শুজা রশীদ : (পর্ব ৪৮)
৬৯
রিমার দোকানের জন্য ছুেেতার মিস্ত্রী শেষ পর্যন্ত জোগাড় করে দিল লিয়াকত। চইনিজ বংশোদ্ভূত। সব কাজ শেষ করতে তার সপ্তাহ খানেক সময় লাগবে। রিমার হিসাব সেই রকমই ছিল। মিস্ত্রীর কাজ শেষ হতে হতে ওর অপারেশনের ধাক্কাটাও মোটামুটিভাবে কেটে যাবে। ওর দীর্ঘ দিনের একটা স্বপ্ন যে শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে ভেবেও মনটা আনন্দে নেচে উঠছে। প্রতিদিনের সিংহভাগ সময় ও দোকান সংংক্রান্ত ব্যাপারেই রিসার্চ করে কাটায়- মার্কেটে কি ধরনের পোশাকের চাহিদা আছে, কোন ধরনের ডিজাইন ঝট করে চোখে পড়ার সম্ভাবনা বেশি, কোথায় এবং কিভাবে এডভার্টাইজিং করলে দ্রুত সাফল্য পাওয়া যেতে পারে, ইত্যাদি। ওর বদ্ধ ধারনা ও যদি জান প্রাণ দিয়ে চেষ্টা করে তাহলে ওর এই ব্যবসাকে ও অর্থনৈতিকভাবে সফল করে তুলতে পারবে। অনেক দেশী কাপড়ের দোকানই যে শুধু টিকে আছে তাই নয়, খুব ভালোও করছে। আগামী দুই বছরের মধ্যে বৃহত্তর টরন্টোতে দেশী মানুষদের কাছে ওর দোকানটা হয়ে উঠবে এক বহুল পরিচিত নাম, এটাই ওর অভিলাষ।

দোকানের জন্য একটা যুতসই নাম খুঁজতে শুরু করেছে ও। এমন একটা নাম যা সহজেই মনে থাকবে। কিন্তু ওর মাথায় যে সব নাম আসছে সেগুলো হয় খুব বেশি গাল ভরা নয়ত একেবারে মিনমিনে। অন্যাদের কাছে সাহায্য চাওয়া যায় কিন্তু ওর ইচ্ছে নামটা ও নিজেই রাখবে। এই দোকানটা ওর কাছে একটা নব্জাতকের মত। নিজের সব বাচ্চাদের নাম ও নিজেই রেখেছে। এটার ক্ষেত্রেও তার ব্যাতিক্রম কেন হবে? প্রতিদিন নানা ধরনের নাম মাথায় আসে- রিমার ফ্যাশন- দ্য গর্জিয়াস গার্ল- বিউটি এন্ড ব্রেইন- দেশী গার্ল- শাড়ি বোনান যা- কিন্তু কোনটাই ভালো লাগছে না। যথাযথ মনে হচ্ছে না।

বিশ্বাসযোগ্য একজন সাপ্লায়ার খুঁজে বের করাও প্রয়োজন। এই জাতীয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ে সফল হতে হলে চাই ব্যাক্তিগত রুচির ছোঁয়া- অধিকাংশ দেশী মহিলারই চান নতুন ধরনের ডিজাইন, ভালো মানের কাপড়, এবং সুসম্পর্কের উপর ভিত্তি করে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ। ও নিজেই তো কত মহিলার কাছ থেকে কাপড় কিনেছে যারা সৌখিনভাবে এই ব্যবসা করছে এবং বেশ ভালোই করছে। তাদের অনেকেই হয়ে ওঠে বন্ধুর মত, বাকীতে বিক্রী থেকে শুরু করে অন্তর্বাস তৈরী করে দেয়ার কাজও করে দেয় মোটামুটি সুলভেই। রিমার ধারনা এই ব্যবসায়ে সফল হবার সব ধরনের গুনগত মান ওর আছে। এখন শুধু প্রয়োজন একজন ভালো পার্টনারের।

