শুজা রশীদ : (পর্ব ৬৪)
“ওরা ভালো আছে। ওদের তিনজনকেই উদ্ধার করা হয়েছে। সবাইকে স্কারবরো জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে চেক আপ এর জন্য।” অফিসার ওমর কথাগুলো দুই বার বলল রিমা যে বুঝেছে সেটা নিশ্চিত হবার জন্য। “ওরা সবাই এখন নিরাপদ।”
রিমা সশব্দে কেঁদে ওঠে। “আমি ওদেরকে দেখতে চাই।”
“নিশ্চয়,” অফিসার ওমর দ্রæত বলে। “এমার্জেন্সীতে চলে এসো। আমি তোমার জন্য এখানে অপেক্ষা করছি।”
রিমা ফোন রেখে দিয়ে গাড়ী স্টার্ট দিল।
“কি হয়েছে রিমা?” নোমান জানতে চায়। “আমাকে বল, প্লিজ!”
“আমার বাড়ীতে আগুন ধরেছিল। বাচ্চারা হাসপাতালে।” ওর দুই চোখ বেয়ে অশ্রæর ধারা গড়িয়ে নামে। গিয়ার পালটে ড্রাইভে দেয় রিমা। “নেমে যাও।”
“আমিও তোমার সাথে যাচ্ছি। চালাও! যদি চাও, আমিও ড্রাইভ করতে পারি।”
রিমা এক্সেলেটরে জোরে চাপ দেয়, গাড়ি লাফিয়ে সামনে এগিয়ে যায়। “আল্লাহ, আমার যা আছে সব নিয়ে নাও কিন্তু আমার বাচ্চাদের কোন ক্ষতি হতে দিও না!” চীৎকার করে কাঁদতে থাকে রিমা। “আজ এখানে আমার আসা উচিৎ হয়নি। ওদেরকে বাসায় একা রেখে আসা আমার একেবারেই উচিৎ হয়নি।”
মাঝরাতে রাস্তা প্রায় শূন্য। রিমা পাগলের মত গাড়ী চালায়, রেড সিগনাল, স্টপ সাইন তোয়াক্কা করে না। নোমান ভয়ে ভয়ে চারদিকে চোখ বোলায়, পুলিশ না থাকলেই হয়। ধরা পড়লে অকারণে বেশ খানিকটা সময় নষ্ট হবে।
৯৯
কিভাবে স্কারবরো জেনারেল হাসপাতালে পৌঁছেছে মনেও নেই রিমার। হাস্পাতালের পার্কিং লটে গাড়ী পার্ক করে এমার্জেন্সী ডিপার্টমেন্টের দিকে দৌড় দেয় ও। ওর ঠিক পেছনেই নোমান, নিশ্চিত হতে চায় পড়ে গিয়ে যেন ব্যাথা না পায়।
অফিসার ওমর জাভেদ একজন তরুণ অফিসার। তাকে দেখে মনে হল সে নিজেও বেশ ভড়কে গেছে। এমার্জেন্সী ডিপার্টমেন্টের দরজায় ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল সে। “মিসেস আহমেদ?”
“আমার বাচ্চারা কোথায়?” রিমা তাকে পাশ কাটিয়ে ঝড়ের মত এমার্জেন্সী ডিপার্টমেন্টের ভেতরে ঢোকে। ওর পিছু পিছু অফিসার ওমরও ভেতরে আসে। নোমান চেষ্টা করে তার কাছ থেকে কিছু তথ্য পেতে।
“আগুনটা কিভাবে শুরু হয়েছিল? কিছু জানো সেই ব্যাপারে?”
