরেন্স পলিসি ছিল।”
লাইফ ইন্সুরেন্সের প্রসঙ্গ আসতেই সতর্ক হয়ে পড়ল আবুল। এই ব্যাপারে কাগজে ইতিমধ্যেই বেশ লেখালেখি হয়েছে। তার কিছু কিছু সে পড়েছে।
“আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস ভাইয়া কখনই শুধু রিমাকে বেনিফিসিয়ারী বানাবে না,” পিন্টু বলল। এর পর আর কিছু শুনবার প্রয়োজন আবুলের ছিল না। তার বোনের স্বামীর পরিকল্পনা সে পরিষ্কার বুঝতে পেরেছে।
“রিমা তার স্ত্রী ছিল। স্ত্রীকে একক বেনিফিসিয়ারী বানানোটাইতো স্বাভাবিক,” আবুল সাবধানে শব্দ চয়ন করে।
“একমাত্র কেন হতে হবে,” পিন্টু বিরক্তি নিয়ে বলল। “তার স্ত্রীর যদি কিছু হয় তখন বেনিফিসিয়ারী কে হবে?”
তার স্ত্রীর যদি কিছু হয়? এই পর্যায়ে আবুল মনে মনে একটু সন্ত্রস্থ হয়ে পড়ে। “তাদের বাচ্চা আছে,” সে স্মরণ করিয়ে দেয়।

“জানি!” পিন্টু প্রায় ধমকে ওঠে। “আমি যেটা বলার চেষ্টা করছি, মিন্টু ভাই ছিল আমাদের পরিবারের সদস্য। তার লাইফ ইন্সুরেন্সের টাকায় আমাদেরও সমান হক আছে, তা কাগজে কলমে যেই তার বেনিফিসিয়রী হোক না কেন। আমি জানতে চাই এই পরিস্থিতিতে কিভাবে এগুনোটা সবচেয়ে যথাযথ হবে। বুঝতে পারছেন?”
আবুলের কাছে সবকিছু স্ফটিকের মত পরিষ্কার হয়ে গেছে। পিন্টু চায় আবুল রিমাকে কোন একভাবে ভয় পাইয়ে দিয়ে মিন্টুর ইন্সুরেন্সের টাকার একটা অংশ তার পরিবারের হাতে তুলে দিতে রাজি করাক। কারণটা ঠিক মাথায় ঢুকছে না ওর। তার ধারণা ছিল পিন্টুরা অর্থনৈতিকভাবে খুবই ভালো করছে। মরিয়ম কখন এমন কিছু বলেনি যা থেকে মনে হতে পারে তারা কোন সমস্যার মধ্যে আছে। হতে পারে ভেতরে ভেতরে হয়ত সবকিছু ততখানি ভালো নয়। কিন্তু সত্য হচ্ছে, রিমার কাছ থেকে কোন টাকাপয়সা পাবার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই।
“এই ব্যাপারে আমি তেমন কিছু করতে পারব বলে মনে হয় না,” আবুল হতাশভঙ্গীতে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে। বাস্তবে এই জাতীয় কোন কিছুর সাথে নিজেকে কোনভাবেই সে জড়াতে চায় না।
পিন্টু তার দিকে রাগী চোখে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ঝুঁকে আবুলের মুখের সামনে মুখ নিয়ে এলো। “আচ্ছা, আরেকটু খোলাসা করে বলি,” সে কন্ঠস্বর নীচু করে বলল। “আমি চাই আপনি ওকে একটু ভয় পাইয়ে দেন। কিছু একটা আইনের প্যাঁচ বের করেন। কেস টেস করবেন এই জাতীয় ভয় দেখান। তাতেই হয়ত কাজ হবে। ভড়কে গিয়ে আমাদের কথামত কাজ করতে রাজি হয়ে যাবে। কি বলছি মাথায় ঢুকছে?”