দেশে ওর ভাই রনককে ফোন দিয়েছিল। রনক ভাবল ও ফোন করেছে ওর সার্টিফিকেটের খোঁজ নেবার জন্য। জানাল, জোগাড় করে ফেলেছে, ফেড এক্স করে ওর কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করছে। রিমা যখন সার্টিফিকেটের আলাপে না গিয়ে মেয়েলী পোষাক আষাক নিয়ে কথা বলতে শুরু করল সে একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।

“আপু, তোমার কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তুমি আমাকে পোশাক কিনে পাঠাতে বলছ?”

“আমার কাপড়ের ব্যবসায়ের জন্য দেশে একজন মানুষ দরকার যে দেখে দেখে ভালো শাড়ি, কামিজ পাঠাবে,” রিমা ব্যখ্যা করে। “ব্যাপারটা যতখানি কঠিন শোনাচ্ছে ততখানি কঠিন নয়। তুই পারবি।”

“আর কাউকে পেলে না তুমি এই কাজ করার জন্য?” রনক অনীহা নিয়ে বলে।
“পেলে কি তোকে বলতাম?” রিমাকে স্বীকার করতে হয়।
“তোমার বান্ধবীরা সব কোথায়?”
“দেশ ছাড়ার পর তো ওদের কারো সাথে আমার কোন যোগাযোগ নেই। তুই যদি না করতে চাস তাহলে একজন খুঁজে দে না। আমার যা লাভ হবে তার একটা অংশ দেব।”
“টাকা-পয়সা দেবে?” রনকের এবার মনে হল কিঞ্চিৎ আগ্রহ বাড়ল।

“অবশ্যই! আমি একজন পার্টনার খুঁজছি।” রিমা পার্টনার শব্দটার উপর বেশ জোর দেয়। রনক আপাতত তেমন কিছুই করছে না। ওর সাথে জোট পাকিয়ে এই ব্যবসায়ে নামলে তারও হয়ত একটা হিল্লে হয়ে যাবে।
“তাহলে আমি চেষ্টা করে দেখতে পারি। এটা কি তোমার অনলাইন বিজনেস?”
“না, না। আমি বাংলা টাউনের কাছে ছোট একটা দোকান ভাড়া নিয়েছি। দেখিস একদিন অনেক বড় হবে,” রিমা দৃঢ় কন্ঠে বলে।
“এতো টাকা কোথায় পেলে?” রনক অবাক হয়ে জানতে চায়। “ইন্সুরেন্সের টাকাটা কি পেয়ে গেছ?”

“হ্যাঁ। একটা বাড়ি কিনেছি- পুরানো, কিছু কাজকর্ম করাতে হবে। আর একটা ছোট দোকান লিজ নিয়েছি। কাউকে কিছু বলিস না। এখনই সবাইকে জানাতে চাই না।”
রনক হাসল। “আপু, তুমি হচ্ছ বিখ্যাত মানুষ। আমার ধারনা যারা তোমার খোঁজ খবর রাখে তারা ইতিমধ্যেই যা জানার সব জেনে ফেলেছে। এই জাতীয় গুজবে মানুষের অনেক আগ্রহ। অনেকেই আছে যারা ভাবে দুলাভাইকে তুমিই খুন করে নীচে ফেলে দিয়েছ।”
“বদমায়েশের দল!” রিমা তেঁতো গলায় বলে। “মানুষ এতো নিষ্ঠুর হতে পারে! মা কেমন আছে রে?”

