শুজা রশীদ : (পর্ব ৪৬)
আধা ঘন্টা পেরিয়ে গেল, তখনও মরিয়মের দেখা নেই। আশ্চর্য! পিন্টু অধৈর্য হয়ে আবার মরিয়মকে ফোন দিতে যাচ্ছিল, ঠিক তখন দেখল সামনের মোড়ে মরিয়মের গাড়ী। এই হল ওর পাঁচ মিনিট? এপল ওয়াচে সময় দেখে ভ্রূঁ কুঁচকাল সে।
দেরীর জন্য মাফ যা চাইবার দোলনই চাইল। মরিয়ম এমন ভাব করল যেন এটা কোন ব্যাপারই নয়। নিজের মনভাব গোপন করার আপ্রাণ চেষ্টা করলেও তার দৃষ্টিতে সামান্য হলেও প্রশংসার চিহ্নটুকু ধরতে বিলম্ব হল না পিন্টুর। জানে মরিয়ম তাকে স্যুট প্যান্টে দেখতে পছন্দ করে। দোলন বাসার ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ না করা পর্যন্ত অপেক্ষা করল সে, তারপর মরিয়মের জন্য গাড়ির দরজা খুলে দিল। মরিয়ম অবিশ্বাস নিয়ে তাকালেও কোন আপত্তি না করে প্যাসেঞ্জার সিটে উঠে বসল। পিন্টু গাড়ি নিয়ে রওনা দেবার সময় দেখল দোলন জানালার পর্দা সরিয়ে উঁকি মারছে।
“এই হল তোমার পাঁচ মিনিট?” পিন্টু ক্ষুব্ধ কন্ঠে বলে।
“দেখছিলাম তুমি আসলেই সিরিয়াস কিনা,” মরিয়ম নির্বিকার মুখে বলল।
পিন্টু বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকাল। নীল জিন্স আরে লাল জ্যাকেট পড়েছে মরিয়ম, চুল একটা রিবন দিয়ে টাইট করে বেঁধেছে। খুব সুন্দর লাগছে, মনে মনে স্বীকার করতেই হল। হালকা মেক আপ করেছে। ওকে এই ভাবেই বেশি মানায়। ওর সবচেয়ে সুন্দর হচ্ছে বড় বড় নিষ্পাপ চোখজোড়া। পুলিশ ওকে এরেস্ট করে এক রাত জেলে রেখেছিল। তখন ওর মানশ্চক্ষে শুধু ঐ শান্ত, নিষ্পাপ চোখজোড়াই ভেসে উঠেছিল বারবার। মনে মনে খুব অবাক হয়েছিল কিন্তু একটা ব্যাপার পরিষ্কার বুঝেছিল- ওর হৃদয় যা চায় তা থেকে ও নিজেকে বুঝে হোক আর না বুঝে হোক ক্রমাগত বঞ্ছিত করে চলেছে। ঐ রাতে নিজের ভেতরে যেন নতুন এক জাগরণ অনুভব করেছিল ও। সব কিছু চিরতরে হারানোর আগেই নিজের জীবনটাকে পুনরুদ্ধার করবার একটা ভয়াবহ তাগিদ অনুভব করেছিল। এই শান্ত সুবোধ মেয়েটির হাতেই তার জীবনের তানপুরা। যে ভাবেই হোক তাকে সে ফিরিয়ে আনবেই।
“তোমার জন্য ফুল নিয়ে এসেছিলাম,” পিন্টু বলল, মাথা নেড়ে পেছনের সিটে ইঙ্গিত করল।
“দেখেছি,” মরিয়ম নীচু স্বরে বলল, “সুন্দর হয়েছে। ধন্যবাদ।”
“ভেবেছিলাম তোমার হাতে দেব কিন্তু দোলন দাঁড়িয়ে ছিল-”
“বুঝেছি,” মরিয়ম শান্ত কন্ঠে বলল।