লোকটার কি মাথা খারাপ? আবুল মনে মনে বলে। এতো পুরোপুরি চাঁদাবাজি! আবুলের শরীর সির সির করে উঠল। এ কি বিপদে পড়া গেল? বোনের শ্বশুরবাড়িকে সাহায্য করাটা তার কর্তব্য কিন্তু সেটা করতে গিয়ে কোন অপরাধ সে করতে পারবে না। কিন্তু মুখের উপর না বলার কোন উপায় নেই। কিভাবে এই আপদ থেকে নিস্তার পাওয়া যায়? তার মাথায় কিছু আসছে না।
“করতে পারবেন?” পিন্টু কপাল কুঁচকে ধমকে উঠল।
আবুল খাঁকারি দিয়ে গলা পরিষ্কার করল। সিদ্ধান্ত নিল এই পরিস্থিতিতে সরাসরি হ্যাঁ কিংবা না-য়ের ভেতর না গিয়ে কৌশলে কিছু একটা করা প্রয়োজন। “আচ্ছা, আগে রিমার সাথে আলাপ করি। তারপর না হয় আমরা আবার বসে কিছু একটা সিদ্ধান্ত নেব।”
পিন্টু একটু ভাবল। কাঁধ ঝাঁকাল। “ঠিক আছে। আলাপ করেন। কি হল আমাকে জানাবেন।”
সে চলে যাবার পর নিজের চেয়ারে বেশ কিছুক্ষণ নীরবে বসে থেকে আকাশ পাতাল ভাবল আবুল। মরিয়মকে কি ব্যাপারটা জানানোটা উচিত হবে? পিন্টু জানতে পারলে ভীষণ ক্ষেপে যাবে। একমাত্র মরিয়মকেই সে তার এই কুত্সিত পরিকল্পনা সম্বন্ধে কিছু জানাতে চায় না।

২০.
পেটের ব্যাথায় রাতে খুব কষ্ট পেয়েছে রিমা, ঘুম প্রায় হয়ইনি। ডাক্তারের কথা মত টেস্ট করেছে, এখন অপেক্ষা করছে ডাক্তারের অফিস থেকে টেস্ট রেজাল্ট কি হল জানার। জেনেছে কয়েক সপ্তাহ লেগে যেতে পারে। ফায়জা এবং জিব্রান স্কুলে চলে যাবার পর খান দুয়েক টাইলানল খেয়ে আবার একটু ঘুমানোর পরিকল্পনা করছিল, সেই সময় মার্সেলের ফোন এলো। একবার ভেবেছিল ধরবে না, ভয়েস মেইলে চলে যাক। কিন্তু পরক্ষণে ভাবল, হয়ত কোন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে। জানাটা দরকার।
“রিমা, সবকিছু কেমন যাচ্ছে?” মার্সেলের বন্ধুত্বপূর্ণ কন্ঠ ভেসে এলো।
“ভালোই যাচ্ছে, ডিটেকটিভ।” রিমা শারীরিক বেদনাকে চাঁপা দিয়ে কন্ঠস্বর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে। দেখা যাবে আবার এইটা নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে।