“একই রকমই। কাজের মহিলাদের সাথে জোট পাকিয়ে সব সিরিয়ালগুলো গিলছে। কথা বলতে চাও?”
রিমা পরে একসময় ফোন করে মায়ের সাথে কথা বলার অঙ্গীকার করল। রনককে বলল চিন্তা ভাবনা করে ওকে জানাতে সে সত্যি সত্যিই ওর সাথে পার্টনারশিপে কাজ করবে কিনা। ওর ব্যবসায়ের জন্য এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা। ওর এমন কাউকে চাই যার সময় এবং রুচি দুটোই আছে। রনক কথা দিল সে একটু খোঁজ খবর নিয়ে জানাবে।

৭০

মরিয়মের পৈত্রিক বাড়িতে আজ বেশ একটা উৎসব-উৎসব ভাব। পিন্টু রাতে ডিনারের দাওয়াতে আসছে। মরিয়ম এবং ওর পরিবারের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করার এটা আরেকটা সুযোগ পিন্টুর। আগের পর্বে সে খুবই ভালো করেছিল। তার পোষাক আষাক, আচার-আচরণ দেখে মরিয়ম খুব খুশী হয়েছিল। আজকের ডিনার কোন ঝুট-ঝামেলা ব্যাতিরেকে চুকলেই বাঁচা যায়। আগে পিন্টু কখনই শ্বশুর বাড়ীর মানুষদের সাথে খুব একটা ঘনিষ্ট হতে চাইত না। ব্যাপারটা সব সময়েই মরিয়মকে কষ্ট দিত। ওর পরিবারের সবাই আহমেদ পরিবারকে সর্বদা সম্মান এবং ভালোবাসা দেখিয়েছে কিন্তু কোন এক অদ্ভুত কারণে আহমেদ পরিবারের আচরণ বরাবরই একটু উন্নাসিক ছিল। সেই মনভাব পালটে এই পরিবারের প্রতি যথাযোগ্য মর্যাদা দেখানোর এটা পিন্টুর একটা মোক্ষম সুযোগ। মরিয়ম আশা করছে পিন্টু এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করবে।

পিন্টু সময় মতই এলো- কালো ইস্ত্রি করা প্যান্ট আর ফুল হাতা নীল টি শার্ট। বাসা ছেড়ে চলে আসার পর এই প্রথম বাবার প্রতি কিঞ্চিৎ আগ্রহ দেখাল জলি এবং হ্যাপি। পিন্টু বিনীত, ভদ্র, এবং হাসিখুশি আচরণ দিয়ে খুব দ্রæত সবার মন জয় করে নিল। সে দুই কন্যার জন্য এবং দোলনের জন্য উপহার নিয়ে এসেছিল। দামী ফুলদানিটা হাতে পেয়ে দোলন খুশীতে একেবারে বাকবাকুম হয়ে গেল। মূল্য নিয়ে তার মাথা ব্যাথা নেই। দূলাভাই যে হাতে করে কিছু নিয়ে এসেছে তাতেই সে ভয়ানক খুশী। এতো দিন ধরে এই বাড়িতে আছে কিন্তু এর চেয়ে রোমান্টিক কোন কিছু কখন ঘটেনি। সে সারা দিন ধরে রান্না-বান্না করেছে, ঘর পরিষ্কার করেছে, খুব যত্ন করে নিখুঁতভাবে সব কিছু গুছিয়েছে। তার ধারনা বড় ভাবী হিসাবে পিন্টুকে এই রাজকীয় অভ্যর্থনা দেয়াটা তার গুরু দায়িত্ব। মরিয়ম চেষ্টা করেছে তাকে বিরত করতে কিন্তু কে শোনে কার কথা।