“এখনই ঐ ব্যাপারে কিছু সঠিক করে বলা কঠিন,” অফিসার ওমর মাথা নেড়ে বলল। “আমরা এই ব্যাপারে তদন্ত করব। হতে পারে কোন ইলেক্ট্রিক সার্কিট শর্ট হয়েছিল। পুরানো বাড়ী। ভাগ্য ভালো যে বড় মেয়েটা বুদ্ধি করে পুলিশে ফোন দিয়ে দুই ভাইকে নিয়ে বাসার বাইরে চলে গিয়েছিল। নাহলে মারাত্বক কিছু হয়ে যেতে পারত।”
রিমা ফ্রন্ট ডেস্কে ছুটে গিয়ে নার্সকে মিনতি করল ওকে ওর বাচ্চাদের কাছে নিয়ে যাবার জন্য। নার্স অফিসার ওমরকে লক্ষ্য করল। বুঝল রিমা কোন বাচ্চাদের কথা বলছে। সে রিমাকে তার পিছু পিছু আসতে ইংগিত করল। “আমার সাথে এসো।”
নোমান অফিসার ওমরের সাথে থেকে গেল। নার্স রিমাকে ছোট একটা কামরায় নিয়ে এলো যেখানে ফায়জা এবং জিব্রানকে রাখা হয়েছে। ওকে দেখে দু’ জনাই লাফিয়ে ওর কাছে চলে এলো। রিমা দুই জনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হু হু কেঁদে উঠল।
তারপর ওর খেয়াল হল রবিন সেখানে নেই।
“রব কোথায়? ফায়জা, রব কই?”
“ও ওঈট তে,” নার্স কোমল গলায় বলল। “এরা দুই জন ঠিক আছে। এদেরকে রেখেছি অব্জারভেশনের জন্য। ছোট ছেলেটার স্মোক ইনহাইলেশন হয়েছে। সে খুব সম্ভবত একিউট রেস্পাইরেটরি ডিস্ট্রেস সিনড্রোমে ভুগছে।”
“না!” রিমা দুই হাত মাথা চেপে ধরে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়।
“আমাকে মাফ করে দিও মা!” ফায়জা কাঁদতে কাঁদতে বলে। “আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তারপর হঠাৎ কিছু একটা শব্দ শুনি। মনে হল ফায়ার এলার্ম। তারপর কিছু একটা পোড়ার উৎকট গন্ধ পেলাম। ভালো করে বুঝে ওঠার আগেই চারদিকে ধোঁয়ায় ভরে গেল। আমি পুলিশে কল করে জিবরান এবং রবকে নিয়ে বাসার বাইরে বেরিয়ে আসি। রবকে দেখে তখন মনে হয়েছিল ও ভালোই আছে। অনেক কাশছিল কিন্তু তেমন সিরিয়াস কিছু মনে হয়নি।”
রিমা ফায়জাকে বুকের মধ্যে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ওর পিঠে আলতো করে হাত বুলায়। “তুমি ভীষণ সাহসের কাজ করেছ। তুমি আমার গর্ব!”
হঠাৎ করেই নিজের মধ্যে একটা অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব করে রিমা। ফায়জাকে কাঁদতে দেখে ওর মনে হল এই মুহুর্তে ওর নিজেকে শক্ত হতে হবে। এই দুই ছেলেমেয়ের সে ছাড়া আর কেউ নেই ভরসা দেবার। একটা বড় করে শ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস ছাড়ল, তারপর নার্সকে জিজ্ঞেস করল, “আমি কি ওঈটতে আমার ছেলেকে দেখতে পারি?”