“পিন্টু কি আর কোন সমস্যা করছে?” মার্সেল কথাচ্ছলে জানতে চায়। তার কন্ঠ শুনেই রিমা বুঝতে পারে, পিন্টুর দিক থেকে আর কোন ঝুট ঝামেলা সে আশা করছে না।
“না। সপ্তাহ দুই হল ওকে দেখিনি।” রিমা ঘুম ঘুম চোখে বলে। কলটা শেষ হলেই বাঁচে। একটু ঘুমানো খুবই দরকার। কেন হঠাত ফোন করেছে কে জানে?
“চমত্কার!” মার্সেলের কন্ঠে পরিষ্কার সন্তুষ্টির ছাপ। “কোন সমস্যা হলে আমাকে ফোন দিতে দ্বিধা কর না। বাচ্চারা কেমন আছে? এতো ঝুট ঝামেলা ওরা কিভাবে সামাল দিচ্ছে?”
“ওদের সাধ্য মত চেষ্টা করছে মানিয়ে নিতে,” রিমা সংক্ষেপে বলে।
অন্য প্রান্তে সামান্য একটু নীরবতা। “মিস্টার আহমেদের মৃত্যু মিউনিসিপালিটিতে এখনও রেজিস্টার্ড হয়েছে কিনা জান?” মার্সেল জানতে চায়। “যে মসজিদ তার কবরের ব্যবস্থা করেছিল তারা সম্ভবত সব কাগজপত্র সময় মতই জমা দিয়েছিল। মিউনিসিপালিটি থেকে কিছু জানিয়েছে তোমাকে?”
রিমার ঐসব খেয়ালই ছিল না। করোনার একটা সার্টিফিকেট অব ডেথ দিয়েছে যেখানে মৃত্যুর কারণ হিসাবে লেখা আছে দূর্ঘটনা। পরবর্তি পদক্ষেপ হচ্ছে মিউনিসিপালিটিতে ডেথ রেজিস্ট্রি করা। লিয়াকত মসজিদের প্রতিনিধির সাথে বসে রেজিস্ট্রেশনের কাগজ পূরণ করে দিয়েছিল।
“আমি তো কিছু পাইনি,” রিমা বলে। হঠাত করে ডেথ রেজিস্ট্রেশন নিয়ে এই লোকের এতো মাথা ব্যাথা কেন?
“তোমার খোঁজ নেয়া উচিত,” মার্সেল বলে। “ইন্সিউরেন্সের টাকার জন্য এপ্লিকেশন করতে হলে তোমার মিউনিসিপালিটি থেকে ডেথ সার্টিফিকেট লাগবে। তোমার কোন ইন্সিউরেন্স লয়ার আছে?”

“ইন্সিউরেন্স লয়ার? আমার কি একজনকে নেয়া দরকার?” রিমা বিহ্বল হয়ে বলে। উকিল নেবার মত টাকা ওর নেই। ওদের জয়েন্ট একাউন্টে অল্প যা কিছু টাকাপয়সা ছিল সেটা মিন্টুর শেষকৃত্যেই চলে গেছে। ওর নিজস্ব একাউন্টে কিছু টাকা আছে কিন্তু সেটা যথেষ্ট হবে না।

“নিতেই হবে তা নয় কিন্তু নিলে ভালো,” মার্সেল বলে। “বিশেষ করে এই ধরণের কেসে। যদি কোন কারণে তোমার ইন্সিউরেন্স ক্লেইম সফল না হয় তাহলে অবশ্যই একজন উকিল ধর। তোমার জানাশনা কেউ না থাকলে আমাকে জানিও। আমি কয়েকজনকে চিনি।”
“নিশ্চয় জানাবো,” রিমা দূর্বলভাবে বলে। ক্লান্তিতে তার কথা বলতেই অসুবিধা হচ্ছে। মার্সেল কি বলছে ঠিক মত শুনছেও না। কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝতে ভুল হচ্ছে না যে আর্ধেক মিলিয়ন ডলার যত্সামান্য অর্থ নয়। তার এবং তার বাচ্চাদের জীবন সম্পূর্ণ পালটে দিতে পারে ঐ অর্থ।

মার্সেল সুযোগ মত একসময় তার সাথে দেখা করতে আসবে প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদায় নিল। রিমা ফোন রেখে দিয়ে বিছানায় ধ্বসে পড়ল। চোখ খুলে রাখতেই কষ্ট হচ্ছে। মার্সেল হঠাত ফোন করে ইন্সিউরেন্সের টাকা নিয়ে আলাপ করছে, ব্যাপারটা ঠিক মেলাতে পারছে না কিন্তু এই মুহূর্তে সেসব নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে হচ্ছে না। রবিন এখন ঘুমাচ্ছে। ছেলেটা ওঠার আগেই ওর একটু ঘুমিয়ে নেয়া দরকার।

২০.
খদ্দেরদের ভীড়ে দোকানটা যেন উপচে পড়ছে। কোন কোন দিন এইরকমই হয়। ছোটখাট একটা ঘুম দেবার পর ভালো বোধ করছিল রিমা। রবিনকে আরিফার এপার্টমেন্টে পৌঁছে দিয়ে কাজে এসেছে ও। ঘন্টা খানেক যেতেই মনে হল আজকের দিনটা ছুটি নিলেই ভালো হত। এতো ভীড়ভাট্টা আর হৈ চৈয়ে ওর অস্বস্তি লাগছে।