পিন্টুর ব্যবহারে খুব বিস্মিত হয়েছে মরিয়ম। শুধু যে সবার সাথে হাসি মুখে কথাবার্তা বলছে তাই নয়, সে মাঝে মাঝে দু চারটে কৌতুক বলেও সবাইকে হাসাচ্ছে। তার দুই কন্যাই বাবাকে এই মেজাজে দেখে একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেছে। পিন্টুকে তারা এভাবে কখন দেখেছে বলে মনে করতে পারে না। দু’জনেই বাবার সাথে একেবারে লেপটে আছে। হাসির কিছু বললেই খিল খিল করে হেসে গড়িয়ে পড়ছে, ঠেলাঠেলি করে খাবার বেড়ে দিচ্ছে, পানি ঢেলে দিচ্ছে- বোঝাই যাচ্ছে এই রকম একজন হাসিখুশি বাবার জন্য তারা সব কিছু করতে প্রস্তুত। মরিয়মের দুই চোখ জলে ভিজে এলো। বাড়িতে থাকতে বাবার সাথে ওদের প্রায় দিনেই তেমন কোন কথাই হত না। পিন্টু যেমন মেজাজ নিয়ে থাকত! সামান্য ব্যাপারে খিটমিট করত। ওর নিজেরই কথা বলতে ভয় লাগত।

খাবারের পর সবাইকে লিভিং রুমে গিয়ে জমায়েত হতে হল। জলি এবং হ্যাপি কেটি প্যারির বার্থডে গানের সাথে খুব ধুম ধাম করে নাচল বাবার সম্মানে। পিন্টু তাদের নাচ দেখে যেমন মুগ্ধ হল তেমন আনন্দও পেল। তার মনের বিষন্নতা কাটানোর জন্য এমন কিছু একটার দরকার ছিল। “ওরা এতো ভালো নাচে সেটা তো জানতাম না,” মরিয়মকে চুপি চুপি বলল।
“সব দোলনের কাজ,” মরিয়ম ফাঁস করে। “ইউ টিউব দেখে দেখে ওদেরকে শিখিয়েছে কয় দিন ধরে।”

আজকের এই দাওয়াত নিয়ে দোলন কি যে হৈ চৈ করেছে কয়টা দিন ধরে। মরিয়মেরই মাথা খারাপ হবার জোগাড়। দোলন খুব ভয়ে ভয়ে ছিল সব ঠিকঠাক মত হবে কিনা ভেবে। তার ভয় একাবারেই অমূলক ছিল। সব কিছু চমৎকারভাবে হয়েছে।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষ হবার পর দোলন মিষ্টি পরিবেশন করল। এই বিশেষ অনুষ্ঠানের জন্য সে তার বিখ্যাত আমের লাসসি এবং নারকেলের ক্ষীর বানিয়েছে। আবুল ড্যানফোর্থ থেকে রাজ্যের দেশী মিষ্টি এনে টেবিল ভরিয়ে ফেলেছে।

মিষ্টি পর্ব শেষ হতে না হতেই আবার দোলনের আবির্ভাব। এইবার সে পিন্টু এবং মরিয়মকে এক রকম জোর করেই আসন থেকে ঠেলে তুলে জ্যাকেট এবং জুতা পরিয়ে রাস্তায় নামিয়ে দিল আশেপাশে গিয়ে কিছুক্ষণ হেঁটে আসার জন্য। মেয়েটা চালাক। ঠিকই বুঝেছে বাসার মধ্যে ওদের দু’জনার কথা বার্তা বলার কোন সুযোগই হবে না।