নার্স মাথা দোলাল। “নিশ্চয়! তিন তলায় চলে যাও। ওখানে গিয়ে অন ডিউটি নার্সের সাথে কথা বল। সে তোমাকে দেখার ব্যবস্থা করে দেবে।”
ওঈট ইউনিটের দিকে ছুটে যেতে যেতে রিমার পা কাঁপতে থাকে, মাথাটা ঝিম ঝিম করে, বুকের মধ্যে হৃতপিন্ডটা ড্রামের মত বাজে। নিঃশব্দে শুধু একটা কথাই পুনরাবৃত্তি করতে থাকে – আল্লাহ, আমার ছেলেটাকে সুস্থ রেখ। অবশেষে যখন ওঈট ইউনিটে পৌঁছাল একজন নার্স ওকে রবিন যে বিছানায় শুয়ে আছে সেখানে নিয়ে গেল। রবিনের শ্বাস প্রশ্বাস চলছে ভেন্টিলেটরের মাধ্যমে, তার দুই চোখ বন্ধ, দেখে মনে হয় শান্তিতে ঘুমাচ্ছে।
“ও কি ভালো হয়ে যাবে?” রিমা গলার ভেতরে থেকে বেদনার দলাটাকে ঠেলে নীচে নামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে।
“বলা কঠিন। ওর অবস্থা বেশ সিরিয়াস,” নার্স গম্ভীর মুখে বলে।
রিমার ফোন আবার বাজছে। প্রাইভেট কলার। ধরল না। ফোনটা মিউট করে দিল। “আবার কখন দেখতে আসতে পারব?” নার্সকে জিজ্ঞেস করল।
“কাল সকালে আসো,” নার্স নরম গলায় বলল। “ও এখন মোটামুটি স্টেবল আছে। এই মুহুর্তে এখানে থেকেও তুমি কিছুই করতে পারবে না।”
এমার্জেন্সী রুমে ফিরে এলো রিমা, বিষাদে ছেয়ে আছে ওর মন। ঊজ নার্সকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফায়জা এবং জিব্রানকে সাথে নিয়ে অফিসার ওমরের সাথে কথা বলতে গেল। নোমান ফায়জা এবং জিব্রানকে জড়িয়ে ধরল। ফায়জা কেঁদে ফেলল। “আমি খুব দুঃখিত। তোমার সব প্ল্যান ভেস্তে দিয়েছি।”
“না, তুমি কিচ্ছু ভেস্তে দাও নি,” নোমান মৃদু স্বরে বলে। “সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি কথা দিচ্ছি।”
“না, ঠিক হবে না। কক্ষন ঠিক হবে না।” ফায়জা কাঁদতে থাকে।
সেই মুহুর্তে রিমা বুঝতে পারে কেন ফায়জা ক্যাম্পেইন অফিসে ওকে পাঠানোর জন্য এতো জেদ ধরেছিল। নোমান আর ও মিলেই নিশ্চয় আংটি দেবার প্ল্যান করেছিল। কিন্তু ক্যাম্পেইন অফিসে কি হয়েছে ফায়জা সেই ব্যাপারে কিছুই জানে না।
অফিসার ওমর গম্ভীর কন্ঠে বলল, “মিসেস আহমেদ, আরেকটা খুব খারাপ খবর আছে। ওরা তোমাকে ফোন করেছিল।”
রিমা ভয়ানক ক্লান্তি বোধ করে। আরোও খারাপ কি হতে পারে? যা হয় হোক। ওর আর কোন কিছুতেই কিছু আসে যায় না। সে নিষ্পৃহ দৃষ্টিতে অফিসার ওমরের দিকে তাকায়।
“কেউ তোমার কাপড়ের দোকানে আগুন ধরেছিল। ভাগ্য ভালো যে ফায়ার ডিপার্টমেন্ট খুব দ্রæত পৌঁছে যায়। আগুন বেশি ছড়াতে পারেনি।”
নোমান চমকে ওঠে। “দোকানেও আগুন ধরেছে? কেউ নিশ্চয় প্ল্যান করে করেছে।”
রিমা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে। দিক, সব পুড়িয়ে ছারখার করে দিক। সব আবার নতুন করে গড়া যাবে। কিন্তু রবের যদি কিছু হয় তাহলে তাকে ফিরে পাবার আর কোন উপায় থাকবে না।
“মিসেস আহমেদ, তোমার সাথে আমার কথা বলা দরকার,” অফিসার ওমর বিনীত ভাবে বলে। “দেখে মনে হচ্ছে তোমার বিরুদ্ধে কেউ ষড়যন্ত্র করছে। তুমি একটু স্টেশনে আসবে আমার সাথে? তোমার স্টেটমেন্ট নিতে হবে।”
“আমি আগে বাড়ি আর দোকানটা দেখতে চাই,” রিমা বলল। “তারপর তোমার সাথে দেখা করতে যাবো।”
ওমর ওকে তার বিজনেস কার্ড দিল। “এই নাম্বারে কল কর। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব।” সে নোমানের দিকে ফিরল। “তুমি কি মিসেস আহমেদের সাথে থাকবে? ওকে দেখে অসুস্থ মনে হচ্ছে। আমি চাই না ও নিজেও কোন দূর্ঘটনায় পড়ে যায়।”
নোমান মাথা দোলাল। হ্যাঁ।
অফিসার ওমর বিদায় নিয়ে চলে গেল।
রিমা একটা চেয়ারে বসল। ওর নিজেকে বিধ্বস্ত, অবসন্ন মনে হয়।
“রিমা, চল আমার এপার্টমেন্টে যাই। তোমার বিশ্রাম দরকার। বাড়ি আর দোকান আমরা পরে গিয়েও দেখতে পারব। পুলিশ হলুদ টেপ দিয়ে পুরো এলাকা আটকে রাখবে। ভেতরে ঢুকতে পারব না আমরা।”
রিমা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে। “তুমি কাউকে বলেছ আগুন ধরার ব্যাপারটা?”