ভালোর মধ্যে একটাই আজ কালাম কাজে এসেছে। মাংসের সেকশনটাই সবচেয়ে ব্যাস্ত। শেষবার যখন ওদের কাজের সময় মিলে গিয়েছিল ওরা কাজের বিরতির সময় দুজনে মিলে সুস্বাদুতে গিয়েছিল দুধ চা আর ভাজাভুজি খেতে। কালাম ওর বাব-মা-ভাই-বোন নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করে। ওর তিন তিনটা ছোট বোন। তারা সবসময় ওকে ফোন করে জ্বালায়। এটা সেটা পাঠাতে বলে। ওর মায়ের বায়না ওকে প্রতি বছর একবার করে দেশে যেতে হবে। ওর উপর ওর বাবার অনেক আশা। তিনি ওকে ক্লাশের সেরা ছাত্র হিসাবে দেখতে চান। তার ক্লাশে একটা সুন্দরী দেশী মেয়ে আছে যাকে দেখলেই তার বুক ধড়ফড় করে। এখনও প্রেম নিবেদন করবার সাহসই হয়নি। ওর ধারণা মেয়েটা ওর দূর্বলতা সম্বন্ধে ঠিকই জানে এবং সম্ভবত আশা করছে ও অগ্রণী হয়ে একসাথে বাইরে টাইরে যেতে বলবে, কিন্তু সে কিছুতেই সাহস করে বলতে পারছে না।
“কিসের এতো ভয় তোমার?” রিমা মুচকি হেসে জানতে চেয়েছিল।

কালাম লাজুক ভঙ্গিতে হেসেছিল। “যদি না করে দেয়? খুব খারাপ লাগবে তাহলে।”
“আর যদি হ্যাঁ বলে?” কালামের মুখ লাল হয়ে যেতে দেখে রিমা খুব মজা পেয়েছিল।
“এইবার ঠিক জিজ্ঞেস করব,” কালাম ভীতু কন্ঠে বলেছিল। “আমার মনে হয় ও-ও আমাকে পছন্দ করে।”
“ভাইরে আমার, জিজ্ঞেস না করলে তো কোন দিন জানতেও পারবে না,” রিমা হাসতে হাসতে বলেছিল।
সেটা ছিল মিন্টুর মৃত্যুর আগের কথা। কালাম গিয়েছিল সামার জব করতে। ফিরে আসার পর রিমার সাথে এখনও দেখা হয়নি ওর। মিন্টুর মৃত্যুর কথা নিশ্চয় শুনেছে। এই ধরণের পরিস্থিতিতে কিভাবে রিমার মুখোমুখি হবে ভেবেই বোধহয় তাকে এড়িয়ে চলছে, ভেবেছে রিমা।
ঠিক করে রেখেছিল আজকে কাজের মাঝে যখন সব কিছু একটু থিতিয়ে আসবে তখন কালামের সাথে কথা বলতে যাবে। রিমার জন্য বেচারার এতো অপরাধী বোধ করার কিংবা দুঃখে কাতর হবার কোন কারণ নেই। তার জানা দরকার যে রিমা ভালোই আছে। কিন্তু সেই সুযোগই হল না। এতো ভীড় লেগে থাকল। কালামের কোন কারণে আগেই কাজ থেকে চলে যেতে হল। যাবার আগে এক মুহূর্তের জন্য থেমেছিল বিদায় জানাবার জন্য।
“কালাম, আমাকে ফোন দিও,” রিমা বলে।

হাসল ছেলেটা, তার দুধ সাদা দাঁতের সারি ঝিলিক দিয়ে গেল, দুই চোখে আনন্দের দ্যুতি। “দেব, আপু।”
রিমা প্রত্যুত্তরে হাসে। এই ছেলেটাকে দেখলেই মনে হয় ওর সাথে যেন তার রক্তের সম্পর্ক আছে।