ফেব্রæয়ারি মাসের শেষের দিকে ঠান্ডা বেশ কনকনে কিন্তু আকাশ পরিষ্কার, ঝকঝকে, তারাদের মেলা বসেছে সেখানে। ফুটপথের সাথে লাগোয়া কিছু ল্যম্পপোস্ট থাকায় এলাকাটা মোটামুটি ভাবে আলোকিত হয়ে আছে কিন্তু খুব উজ্জ্বল হয়ে নেই। বেশ একটা কোমল, আলো আধারী ভাব, নক্ষত্র খচিত আকাশটাকে মলিন করে দেবার মত নয়। মাথার উপরে ছাতার মত ছড়িয়ে থাকা বড় বড় গাছের নীচ দিয়ে ফুটপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে ওরা দু’ জনে বেশ কিছুক্ষণ কোন কথা বলে না। মরিয়ম চাইছিল পিন্টুই আগে কথা শুরু করুক। এটা তো পিন্টুর পরীক্ষা। তারই তো চালকের আসনে বসা উচিৎ। কিন্তু পিন্টু ফুটপথের উপর দৃষ্টি রেখে নীরবে হাঁটছে, মাঝে মাঝে শুধু মুহুর্তের জন্য চোখ তুলছে সামনের পথটা দেখার জন্য। মরিয়ম কেঁশে গলা পরিষ্কার করল। ভাবল কিছু একটা করে পিন্টুকে উৎসাহিত করতে পারলে সে হয়ত মুখ খুলবে। সৌভাগ্যবশত পিন্টু তার ইঙ্গিতটা ধরতে পারল।
“এইভাবে আমরা কিন্তু কখন হাঁটি নি একসাথে,” মিন্টু বিড়বিড়িয়ে বলে।
“শীতকালে তো নয়ই,” মরিয়ম দ্রæত যোগ করে, পিন্টুকে খেই হারিয়ে ফেলার সুযোগ দিতে চায় না।
“কোন কালেই না,” পিন্টু বলল। “মনে আছে একবার গরমের সময় তুমি আমাকে নিয়ে বিকালে হাঁটতে যেতে চেয়েছিলে? আমিও বোধহয় যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু শেষ পর্যন্ত যাওয়া হয়ে ওঠে নি। বোধহয় রেস্টুরেন্টে যেতে হয়েছিল। নতুবা অন্য কিছু একটা নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়েছিলাম।”

“আমি তো তোমাকে অনেকবারই নিতে চেয়েছি,” মরিয়ম শান্ত কন্ঠে বলে। “সব সময় কিছু না কিছু একটা অজুহাত তৈরী করে ফেলেছ তুমি। রেস্টুরেন্ট চালিয়েও অনেক কিছু করা সম্ভব ছিল। আমাদের করা হয় নি। দোষটা হয়ত দু’জনারই।”
“দোষ তোমার নয়, আমারই,” পিন্টু স্বীকার করল। কয়েকটা নীরব মুহুর্ত কাটল। “আমার নজর সব সময়েই একটু বেশীই উপরে ছিল। আব্বা রেস্টুরেন্টটা শুরু করেছিলেন। আমি ভেবেছিলাম আমি আরোও অনেক বড় কিছু করব। রেস্টুরেন্টের ব্যবসা দিয়ে ধনী হওয়া যায় না। এই জাতীয় মধ্যম মানের রেস্টুরেন্ট দিয়েতো নয়ই। নিজের উচ্চাকাংখ্যা পূরণ করবার জন্য এমন অনেক কিছু করেছি যা আমার করাটা উচিৎ হয় নি। অনেক টাকা পয়সা নষ্ট হয়েছে। কিন্তু আমার ভাগ্যটাও খারাপ ছিল। কোন কিছুতেই কিছু হয় নি। তারপর মিন্টু ভাই বিয়ে করে দূরে সরে গেল। কারো কাছে গিয়ে যে মনের কথা বলব, এই সব নিয়ে আলাপ করব, তেমন কেউও ছিল না।”
“ছিল,” মরিয়ম বলল। “রেস্টুরেন্টে প্রতিদিন তোমার সাথে আমিও কাজ করতাম। ভুলে গেছ? রাতেও আমরা দু’জনে একই বিছানায় শুতাম।”
পিন্টু দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ল। “তোমার যথাযথ মূল্য আমি তোমাকে কখন দেই নি। এখন বুঝতে পারি। খুব কি বেশী দেরী হয়ে গেল?”