“না, কেন?” নোমান বিস্মিত হয়।
“কাউকে বলার দরকার নেই,” রিমা বলল। “ওদের দুই জনকে তোমার সাথে নিয়ে যাও। একটা উবার ডেকে নাও। আমার দেখতেই হবে কত খানি পুড়েছে।”
“আমি তোমার সাথে যাবো, মা,” ফায়জা বলল।
“না, তুমি আসবে না,” রিমা জোরের সাথে বলল। “নোমানের সাথে যাও। আমি তোমাকে পরে কল দেব।”
“তোমার ইন্সিউরেন্স ক্লেইম না করা পর্যন্ত আমার এপার্টমেন্টে থাকতে পারো,” নোমান বলল।
“আমি কোন হোটেলে একটা রুম নিয়ে নেব।” রিমা প্রস্তাবটা নাকচ করে দিল। “কাল সকালেই ইন্সুরেন্সে কল করব। আজ রাতে না হয় ওরা তোমার ওখানেই থাক।”
নোমান মাথা দোলাল। “আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু তোমার এখন ড্রাইভ করাটা ঠিক হবে না। আমার কথা শোন। আপাতত আমার ওখানে চল। একটু বিশ্রাম নিয়ে ঠান্ডা মাথায় যা করার কর।”
রিমা মাথা নাড়ল। “একটা উবার ডাকো তুমি। আমি চলে যাচ্ছি। ফায়জা, জিব্রান, ভালো হয়ে থেক। আমি একটু পরেই চলে আসব।” দুই জনকে আরোও একবার বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করে হন হন করে হেঁটে চলে গেল রিমা।
নোমান দ্বিধা দ্ব›েদ্ব পড়ে যায়। রিমার এই মানসিক অবস্থায় ওর একাকী ড্রাইভ করাটা ঠিক নয় কিন্তু যদি জেদ ধরে তাহলে নোমানের কিছুই করার নেই। ফোন বের করে উবারেই কল করল। হাসপাতালে এসেছিল রিমার সাথে। ওর নিজের গাড়ি এখনও ক্যাম্পেইন অফিসের পার্কিং লটে।
“মাকে আংটিটা দিয়েছিলে,” ফায়জা ফিসফিসিয়ে বলে। নোমান দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে। “দিয়েছিলাম কিন্তু সমস্যা হয়েছে। পরে বিস্তারিত বলব। আমি নিজের দোষেই পুরোটাই ভেস্তে দিয়েছি।”
ফায়জা হতাশা নিয়ে মাথা নাড়ে। “আজকের দিনটা খুব অদ্ভুত গেল, না? একদিকে আমরা ভোটে জিতলাম, অন্যদিকে আবার সব হারালাম। রব ওঈট তে। কি হবে কে জানে?”