পিন্টু একটা জাপানিজ রেস্টুরেন্টে নিয়ে এলো ওকে। জানে মরিয়ম সুসি পছন্দ করে। সে নিজে খুব একটা না। সৌভাগ্যবশতঃ এই রেস্টুরেন্টে কিছু চাইনিজ খাবারও আছে। দুজনে অর্ডার দিল। মুখোমুখি বসে যখন খাবারের জন্য অপেক্ষা করছে তখন পিন্টু হঠাৎ করেই যেন কথা হারিয়ে ফেলল। কি বলবে বুঝতে পারছে না। রেস্টুরেন্ট আর বাচ্চা-কাচ্চা সংক্রান্ত ব্যাপার ছাড়া কবে শেষ মরিয়মের সাথে সত্যিকারের কোন সংলাপ হয়েছিল মনে করতে পারে না।
“রেস্টুরেন্ট চালাচ্ছে কে?” মরিয়ম সেই অনভিপ্রেত নিঃশব্দতা ভাঙে।
“আব্বা। চিন্তা ভাবনা করার জন্য একটু সময় দরকার ছিল আমার।”
“চিন্তা-ভাবনা করছ তাহলে? ভালো! তোমার মেয়েরা স্থানীয় খবরের কাগজে তোমার ছবি দেখেছে। তোমার মারপিটের কাহিণীটা খুব ফলাও করে ছাপা হয়েছিল। জলি কাঁদছিল। ভেবেছিল তোমাকে পুলিশ ধরে ডানজানে ফেলে দেবে।”
পিন্টু ফিক করে হেসে ফেলল। “কি? ডানজানে?”
মরিয়ম হাসল। “আজকালকার বাচ্চাদের প্রিয় বিষয় হচ্ছে ড্রাগন আর ডানজান।”
“কেমন আছে ওরা? খুব মিস করি ওদেরকে।”
“ভালোই আছে,” মরিয়ম ওর দিকে তাকিয়ে বলল। “সবসময় তোমার কথা জিজ্ঞেস করে।”
পিন্টুর চোখ ভিজে এলো। নিজের মেয়ে দুটোকে ও দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশী ভালোবাসে কিন্তু কখন ওদেরকে সেই কথাটা বলা হয়নি। “ওদের সাথে কখন দেখা করা যাবে?”
“তুমি যখন চাও। আমিতো তোমাকে ওদের সাথে দেখা করতে কখন মানা করিনি,” মরিয়ম নরম গলায় বলল।
খাবার চলে এলো। পিন্টুর ক্ষিধা চলে গেছে। সে তার মেয়ে দুটোকে দেখার জন্য হঠাৎ অসম্ভব আকুলতা অনুভব করে।
“প্লিজ, বাসায় চলে আসো,” মরিয়মের চোখে চোখ রেখে বলল।
“এসো খাই,” মরিয়ম চোখ নামিয়ে বলল। “আমার অনেক ক্ষুধা লেগেছে।”
পিন্টু বুঝল ওর উপর বিশ্বাস ফিরে পেতে মরিয়মের আরোও সময় লাগবে। তার এই অকস্মাৎ পরিবর্তন যে বানোয়াট নয় সেটা অনুধাবন করতে পারাটা মরিয়মের জন্য জরুরী। স্যুট-প্যান্ট পরে, কিছু ফুল এনে, গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে তাকে প্রিয় খাবার খাওয়াতে আনাটা যথেষ্ট নয়। এই পরিবর্তন যে ক্ষণস্থায়ী নয় সেটা প্রমাণ করবার দায়িত্বভার তারই। মরিয়মের বিশ্বাস ফিরে পাবার জন্য যা যা করতে হয় সবই করতে সে প্রস্তুত থাকবে, মনে মনে সংকল্প করে পিন্টু।
৬৬