মরিয়ম আঁড় চোখে পিন্টুকে দেখল। তার দৃষ্টি মাটিতে। যা বলল সেটা কি মন থেকে বলা? যদি কথাটা সে আন্তরিকভাবে বলে থাকে তাহলে তাদের এগারো বছরের বিবাহিত জীবনে সেটাই হবে সবচেয়ে তৃপ্তিকর। অবশেষে নিজের ত্রæটি সে স্বীকার করেছে, এগারো বছর ধরে যে অবহেলা সে করেছে তার জন্য অনুশোচনা করেছে। অন্য সবকিছু উপেক্ষাও করতে পারলেও ঐ একটা ব্যাপার মরিয়মকে সব সময়ই কষ্ট দিত। তার মত সুশিক্ষিত, বুদ্ধিমতী একটা মেয়ে পিন্টুর মত অর্ধশিক্ষিত, অর্ধসফল একজন ছেলেকে বিয়ে করেছিল শুধুমাত্র তার পারিবারিক সম্মান বিবেচনা করে। পিন্টু কি সেটা কখন অনুধাবন করেছে? করেছে বলে মনে হয় নি। নাকি সে নিজেও হীনমন্যতায় ভুগত? জানত স্ত্রীর তুলনায় তার নিজের যোগ্যতা ছিল প্রশ্নসাপেক্ষ, হয়ত সেই কারণেই সে সবসময় চেষ্টা করত মরিয়মকে ছোট করে রাখতে। কে বলতে পারে তার মনের মধ্যে কি চলত। আজকের এই স্বীকারোক্তিই মরিয়মের জন্য যথেষ্ট।
মরিয়ম বুঝতে পারে না তার কিছু বলা উচিৎ কিনা। পিন্টু অনেক কথা বললেও তাকে বাসায় ফিরে যাবার প্রসঙ্গে কিছুই বলে নি। তার কন্ঠে মরিয়মকে সে ইতিমধ্যেই হারিয়ে ফেলেছে কিনা সেই সংশয় ছিল কিন্তু সেটা মরিয়মের জন্য যথেষ্ট নয়। এখন পর্যন্ত সব কিছু আশান্বিতভাবে করেছে পিন্টু কিন্তু তার মুখ থেকে যে কথাগুলো শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে ছিল মরিয়ম সেটাই এখনও বলে নি। ও নিজেও চায় না পিন্টুর মুখ থেকে কথা টেনে বের করে আনতে। পিন্টু বলুক সে তার স্ত্রী এবং দুই কন্যাকে বাসায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়, তার জীবনে তাদেরকে তার প্রয়োজন, তাদের অভাবে তার জীবন থেমে যাবার উপক্রম হয়েছে। এতো বছরের বিবাহিত জীবনে এই একবারই মরিয়ম রুখে দাঁড়িয়েছে। যদি যথাযথ ফলাফল না দেখেই সে ফিরে যায় তাহলে সেটা অনেক বড় ভুল হবে। বারবার স্বামীর সাথে কলহ করে পৈত্রিক বাড়ীতে সে ফিরে আসতে পারবে না। বাবা,মা, বড় ভাইকে সে আবারও এই জাতীয় একটা অনভিপ্রেত পরিস্থিতিতে ফেলে দিতে চায় না। দোলন এবং কালামের বন্ধুত্বকে কেন্দ্র করে বাসার পরিবেশ ইতিমধ্যেই বেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।
“আমাদের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না,” পিন্টু বলল।
“কেন?” দুজনেরই হাঁটার গতি শ্লথ হয়ে পড়েছে। মরিয়মের দৃষ্টি পিন্টুর উপর।