“ও কি মরে যাবে?” জিব্রান ভীত কন্ঠে জানতে চায়।
“না, না, ওর কিচ্ছু হবে না,” নোমান দৃঢ় কন্ঠে বলে। ওর মনে সন্দেহ থাকলেও ভাই-বোনের কাছে সেটা ও প্রকাশ করতে চায় না।
১০০
রিমা যখন গাড়ি নিয়ে রাস্তায় নামে এক ভীষণ ক্ষোভ ওর ভেতরটা কুরে কুরে খেতে থাকে। নিজেকে শান্ত করবার জন্য কিছুক্ষণ একাকী থাকার দরকার ছিল। ওর ইচ্ছা হয় নিজেকে ভয়ানক কোন শাস্তি দিতে। ওর উচিৎ ছিল আরোও অনেক সতর্ক থাকা। চারদিকে এতো শ্ত্রæতার মাঝেও কোন এক অদ্ভুত কারণে পরিস্থিতি নিরাপদ ভাবতে শুরু করেছিল। ওর নির্বুদ্ধিতা আর অসাবধানতার জন্যই ওরা এখন গৃহহীণ, ছেলেমেয়েরা আতঙ্কিত, রব মৃত্যূমুখে। ওর ভালো ইন্সিউরেন্স আছে। সুতরাং কষ্ট হলেও আবার নিজের পায়ে ঠিকই দাঁড়াতে পারবে কিন্তু কখন কি আর নিরাপদ বোধ করবে? মিন্টুর মৃত্যুর পর যে ঝড় বয়ে গিয়েছিল, ভেবেছিল অবশেষে তা বোধহয় থিতিয়ে আসছে, কিন্তু বাস্তব বড় নির্মম। তার সামান্য একটু সুখ কারো সহ্য হয় না।
কোথায় যাবে স্থির না করতে পেরে আনমনে নিজের বাড়ির দিকেই ড্রাইভ করছিল ও। একটা রেড লাইটে থামল। সিগনাল সবুজ হবার জন্য অপেক্ষা করছিল। আচমকা বিদ্যুৎ চমকানোর মত চিন্তাটা মাথায় এলো। কাজটা পিন্টু করায়নি তো? ইদানীং কোন ঝুট ঝামেলাই করছিল না কিন্তু সেটা বড় কোন আঘাত হানবার আগে ওকে অসতর্ক করে দেবার জন্যও হতে পারে। মুহুর্তের মধ্যে ভয়ানক এক ক্রোধ ওকে গ্রাস করে। ওর শ্বাস প্রশ্বাস দ্রুততর হয়, মাথাটা ঝিম ঝিম করতে থাকে, প্রতিশোধ স্পৃহায় সমস্ত শরীর কাঁপতে থাকে। পিন্টুকে ও দেখিয়ে দেবে রিমা দূর্বল নয়। চোখের পলকে সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলে। গাড়ী ঘুরিয়ে ম্যাককাউন রোডের দিকে ধেয়ে যায়, বায়ে মোড় নিয়ে স্পিড বাড়িয়ে দেয়। ওকে ক্ষ্যপানোর পরিণতি এবার বুঝবে পিন্টু!
পরবর্তি পনের মিনিটের স্মৃতি ওর কাছে ধোঁয়া ধোঁয়া। উন্মত্ত ক্রোধ ওকে এমনবভাবে গ্রাস করেছিল যে সুস্থভাবে চিন্তাভাবনা করবার মত অবস্থা ওর ছিল না। একটা গাড়ীর সাথে ধাম করে প্রচন্ড ধাক্কা লাগার পর এয়ার ব্যাগটা যখন ওর মুখে এসে আছড়ে পড়ে তখন ওর সম্বিত ফিরে আসে। শব্দটা এতো জোরে হয়েছে যে রাতের নিঃশান্ততায় দুই-তিন কিলোমিটার দূর থেকে শোনা গেলেও আশ্চর্য হবে না। এয়ার ব্যাগটাকে মুখে থেকে সরিয়ে গাড়ী থেকে নেমে বাইরে পা রাখতে বেশ কিছুক্ষণ গেল। ওর মুখ অবশ হয়ে গেছে, পা থর থর করে কাঁপছে, কিন্তু দৃষ্টি পরিষ্কার। সামনে তাকিয়ে যা দেখল তাতে ওর মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল। একেবারে জায়গা মতই লাগিয়েছে। আহমেদ পরিবারের বাড়ির ড্রাইভওয়েতে দুইটা গাড়ি পার্ক করা