জানুয়ারী মাসের মাঝামাঝি যখন রিমার অপারেশনের দিন ঘনিয়ে এলো, রিমা ভীষণ ঘাবড়ে গেল। ওর সার্জেন্ট ওকে আশ্বস্ত করলেন এই বলে যে এটা একটা অপেক্ষাকৃত সহজ অপারেশন এবং অপারেশনের পর দিন দুয়েকের মধ্যেই ও বাসায় ফিরে যেতে পারবে। কিন্তু তারপরও রিমার ভয় দূর হয় না। ভালোর মধ্যে একটাই যে ও যে কয়টা দিন হাসপাতালে কাটাবে সেই দিনগুলো মিলা ওর বাসায় এসে থাকবে এবং বাচ্চাদের দেখভাল করবে। তাতে অন্তত একটা চিন্তা দূর হয়েছে ওর। মিলা থাকলে বাচ্চাদের ভালোমন্দ নিয়ে আর কোন দুশ্চিন্তা থাকবে না। অবশ্য নোমান এবং লিয়াকতও আছে। প্রয়োজনে তাদের সাহায্যও চাওয়া যেতে পরে। হাসপাতালে ওকে হয়ত দিন দুয়েকের বেশিও থাকতে হতে পারে। শুধু মিলার উপর নির্ভর করাটা ঠিক হবে না।
ওর সার্জারীর কথাটা কিভাবে রটিয়ে গেল জানে না রিমা, কিন্তু অচিরেই ওর বন্ধু-বান্ধব, পরিচিতদের ফোন এবং টেক্সট মেসেজের ঝড় উঠে গেল, সবাই ওর শুভ কামনা জানাচ্ছে। ভালোই লেগেছে রিমার। কখন ভাবেনি এতো মানুষ ওকে ভালোবাসে, ওর ভালোমন্দ নিয়ে চিন্তা করে। অবশ্য বুঝেছে এই পুরো ব্যাপারটার পেছনেই রয়েছে মিলা। সেই খবর ছড়িয়েছে এবং নিজেই সবাইকে উৎসাহিত করেছে রিমাকে শুভ কামনা জানাতে। সন্দেহ নেই তার পরিকল্পনায় যথেষ্ট কাজ হয়েছে। রিমার মনের জোর কিছু হলেও বেড়েছে।
যেদিন সকালে রিমা স্কারবরো জেনারেল হাসপাতালে অপারেশনের জন্য হাজিরা দিল ওর সাথে ছিল নোমান, মিলা এবং ওর তিন সন্তান। ও চেয়েছিল ফায়জা দুই ভাইকে নিয়ে বাসাতেই থাকুক কিন্তু ফায়জা মানেনি, ওর সাথে আসতে চেয়েছে। ওকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাবার আগে তিন সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরল ও। এই তিনজন মানুষের সাথে এর চেয়ে বেশী ঘনিষ্টতা সে আগে কখন অনুভব করেনি। যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে না কাঁদার কিন্তু খুব একটা সফল হয়নি। সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে মা- ওর কানে কানে বলেছে ফায়জা। দুই ছেলে কি করবে কিংবা বলবে ঠিক বুঝতে পারে না। হাসপাতালের ভেতরে দৌড়াদৌড়ি করতেই তাদের আগ্রহ বেশী। মিলা মুখে হাসি আর চোখে অশ্রæ নিয়ে রিমার দুই হাত ধরে থাকল। সেই নিঃশব্দ চাহনিই যা বলার বলে দিল রিমাকে। কোন শব্দের প্রয়োজন হল না।
লেটার এলিগেটর- নোমান নীচু স্বরে বলে। গাম্ভীর্য দিয়ে উদ্বেগ লুকিয়ে রাখবার ব্যার্থ চেষ্টা করে সে।
রিমা হাসে, তাকে মানসিক শক্তি দিতে চায়। কে ভেবেছিল এতোগুলো বছর পর নোমান আবার ওর পাশে এসে দাঁড়াবে? অপারেশন থিয়েটারে গিয়ে চিন্তা করার মত একটা চমৎকার বিষয়!