“আমাদের ঋণের কিস্তি শোধ করতে পারছি না আমরা। বাড়ীর মর্টগেজ অনেক। রেস্টুরেন্টের ভাড়াও বেড়ে গেছে। ব্যবসা কমে গেছে বিশ পার্সেন্ট। ব্যাংকে বলতে গেলে কোন টাকা-প্য়সাই নেই। দোষটা আমারই। উলটা পাল্টা জায়গায় টাকাপয়সা খাটিয়ে বেশ লোকসান করেছি। কিন্তু এটাই আমদের বর্তমান পরিস্থিতি। রিমার পেছনে লেগেছিলাম শুধু ক্ষেপে ছিলাম বলে না, টাকা-পয়সারও দরকার ছিল। কিন্তু যা করেছি অন্যায় করেছি। ঐরকম আর কখন হবে না।”
বাসা থেকে ইতিমধ্যেই বেশ খানিকটা দূরে চলে এসেছে ওরা। এবার ফিরে যাওয়া দরকার, ভাবল মরিয়ম। সে ঘুরে ফিরতি পথ ধরতে পিন্টুও তাকে অনুসরণ করল।
“কি করবে এখন?” মরিয়ম জিজ্ঞেস করে। ঐ রেস্টুরেন্ট এখনও ওর রেস্টুরেন্ট, ঐ বাসা এখনও ওর বাসা। সেখানেই ওর সংসার। ওর এবং ওর দুই মেয়ের ভবিষ্যত ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে আহমেদ পরিবারের সাথে। তাদের ভালো মন্দই ওদের সবার জীবনের প্রশ্ন।
“জানি না, মরিয়ম। মাথায় কিছুই আসছে না।” পিন্টুর কন্ঠে হতাশা। “দেশে আমাদের এখনও কিছু জমি জমা আছে। মিন্টু ভাই লুকিয়ে যা বিক্রী করেছে তার পরেও। ভেবেছিলাম সেগুলো বেঁচে কিছু টাকা পয়সা পাওয়া যাবে। কিন্তু সমস্যা আছে। আমদের আত্মীয়স্বজনেরা যারা সেই সব জমিজমা দেখভাল করত তারা এখন আর সেখান থেকে নড়তে চায় না। তারা সেগুলো অর্ধেক দামে কিনে নিতে চায়। টাকাও একবারে দেবে না, একটু আধটূ করে দেবে আগামী দশ বছর ধরে। আমারও তেমন কিছু করার নেই এখানে। চেষ্টা করলে এখনও হয়ত কলকাঠি নেড়ে তাদেরকে বের করার ব্যবস্থা করতে পারি কিন্তু বাবা-মা চান না আমি আমাদের আত্মীয় স্বজনদের বিরুদ্ধে কিছু করি।”
“তাহলে?” মরিয়ম তার প্রশ্ন অসামপ্তই রাখে।

“কিছু একটা উপায় বের করে ফেলব,” পিন্টু আনমনে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল। “যাইহোক, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তোমার ঠান্ডা লাগছে। চল, ফিরে যাই বাসায়। অকারণে ঠান্ডা লাগানোটা ঠিক হবে না।”
ফিরতি পথে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে ওদের বাহুতে বাহু ছুঁয়ে যায়, ওদের নিঃশ্বাস শৈত্যতায় ঘনীভূত হয়ে বায়বীয় সাবলীলতায় পরস্পরের সাথে মিলে মিশে যায়। আজ বহুদিন পর তার পাশের এই মানুষটার প্রতি এক ভিন্ন ধরনের আবেগ অনুভব করে মরিয়ম। হাজার দোষ ত্রুটি থাকলেও সে তার স্বামী, যদিও প্রেমিক হয়ত কখনই হতে পারে নি। কিন্তু এই মুহুর্তে ও তার হৃদয়ের ছোঁয়াটুকু অনুভব করে, তার উদবেগটুকু উপলদ্ধি করে। হাত বাড়িয়ে লোকটার একখানা হাত ধরে। তার শীতল হাতের মাঝে পিন্টুর উষ্ম হাতের ছোঁয়াটুকু খুব ভালো লাগে। ওর এই আচমকা আবেগের প্রকাশ দেখে একটু চমকে ওঠে পিন্টু কিন্তু পরক্ষণেই শক্ত করে চেপে ধরে মরিয়মের হাতখানা, আঙ্গুলে আঙ্গুল দিয়ে চেপে ধরে রাখে বাকী পথটুকু, যেন ছেড়ে দিলেই তার জীবন থেকে উধাও হয়ে যাবে এই মেয়েটা।