ছিল। ও তীরের মত নিজের গড়ীটাকে সবেগে চালিয়ে ধাক্কা দিয়েছিল গাড়ী দুইটাকে। একেবারে ভচকে গেছে দুইটাই। চেয়েছিল পর্শাটার বারোটা বাজাতে কিন্তু সেটাকে কোথাও দেখে নি। পিন্টু নিশ্চয় সেটাকে গ্যারাজের মধ্যে রাখে। বেঁচে গেল, শালা! তারপরও ক্ষতি যা হয়েছে সেটাই বা কম কি? মনে মনে যথেষ্ট সন্তুষ্টি অনুভব করে। রিমার সাথে ঝামেলা পাকাস? ঠ্যালা সামলা এবার। দরকার হলে মহাযুদ্ধ বাঁধিয়ে দেবে ও।
বিধ্বস্ত দুই গাড়িরই এলার্ম বেজে চলেছে। প্রচন্ড শব্দে কানে তালা লেগে যাবার মত অবস্থা। পিন্টু পিস্তল হাতে বাইরে বেরিয়ে এলো। তার ঠিক পেছনেই লাট্টু এবং মরিয়ম।
“বাইরে এসো না,” পিন্টু মরিয়মকে লক্ষ্য করে বলে। “পুলিশ ডাকো।”
বাসার বাইরে অনেকগুলো অটো সেন্সর বাল্ব জ্বলে উঠে স্থানটা আলোয় আলোকিত করে দিয়েছে। ড্রাইভওয়েতে আবছায়ার মত কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল পিন্টু। সে পিস্তল তুলে সেদিকে তাক করল। “নড়ো না। হাত মাথার উপরে তোল। পিস্তল লোডেড।”
রিমা পিস্তলের থোড়াই তোয়াক্কা করে। সুস্থ মাথায় চিন্তা করবার মত ক্ষমতা ওর তখন নেই। মাথাটাকে একটা পাথরের টুকরা মনে হচ্ছে। নীচু হয়ে নিজের পা থেকে একটা সান্ডেল খুলে পিন্টুকে লক্ষ্য করে ছুড়ল, পিন্টুর ধারে কাছেও গেল না সেটা। “হারামী! তুই আমাকে ধ্বংস করতে চাস, তাই না?”
পিন্টু দ্রæত পিস্তল ওর পকেটে ঢুকিয়ে ফেলল। কয়েক পা এগিয়ে এসে বিস্মিত কন্ঠে বলল, “রিমা ভাবী!”
“ভাবী বলে ডাকবি না হারামী!” রিমা কন্ঠের সমস্ত শক্তি দিয়ে চীৎকার করে ওঠে। “তুই আমার বাড়ীতে আগুন লাগিয়েছিস। আমার দোকানে আগুন লাগিয়েছিস। স্বীকার কর। আমি জানি তুইই করেছিস।”
মরিয়ম ফোন বের করে পুলিশে কল করছিল, কিন্তু রিমার কন্ঠস্বর শুনে থমকে গেল ও। বাইরে বেরিয়ে দেখল রিমাই তো!
“রিমা! এখানে কি করছ তুমি?”
“ওকে শাস্তি দিচ্ছি!” রিমা লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে বলল। “কি করেছে জানো? আমার বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে, দোকান পুড়িয়ে দিয়েছে। রবের অবস্থা খুবই খারাপ। ওঈট তে। বাঁচবে কিনা জানি না। ঐ শয়তানটাই এইসব করিয়েছে আমাকে জব্দ করবার জন্য।”
পিন্টু এবং মরিয়ম দুই জনকেই হতবিহবল দেখায়, পরস্পরের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করে তারা, তারপর রিমার দিকে ফেরে।
“কোথায় আগুন লেগেছে?” পিন্টু অবশেষে প্রশ্ন করে, যেন নিশ্চিত হতে চায় সে ভুল শোনেনি।
“আমার বাড়ীতে। আমার দোকানে। আমি কি বলছি বুঝতে পারছ না?” রিমার মনে হয় তার শরীর থেকে সমস্ত শক্তি কেউ শুষে নিয়েছে। তার ক্রোধের তীব্রতা ধীরে ধীরে পড়ে যাচ্ছে।