নোমান মিলা এবং বাচ্চাদেরকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আবার হাসপাতালে ফিরে এলো। যদি রিমার কিছু লাগে। সেই সম্ভাবনা খুবই কম কিন্তু বাসায় চুপচাপ বসে থাকতে তার অপরাধবোধ হচ্ছিল। হাসপাতালে বসে থাকতে ভালো লাগে।
সেই দিন সন্ধ্যায় যখন রিমার সার্জারী হয়ে গেল এবং ডাক্তার জানাল সবকিছু ঠিকঠাক মতই হয়ে গেছে পরিত্রাণের নিঃশ্বাস ছাড়ল নোমান। রিমার একটা ওভারি এবং সংযুক্ত ফেলোপিন টিউব কেটে সরিয়ে ফেলা হয়েছে কোন রকম সমস্যা ব্যাতিরেকেই। রাতে হাসপাতালেই থাকতে হবে রিমাকে কিন্তু পরের দিন যদি সে ভালো বোধ করে তাহলে বাসায় ফিরে যেতে পারবে। পরবর্তি এক থেকে দুই সপ্তাহ সাবধানে থাকতে হবে ক্ষতটাকে শুকিয়ে যাবার সুযোগ দেবার জন্য। নোমান ওর সাথে দেখা করতে চেয়েছিল কিন্তু অনুমতি পেল না। রিমার বিশ্রাম দরকার। নোমান মিলাকে ফোন করে খবরটা জানিয়ে দিল। উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছিল মিলা। খবরটা জানার পর স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল।
ঐ দিন সন্ধ্যায় নোমান রিমার বাসায় গেল বাচ্চাদের খোঁজ খবর নেবার জন্য। ও রেস্টুরেন্ট থেকে টেক আউট আনতে চেয়েছিল কিন্তু মিলা ওকে মানা করল। সে নাকি ফায়জার সাথে জোট পাকিয়ে রান্না-বান্না করার পরিকল্পনা করছে। পরদিন রিমা বাসায় ফিরলে তাকে খাওয়াবে।
রিমার বাসায় রাতে মিলা আর বাচ্চাদের সাথে একসাথে খেতে খেতে শুধু রিমার কথাই হল। রিমার অতীত নিয়ে মিলার অনেক কৌতূহল ছিল। রিমা তাকে মাঝে মাঝে অল্প বিস্তর বলেছে কিন্তু তারপরও এতো কিছু না বলা রয়ে গেছে যে তার অতীত সম্বন্ধে পরিষ্কার করে কোন ধারনা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। নোমান সম্বন্ধেইতো রিমা কখন একটা কথাও বলেনি! অথচ নোমান তার সবচেয়ে ঘনিষ্ট বন্ধুদের একজন।
কি জানতে চায় মিলা? নোমান জিজ্ঞেস করে।
সবকিছু, তাদের বন্ধুত্বের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত। মিলা লোভীর মত দাবি করে।
কিন্তু খুব শীঘ্রই মিলা বুঝতে পারে নোমান হচ্ছে এক বিশ্বস্ত রাজকীয় প্রহরীর মত যে প্রাসাদের পবিত্রতা বজায় রাখার জন্য জীবন বিসর্জন দিতেও প্রস্তুত। মিলাকে হতাশ হতে দেখে নোমান খুব মজা পায়। পরে, খাওয়া দাওয়া শেষ করে দুজনে দুই কাপ চা নিয়ে লিভিং রুমে বসে। নোমান মিলাকে তার নিজের জীবনের কাহিনী বলার সুযোগ করে দিয়ে পুর্বের নৈরাশ্যের কিছুটা হলেও ক্ষতিপূরণ করার চেষ্টা করে। মিলা সেই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে এবং তার বৈচিত্রময় জীবনের একটা বিশদ চিত্র নোমানের সামনে তুলে ধরে। প্রায় এক যুগ আগে মিলার বাবা-মা কানাডা ছেড়ে দেশে চলে গিয়েছিলেন প্রধানত মেয়ের পশ্চিমী জীবনধারাকে মেনে নিতে পারেননি বলেই। তখন থেকে একাই আছে সে। একে একে বেশ কিছু পুরুষের সাথে ওর প্রেমের সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল কিন্তু পরিবর্তে শুধু যন্ত্রণা আর কষ্টই পেয়েছে। বারবার বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়েও দিতে হয়েছে ভুলের খেসারত।
নোমান অবাক হয়ে ভেবেছে রিমা এবং মিলার মধ্যে এতো চারিত্রিক পার্থক্য থাকা স্বত্বেও কোন এক অদ্ভুত কারণে তারা পরস্পরের প্রিয় বন্ধুতে পরিণত হয়েছে, আত্মীয়ার মত। রিমা নিজের অতীত কিংবা বর্তমান নিয়ে কখনই আলাপ করে না আর মিলা কিছুই বলতে বাকি রাখে না। এমন ভিন্ন ধর্মী দুটি মানুষ কিভাবে পরস্পরের সান্নিধ্যে স্বস্তি বোধ করে সেটা গবেষণার বিষয় হতে পারে। ওর নিজের কথাই ধরা যাক। রিমার সাথে ওর যে সম্পর্ক সেটাও কি প্রায় সেই রকমই নয়? তারা দুই জন সম্পূর্ণ দুই ধরনের মানুষ অথচ আজ কত বছর হয়ে গেল সে রিমার প্রেমে পাগলের মত মজে আছে আর রিমা তাকে ভালোবাসুক আর না বাসুক তাকে যে বিশ্বাস করে, আপন ভাবে সেটা প্রকাশ করতে কখন দ্বিধা করেনি। অতীতের দিকে তাকিয়ে ওর মনে হয় যদি রিমা ওর আরোও কাছের মানুষ হত তাহলে তার জীবনটা কত খানিই না পূর্ণ হত! অন্য পুরুষদের মত সে হয় ছক্কা নয় ফক্কার ফাঁদে পড়তে চায়নি। যেটুকু স্বাভাবিকভাবে তার কাছে এসেছে সেটুকুই দুই হাত বাড়িয়ে গ্রহণ করেছে। লোভে পড়ে সব কিছু হারাতে চায়নি।
৬৭
বাবার কাছ থেকে রেস্টুরেন্টের দায়ভার আবার বুঝে নেবার পর পিন্টু প্রথম যে কাজটা করল সেটা হচ্ছে জাহানকে বিদায় করা। জাহান একাধারে ক্ষুব্ধ এবং আহত হল। পিন্টু তাকে নিজের অফিসে ডেকে নিয়ে দরজা লাগিয়ে দিয়েছিল। তার সমস্ত সাহায্য সহযোগীতার জন্য কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তার হাতে পাঁচ হাজার ডলারের একটা চেক ধরিয়ে দিয়েছিল। বেতনের বাকী টাকাটা সে যথাসময়ে পেয়ে যাবে। চেকটা পেয়ে খুশী হলেও কাজটা চলে যাবে সেটা জাহান কল্পনাতেও ভাবে নি। দিনার এই রেস্টুরেন্টের জন্য অমূল্য কথাটা ঠিক কিন্তু গত বছরগুলোতে জাহান কি এই প্রতিষ্ঠানের জন্য এমন কিছু কাজ করে নি যা একেবারে মাফিয়ার সাথে তুলনীয় না হলেও তাকে আইনগত সমস্যায় ফেলে দেবার জন্য যথেষ্ট? অনেক কিছু সে করতে চায়নি তবুও করেছে, পিন্টুর মুখের দিকে তাকিয়েই। রিমাকে ভয় দেখানোর ব্যাপারটা ছিল সেই রকমের। ব্যাক্তিগতভাবে সমর্থন না করলেও পিন্টুর নির্দেশ অমান্য করতে পারে নি। পিন্টু নির্দেশ দিলে হয়ত আরোও খারাপ কিছুও করতে পারত। পিন্টুর প্রতি ওর শ্রদ্ধাবোধ আকাশচুম্বী। লোকটার অতীত ছিল বর্ণময়। বর্তমানেও মানুষ তাকে মান্যগণ্য করে, সে কিছু বললে মনযোগ দিয়ে শোনে, অপছন্দ করলেও মুখ ফুটে কেউ কিছু বলার সাহস পায় না।
চেকটা হাতে নিয়ে দীর্ঘক্ষণ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে ছিল সে। “কেন? কি করেছি আমি?” জানতে চেয়েছিল সে। যা কিছু সে করেছে পিন্টু এবং পিন্টুর পরিবারকে সাহায্য করবার জন্যই করেছে।
পিন্টু মেজাজ ঠাণ্ডা রেখেছিল। “তুই তো জানিসই রেস্টুরেন্টের ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না,” ব্যাখ্যা করেছিল সে। “দুই এক মাসের মধ্যে অনেক কিছু হয়ে যেতে পারে। আমি চাই তোর যেন কোন অসুবিধা না হয়। ভালো কোন কাজ খুঁজে নে। কিছু লাগলে আমার সাথে যোগাযোগ করিস।”
ব্যাস, পিন্টু আর বেশী কিছু বলে নি, জাহানেরও এই ব্যাপারে আর কথা বাড়ানোর সাহস হয় নি। দিনার এই রেস্টূরেন্টে কাজ করতে পছন্দ করে। এমন কোন কিছু জাহান করতে চায় না যা দিনারের জন্য ক্ষতিকারক হয়। দিনার ওকে হয়ত খুনই করে ফেলবে। বিদায় নেবার আগে দিনারের কাছে গিয়ে নালিশ জানাল। দিনার ওকে কথা দিল পরে এক সময় সুযোগ বুঝে পিন্টুর সাথে কথা বলে সে জাহানকে আবার কাজে ফিরিয়ে আনবে।
পিন্টু মরিয়মকে ফোন করে জাহানের খবরটা জানাল। মরিয়মের এটা জানা দরকার। পিন্টু যে তাদের দুজনার মাঝের সমস্যাটা মিটিয়ে ফেলতে কতখানি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সেটা প্রমাণ করাটা খুবই জরুরী। কালামের সাথে জাহানের মারপিট হবার পরই মরিয়ম চলে গিয়েছিল। জাহানকে ছাটাই করে দেবার ফলাফল ভালো বই মন্দ হতে পারে না। তার ধারনা সত্য প্রমাণিত হল। মরিয়ম তাকে বাসায় ডিনারের আমন্ত্রণ জানালো। পিন্টু ভীষণ খুশী হয়ে গেল। এমন একটা সুযোগই সে চাইছিল। কোন ভাবে যদি এই ডিনারটা ঠিকঠাক মত পার করতে পারে তাহলে হয়ত এই পরীক্ষায় এবারের মত তার পাশ হয়ে যাবে।
মরিয়মের মাথায় পিন্টু ছাড়াও অন্য আরেকটা দুশ্চিন্তা জমাট বাঁধছে। খুব কঠিন এক সমস্যায় পড়ে গেছে সে। কি করবে বুঝতে পারছে না। চিন্তাও করে নি এমন একটা অযাচিত পরিস্থিতিতে পড়ে যাবে। কালাম যেদিন থেকে মেয়েদেরকে পড়াতে এই বাসায় আসতে শুরু করেছে প্রায় সেদিন থেকেই দোলনের সাথে বন্ধুত্বের সূচনা হয়েছে। তার মধ্যে অস্বাভাবিক কিছুই নেই। তাদের বয়েস কাছাকাছি – দোলন চার পাঁচ বছরের বড় হবে। মরিয়ম তাদের বন্ধুত্ব নিয়ে কখন মাথা ঘামায় নি। প্রধানত কারণ দোলনের উপর ওর সম্পূর্ণ আস্থা ছিল। নিজের দাম্পত্য জীবনে মেয়েটা সুখী হোক আর না হোক সে এমন কোন কাজ কখন করবে না যা তার নিজেকে এবং তার শ্বশুর বাড়ীর মানুষদেরকে একটা অপমানজনক পরিস্থিতিতে ফেলবে, বিশেষ করে আবুলকে যে তার প্রতিটা ইচ্ছাকে সব সময় পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে এসেছে। কিন্তু যখন ওর বাবা-মা, বিশেষ করে সন্দেহপ্রবণ মা ওকে জানালেন দোলন সকলের অনুপস্থিতিতে কালামের সাথে দীর্ঘক্ষন ফোনে কথা বলে এবং খুব সম্ভবত বাইরেও দেখা করতে যায় তখন মরিয়মের টনক নড়ল। কালাম ছেলে হিসাবে অসম্ভব ভালো এবং তার সাথে বন্ধুত্বের পেছনে মন্দ কিছু আছে তেমন ধারণা করার কোন কারণ নেই কিন্তু যদি সেটা একটা ভিন্ন দিকে মোড় নেয় তখন কি হবে?
সমস্যা হচ্ছে ও দোলন কিংবা কালাম কারো সাথেই এই ব্যাপারে আলাপ করতে পারছে না। কেমন দেখাবে সেটা? ওর নিজেরই বৈবাহিক সমস্যা হচ্ছে আর ও তাদের দু’জনার বন্ধুত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলছে? ওকে খুব নীচু মনের মানুষ মনে হবে। ওর মা নিশ্চয় তার সন্দেহের কথা আবুলের কানেও তুলেছেন কারণ সে হঠাৎ করেই দুনিয়ার সবচেয়ে দুখী মানুষে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। আগে কালাম কখন আসত কিংবা যেত সেটা নিয়ে কখন মাথাও ঘামাত না। এখন কালাম যখন পড়াতে আসে তখন সে এক মুহুর্তের জন্যও বাসা থেকে নড়ে না। দোলনও নিশ্চয় কিছু একটা আন্দাজ করে থাকবে কারণ সেও কালামের কাছ থেকে একটা দূরত্ব বজায় রাখতে শুরু করেছে। পরিস্থিতি খারাপ দিকে মোড় নেবার আগেই কিছু করা দরকার, ভাবছে মরিয়ম। কিন্তু কালামকে যথাযথ কোন কারণ ছাড়া ছাঁটাই করলে ব্যাপারটা ভালো দেখাবে না। তার মেয়েরাও খুব মুষড়ে পড়তে পারে। দু’জনাই কালামকে খুবই পছন্দ করে এবং তার কথা শোনে। সে কখন আসবে সেই অপেক্ষায় বসে থকে।
মরিয়ম বুঝতে পারছে এই বাসা থেকে যত দ্রæত সম্ভব ওকে চলে যেতে হবে। নিজের বাসায় ফিরে গেলে কালাম মেয়েদেরকে পড়াতে সেখানে যাবে, খুব সম্ভবত দোলন সংক্রান্ত সমস্যাও মিটে যাবে। এখন সবকিছু নির্ভর করছে পিন্টুর উপর। তাকে এতো শীঘ্র ডিনারে ডাকার কারণ ওর অসহায়ত্ব। যদি সব কিছু ঠিক ঠাক মত হয় এবং পিন্টু যদি ওকে সুন্দর করে বাসায় ফিরে যাবার জন্য অনুরোধ করে তাহলে ও খুশী মনে ফিরে যাবে।